তারে চিনতে হয় রে /
তারে চিনতে হয়, তারে জানতে হয় ।
নিজ ঘরের সেই অজান মানুষের সন্ধানই বাউলের জীবন সাধনা । তারা স্রষ্টাকে দূরে রেখে তার সাধনা করতে রাজি নয় । তারা স্রষ্টাকে খুজে পাতে চায়, তাকে চিনতে চায়, তাকে জানতে চায় । ‘যাহা নেই ভান্ডে তাহা নেই ব্রহ্মান্ডে ’... তাই তারা দেহভান্ডেই জগত আর জগতের স্রষ্টাকে অণ্বেষণ করে । বাউল ধর্ম তাই দেহতাত্ত্বিক । এবং গুরুমুখীও । গুরু পথের দিশারি কিংবা স্রষ্টাকে পাবার পাথেয় । আর দেহ সেই জগত স্রষ্টার উপাসনালয় । তাই বাউলেরা দেহের সাধনায় পেতে চায় দেহাভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা মনের মানুষের দেহাতীত সংস্পর্শ কিংবা সান্নিধ্য।
বাউল দর্শনের সাথে সূফি দর্শনের সাযুজ্য-সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য বহুল আলোচিত । এ দুই দর্শনের মাঝে একটা জায়গায় প্রচন্ড মিল – আর তা হল উভয়ই আত্মোপলব্ধিমূলক সাধনায় ব্রতী । উভয়ই স্রষ্টাকে দূরে না রেখে দেহাভ্যন্তরেই তার সিংহাসন ও অবস্থিতির কথা বলে । কিন্তু এ সাধনায় সিদ্ধি লাভের পথ দুই দর্শনে একেবারেই আলাদা ।
সূফি দর্শনঃ
বৈদান্তিকরা যেখানে জাগতিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করে, সূফি দর্শনে সেখানে এ জীবনের অপরিহার্যতাকে স্বীকার করে নেয় এ জন্য যে এ জীবনের সাধনাই মৃত্যুপরবর্তী জগতের ভিত্তি ।
বৌদ্ধ দর্শনে কর্মই হল চালিকা শক্তি । আর নির্বাণে মানব জন্মের মুক্তি । আত্মা যখন মুক্তি লাভ করে তখনই সার্থকতা । এটাই নির্বাণ । আত্মার মুক্তির পর আর কিছু নেই । কিন্তু লোভে,পাপে আত্মা বা চৈতন্য জন্মচক্রে পরে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শাস্তি পেতে থাকে । নির্বাণ তাই বৌদ্ধ দর্শনে পরম কাঙ্খিত ।
সূফি দর্শনে ‘ফানা’ বলতে এই নির্বাণকেই বোঝায় । তবে ফানা বা নির্বাণই এখানে শেষ কথা নয় । এখানে ফানা স্তরে মানুষ বা তার চৈতন্য জাগতিক অসারতা থেকে মুক্তি পায় এবং তার দিব্যদৃষ্টির উন্মিলন ঘটে । এই দিব্যদৃষ্টির উন্মিলনে সে সৃষ্টির মাঝে স্ররষ্টার নিদর্শন ও অবস্থিতি উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় ।
‘আমি আমার স্বীয় চিহ্নসমূহ জগতেও ও মনুষ্য শরীরে প্রকাশ করেছি ’ – (হা-মীম-সিজদা)
[53-54] Soon shall We show them Our Signs in the World around them, as well as in themselves
এভাবেই সে ‘বাকা-বিল্লা’য় পৌছে যায় । এ স্তর সূফি দর্শনে পরম আরাধ্য । কেননা ‘বাকা-বিল্লা’ স্তরেই সূফি স্রষ্টার চিরন্তন সত্ত্বায় পৌছে ।
‘আমি যদি তোমাকে সৃষ্ট না করতাম তবে আমি জগত সৃষ্টি করতাম না’
মুহম্মদের(সাঃ) বাস্তবতাই তাই সৃষ্টির মাধ্যম ।
‘আমি ছিলাম গুপ্ত সম্পদ এবং আমি জ্ঞাত হতে চেয়েছিলাম। সুতরাং আমি জগত সৃশটি করলাম’ (হাদিসে কুদসী)
সূফি দর্শনে সৃষ্টির মাঝেই স্রষ্টার অবস্থিতি । এবং প্রতিটি সত্ত্বাই অনন্ত সত্ত্বার একটি সসীম প্রকাশ । বাকা-বিল্লায় পৌছে সূফি উপলব্ধি করে যে, তার আত্মসত্ত্বা অস্তিত্ত্বহীন এবং কেবল আল্লাহর সত্ত্বাই অস্তিত্ত্বশীল ।
সৃষ্টির শুরুতে স্রষ্টা ছিলেন একটি অবিভক্ত অপৃথকীকৃত অখন্ড সত্ত্বা । তিনি নিজেকে প্রকাশ করতে চাইলেন এবং এতেই মহা-জগতের সৃষ্টি হল । এভাবেই সৃষ্টির মাঝে অভিব্যক্ত হন । বৈদান্তিকরা যেখানে মনে করেন, সৃষ্টি একদিন স্রষ্টার সাথে একাত্ম হয়ে যাবে, সূফিরা সেখানে এ ধারনা পুরোপুরি নাকচ করে দেন । তাদের মতে, স্রষ্টার সাথে সৃষ্টি একাত্ম হবে না, তবে সাধনার মাধ্যমে তার অসীম চিরন্তন সত্ত্বার সান্নিধ্য লাভ সম্ভব ।
সূফি সাধনার পথ পরিক্রমা ৫টি স্তরে বিভক্ত ।
# শরীয়তঃ ব্যক্তিগত,সামাজিক জীবনে ধর্মীয় রীতি-নীতি মেনে চলা ।
# তরীকতঃ তাওহীদে একীভূত হয়ে পরম সত্ত্বায় উপনীত হয় । # মারেফতঃ দিব্যজ্ঞান অর্জন ।
# হকিকতঃ এ স্তরে আল্লাহ ব্যতীত কেউ নেই, কিছু নেই, আমি নেই, শুধুই এক ও একমাত্র আল্লাহ ।
# ওয়াহদানিয়াতঃ এ স্তরে সাধক সবখানে অসীম সত্ত্বার অস্তিত্ত্ব দেখতে পায় । এবং স্বীয় সত্ত্বার বিলুপ্তি ঘটে পরম সত্ত্বার সংস্পর্শে সিদ্ধির চূরান্ত পরিণতি ঘটে । এ স্তরে সাধকের বাণী স্রষ্টারই বাণী ।
বাউল দর্শনঃ
উপাসনা নাই গো তার/
দেহের সাধন সর্ব-সার /
তীর্থ ব্রত যার জন্য /
এ দেহে তার সকল মিলে ।।
এইতো বাউল দর্শনের মূল কথা । কাকে খুজবার জন্য শত ক্রোশ পথ পাড়ি দেয়া ? কাকে পাবার আশায় অগুনতি আচার-প্রকার ? তিনি তো এই দেহভাণ্ডেই । তাই ‘জগতের যত পবিত্র গ্রন্থ ভজনালয় / ওই একখানি দেহের সম পবিত্র নয় ।’ বাউলের ভজনালয় তাই মানবদেহ । লালন কন্ঠে তাই পরিষ্কার উচ্চারণঃ
মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি /
মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি ।
তার উপাসনার ধরনও আলাদা ।
বীণার নামাজ তারে তারে /
আমার নামাজ কণ্ঠে গাই ।।
বাউল দর্শনের অনেক কিছুই ইসলাম এবং সূফি দর্শনের সম্পূর্ণ বিপরীত এবং রীতিমত সাঙ্ঘর্ষিক । এ দর্শনে আল্লাহ আর রাসূল এক ও অভিন্ন । রাসূল অসীম আল্লাহর সসীম প্রকাশ । লালন বলেন-
লামে আলীফ লুকায় যেমন /
মানুষে সাই আছেন তেমন /
তা নইলে কি সব নূরীতন /
আদম তনে সেজদা জানায় ।
অথবা
আল্লা আদম না হলে /
পাপ হত সেজদা দিলে /
শেরেক পাপ যারে বলে /
এ দীন দুনিয়ায়
সৃষ্টকর্তা যখন আদম সৃষ্টি করলেন, তখন তিনি ফেরেশতাদের ডেকে আদমকে সেজদা করতে বললেন । লালন বলেন, যদি আদমেই আল্লাহ নিহিত না থাকেন, তবে তো আদম সেজদা শিরিকের নামান্তর হয় !! বাউল ধর্মে মানুষের মাঝেই ভগবান লুকিয়ে । তিনিই ‘মনের মানুষ’, ‘সহজ মানুষ’, ‘অচিন পাখি’, ‘রসের রসিক’ আরশীনগরের ‘পড়শী’ ।
লালন ফকিরের অনেক পদেই এই কথা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, সৃষ্টিতেই স্রষ্টা, রাসূলেই আল্লাহ ।
যায় মর্ম সে না যদি কয় /
কার সাধ্য কে জানিতে পায় /
তাইতে আমার দীন দয়াময়/
মানুষ রূপে ঘোরে ফেরে ।
আবার
আলিফ, হে আর মীম দালেতে /
আহম্মদ নামটি লেখা হয়/
মীম হরফটি নফি করে /
দেখনা খোদা কারে কয় ।।
বাউল দর্শনের মূল কথা তাই দেহ সাধনা । কেননা দেহই মোকাম-মঞ্জিল । দেহ জগতেরি ক্ষুদ্র রূপ । ‘আট কুঠুরি-নয় দরজা’র এই খাঁচা তো জগতেরই প্রতিচ্ছবি ।
ও তার চারধারে চার নুরের ইমাম/ মধ্যে সাই বসিয়ে ।।
মানব দেহের আটটি কুঠুরি । দুই পা, দুই হাত, ক্ষুদ্রান্ত্র, বৃহদান্ত্র, বক্ষ পিঞ্জর-মধ্যে মধ্যে যার ঝলকা কাটা, এবং সদর কোঠা মস্তিষ্ক । আর দুই চোখ, দুই কান, নাসিকা রন্ধ্র, মুখ গহবর, নাভি, গুহ্যদ্বার আর মূত্রপথ এই নিয়ে নয় দরজা । আট কুঠূরি নয় দরজার এই জগত আবার ৫ মোকামে বিভক্ত । চারধারে চার নূরের ইমাম- আজ্রাইল,জিব্রাইল,মিকাইল আর ইস্রাফিল । আর সবার মাঝখানে সাই বা স্রষ্টা স্বয়ং ।
জগতে ও দেহে এই চার ফেরেশ্তার কাজ এরকমঃ
মিকাইল(আঃ) ঝর-বৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ || যে মোকামে জল ধারা বয়, দেহের জল ধারা নিয়ন্ত্রণ ।
জিব্রাঈল(আঃ) আল্লাহর বাণী নিয়ে রাসূল কে জানানো || ধ্বনি সৃষ্টি হয় যে মোকামে, স্বর-সুর-কথা সৃষ্টি ।
ইস্রাফিল(আঃ) শিঙ্গায় ফু দিয়ে কেয়ামতের ঘন্টাধ্বনি বাজাবেন|| শব্দের ধ্বনি শোনা যায় যে মোকামে, মৃত্যুর পূর্বে মানুষ ইস্রাফিলের শিঙ্গার ধ্বনি শুনবে ।
আজ্রাইল (আঃ) জীবের মৃত্যু ঘটানো|| ওরাউল ওরায় বসে আছেন । দেহরূপ জগতের প্রলয় ঘটাবেন ।
লালন তাই দেহকে কেন্দ্র করেই করেন মনের মানুষের সাধনা । কেন কাছের মানুষ ডাকছ শোর করে/
আছিস তুই যেখানে সেও সেখানে/
খুজে বেড়াস কারে রে
To be continued………….
তৃতীয় পর্বঃ সূফি দর্শনের সাথে বাউল দর্শনের মিল-অমিল
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই এপ্রিল, ২০১২ রাত ৮:৫৪