somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লালন সাঁইএর সন্ধানে (দ্বিতীয় পর্বঃ বাউল দর্শন ও সূফি দর্শন)

১৮ ই এপ্রিল, ২০১২ রাত ৮:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এক অজান মানুষ ফিরছে দেশে/
তারে চিনতে হয় রে /
তারে চিনতে হয়, তারে জানতে হয় ।

নিজ ঘরের সেই অজান মানুষের সন্ধানই বাউলের জীবন সাধনা । তারা স্রষ্টাকে দূরে রেখে তার সাধনা করতে রাজি নয় । তারা স্রষ্টাকে খুজে পাতে চায়, তাকে চিনতে চায়, তাকে জানতে চায় । ‘যাহা নেই ভান্ডে তাহা নেই ব্রহ্মান্ডে ’... তাই তারা দেহভান্ডেই জগত আর জগতের স্রষ্টাকে অণ্বেষণ করে । বাউল ধর্ম তাই দেহতাত্ত্বিক । এবং গুরুমুখীও । গুরু পথের দিশারি কিংবা স্রষ্টাকে পাবার পাথেয় । আর দেহ সেই জগত স্রষ্টার উপাসনালয় । তাই বাউলেরা দেহের সাধনায় পেতে চায় দেহাভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা মনের মানুষের দেহাতীত সংস্পর্শ কিংবা সান্নিধ্য।

বাউল দর্শনের সাথে সূফি দর্শনের সাযুজ্য-সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য বহুল আলোচিত । এ দুই দর্শনের মাঝে একটা জায়গায় প্রচন্ড মিল – আর তা হল উভয়ই আত্মোপলব্ধিমূলক সাধনায় ব্রতী । উভয়ই স্রষ্টাকে দূরে না রেখে দেহাভ্যন্তরেই তার সিংহাসন ও অবস্থিতির কথা বলে । কিন্তু এ সাধনায় সিদ্ধি লাভের পথ দুই দর্শনে একেবারেই আলাদা ।

সূফি দর্শনঃ
বৈদান্তিকরা যেখানে জাগতিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করে, সূফি দর্শনে সেখানে এ জীবনের অপরিহার্যতাকে স্বীকার করে নেয় এ জন্য যে এ জীবনের সাধনাই মৃত্যুপরবর্তী জগতের ভিত্তি ।
বৌদ্ধ দর্শনে কর্মই হল চালিকা শক্তি । আর নির্বাণে মানব জন্মের মুক্তি । আত্মা যখন মুক্তি লাভ করে তখনই সার্থকতা । এটাই নির্বাণ । আত্মার মুক্তির পর আর কিছু নেই । কিন্তু লোভে,পাপে আত্মা বা চৈতন্য জন্মচক্রে পরে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শাস্তি পেতে থাকে । নির্বাণ তাই বৌদ্ধ দর্শনে পরম কাঙ্খিত ।
সূফি দর্শনে ‘ফানা’ বলতে এই নির্বাণকেই বোঝায় । তবে ফানা বা নির্বাণই এখানে শেষ কথা নয় । এখানে ফানা স্তরে মানুষ বা তার চৈতন্য জাগতিক অসারতা থেকে মুক্তি পায় এবং তার দিব্যদৃষ্টির উন্মিলন ঘটে । এই দিব্যদৃষ্টির উন্মিলনে সে সৃষ্টির মাঝে স্ররষ্টার নিদর্শন ও অবস্থিতি উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় ।
‘আমি আমার স্বীয় চিহ্নসমূহ জগতেও ও মনুষ্য শরীরে প্রকাশ করেছি ’ – (হা-মীম-সিজদা)
[53-54] Soon shall We show them Our Signs in the World around them, as well as in themselves
এভাবেই সে ‘বাকা-বিল্লা’য় পৌছে যায় । এ স্তর সূফি দর্শনে পরম আরাধ্য । কেননা ‘বাকা-বিল্লা’ স্তরেই সূফি স্রষ্টার চিরন্তন সত্ত্বায় পৌছে ।
‘আমি যদি তোমাকে সৃষ্ট না করতাম তবে আমি জগত সৃষ্টি করতাম না’
মুহম্মদের(সাঃ) বাস্তবতাই তাই সৃষ্টির মাধ্যম ।
‘আমি ছিলাম গুপ্ত সম্পদ এবং আমি জ্ঞাত হতে চেয়েছিলাম। সুতরাং আমি জগত সৃশটি করলাম’ (হাদিসে কুদসী)
সূফি দর্শনে সৃষ্টির মাঝেই স্রষ্টার অবস্থিতি । এবং প্রতিটি সত্ত্বাই অনন্ত সত্ত্বার একটি সসীম প্রকাশ । বাকা-বিল্লায় পৌছে সূফি উপলব্ধি করে যে, তার আত্মসত্ত্বা অস্তিত্ত্বহীন এবং কেবল আল্লাহর সত্ত্বাই অস্তিত্ত্বশীল ।

সৃষ্টির শুরুতে স্রষ্টা ছিলেন একটি অবিভক্ত অপৃথকীকৃত অখন্ড সত্ত্বা । তিনি নিজেকে প্রকাশ করতে চাইলেন এবং এতেই মহা-জগতের সৃষ্টি হল । এভাবেই সৃষ্টির মাঝে অভিব্যক্ত হন । বৈদান্তিকরা যেখানে মনে করেন, সৃষ্টি একদিন স্রষ্টার সাথে একাত্ম হয়ে যাবে, সূফিরা সেখানে এ ধারনা পুরোপুরি নাকচ করে দেন । তাদের মতে, স্রষ্টার সাথে সৃষ্টি একাত্ম হবে না, তবে সাধনার মাধ্যমে তার অসীম চিরন্তন সত্ত্বার সান্নিধ্য লাভ সম্ভব ।
সূফি সাধনার পথ পরিক্রমা ৫টি স্তরে বিভক্ত ।
# শরীয়তঃ ব্যক্তিগত,সামাজিক জীবনে ধর্মীয় রীতি-নীতি মেনে চলা ।
# তরীকতঃ তাওহীদে একীভূত হয়ে পরম সত্ত্বায় উপনীত হয় । # মারেফতঃ দিব্যজ্ঞান অর্জন ।
# হকিকতঃ এ স্তরে আল্লাহ ব্যতীত কেউ নেই, কিছু নেই, আমি নেই, শুধুই এক ও একমাত্র আল্লাহ ।
# ওয়াহদানিয়াতঃ এ স্তরে সাধক সবখানে অসীম সত্ত্বার অস্তিত্ত্ব দেখতে পায় । এবং স্বীয় সত্ত্বার বিলুপ্তি ঘটে পরম সত্ত্বার সংস্পর্শে সিদ্ধির চূরান্ত পরিণতি ঘটে । এ স্তরে সাধকের বাণী স্রষ্টারই বাণী ।

বাউল দর্শনঃ

উপাসনা নাই গো তার/
দেহের সাধন সর্ব-সার /
তীর্থ ব্রত যার জন্য /
এ দেহে তার সকল মিলে ।।

এইতো বাউল দর্শনের মূল কথা । কাকে খুজবার জন্য শত ক্রোশ পথ পাড়ি দেয়া ? কাকে পাবার আশায় অগুনতি আচার-প্রকার ? তিনি তো এই দেহভাণ্ডেই । তাই ‘জগতের যত পবিত্র গ্রন্থ ভজনালয় / ওই একখানি দেহের সম পবিত্র নয় ।’ বাউলের ভজনালয় তাই মানবদেহ । লালন কন্ঠে তাই পরিষ্কার উচ্চারণঃ

মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি /
মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি ।
তার উপাসনার ধরনও আলাদা ।
বীণার নামাজ তারে তারে /
আমার নামাজ কণ্ঠে গাই ।।
বাউল দর্শনের অনেক কিছুই ইসলাম এবং সূফি দর্শনের সম্পূর্ণ বিপরীত এবং রীতিমত সাঙ্ঘর্ষিক । এ দর্শনে আল্লাহ আর রাসূল এক ও অভিন্ন । রাসূল অসীম আল্লাহর সসীম প্রকাশ । লালন বলেন-
লামে আলীফ লুকায় যেমন /
মানুষে সাই আছেন তেমন /
তা নইলে কি সব নূরীতন /
আদম তনে সেজদা জানায় ।
অথবা
আল্লা আদম না হলে /
পাপ হত সেজদা দিলে /
শেরেক পাপ যারে বলে /
এ দীন দুনিয়ায়
সৃষ্টকর্তা যখন আদম সৃষ্টি করলেন, তখন তিনি ফেরেশতাদের ডেকে আদমকে সেজদা করতে বললেন । লালন বলেন, যদি আদমেই আল্লাহ নিহিত না থাকেন, তবে তো আদম সেজদা শিরিকের নামান্তর হয় !! বাউল ধর্মে মানুষের মাঝেই ভগবান লুকিয়ে । তিনিই ‘মনের মানুষ’, ‘সহজ মানুষ’, ‘অচিন পাখি’, ‘রসের রসিক’ আরশীনগরের ‘পড়শী’ ।
লালন ফকিরের অনেক পদেই এই কথা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, সৃষ্টিতেই স্রষ্টা, রাসূলেই আল্লাহ ।

যায় মর্ম সে না যদি কয় /
কার সাধ্য কে জানিতে পায় /
তাইতে আমার দীন দয়াময়/
মানুষ রূপে ঘোরে ফেরে ।
আবার
আলিফ, হে আর মীম দালেতে /
আহম্মদ নামটি লেখা হয়/
মীম হরফটি নফি করে /
দেখনা খোদা কারে কয় ।।

বাউল দর্শনের মূল কথা তাই দেহ সাধনা । কেননা দেহই মোকাম-মঞ্জিল । দেহ জগতেরি ক্ষুদ্র রূপ । ‘আট কুঠুরি-নয় দরজা’র এই খাঁচা তো জগতেরই প্রতিচ্ছবি ।

ও তার চারধারে চার নুরের ইমাম/ মধ্যে সাই বসিয়ে ।।

মানব দেহের আটটি কুঠুরি । দুই পা, দুই হাত, ক্ষুদ্রান্ত্র, বৃহদান্ত্র, বক্ষ পিঞ্জর-মধ্যে মধ্যে যার ঝলকা কাটা, এবং সদর কোঠা মস্তিষ্ক । আর দুই চোখ, দুই কান, নাসিকা রন্ধ্র, মুখ গহবর, নাভি, গুহ্যদ্বার আর মূত্রপথ এই নিয়ে নয় দরজা । আট কুঠূরি নয় দরজার এই জগত আবার ৫ মোকামে বিভক্ত । চারধারে চার নূরের ইমাম- আজ্রাইল,জিব্রাইল,মিকাইল আর ইস্রাফিল । আর সবার মাঝখানে সাই বা স্রষ্টা স্বয়ং ।

জগতে ও দেহে এই চার ফেরেশ্তার কাজ এরকমঃ
মিকাইল(আঃ) ঝর-বৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ || যে মোকামে জল ধারা বয়, দেহের জল ধারা নিয়ন্ত্রণ ।
জিব্রাঈল(আঃ) আল্লাহর বাণী নিয়ে রাসূল কে জানানো || ধ্বনি সৃষ্টি হয় যে মোকামে, স্বর-সুর-কথা সৃষ্টি ।
ইস্রাফিল(আঃ) শিঙ্গায় ফু দিয়ে কেয়ামতের ঘন্টাধ্বনি বাজাবেন|| শব্দের ধ্বনি শোনা যায় যে মোকামে, মৃত্যুর পূর্বে মানুষ ইস্রাফিলের শিঙ্গার ধ্বনি শুনবে ।
আজ্রাইল (আঃ) জীবের মৃত্যু ঘটানো|| ওরাউল ওরায় বসে আছেন । দেহরূপ জগতের প্রলয় ঘটাবেন ।

লালন তাই দেহকে কেন্দ্র করেই করেন মনের মানুষের সাধনা । কেন কাছের মানুষ ডাকছ শোর করে/
আছিস তুই যেখানে সেও সেখানে/
খুজে বেড়াস কারে রে



To be continued………….
তৃতীয় পর্বঃ সূফি দর্শনের সাথে বাউল দর্শনের মিল-অমিল
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই এপ্রিল, ২০১২ রাত ৮:৫৪
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×