১.
ছোট্ট কিন্তু ছিমছাম ডমিস্টিক প্লেনটায় চেপে সবে সিটবেল্ট হাতড়াচ্ছি। জাহাজের ক্যাপ্টেন উৎসাহের সাথে অনর্থক বাকবাকুম করে যাচ্ছে। তার বিষয়বস্তুর ভেতর আছে সকালের মিষ্টি রোদ, চমৎকার আবহাওয়া আর পৌঁছাতে কতক্ষ্ন লাগবে ইত্যাদি শুভযাত্রামূলক কথাবার্তা। বৈমানিক না হয়ে উপস্থাপিকা হলেও তাকে বেশ মানিয়ে যেত। তবে অতি কথনের ফলে আজকে ষোলই ডিসেম্বরে সে দুই বার করে সবাইকে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়েছে। একবার বাংলায় আরেকবার ইংরেজিতে। ভীষন একটা অস্বস্তি নিয়ে ব্যাপারটাকে ‘স্লিপ অব টাঙ’ ধরে নিলাম। এক ফাঁকে বিমানবালা এসে আঙ্গুলের ফাঁকে লাল-সবুজ কাগজের পতাকা গুঁজে দিয়ে গেল। শিশুতোষ আগ্রহে পতাকা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে বিজয় দিবস গুলিয়ে ফেলার গুরু পাপটা মাফ করে দেবো কিনা ভাবছি। স্বাধীন দেশে ভুল করার স্বাধীনতা লোকের থাকতেই পারে। এখন শুধু ভুল করে আমাদেরকে ঢাকা-টু-কক্সবাজারের বদলে আরেকখানে উড়িয়ে নিয়ে না ফেললেই হল।
এই ভ্রমনের মাথা মুন্ডু কিছুই জানি না। গন্তব্য আপাতত কক্সবাজার হলেও আসলে সেখান থেকে যাচ্ছি সেন্ট মার্টিন্স। ব্যস, এর বেশি কিছু জানানো হয় নি। এটা নাকি একটা সারপ্রাইজ ট্যুর। তাই চাপাচাপি করতে গেলে রহস্যের মুচকি হাসি ছাড়া আর কোনো উত্তর মেলে নি। খালি বলা হয়েছে, যেন চক্কর বক্কর জামা না পড়ে সাধারন জিন্স-ফতুয়া আর আরামদায়ক চপ্পল পড়ে আসি। আর হালকা একটা কাঁধের ঝোলায় খান কতক কাপড় পুরে আনি। কথা পুরোপুরি রাখা সম্ভব হয় নি। ব্যাগে কি সব হাবিজাবি পুরে জগদ্দল পাথর বানিয়ে এনেছি। দেখতে লাগছে উঁইয়ের ঢিপির মতন। সেটাকে ওভারহেড বাংকারে আঁটাতে না পেরে আসনের নিচে আশ্রয় দিতে হয়েছে। পা ছড়িয়ে বসার আরামটুকু এখন সম্পূর্ন বেদখলে।
পুরো ভ্রমনের নীল নকশা এঁকেছে আমার ভাই রোনে আর ঝুমু আপু মিলে। আপু ডাকলেও সম্পর্কে ভাবী হন। তার ছটফটে স্বভাবের সাথে ভাবী ডাকটা ভারিক্কি লাগে দেখে সেদিকে যাই না। তবে ‘আপনি’ বলার সহবতটুকু মেনে চলি। ওদিকে সাত বছরের বড় ভাইয়ের বেলায় আদব-কেতার ব্যাপারগুলো কেন যেন ঠিক মনে আসে না। যদিও তাকে জনসম্মুক্ষে মামদো ভূত ডাকা ছেড়ে দিয়েছি বেশ কয়েক বছর হল।
যাহোক, পেশায় মারাত্মক ব্যস্ত এই দু’জন ডাক্তার মানুষ কিভাবে যেন তাদের রুটিন থেকে দিন কতক ছুটি ম্যানেজ করে আমাদেরকে ভজিয়ে ভাজিয়ে বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে। প্রতি বছর প্রবাস থেকে দেশে ফিরে সেই এক ঢাকাতেই ঘুরপাক খেতে থাকা আমরা এমন নিরুদ্দেশ হবার সুযোগ লুফে নিতে তাই দুইবার ভাবি নি। তাছাড়া, এ যে ছুটির ভেতর ছুটি!
চল্লিশ মিনিটের মাথায় কক্সবাজারের মাটি ছুঁয়ে ফেললাম। আমাদের সাতজনের দলটা বিমান থেকে প্রায় লাফিয়ে বেরিয়ে এলাম। সাতজন বলতে দুই ছানা পোনা সমেত ভাইয়া-আপুরা চার জন আর এদিকে ছোট এক ছানা, তার বড় এক বাবা আর মাঝারি আমি-এই আমরা তিন জন। ছানাদের কারো বয়স সাত, কারো বারো, কারো বা পাঁচও হয় নি। তবে আজকে আমরাও শিং কেটে বাছুর বনে গেছি। কারন, প্লেন থেকে নেমেই ডাবল ডিজিটের গম্ভীর বয়সগুলোকে বঙ্গোপসাগরের পানিতে ডুবিয়ে দিয়ে এক ধাক্কায় সিঙ্গেল ডিজিটের আট-নয় বনে গেছি। হারিয়ে যাবার আজ নেই মানা।
এখানে সাগর থেকে উড়ে আসা নোনা স্বাদের বাতাসটা অদ্ভূত রকমের তাজা। জোরে একটা দম নিয়ে আত্মহারা হয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম সবাই, ‘হিপ্ হিপ্, হুররে...!’ ঘাড় ঘুরিয়ে লোকজন অবাক তাকালো। তোয়াক্কাই করলাম না। বরং শীতের সকালের কুসুম কুসুম রোদ গায়ে মেখে তিড়িং বিড়িং ফড়িং নেচে অপেক্ষায় থাকা মাইক্রোবাস বরাবর রওনা দিলাম। বাচ্চা-কাচ্চারা আগে আগে ছুটছে। উঁচিয়ে ধরা কাগজের পতাকাগুলো মাতাল হয়ে উড়ছে খোলা হাওয়ায়।
২.
মেরিন ড্রাইভ। কক্সবাজার সৈকতের সমান্তরালে বয়ে চলা পথ। ডানে সারি সারি রং বেরঙ্গের সাম্পান অলস দাঁড়িয়ে। ডাক পড়লেই আলস্য ঝেড়ে সাগরে পাল তুলে দেবে। আর বামে পাহাড়। যেন ঘুমিয়ে থাকা সবুজ ড্রাগন। এই বুঝি ফোঁস্ করে জেগে উঠলো। পাহাড়ের আঁচলে কখনো পানের বরজ, কখনো বা ধান ক্ষেতের আলে জাবর কাটায় ব্যস্ত একটা দুটো গরু।
সেই শৈশবে, পাঁচ বছর বয়সে একবার কক্সবাজার এসেছি। তবুও স্মৃতিতে সমুদ্রের গর্জন আর লাল কাঁকড়া ঠিকই রয়ে গেছে। তার সাথে এখন যোগ হল পথের দুই ধারের অপরূপ ছবিগুলো। কাঁচ ঢাকা গাড়ির ভেতরে বসে আমরা যতটুক পারছি হা করে দেখছি। বাচ্চারাও ট্যাঁ-ফো থামিয়ে দিয়েছে। তাদের চোখে-মুখে অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের বিস্ময়।
ছাপড়া দোকানে ঝুলিয়ে রাখা কচি ডাব দেখে তেষ্টা পেয়ে গেল। যাত্রা বিরতি নেয়া দরকার। ড্রাইভার মোতালেব বিশাল মাইক্রোবাসটা কসরত করে এক পাশে থামালো। জনপ্রতি একটা করে ডাব নিয়ে নড়বড়ে চেয়ারে আর বেঞ্চিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছি সবাই আয়েশী ভঙ্গিতে। পানি খেয়ে শেষ করার পরে ডাব ফাটিয়ে দেয়া হল। সাথে ডাবের এক কোনা ভেঙ্গে চামচ বানিয়ে দেয়া হয়েছে। শ্বাস খাবার জন্যে। ডাব-নারকেলের বিশেষ একটা ভক্ত নই। কিন্তু ভাইয়া আর ঝুমু আপু দুইজন দুদিক থেকে চাপাচাপি জুড়েছে। বিপদ বুঝে এক কাপ চা হাতে নিরাপদ দূরত্বে পিছলে গেলাম। কিন্তু ছাড়া পেল না তাফসু মিয়া। তার দুই পাশ থেকে রেন আর রন জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এরা ভাইয়া-আপুর যোগ্য উত্তরসূরী। কারন, সাড়ে চার বছরের তাফসু মিয়ার হাতে তার মাথার সাইজের একটা ডাব দেখা যাচ্ছে। তাকে এক টুকরো শ্বাস মুখে তুলে দেয়া হচ্ছে। বেচারা পিয়ার প্রেশারে পড়ে ক্যোৎ করে জিনিসটা গিলে ফেলে ঠোঁটের কোনে বোকাটে হাসি ঝুলিয়ে সহজ হবার চেষ্টা করছে।
কোত্থেকে লম্বা কানের কালো একটা ছাগল জুটে গেছে। ছুড়ে দেয়া ডাব থেকে চেটেপুটে শ্বাস খেয়ে তৃপ্তির একটা ব্যা ব্যা ঢেকুর তুলে সে গা এলিয়ে বসেই পড়লো পায়ের কাছে। তাকে হতাশ করে চায়ের কাপে শেষ চুমুক মেরে উঠে দাঁড়ালাম। বেনী দুলিয়ে রেন এসে ঘাড়ে উপর এসে তাড়া দিতে লাগলো, ‘রিম, তাড়াতাড়ি। চলো, গাড়িতে উঠি।‘ রেনের চেহারা হুবহু আমার মত। একেবারে যমজ বলে ভুল হবার মত অবিকল, যদিও আমি তার ফুপু এবং বয়সে তিন গুন। কিন্তু ওসব ফুপু-টুপুর ধার আমরা দু’জনের কেউই ধারি না। সুতরাং, ডাকাডাকিগুলো ডাকনামেই চলে। একই স্বাধীনতা সাত বছরের বেজায় দুষ্টু ছেলে রন-কেও দেয়া আছে। সেও খানিক দূর থেকে নাম ধরে চেঁচিয়ে চলছে, ‘এ্যাই রিইইইম...’।
৩.
নাফ নদীর ঘাটে আগে থেকে ঠিক করা স্পীডবোট দাঁড়িয়ে আছে। যাত্রার আয়োজনে কোথাও কোনো ত্রুটি নেই। মনে মনে তারিফ করতেই হল। লাইফ জ্যাকেটগুলো চাপানোর পর তীব্র কটকটে কমলা রঙে চারপাশে রীতিমত আগুন লেগে গেল। আমাদের স্পীডবোট পঙ্খিরাজের বেগে ছুটে চলল ঘোলাটে নদীর ঢেউ চিরে।
হঠাৎ আবিষ্কার করলাম সাগরে এসে পড়েছি। জলের রং বদলে গেছে। এই রঙ না নীল, না সবুজ। বরং একটা পাথরের সাথে খুব মিল। ঝকঝকে ফিরোজা আকাশটা দেখে চট করে মনে পড়ে গেল। এই সাগরের পানি আসলে পান্না রঙের। রোদের ছোঁয়ায় ঢেউয়ের চূড়াগুলো পান্নার মত ঝিকমিক করছে। মাথা ওপর ফিরোজা আকাশ, পায়ের নিচে পান্না সাগর আর সারা গায়ে কাঁচা সোনা রোদ- মনি মানিক্যের বেশুমার ছড়াছড়ির ভেতর আমরা, গৎবাধা শহুরে মানুষগুলো মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বসে আছি।
খানিক বাদে চোট্ট একটা দ্বীপ ভেসে উঠল সাগর ফুড়ে। স্পীডবোটটা গতি কমিয়ে শূন্যে নিয়ে আসলো। নৌকা আর চলবে না। স্বচ্ছ জলের নিচে কোরালের উঁকিঝুঁকি দেখে বুঝে নিলাম। হাঁটুপানিতে নেমে পড়তে হবে জিন্স গুটিয়ে। বাচ্চাগুলোকে কোলে করে পাড় করে দেয়া হল। টালুমালু খেতে খেতে জল ডিঙ্গিয়ে পাড়ে এসে নরম বালুতে পা ডুবিয়ে দাঁড়ালাম। সারি সারি নারিকেল গাছের পাতাগুলো মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানিয়ে আবার বাতাসে এঁকেবেঁকে নির্বিকার বইতে লাগলো।
পাড়ে দাঁড়ানো জনাকয়েক লোক এসে একে একে ভাইয়াকে জাপটে ধরছে। সেও সহাস্যে প্রশেনের পর প্রশ্ন ছুড়ছে। ‘আরে চাচা, কেমন আছেন? কি খবর সুমন, ইয়াসীর কই?’ এখানে ভাইয়া ছানাপোনা নিয়ে আগেও এসেছিল। নাম মনে রাখার অদ্ভূত ক্ষমতা আর উষ্ণ স্বভাবের কারনে সে যেখানে যায়, লোকজন তাকে নিজেদের একজন বানিয়ে নেয়। এখানেও তাই।
দূর থেকে দেড়ফুটি আরেকজন দূর্বার গতিতে ছুটে আসছে। তার গায়ে গোলাপি শার্ট। পরনে ঢলঢলে হাফ প্যান্ট, যেটা যেকোন দুর্বল মুহূর্তে খুলে পড়তে পারে। তীরের কাছে এসেই সে আমাদের রন-কে পেয়ে ঈদের কোলাকুলি করে নিল প্রায়। রনও আনন্দে গলা ফাটিয়ে হুঙ্কার ছাড়ল, ‘ইয়াসীইইইর...!’ এই তাহলে ইয়াসীর। আগেরবারে বেড়াতে এসে তার সাথে দারুন বন্ধুত্ব বনে গিয়েছিল রনের। ইয়াসীরকে ঘিরে বাচ্চারা হইহই করছে খুশিতে। সেও স্থানীয় কক্সবাজারীয় আর সেন্ট মার্টিনীয় উচ্চারনের মিশেলে হিং পিং করে কি কি যেন বলছে। ভাল করে শুনেও কিছু বুঝতে পারলাম না। হাল ছেড়ে বাকিদের সাথে পা মিলিয়ে কোরাল দ্বীপের মিহি বালু মাড়িয়ে এগোতে থাকলাম। (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জানুয়ারি, ২০২০ ভোর ৪:২৮