১
রুপালি চেইনটা চমৎকার মানিয়ে যায় ববছাট সাদা চুলের সাথে। কখনো বা আলগোছে গলা জড়িয়ে রাখে রঙ্গীন কোনো শাল। ব্যাস, অলংকার বলতে এটুকুই। প্রায় আশি ছুঁইছঁই ক্রিস্টিয়ানের পরিপাটি অথচ খুব সাধারন রূপটা দেখে বোঝা মুশকিল যে তার ঝুলিতে আস্ত একটা নোবেল পুরষ্কার আছে। তাও আবার শারীরবিদ্যা বা চিকিৎসাশাস্ত্রের মত খটোমটো বিষয়ে। ১৯৯৫ সালে ভ্রুনের বেড়ে ওঠায় জিনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যুগান্তকারী গবেষনার জন্যে আরো দুই জন বিজ্ঞানীর সাথে নোবেল জয় করে নেন এই বিদুষী জার্মান নারী।
সেই থেকে তার গয়নার বাক্সে রুপার চেইন পাশে ঢাউস সাইজের সোনার পদকটাও আছে সগৌরবে। অলংকার হিসেবে সেটা একেবারে খারাপ নয় বই কি। আজকের দুনিয়ায় প্রথম সারির একজন বিজ্ঞানী মানা হয় তাকে। তবে চলার পথ তেমন মসৃন ছিল না ক্রিস্টিয়ানের জন্যে। উঁচুনিচু রাস্তায় তার দীর্ঘ যাত্রার গল্পটা কোনো টান টান ভ্রমন কাহিনির চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়।
সাল ১৯৪২। ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বের ডামাডোল তখন মধ্যগগনে। জার্মান শহরগুলো আতংকে দিন কাটাচ্ছে। কখন আকাশ থেকে বোমা পড়ে শহর গুড়িয়ে যায়, এই শঙ্কা দিন রাত। তারই মাঝে জার্মানির মাগদেবুর্গ শহরে ফলহার্ড দম্পতির ঘরে ফুটফুটে এক মেয়ে হল। নাম রাখা হল ক্রিস্টিয়ানে ফলহার্ড। স্থপতি বাবা আর স্কুল শিক্ষিকা মায়ের আরো ছানাপোনা ছিল। আর ছিল যুদ্ধকালীন অভাব। তিনবেলা পেট পুরে খেতে পেলেই লোকে বর্তে যেত, সময়টা এমনই।
ফলহার্ড দম্পতি অবশ্য অভাবকে বশ করতে জানতেন। দারুন ক্রিয়েটিভ ছিলেন দু’জনই। গান করতেন, ছবি আঁকতেন। এই শিল্পী মন কাজে লাগিয়ে গল্প লিখে, ছবি এঁকে পাতার পর পাতা জুড়ে বই বানিয়ে দিতেন ছেলেমেয়েদের। কারন, ওসব কেনা রীতিমত বিলাসিতা ছিল তখন। সব দেখেশুনে ক্রিস্টিয়ানে আর তার ভাইবোনরাও খুব ছোট বয়সেই শিখে গেল কি করে সেলাই মেশিন ঘুরিয়ে নিজেদের কাপড় নিজেরাই বানিয়ে নিতে হয়। আবার ইতস্তত পড়ে থাকা ফেলনা দিয়েই খেলনা গড়িয়ে নিত তারা অনায়াসে। সুতরাং, অভাবকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাতে ফলহার্ড পরিবারের কোথাও বাঁধল না। ছোট্ট মেয়েটা ভাইবোনদের সাথে হইহুল্লোড় করে বড় হতে লাগলো। আর তাতে যুদ্ধের মত কঠিন সময়টা কিছুটা হলেও সহনীয় হয়ে এল।
অভাবের বাস্তবতা থেকে ক্রিস্টিয়ানে আরো এক বিচিত্র এক দক্ষতা শিখে নেয়। পরবর্তীতে গবেষনা করতে গিয়ে কোথাও ঠেকে গেলে হাতের কাছে মামুলি সরঞ্জাম দিয়ে একটা চলনসই সমাধান বের করে ফেলা তার কাছে ছেলেখেলার মত সহজ ছিল। থমকে না দাঁড়িয়ে এগিয়ে যাবার প্রবল ইচ্ছেটা তাকে আর দশজনের চাইতে আলাদা করে দিয়েছিল।
২
জন্ম মাগদেবুর্গে হলেও ক্রিস্টিয়ানের শৈশব-কৈশোর কাটে ফ্রাংফুর্ট শহরে। যুদ্ধের শেষ দিকটায় নিরাপত্তার কথা ভেবে সপরিবারে এখানেই চলে আসে সবাই। বাড়ির সামনে সুবিশাল বাগান আর খুব কাছেই বনজঙল-ঝোপঝাড়ের রাজত্ব। চমৎকার নিরিবিলি পরিবেশ। খেলার ছলে ফুলপাখি-লতাপাতা খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে নেশা ধরে যায় তার। কত না রঙের ফুল আর কত না ঢঙ্গের পোকামাকড়। বইয়ের সাথে মিলিয়ে তাদের কথা জানতে গেলে সময় উড়ে যেত এক নিমিষেই। ভাইবোনেরা গান-কবিতা-ছবি নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও ক্রিস্টিয়ানের ভাল লাগতো প্রকৃতির গায়ে যা আঁকা আছে, তা-ই মন ভরে দেখতে।
ভাল লাগত না শুধু ইশকুলের গৎবাঁধা পড়াশোনা। সেখানে ছিল তার ইচ্ছেমাফিক আলসেমি। বাড়ির কাজের খাতা ফাঁকাই পড়ে থাকতো। অপছন্দের বিষয়গুলোতে চরম উদাসীন। ইংরেজিতে তো একবার লাল দাগ প্রায় পড়েই গিয়েছিল। শুধু ভাল লাগতো অংক, জীববিজ্ঞান আর সাহিত্যটা। আর তার বরাতেই রিপোর্ট কার্ডে মাঝারি মানের নম্বর জুটত সব মিলিয়ে।
একটাই বাঁচোয়া যে ক্রিস্টিয়ানের বাবা-মা আদর্শ বাঙালি বাবা-মা’র মত ছিলেন না। মেয়েকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার কি কেউকেটা বানাবার ইচ্ছেটা তাদের অত প্রবল ছিল না তাদের ভেতর। মোদ্দা কথা, পড়াশোনার জন্যে তারা তর্জন-গর্জন আর হুমকি-ধামকি দিয়ে কচি মনটা মিইয়ে দেন নি। বরং, খাতায় লাল কালি কি নীল কালি, সব সময়ই পাশে থেকে উৎসাহ জুগিয়েছেন। আর ফল হিসেবে তাদের ছেলেমেয়েরা শেষতক একেবারে খারাপও করে নি। দুই ছেলেমেয়ে বাবার মতন স্থপতি পেশায় এসেছে। বাকিরা কেউ সঙ্গীত, কেউ ভাষা নিয়ে ক্যারিয়ার গড়েছে। আর এক্কেবারে গড়পড়তা নম্বর পাওয়া মেয়েটা হয়েছে বিশ্ববিখ্যাত নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী। মোটের উপর, ফলহার্ড দম্পতিকে সেলুট ঠুকতেই হয়।
হাই স্কুলের গন্ডি টপকানোর সময়ে ক্রিস্টিয়ানের মনে হল এরপর ডাক্তারি পড়লে কেমন হয়। সেখানে তো জীববিজ্ঞান বা বায়োলজি বিষয়টা আছেই, আবার একই সাথে অসুখ সারিয়ে লোকের উপকারেও আসা যাবে। কৌতূহল পরখ করতেই হাসপাতালে নার্সিং-এর উপরে কোর্স নেয়া। কিন্তু হাসপাতাল নামের যজ্ঞখানা মনে ধরে নি ঠিক। তাই রোগী-অসুখ-ওষুধের এই জটিল সমীকরন থেকে বেরিয়ে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো সে। আর ডাক্তারির ভূতও মাথা থেকে নেমে গেল আচমকাই।
এরপর শুরু হল ফ্রাংকফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে তার মনের মত বিষয়, জীববিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা। কিন্তু বিধি বাম। কোর্সগুলো কেমন একঘেয়ে লাগতে থাকলো। এর চেয়ে ঢের দারুন জিনিস সে বইয়ে পড়েছে। ঝাঁ চকচকে নতুন কিছু খুঁজতে থাকা ক্রিস্টিয়ানে খানিকটা হতাশ হল যেন। এমন সময়ে কানে এল যে আরেক শহর, ট্যুবিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে নাকি নতুন একটা বিভাগ চালু হয়েছে। সেখানে বায়োকেমিস্ট্রি পড়ানো হয়। জার্মানিতে এমন বিভাগ এই প্রথম। শুনে আর তর সইলো না। ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট-টু-ট্যুবিংগেন ট্রেন ধরে সোজা চলে এল অচেনা এক নির্বান্ধব শহরে।
আস্তে আস্তে বন্ধুবান্ধব কিছু জুটলো বটে, তবে যার জন্যে আসা, সেই পড়াশোনাটা তেমন যুতসই লাগলো না। দেখা গেল বায়োকেমিস্ট্রির ভেতর ‘বায়ো‘ অংশটা সামান্যই। কেমিস্ট্রি-ই যেন সিংহভাগ। সকাল-বিকাল রাসায়নিক বিক্রিয়ার মোটা মোটা শুষ্কং-কাষ্ঠং বই পড়ে অভক্তি ধরে গেল রীতিমত। কিন্তু, বাড়ি ছেড়ে এত দূরে পড়তে এসে অত খুঁতখঁতে হলে চলে না। কি আর করা, ঘাড় গুঁজে একরকম পড়া চালিয়ে যেতে হল।
৩
ধৈর্য্য যখন তলানিতে এসে ঠেকলো, ঠিক তখন জেনেটিক্সের ক্লাসগুলো যেন মুশকিল আসান হয়ে হাজির হল। ট্যুবিংগেনের বিখ্যাত ম্যাক্স-প্লাংক ইন্সটিটিউটের নাম করা সব তাবড় তাবড় প্রফেসরদের লেকচারগুলো দুর্দান্ত লাগলো ক্রিস্টিয়ানের কাছে। ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার আনুবীক্ষনিক জগতের বিশাল দুয়ার খুলে গেল চোখের সামনে। ছেলেবেলায় বাড়ির বাগানে ফুল-পাখি-পোকামাকড়ের ঘরবসতি দেখে বড় হওয়া কৌতূহলী মনটা ধূলোর পর্দা সরিয়ে আবার সজাগ হয়ে উঠলো। জিন দিয়ে কি করে জীবনের রহস্য লেখা হয়, কি করে হাজারো জিনের সমাবেশে ডিএনএ তৈরি হয় আর কি করেই বা বিশেষ কিছু জিনের ইশারায় প্রোটিন তৈরি হয়, যা কি না সেই ভাইরাস থেকে শুরু করে এই মানুষ-সবার টিকে থাকা না থাকা ঠিক করে দেয়- এত শত নতুন আর আনকোরা তথ্য জেনে তাক লেগে গেল সদ্য তরুনী ক্রিস্টিয়ানের নবীন মনে। যদিও এই নতুন রকমের জ্ঞানের সে কতকটা বুঝলো আর কতকটা মাথার ওপর দিয়ে গেল। কিন্তু বিজ্ঞানের কড়কড়ে নতুন আবিষ্কারকে জানার ভেতর একটা মারাত্মক একটা অঘোম আকর্ষন আছে, সেটা বুঝতে সময় লাগলো না তার।
১৯৬৯ সালে যথারীতি যেমন তেমন একটা ডিপ্লোমা ডিগ্রি হাতে নিয়ে বায়োকেমিস্ট্রির পাঠ চুকল ক্রিস্টিয়ানের। জেনেটিক্সের ঐ হাতেগোনা ক্লাসগুলো ছাড়া আর কিছুই ভাল লাগে নি বলে এই হাল। ভাল লাগা-না লাগার এই তীব্র বোধটা বেশ ভোগাচ্ছিল। কিন্তু ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়াটা যে একরোখা অদ্ভূত মেয়েটা ধাতে নেই।
আরো বেশি জানার আগ্রহ থেকে এবার শুরু হল পিএইচডি গবেষনা। আর হঠাৎ করেই ক্রিস্টিয়ানে খেয়াল করলো, তার সহপাঠী ছাত্রীর সংখ্যা লাফিয়ে কমে এসেছে। বান্ধবীদের বেশিরভাগই পড়াশোনায় ইস্তফা আর সংসারে মন। ক্যারিয়ার বনাম টিফিন ক্যারিয়ারের চিরায়ত লড়াইয়ে টিফিন ক্যারিয়ারেরই জয় হল। বেচারা ক্রিস্টিয়ানেই শুধু অনেকগুলো ছেলে সহপাঠীর প্রশ্নবোধক চাহনি এড়িয়ে গবেষনার ল্যাবে পা রাখলো।
সহপাঠীদের ঝরে পড়া ব্যাপারটা খুব ভাবিয়েছিল তাকে। খালি মনে হচ্ছিল, সাংসারিক দৈনন্দিন রুটিন কাজে সামান্য সাহায্য পেলে সহপাঠীদের অনেকেই হয়তো ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিদায় নিত না। ঘরে-বাইরে সমান তালে নিজেদের সাক্ষর রাখতো অবলীলায়। শুধু নিজে এগিয়ে যাওয়া নয়, হাত ধরে বাকিদেরও সঙ্গী করে নেবার ছোট্ট ইচ্ছেটা পরবর্তী জীবনে সে সত্যিই ঘটিয়ে দেখিয়েছিল।
যাহোক, ম্যাক্স-প্লাঙ্কের গবেষক হাইঞ্জ শিলার-এর ল্যাবে শুরু হল তার গবেষনা জীবনের হাতেখড়ি। এই সেই ডক্টর শিলার, যার লেকচার শুনে জিনতত্ত্ব আর অনুজীব্বিজ্ঞানের উপর গভীর আগ্রহ জন্মেছিল ক্রিস্টিয়ানের। আগ্রহটা সামান্য দমে গেল যখন দাঁতভাঙ্গা একটা থিসিস টপিক ধরিয়ে দেয়া হল তাকে। কাজটা ছিল ব্যাকটেরিয়াকে আক্রমন করে তাতে বাসা বেঁধে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে- এমন ভাইরাসদের নিয়ে। যাদের নাম কিনা ব্যাক্টেরিওফায বা ব্যাক্টেরিয়াখেকো। এই ধরনের কিছু ভাইরাসের ডিএনএ সিকোয়েন্সের তুলনামূলক গবেষনার দায়িত্ব পড়েছিল ক্রিস্টিয়ানের কাঁধে।
মুশকিল হল, পরীক্ষাগুলো করার জন্যে যে ডিএনএ সিকোয়েন্সিং পদ্ধতির প্রয়োজন, সেটা তখনও ভাল করে জানা ছিল না কারো। অগত্যা, বারবার ব্যর্থতার ভেতর ঘুরপাক খেয়ে এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে তাকে গবেষনার দিক পাল্টাতে হয়।
হতাশ না হয়ে এবার সে মন দেয় প্রোটিন আর ডিএনএ-এর মাঝের মিথস্ক্রিয়া জানার জন্যে। আরএনএ পলিমারেজ নামের খুব অপরিহার্য একটা প্রোটিন কি করে ব্যাকটেরিওফাযের ডিএনএ’র ঘাড়ে চেপে তা থেকে আরএনএ তৈরি করিয়ে ছাড়ে, সেই কাহিনীটাই ক্রিস্টিয়ানে খুব খেটেখুটে বের করে ফেললো। ডিএনএর এই ঘাড় যে যেনতেন কোন জায়গা নয়, বরং ‘প্রোমোটার‘ নামের বিশেষ একটা অংশ, তা-ও সে প্রমান করে ছেড়েছিল। আর পুরো কাজটাই করা হয়েছিল ডিএনএ সিকোয়েন্সিংয়ের কোনো রকম সাহায্য ছাড়াই। সম্পূর্ন বিকল্প পদ্ধতিতে এগোনো গবেষনার ফল খুব দ্রুতই প্রকাশ পায় বিখ্যাত ‘নেচার‘ বিজ্ঞান-সাময়িকীতে। এবার থিসিস জমা দিয়ে ডক্টরেট তকমা তো যুটলই। সেই সাথে বিজ্ঞানী হিসেবে নিজের জাতটাও চিনিয়ে দিল আজীবন গড়পড়তা রেজাল্ট করে আসা মেয়েটা।
৪
বিজ্ঞানী জীবন মানেই যাযাবরের জীবন। আজ এদেশের কোনো ল্যাবে, তো কাল মানচিত্র ডিঙ্গিয়ে ভিনদেশে কোনো গবেষনাগারে। এই সূত্র মেনে তাই ক্রিস্টিয়ানেও ক্ষান্ত হল না। পিএইচডি ডিগ্রি ঝুলিতে পুরেও জ্ঞানের পিপাসা মিটছিল না তার। নতুন কিছু শেখার আশায় ট্যুবিংগেন ছেড়ে সুইজারল্যান্ডে পাড়ি জমালো এবার। সঙ্গী হল ইউরোপিয়ান মলিক্যুল্যার বায়োলজি অর্গানাইজেশন থেকে ফেলোশিপ। নামকরা বাজেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসাইটে গবেষক, ওয়াল্টার গেরিং-এর ল্যাবে হিসেবে যোগ দেয় ক্রিস্টিয়ানে।
সেখানে আরেক তরুন গবেষক, এরিক ভিসশাউ-এর সাথে পরিচয়। তার সাথে গল্পে-আড্ডায় আর কাজের মাঝে জিনতত্ত্ব নিয়ে অনেক কিছুই খুব চটজলদি শিখে নিল সদা উৎসাহী ক্রিস্টিয়ানে। আবার যম্মিন দেশে যদাচার মেনে সুইস ভাষাটাও রপ্ত করতে ভুলল না। সপ্তাহান্তে ক্ল্যাসিক সুইস শহরগুলোও দেখা হল ঘুরে ফিরে। মোটের উপর প্রানবন্ত একটা সময় কাটলো সুইজারল্যান্ডে। তবে সব ছাপিয়ে, এরিকের সাথের বন্ধুত্বটা বিরাট প্রাপ্তি ছিল। তখনো তারা জানত না, তাদের এই ‘কমন কিউরিওসটি’ একদিন নোবেল পুরষ্কারে রূপ নেবে।
আরো কতগুলো গবেষনা ল্যাব ঘুরে, আরো কাজ শিখে ১৯৭৮-এর দিকে প্রথমবারের মত নিজের একটা ল্যাব গড়ে তুললো ক্রিস্টিয়ানে। জার্মানির হাইডেলবার্গ শহরে তার সাথে যোগ দেয় বন্ধু এরিক। খুব মৌলিক এক জিজ্ঞাসা দিয়ে শুরু হয় তাদের গবেষনা। জীবনের এত বৈচিত্র্যের উৎস কোথায় আসলে? জীবনের যাত্রা শুরু হয় অতি ক্ষুদ্র নিষিক্ত ডিম্বানুর কোষ বিভাজন থেকে। সেই শুরুতে সব কোষ দেখতে অবিকল। প্রতি কোষেই আছে একই রকম সব জিন। একই নীল নকশা। তাহলে কে ঠিক করে দেয় একেক কোষের বিচিত্র ভবিষ্যত? কেন কোনো কোষ বিভাজনের চক্করে পড়ে আস্তে আস্তে হৃৎপিণ্ড তৈরিতে লেগে যায়, আর কেনই বা কেউ ব্যস্ত হয়ে পড়ে ফুসফুস গড়তে? কি করে ডিম্বানু থেকে ভ্রুন আর তা থেকে পরিপূর্ণ জীবের গঠন দাঁড়িয়ে যায়।
হাইডেলবার্গের মাত্র দুইশ স্কয়ার ফিটের নেহাত গরিবী হালের ছোট্ট ল্যাবে বসে এইসব অতি উচ্চমার্গীয় চিন্তার বড় বড় মাছি মারতে লাগলো দুই বন্ধু ক্রিস্টিয়ানে আর এরিক।
কিছু মাছি তারা আসলেই মারলো বটে। এই মাছি হল ফল-ফ্রুটে উড়ে এসে জুড়ে বসা অতি সাধারন মাছি বা ফ্রুট ফ্লাই। বৈজ্ঞানিক নামটা যার বেশ বলিহারি-Drosophila melanogaster। বিশেষ পদ্ধতিতে জিনের পরিবর্তন বা মিউটেশন ঘটিয়ে দেখতে চাইলেন মাছির চোখ, শূড়, পাখা বা অন্যান্য অঙ্গে তার কি প্রভাব পড়ে। হাজার বিশেক এমনতর মাছি পরীক্ষা করে দেখা গেল মিউট্যান্ট ভ্রুন থেকে বড় হওয়া মাছির লার্ভাগুলো বেজায় আজগুবি দেখাচ্ছে। কোনোটা স্বাভাবিক আকারের বদলে মিনিয়েচার শশার মত দেখাতে লাগলো, কোনো লার্ভা যেন বা একদম কুন্ডুলী পাঁকিয়ে থাকা সজারু। খুঁজে পেতে পাক্কা পনেরোটা জিন পাওয়া গেল, যাদের সামান্য অদল বদল হলেই এমন বিচিত্র পরিবর্তন ঘটছে। ভ্রূণ থেকে স্বাভাবিক লার্ভা হবার গ্যারান্টি তখন আর থাকে না।
মাছির দেহের বিকাশের জন্যে খুব জরুরী এই জিনগুলোর নাম খুঁজতে গিয়ে সময় নিলেন না দুই মহা ব্যস্ত বিজ্ঞানী। আলপটকা নাম দিয়ে দিলেন, Hedgehog (সজারু) কিংবা Gurken (জার্মান: শসা)। ব্যস, নাম দেয়ার মত মামুলি মামলা পাঁচ মিনিটেই খতম! তবে এই আবিষ্কার মামুলি নয় মোটেও। ভ্রুনবিজ্ঞানের জগতে হইচই পড়ে যায় একদম। এই প্রথম জানা গেল প্রানের বেড়ে ওঠায় বিশেষ জিনের বিশেষ ভূমিকা।
মুশকইল একটাই। সব ক্রিয়ার যেমন পার্শ্বপতিক্রিয়া থাকে, তেমনি ক্রিস্টিয়ানেও একটা সাইড ইফেক্টে পড়ে গেল। দিনভর মাছি নিয়ে কাজ করার পর রাতের বেলা ঘুমের মাঝেও মাছি দেখা শুরু করলো সে। স্বপ্নে মাছিরা না এলে তার ঘুম হত না, এমন দশা। লোকে আড়ালে আবডালে চোখ টিপে তাকে ‘কুইন অফ ফ্লাইস’ বা ‘মক্ষীরানী’ ডাকতে লাগলো। সিরিয়াস গোছের বিজ্ঞানী ক্রিস্টিয়ানের এই চটকদার উপাধি খুব একটা মনে ধরল না। মাছি তার রিসার্চ টপিক। এমন তো নয় যে আঙ্গুলে তুড়ি ছোটালেই এক আকাশ মাছি বিজবিজ শব্দে উড়ে এসে অনুগত সৈন্যের মত বলবে, ‘জো হুকুম মহারানী, আদেশ করুন এই মক্ষীবাহিনীকে। আমরা আপনার ডাক শুনে আমরা সুদূর ভনভন্ নগর থেকে উড়ে এসেছি’।
কিন্তু চটুল রসিকতার বিপরীতে রাশভারী ফ্রাউ ক্রিস্টিয়ানেকে তেড়ে আসতেও দেখা গেল না। এই মৌনতা হয়তো বা সম্মতিরই লক্ষন, কে জানে।
৫
হাইডেলবার্গের পাট চুকিয়ে ট্যুবিংগেনে ফিরে আসে ক্রিস্টিয়ানে। তবে ড্রোসোফিলা নিয়ে কাজ চলছে বিরামহীন। তার বছর খানেক পর, ১৯৮৪ সালে ট্যুবিংগেনের ম্যাক্স-প্লাঙ্ক ইন্সটিটিউটের পরিচালক পদে যোগ দেবার বিরল সুযোগ আসে। সে সময়ে জার্মানি জুড়ে ছড়িয়ে থাকা আশির মত ম্যাক্স-প্লাঙ্ক প্রতিষ্ঠানের দুইশ পরিচালকের ভেতর নারী ছিলেন মাত্র দুই জন। ক্রিস্টিয়ানে সেই দুইজনের অন্যতম হয়ে অসাধ্য সাধন করলেন বটে, তবে সমীকরণটা ছিল বড্ড জটিল। পদমর্যাদা থাকলেও পদে পদে শিকার হতে হল নানান বৈষম্যের। না ছিল স্বচ্ছন্দ্যে কাজ করবার মত বড় ল্যাব, না ছিল গবেষনার জন্যে যথেষ্ট অর্থের যোগান। পুরুষ সহকর্মীরা নিত্যদিন টিপ্পনি কেটেছে, ‘অনেক তো হল বিজ্ঞান-টিজ্ঞান। এবার এসব ছেড়ে কয়টা ছানাপোনা নাও আর নিজের স্মার্ট জিনগুলোকে তাদের মাঝে বিলিয়ে দাও। শুধু নিজে বুদ্ধির ঢেকি হয়ে বসে থাকলেই হবে নাকি?’।
ক্রিস্টিয়ানে শুধু শুনেই গেছে। কারন, নিঃসন্তান ডিভোর্সী নারীর প্রতিবাদ কে-ই বা পাত্তা দেবে। ব্যক্তিগত দুঃখ আর অপ্রাপ্তির খাতা সমাজের সামনে মেলে ধরার ইচ্ছে আর আগ্রহ, কোনোটাই তার ছিল না। তবে চৌকস এক জবাব আসা আরম্ভ হল ভিন্ন পথে।
ঈর্ষনীয় গবেষনার বনামে ধীরে ধীরে দারুন সব অর্জন এসে কড়া নাড়লো দরজায়। লিবনিজ প্রাইজ থেকে গ্রেগর মেন্ডেল পুরস্কার এল। আরো এল অক্সফোর্ড-হার্ভার্ড-ইয়েল-প্রিন্সটন থেকে একের পর এক সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি। জার্মানির সবচেয়ে বড় পদক, ‘ক্রস অব মেরিট’ও বাদ পড়লো না পদক আর পুরষ্কারের লম্বা তালিকাটা থেকে।
পাশার দান এবার পুরোপুরি পালটে গেল। অর্থাভাব আর বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারল না। নতুন নতুন গবেষনার পথ খুলে গেল।
এবার অমেরুদন্ডী মাছির জিনগুলো মেরুদন্ডী প্রানীর বেলাতেও একই কাজ করে কিনা, সেই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হন্যে হয়ে পড়লো ক্রিস্টিয়ানে। ট্যুবিংগেনে ম্যাক্স-প্লাঙ্ক ল্যাবে সাত হাজার এ্যাকুরিয়াম নিয়ে গড়ে তোলা হল জেব্রাফিশের সুবিশাল এক সংগ্রহ। জেব্রাফিশ- যার বৈজ্ঞানিক নাম Danio rerio। নাম শুনে স্প্যানিশ লীগের ফুটবলার মনে হলেও আসলে সে নীল-সাদা ডোরাকাটা ছোট একটা নিরীহ মাছ।
এই জেব্রাফিশের জিনের ওপর চালানো হল নানান রকম মিউটেশন। প্রমান হল যে, জেব্রাফিশের বেড়ে ওঠা আর মাছির বৃদ্ধি ভীষন সমান্তরাল। তাদের জিনগত কলকাঠির নিয়ন্ত্রন প্রায় একইরকম। মেরুদণ্ডী মাছের আরেক মেরুদন্ডী আত্মীয়, আমরা, এই মানুষেরা। তাই আমাদের বেলাতেও একই নিয়ন্ত্রন কাজ করবে বলে হাইপোথিসিস ধরে নেয়া হল বিজ্ঞানী মহলে।
৬
ক্রিস্টিয়ানের মুকুটে সবচেয়ে বড় পালকটা যোগ হয় ১৯৯৫ সালে। হেমন্তের এক সকালে গোলমেলে একটা নম্বর থেকে রহস্যময় ফোনকল এল । ‘ফ্রাউ ডক্টর ক্রিস্টিয়ানে বলছেন? রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি থেকে বলছি। একটা সুখবর আছে। ড্রোসোফিলা মাছির ভ্রুন নিয়ে আপনার জেনেটিক নিয়ন্ত্রনের কাজটাকে আমরা এ বছর মেডিসিনের নোবেল দিচ্ছি। হ্যালো, হ্যালো, শুনতে পাচ্ছেন…?’।
ওপাশে বাকরুদ্ধ ক্রিস্টিয়ানের কি অভিব্যক্তি হল, তা আর বলে দিতে হয় না। আরো দুর্দান্ত ব্যাপার হল, এই নোবেলের কান্ডারী তার দীর্ঘদিনের গবেষক বন্ধু এরিক ভিসশাউ আর আরো এক আমেরিকান সহবিজ্ঞানী। তবে সবচেয়ে সাংঘাতিক ঘটনা হল, জার্মানিতে মেডিসিনে তিনিই প্রথম নোবেলজয়ী। সেই ১৯৯৫ অবধি একশ ছাপান্ন জন পুরুষ নোবেলজয়ীর বিপরীতে নারীর সংখ্যা ছিল মাত্র ছয় জন। তাদেরই একজন বনে গিয়ে রাতারাতি পুরো জার্মানির আইকনে পরিনত হন ক্রিস্টিয়ানে।
মজার ব্যাপার, আরো দুই-দুইটা নোবেল জয়ের সাথে ক্রিস্টিয়ানের নাম জড়িয়ে আছে। রোগ প্রতিরক্ষায় কাজ করে এমন একটা জিনের ভূমিকা আবিষ্কারে তার সরাসরি ভূমিকা আছে। ‘Toll’ নামের এই জিনের ভূমিকার কথা প্রথম সেই ড্রোসোফিলা নিয়ে কাজ করার সময়েই জানা যায়। মাইক্রোস্কোপে চোখ রেখে বিশেষ এক মিউট্যান্ট লার্ভা দেখে ক্রিস্টিয়ানে চিৎকার করে ওঠেন, ‘Das ist toll! কি দুর্দান্ত!’। পরে এ নিয়ে বিস্তর গবেষনা করে অন্যান্য বিজ্ঞানী যার স্বীকৃতস্বরূপ তাদের নোবেল দেয়া হয় পরবর্তীতে।
আবার এই তো সেদিন ২০২১ সালে ক্রিস্টিয়ানের বোনের ছেলে, বেঞ্জামিন লিস্ট রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পান। একই পরিবারে একাধিক নোবেল জয়ের ইতিহাস খুব বেশি লোকের নেই। ফ্রান্সে কুরী পরিবার এক ছিল বটে, কিন্তু জার্মান মুলুকে এমন উদাহরন আর নেই।
৭
আর সেই সব অতীত নিন্দুকেরা? তাদের মুখে কুলুপ এঁটে দিতে ২০০৪ সাল নাগাদ প্রতিষ্ঠা হয় ক্রিস্টিয়ানে নুসলাইন-ফলহার্ড ফাউন্ডেশন। উদ্দেশ্য, ছোট শিশু আছে-এমন নারী বিজ্ঞানীদের দিকে হাত বাড়ানো। কিছু বাড়তি আর্থিক সাহায্য দেয়া। যা দিয়ে ঘরের রুটিন কাজগুলো করিয়ে নেয়া যায় পেশাদার লোক দিয়ে। আর সেই বাড়তি সময়টুকু সন্তান আর গবেষনায় যোগ করলে নারীও যেন শ্বাস নিয়ে বাঁচে। ঘরে লক্ষী আর বাইরে সরস্বতী হবার কঠিন ভারসাম্যের লড়াইটা তখন কিছুটা হলেও সহজ হয়ে আসে। অগুনতি নারী বিজ্ঞানীর পাশে নিঃশব্দে বন্ধুর মত দাঁড়িয়ে এই অসামান্য কাজটাই করে চলেছেন এই অতিমানবী। ছেলেমেয়েদের মাঝে স্মার্ট জিন বিলিয়ে দেবার পরও সমাজকে, বিজ্ঞানকে আরো কিছু দেবার থাকতে পারে একজন নারীর, প্রকারান্তরে নিন্দুকদের তা-ই দেখিয়ে দিলেন যেন।
কর্মজীবনে বিজ্ঞানী ক্রিস্টিয়ানে যতটা বহির্মুখী, ব্যক্তিজীবনে ঠিক ততটাই অন্তর্মুখী, মৃদুভাষী। পড়তে ভালবাসেন খুব। ইতিহাস, সাহিত্য আর সঙ্গীত নিয়ে আগ্রহ আছে গভীর। আর ভাল লাগে শৌখিন রান্না। রান্না বইও বেরিয়েছে শখের বশে। তবে লেখার হাতটা বিজ্ঞানের জন্যেই বেশি বরাদ্দ। সরল ভাষায় গবেষনার কথা সহজ করে মেলে ধরেছেন ‘The Beauty of Animals বা প্রানীর সৌন্দর্য্য’ বইতে। এমনি আরো বই আছে তার লেখার ঝুলিতে। আর ফুলপাখি-লতাপাতার প্রতি চিরকালের আকর্ষন থেকে বাগান বিলাসিতাও আছে সমান তালে।
ক্রিস্টিয়ানে নুসলাইন-ফলহার্ড। বিজ্ঞানকে যার কখন পেশা হিসেবে মনে হয় নি। বরং এ যেন নেশা। ট্যুবিংগেনের ম্যাক্স-প্লাঙ্কে তার গবেষনা দল আছে এখনও। ‘অবসর’ শব্দটা যে তার অভিধানেই নেই। তাই তো আজতক আশি বছরের এই ছটফটে তরুনী কাজ করে চলছেন উল্কার বেগে।
লেখক-
ডঃ রিম সাবরিনা জাহান সরকার
মিউনিখ, জার্মানি
ছবি সৌজন্যঃ উইকিপিডিয়া
ব্লগ দিবস উপলক্ষে ফিচার ক্যাটাগরিঃ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের জন্যে লেখাটি দেয়া হল।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০২২ রাত ১:৪০