পদ্মা সেতু নিয়ে দেশ জুড়ে চলছে হৈচৈ। কিন্তু কেউ কি কখনো ভেবেছে এ ব্যাপারে পদ্মানদী কি ভাবছে সেটাও জানা দরকার? আমি গিয়েছিলাম পদ্মা পাড়ে, পদ্মা নদীর সাথে কথা বলতে।
পদ্মাপাড়ে গিয়ে দেখি শান্ত নিঃশব্দ পদ্মা। কোন সাড়াশব্দ নেই কেন? এত বেলা হয়ে গেল এখনো ঘুমুচ্ছে? অসুখ বিসুখ করেনি তো? কিছুক্ষন অপেক্ষা করে হাঁক দিলাম, "পদ্মার ঢেঁউ রে..........."
তার ঠিক দশ সেকেন্ড পর ঝপাত্ করে এক ঝটকা পানি এসে আমাকে ভিজিয়ে দিল। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে উঠে বললাম, এতক্ষন কোথায় ছিলে? আমি সেই কখন থেকে দাড়িয়ে আছি। আর এভাবে পানি ছিটালে কেন?
"পানি ছিটালাম কোথায়? এটা তো একটা চড় ।"
"চড়! চড় মারলে কেন?"
"এভাবে হাঁকডাক শুরু করেছিস কেন? আমার কি শরীর বলে কিছু নেই? একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। সারাজীবনই তো এপাড় থেকে ওপাড় ছুটোছুটি করছি। এখন তো বয়সও হয়েছে নাকি?"
"ওমা! তোমার আবার বয়স কি গো!" আমি মৃদু হেসে বললাম, "তোমাকে তো দেখতে এখনো দিব্যি সুন্দরী লাগে।"
"ও কথা তোর পরদাদাও বলত। যা হোক, কেন এসেছিস বললি না তো। আমার আবার তাড়া আছে। ওপাড়ে যেতে হবে। যা বলবি তাড়াতাড়ি বল।"
"হুম বলছি। কিন্তু তার আগে বলতো তোমার জ্বরটর করে নি তো? পানি তো বেশ গরম দেখলাম।"
"ওটা রাগে গরম হয়েছিল। না জ্বরটর করে নি। তবে মন খারাপ।"
"মন খারাপ কেন?"
"বিশ্বব্যাংক যে অপমানি করল আমাকে। জানিস না?
"ও অপমান শুধু তোমার গায়ে না, আমাদের সবার গায়েই লেগেছে।"
"এতদিন বুকে করে নৌকা, জাহাজ, লঞ্চ পাড় করেছি। কত তেল পেট্রোল, বিষ্ঠা, ময়লা আবর্জনা আমার গায়ে ছুঁড়েছিস। আমি অসুস্থ হয়েছি। তবুও কাউকে কষ্ট দেই নি। অসুস্থ শরীর নিয়েও তোদের পাড়াপাড় করেছি। তারপর শুনলাম আমাকে খোঁড়াখুঁড়ি করে ইটপাথর দিয়ে সেতু বানাবি। ভেবেছিলাম বুকে সেই পাথর চাপা দিয়ে সব সহ্য করে নিব। তাও যদি দেশটা উন্নত হয়।"
"হ্যা। আমি তো সে ব্যাপারেই তোমার সাথে কথা বলতে এলাম। পদ্মাসেতু এখন যে আমরা বিশ্বব্যাংকের সাহায্য ছাড়াই বানাবো জানো তো?"
"জানি বৈকি। এ নিয়ে তো কত কথাই শুনলাম। কত টাকা জানি লাগবে?"
"৬.১ কিলোমিটার দীর্ঘ বিরাট সেতু প্রকল্প, লাগবে ২৯০ কোটি ডলার।"
"তোদের যে এত টাকা আছে তা আগে বলিস নি তো।"
"এত টাকা কোথায়? টাকা জোগার করতে হবে। সরকার বলেছে ১-২ বিলিয়ন টাকা খরচ করার মত ক্ষমতা আমাদের আছে। আরো আছে ১৬ কোটি মানুষ। ৮০ লাখ প্রবাসী বাঙালী। আর মালশিয়াও তো টাকা দিবে বলছে।"
"শুনেছি মালশিয়া নাকি উচ্চ হার সুদে টাকা দিবে? এটা তো বিরাট ক্ষতি। তোরা জনগন কিভাবে টাকা দিবি?"
"জনগন যে যেভাবে পারে দিবে। মোবাইল কলরেট থেকে নাকি কাটবে, আবার একদিনের বাজার খরচ দিয়ে দিবে আরো কত কি?"
"ওমা সে একদিন তোরা না খেয়ে থাকবি নাকি রে?"
"তাই তো থাকতে হবে বলে মনে হচ্ছে, তা না হলে সেতু হবে কি করে?"
"তুই কত টাকা দিবি?" চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে পদ্মা।
একথা শুনে আমি একটু হকচকিয়ে গেলাম। বললাম, "তা তো জানি না। দেখি মাসে একটু টানাটানি করে চলে যদি কিছু বাঁচাতে পারি, সেটাই দিব।"
পদ্মা ম্লান হাসে। বলে, "আচ্ছা দেশের অর্থনীতির তো বিরাট ক্ষতি হবে বলে মনে হচ্ছে।"
"হুম। বিশেষজ্ঞরা বলেছে এতে দেশের অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ কমে যাবে। বৈদেশিক মুদ্রায় অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হবে। পুরা অর্থনীতিতে একটা বিরাট প্রভাব পড়বে।"
"আচ্ছা সেতু যে তৈরি করছিস। সেটা আবার দুইদিন পর ভাইঙ্গা পইড়া আমার মাজা ভাঙবে না তো?"
আমি হাসলাম। "কি জানি বলতে পারি না। সেরকম কোন প্রতিষ্ঠান না তৈরি করলে ভেঙ্গে পড়তেও পারে। সাবধানে থাইকো।"
পদ্মার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। তত্ক্ষনাতই সে হেসে ফেলল। বলল, "তুই বাংলা সিনেমা দেখিস?"
"তেমন না। কেন?"
"অনেক বাংলা সিনেমায় দেখা যায় নায়ক ও তার বোন মাটির ব্যাংক ভেঙ্গে একটা সেলাই মেশিন নিয়ে কাজ শুরু করে।১০ সেকেন্ড পর ঘর ঘরে ১০ টা মেশিন-দশজন মানুষ কাজ করছে। তার ১০ সেকেন্ড পর একটা টেইলার্সের দোকান, তার ১০ সেকেন্ড পর একটা গার্মেন্টস ফ্যক্টরী। নামঃ ভাই-বোন গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রি"
আমি হাঃহাঃ করে হেসে উঠলাম।
"তুমি এসব সিনেমা কই দেখো!"
পদ্মাও হাসে। "আরে নদীর পাড়ে ভাতের হোটেল, চায়ের দোকানগুলোতে তো সারাক্ষনই সিনেমা চলে। দেখা তো যায়-ই। কেন বললাম আগে সেটা শোন।"
"বলো"
"আমার সেতু মানে পদ্মা সেতু হয়তো নির্মান হবে। তবে সিনেমার প্রতি ১০ সেকেন্ডকে ১০ বছরে কনর্ভাট কইরা তারপর চিন্তা করিস। এখন বাড়িত গিয়া ঘুমা"
আমি চুপ মেরে দাড়িয়ে রইলাম। পদ্মা আরেক ঝটকা পানি ছিটিয়ে চলে গেল। এ ঝটকায় কোন চড় ছিল না। ছিল এক নির্মল ভালবাসা।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুলাই, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:১১