পর্ব ১, ২
৩.
মনের ভেতর এক ইবনে বতুতা বগলে জুতা নিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। সুযোগ পেলেই সে জুতা ফটফটিয়ে বেরিয়ে আসে। তাই হাতের মুঠোয় গুগল ম্যাপ নামের মানচিত্রের বাপ থাকতেও লোকজনকে ঠিকানা জিজ্ঞেস করে করে হেলেদুলে হাঁটছি। আর সকালের মিষ্টি রোদ, ভেসে থাকা নৌকার ভিড়, নতুন শহরের পথঘাট, দালানকোঠার নকশা, অপরিচিতের ক্ষনিক সঙ্গ-সব কিছুই তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছি। বিশ মিনিটের হাঁটা পথ আধা ঘন্টা লাগিয়ে পৌঁছালাম জায়গামত।
অতিকায় সান ডিয়াগো কনভেনশন সেন্টার কিছুতেই চোখ এড়াতে পারে না। আর কয়েক সপ্তাহ পরেই এখানে শুরু হবে কমিক কনভেনশন। কমি-কন নামেই বেশি পরিচিত আসরটা। হলিউডি ব্যাটম্যান, স্পাইডারম্যান আর আয়রনম্যানে ছেয়ে যাবে শহরটা। রবার্ট ডাউনি জুনিয়র আসছে শুনলাম। ইশ্, আফসোস! ভাবছিলাম আর খুঁজছিলাম ল্যাবের লোকজনকে।
সবার দেখা মিলল অবশেষে। সুপারভাইজার চোখ নাচিয়ে খুব সাগ্রহে জানতে চাইল, ‘কি, কেমন ধরাটা খেলে এয়ারপোর্টে? আটলান্টায় ধরে নি তোমাকে?’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললাম, ‘কিসের ধরা খাওয়া, আমাকে তো আরো ইঁদুরের ডাক্তার ভেবে ঝামেলা ছাড়াই আস্তে করে ছেড়ে দিল। কিন্তু, তুমি কোথাও আটকেছো মনে হচ্ছে?‘ উত্তরে তার চোয়াল ঝুলে গেল। জানালো, বেচারার তুর্কি চেহারা আর জার্মান পাসপোর্ট ইত্যাদি দেখে তাকে দলছুট করিয়ে আলাদা করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে নিয়ে গিয়েছিল। হাজার প্রশ্নের জবাব নিয়ে তারপর নাকি ছেড়েছে। ফ্লাইট মিস নাকি একদম কানের পাশ দিয়ে গিয়েছে।
টম আর গেরিট হাতের ইশারায় কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে। সুপারভাইজারকে পাশ কাটিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমাদের ল্যাবের দুই পোস্টডক। গেরিট চোস্ত জার্মান, ধারালো চেহারা। জার্মান স্বভাব মোতাবেক সারাক্ষন খঁচে থাকে। টম আইরিশম্যান, গোলগাল ভালোমানুষ। তবে ব্রিটিশ বললে ক্ষেপে যায়। তাই তাকে আমরা নিষ্ঠার সাথে ব্রিটিশ ব্রিটিশ বলে ক্ষ্যাপাই। কাছে এগোতেই খবর দিল, সেভেন-সিটার একটা পাওয়া গেছে। অমুক দিন সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়া যাবে। সময় মত যেন পার্কিংয়ে অপেক্ষা করি। এই বুদ্ধি আগেই আঁটা। শেষের একটা দিন খালি ক্লিনিকাল আলোচনা। আমাদের মত মৌলিক গবেষনার লোকের জন্যে তেমন একটা জরুরী না। সেদিন আমরা ফাঁকি দিবো। সারাদিনের জন্যে গাড়ি ভাড়া নেয়া হয়েছে। আরেক ল্যাবের দুই একজনকে জুটিয়ে সদলবলে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ব। আমাদের সুপারভাইজার যাবে না। সে যাবে মেক্সিকোর সীমান্তের দিকে। সেখানে দারুন সব বিখ্যাত ব্রান্ডের জিনিস প্রায় অর্ধেক দামে কিনতে যাওয়া যায়। নিজে সৌখিন লোক। তার উপর বউ বিশাল ফর্দ ধরিয়ে দিয়েছে। সে ফর্দ মিলিয়ে ডিজাইনার’স ব্যাগ, ঘড়ি ইত্যাদি কিনবে। শুনে একরকম খুশিই হলাম। নেতা গোছের কেউ থাকলে স্বাধীনতা খর্ব হয়।
এলোমেলো ঘুর-ঘুরান্তির দিনটা আর আসে না। এদিকে সকাল-সন্ধ্যা জ্ঞানের ঘ্যানঘ্যান আর কাঁহাতক সহ্য হয়! নিজের পোস্টার প্রেজেন্টেশন না হয় এরকম উৎরে গেল। বাকিরাও ভাল করল। তবু সুপারভাইজার লোকটা গাঁয়ের পাঠশালার পন্ডিতের মত পিছে লেগে থাকে। অমুক নামকরা বিজ্ঞানীর আলোচনায় আমরা যেন বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন করে তাক লাগিয়ে দেই। নইলে ‘কিন্তু কপ্ করে খেয়ে ফেলবো’ জাতীয় হুমকি চলে। তাই কিছুটা প্রানভয়ে কোন সেশনে বোকাটে বোকাটে সব প্রশ্ন ছুড়লাম। কোনটায় সত্যিকারের আগ্রহ নিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে গেলাম। কাউকে কাউকে তো স্টেজ থেকে কফির টেবিল পর্যন্ত ধাওয়া করলাম। আবার কোনটায় একদম সামনের সারিতে বসে আধ খোলা মুখে হাঁ করে ঘুমিয়ে গেলাম।
সারাবেলা কনফারেন্সের পর রাতে আশেপাশের রেস্তোরায় হানা দিয়ে পেটচুক্তি খেয়ে সময় কেটে যাচ্ছিল এক রকম। এক আধ দিন মাহদি এসে আবার সেই লেবানিজ রেস্তোরায় নিয়ে গিয়েছিল। নাম যার সুলতান। একদিন সেখানে চোখে পড়ল, এক ধারের দেয়ালে প্রায় সব দেশের খুচরো টাকার নোট ফ্রেম বন্দী হয়ে ঝুলছে। বাংলাদেশের দুই টাকার নোটও আছে দেখলাম। দোয়েল পাখিটা পরিচিত ভঙ্গিতে উঁকি দিচ্ছে। তার একটু বাদেই এক দল দেশী ভাই জাতীয় পোশাক চেক লুঙ্গি বিপজ্জনকভাবে হাঁটু অবধি তুলে গটগট করে ঢুকলো। নোয়াখালীর ভাষায় চলা আড্ডা দেখে বোঝা গেল তারা নিয়মিত কাস্টমার। ‘এটাই আমেরিকার মজা, বুঝলা?’, চওড়া হাসিতে মাহদি দুই মহাদেশের উদারতার ফারাক ইঙ্গিত করল। বাকিটা সময় মনে হল, লেবাননি রেস্তোরা সুলতানে না, বরং বসে আছি ‘ইয়ান তুন খাই যান’ নামের নোয়াখাইল্যা কোন ভাতের হোটেলে। (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০১৯ রাত ১২:৩৪