‘এক আকাশের তারা তুই একা গুনিস নে/ গুণতে দিস তুই কিছু মোরে/ ওরে সব ভালো তুই একা বাসিস নে/ একটু ভালো বাসিতে দিস মোরে’- গত মঙ্গলবার রংপুরের কনসার্টে জীবনের শেষ গান হিসেবে এটিই গেয়েছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। গানে গানে ভালোবাসার সুযোগ চাইলেও আজ তিনি কোটি ভক্তের ভালোবাসায় সিক্ত। লাখো শ্রোতারা অশ্রু ভেজা নয়নে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে প্রিয় রকস্টারের জন্য হাজার হাজার শব্দের শোকগাঁথা লিখে চলেছেন। অথচ এসব পড়ার বা দেখার আর কোন সুযোগই হবে না ব্যান্ডদল এলআরবির লিড গিটারিস্ট ও ভোকালিস্ট আইয়ুব বাচ্চুর।
আজ বৃহস্পতিবার ৫৬ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ব্যান্ড সংগীতের অন্যতম দিকপাল আইয়ুব বাচ্চু। সকালে তাকে অচেতন অবস্থায় ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন বলে জরুরি বিভাগের নার্স হাবিবুর রহমান জানান।
স্কয়ার হাসপাতালের মেডিকেল সার্ভিসের পরিচালক ডা. মির্জা নাজিমউদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘সকালে আইয়ুব বাচ্চুর হার্ট অ্যাটাক হয়। সকাল সোয়া ৯টার দিকে তার ড্রাইভার তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। তার আগেই তার মৃত্যু হয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘আইয়ুব বাচ্চুকে অসুস্থাবস্থায় তার গাড়িচালক সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে আসেন। তখনই আমরা ধারণা করেছিলাম যে তিনি হয়তো মারা গেছেন। কারণ তখন তার মুখ দিয়ে লালা বের হচ্ছিলো। তবু আমাদের ডাক্তারদের একটি বিশেষজ্ঞ দল তার দেখাশোনা করে এবং সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটে ডাক্তাররা তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
আইয়ুব বাচ্চু দীর্ঘদিন ধরে হৃদযন্ত্রের অসুস্থতায় ভুগছিলেন জানিয়ে ডা. নাজিম বলেন, তার হার্টের কার্যক্ষমতা ছিলো ৩০ শতাংশ। সর্বশেষ তিনি গত সপ্তাহে স্কয়ার হাসপাতালেই চিকিৎসা নিয়েছেন। এর আগে ২০০৯ সালে তিনি হার্টে রিং পরিয়েছিলেন।
এলআরবি ব্যান্ডের সদস্য শামিম বলেন, আইয়ুব বাচ্চু বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। হৃদরোগের কারণে সপ্তাহ দুই আগেও একবার তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। মগবাজারের বাসায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে সকালে তাকে স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।
গতকাল সকালে আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। ভক্ত শ্রোতাদের পাশাপাশি সংগীত জগতের অনেকেই ছুটে আসেন হাসপাতালে।
হাসপাতালে এসে আইয়ুব বাচ্চুকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন সংগীতাঙ্গনে তার সহকর্মীরা। ব্যান্ডদল ‘সোলস’র লিড ভোকাল পার্থ বড়ুয়া বলেন, ‘কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। তিনি আমার শিক্ষক ছিলেন। আমাকে তৈরি করেছেন। গিটার শিখিয়েছেন। গান করতে ঢাকায় নিয়ে এসেছিলেন। কখনোই ভাবিনি বাচ্চু ভাই চলে যাবেন। ওনার মতো গিটারিস্ট বাংলাদেশ আর আছে কি-না আমার জানা নেই। সংগীতাঙ্গন অনেক বড় এক সম্পদ হারালো। বাচ্চু ভাইয়ের মতো শিল্পী আর বাংলাদেশে আসবে কি-না সন্দেহ আছে।’
‘আর্ক’ ব্যান্ডদলের ভোকাল হাসান বলেন, ‘এ ক্ষতি পূরণ হবার মতো নয়। বহুদিন বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করেছি। তিনি ছিলেন সংগীতের উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।’
সংগীতশিল্পী সামিনা চৌধুরী বলেন, ‘বাচ্চু ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক। তিনি সবসময় স্টেজ শো শেষে সবাইকে নিয়ে জাতীয় সংগীত গাইতেন। এটা একজন শিল্পীর জন্য অনেক বড় গুণ। সবাইকে বলবো তার আত্মার মাগফেরাতের জন্য দোয়া করতে।’
চিত্রনায়ক ফেরদৌস বলেন, ‘যখন সংগীতের নতুন একটি ধারা তৈরি হচ্ছিলো ঠিক তখন বাচ্চু ভাই চলে গেলেন। সংগীতে বড় একটা শূন্যতা তৈরি হলো।’
চিত্রনায়ক হেলাল খান বলেন, ‘আমি ওনার গানের অনেক বড় ভক্ত ছিলাম। এভাবে অকালে তাকে হারাতে হবে, তা ভাবতেও পারিনি। সংগীতের বড় ক্ষতি হয়ে গেলো।’
পপ তরকা ফেরদৌস ওয়াহিদ বলেন, ‘গানের জগতের একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটলো। তিনি ছিলেন ক্ষণজন্ম। তার চলে যাওয়ার ক্ষতি আর কখনোই পূরণ হবে না।’
গণসংগীতশিল্পী ফকির আলমগীর বলেন, ‘আইয়ুব বাচ্চু বড়দের সম্মান করতেন ছোটদের স্নেহ করতেন। তিনি রয়েছেন জনপ্রিয়তার মধ্যগগনে। তাকে হারিয়ে ব্যান্ডের গানে হাহাকার সৃষ্টি হলো। সংস্কৃতি অঙ্গনে কালো ছায়া নেমে এলো। তরুণ প্রজš§ তার থেকে শিক্ষা নেবে সেটাই আশা করছি।’
এদিকে আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও সৌদি আরবে অবস্থানরত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে বাংলাদেশে অবস্থিত আমেরিকান (ইউএস) অ্যাম্বাসি।
সাংস্কৃতিক সংগঠক নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু আজ হাসপাতালে সাংবাদিকদের বলেন, আগামীকাল শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় আইয়ুব বাচ্চুর মরদেহ সবার শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য নেওয়া হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। জুমার নামাজের পর জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে আইয়ুব বাচ্চুর নামাজে জানাজা হবে। তারপর মরদেহ রাখা হবে হিমঘরে। তার দুই ছেলে মেয়ে বিদেশ থেকে ফিরলে শনিবার চট্টগ্রামে নেওয়া হবে তার মরদেহ। সেখানে আরেক দফা জানাজার পর পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।
প্রসঙ্গত, আইয়ুব বাচ্চুর জন্ম চট্টগ্রামে ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট। তার ডাক নাম রবিন। চট্টগ্রামে কেটেছে তার কৈশোর আর তারুণ্যের দিনগুলো। কলেজে পড়ার সময় বন্ধুদের নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন একটি ব্যান্ডদল। শুরুতে ‘গোল্ডেন বয়েজ’ নাম দিলেও পরে বদলে রাখা হয় ‘আগলি বয়েজ’। পাড়া মহল্লার বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে চলত তাদের পরিবেশনা। পেশাদার ব্যান্ডশিল্পী হিসেবে আইয়ুব বাচ্চুর ক্যারিয়ার শুরু ১৯৭৮ সালে। ব্যান্ড দলে ‘ফিলিংস’ এর সঙ্গে সে সময় চট্টগ্রামের বিভিন্ন অভিজাত হোটেলে পারফর্ম করতেন তিনি।
দুই বছরের মাথায় যোগ দেন জনপ্রিয় ব্যান্ড দল সোলসে। টানা দশ বছর সোলসের লিড গিটার বাজানোর পর ১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল আইয়ুব বাচ্চু গড়ে তোলেন নতুন ব্যান্ড এলআরবি। সে সময় তার সঙ্গী ছিলেন জয়, স্বপন আর এস আই টুটুল। শুরুতে এলআরবির পুরো নামটি ছিল ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’, পরে তা বদলে নাম হয় ‘লাভ রানস ব্লাইন্ড’। এলআরবির প্রথম কনসার্ট হয়েছিল ঢাকার একটি ক্লাবে। সেখানে ইংরেজি গানই পরিবেশন করেছিলেন তারা। কিছুদিন পর ঢাকা শিশু একাডেমিতে এক কনসার্টে প্রথমবারের মত ক্লাব বা হোটেলের বাইরে দর্শকদের সামনে আসে এলআরবি। ১৯৯২ সালে দলের নামেই বাজারে আসে এলআরবির জোড়া অ্যালবাম এলআরবি-১ ও ২। এরপর গত ২৭ বছরে সুখ, তবুও, ঘুমন্ত শহরে, স্বপ্ন, ফেরারী মন, বিস্ময়, যুদ্ধ, স্পর্শসহ ১৪টি অ্যালবাম শ্রোতাদের সামনে এনেছে এলআরবি।
আইয়ুব বাচ্চুর প্রথম একক অ্যালবাম ‘রক্ত গোলাপ’ বাজারে আসে ১৯৮৬ সালে। তখনও তিনি সোলসে। প্রথম অ্যালবাম খুব একটা সাড়া না পেলেও ১৯৮৮ সালে ‘ময়না’ অ্যালবামে গায়ক হিসেবে বাচ্চু শ্রোতাপ্রিয় হতে শুরু করেন। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত আইয়ুব বাচ্চুর তৃতীয় একক অ্যালবাম কষ্ট দারুণ ব্যবসা সফল হয়।
পরের বছরগুলোতে ‘সময়’, ‘একা’, ‘প্রেম তুমি কি’, ‘কাফেলা’, ‘পথের গান’, ‘জীবন’, ‘রিমঝিম বৃষ্টি’, ‘বলিনি কখনো’র মত একক অ্যালবাম নিয়ে শ্রোতাদের কাছে পৌঁছেনে আইয়ুব বাচ্চু। ২০১৫ বাজারে আসে তার একক অ্যালবাম ‘জীবনের গল্প ’।
আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন একাধারে গীতিকার, সুরকার এবং প্লেব্যাক শিল্পী। চার দশক বাংলাদেশের তরুণদের গিটারের মূর্ছনায় মাতিয়ে রাখা রকস্টারের গিটার বাদনের খ্যাতি পুরো ভারতীয় উপমহাদেশেই। আইয়ুুব বাচ্চুর কণ্ঠে ‘ফেরারী এই মনটা আমার’, ‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘একদিন ঘুমভাঙা শহরে’, ‘চল বদলে যাই’, ‘এখন অনেক রাত’, ‘রুপালি গিটার’, ‘হাসতে দেখ গাইতে দেখ’র মত বহু গান শ্রোতাদের হƒদয়ে বাজবে বহুদিন।
এছাড়া লাল বাদশা, গুণ্ডা নাম্বার ওয়ান, ব্যাচেলর ও চোরাবালি সিনেমায় প্লেব্যাক করেছেন বাচ্চু। চলচ্চিত্রে তার গাওয়া প্রথম গান- ‘অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে’ দারুণ জনপ্রিয় হয়।
আইয়ুব বাচ্চু ও এলআরবির অ্যালবামগুলো:
একক: রক্তগোলাপ (১৯৮৬), ময়না (১৯৮৬), কষ্ট (১৯৯৫), সময় (১৯৯৯), একা (১৯৯৯), প্রেম তুমি কী (২০০০), দুটি মন (২০০২), কাফেলা (২০০২), প্রেম প্রেমের মতো (২০০৩), পথের গান (২০০৪), ভাটির গানে মাটির টানে (২০০৬), জীবন (২০০৬), সাউন্ড অব সাইলেন্স-ইন্সট্রুমেন্টাল (২০০৭), রিমঝিম বৃষ্টি (২০০৮) ও বলিনি কখনও (২০০৯)।
ব্যান্ড: এলআরবি ১ ও ২ (১৯৯২), সুখ (১৯৯৩), তবুও (১৯৯৪), ঘুমন্ত শহরে (১৯৯৫), স্বপ্ন (১৯৯৬), আমাদের বিস্ময় (১৯৯৮), মন চাইলে মন পাবে (২০০১), অচেনা জীবন (২০০৩), মনে আছে নাকি নাই (২০০৫), লাইভ অ্যালবাম ফেরারি মন (আনপ্লাগড ১৯৯৬), স্পর্শ (২০০৮)।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই অক্টোবর, ২০১৮ রাত ১১:৫২