পর্ব ২
৩.
সারাটা রাত খকর খকর কেশে মহল্লার সব ইটালিয়ান চোরদের ভাত মেরে ভোরের দিকে চোখ বুজে আসল। কিন্তু সে সুখ বেশিক্ষন সইলো না। বাকিরা উঠে পড়েছে। আমি একা মটকা মেরে অলস পড়ে থাকলে কেমন দেখায়। অগত্যা অনিচ্ছার আড়মোড়া ভাঙতে হল। মৌরি আপুও সকালের প্রথম চায়ের জোগাড়ে ব্যস্ত। স্বাস্থ্যসচেতন হাদী ভাই ছয়টায় বেড়িয়ে গেছেন দৌড়াতে। ঘরের ভেতরটা সোনারঙ্গা রোদে সয়লাব। ঘুম ঘুম রেশটা কেটে গেল। রোদের এমনই ক্ষমতা। আজকের বেড়ানো ঝরনাকেন্দ্রিক। খুব চমৎকার একটা ঝরনা আছে কাছেপিঠে, সেখানে যাওয়া হবে খানিকবাদে। মনটা চনমনিয়ে উঠল। কাঁধে ঝোলা নিয়ে বেরোবার জন্যে তর সইছে না।
একে একে সবাই তৈরি হয়ে নিলাম। ঘাপলাটা বাঁধিয়ে দিল দলের সবচেয়ে ধবধবে সদস্য রুমি। সে মিনিট চল্লিশেক লাগিয়ে গোসল করছে তো করছেই। ইশ্রাফিলের শিঙ্গা ফোঁকার আগ পর্যন্ত মনে হয় চলবে এই প্রাতঃস্নানের ঘটা। মৌরি আপু তো আর না পেরে দরজায় দড়াম দড়াম কিল মেরে আসলো। অভিযোগের সুরে জানালাম, এই গোসলের নাম বিউটি গোসল। হাদী ভাই যেমন স্বাস্থ্যসচেতন তার ছোট ভাই তেমন রূপসচেতন। ঘরে তো প্রতিদিন এই অত্যাচার চলে। এখানে এসেও সে ধারাবাহিকতার হের ফের হয় নি। শুনে আপু কি বলল ঠিক বোঝা গেল না। শুধু দাঁত কিড়মিড়টা স্পষ্ট শোনা গেল। যাহোক, সবার চুলে পাক ধরে যাবার ঠিক আগ মুহূর্তে বিস্ময়কর বিউটি গোসলের জনক শ্রীযুক্ত জনাব রুমি তার গোলাপি কানের লতি নিয়ে লাজুক হাসি হেসে বেরিয়ে এল। গোলাপি লতি আমাদের মুগ্ধ করতে পারলো না। তাকে আমরা প্রায় চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে গজগজ করতে করতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম।
রিভা শহর থেকে বাসে করে মিনিট বিশেকের পথ। গন্তব্যের পুরো নাম পার্কো গ্রোত্তা কাস্কাটা ভারোনে। বলতে গিয়ে জিভ পেঁচিয়ে আসছে। তার চেয়ে ব্যবচ্ছেদ করে বলি। জায়গাটা আকর্ষন দুইটা। এক, কাস্কাটা ডেল ভারোনে। মানে কাস্কাটার ঝরনাধারা। আরেকটা হল পার্কো গ্রোত্তা বা গুহা বাগান। বাগান অবশ্যই গুহার ভেতরে নয়। বরং গুহার আশপাশ দিয়ে উঠে-নেমে গিয়েছে নাকি। খুব সহজ বাসযাত্রা আমরা কৃতিত্বের সাথে গুবলেট করে ফেললাম। ভুল বাসে চড়ার মাশুল হিসেবে এক স্টেশনে বসে ঠিক বাসের জন্যে অপেক্ষায় কেটে গেল ঘন্টাখানেক। ভোগান্তি পর্ব দুই পর্যন্ত গড়াতো যদি না হাদী ভাই তার স্বল্প ইটালিয় বিদ্যার জোরে আধবোজা চোখে ঝিমোতে থাকা বাস চালকদের মারফত বাসের নাম্বারটা জেনে না আস তো। অল্প বিদ্যা এখানে ভয়ংকর হয় নি। বরং তাক লেগে গেল এটা দেখে যে, একটা ভাষার শুধু সংখ্যা জ্ঞান থাকলেই ছোটখাট বিপদ-আপদ এড়ানো যায় কত সহজেই।
অবশেষে পৌঁছালাম। টিকেটের সাথে সাথে স্যুভিনির শপ-কাম-ক্যাফে থেকে দুপুরের খাবার হিসেবে কয়েক টুকরা পিজা কিনে নিলাম। সুকান্তের কাছে ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় লাগলেও আমাদের কাছে খালি পেটে কাস্কাটা ডেল ভারোনের অনিন্দ্যসুন্দর ঝরনাধারা আবার ফুটো হয়ে যাওয়া ওয়াসার পাইপের পানির তোড়ের মত লাগতে পারে। তাই পেটপূজার এই আগাম ব্যবস্থা। পা বাড়িয়েছি আর চোখে পড়ল, দোকানের সামনে বর্ষাতি সাজিয়ে রাখা। ঝরনার কাছে গেলে পানির ঝাপটায় ভেজার হাত থেকে বাঁচার জন্যে। এই জিনিস পাই পাই গুনে পয়সা খরচ করা জার্মানরা কেউ কিনবে না। জার্মান মুলুকে থেকে আর তাদের স্বভাবের বাতাস গায়ে লেগে হাতখরুচে বাঙ্গাল আমরাও কিপ্টে হয়ে গেছি। তাই বর্ষাতিগুলোকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সামনে এগোতে বাঁধলো না।
ঝরনার পথটা বাগানের ভেতর দিয়ে চলে গেছে। বোটানিকাল গার্ডেন একটা। সব গাছের নাম-ধাম, গোত্র-বংশ গাছের গায়ে সাঁটা রয়েছে। বাগানটা একই সাথে একটা zen gaden ও বটে। জেন গার্ডেন আসলে প্রকৃতির আদল ধরতে চেয়ে বাগান করার একটা জাপানি বুদ্ধি বলা যেতে পারে। zen বা জেন কথাটা নাকি চাইনিজ শব্দ থেকে এসেছে। আর সেই চাইনিজ শব্দ আবার এসেছে সংস্কৃত ‘ধ্যান’ থেকে। খেয়াল করে দেখলাম কথা সত্য। কেমন শান্তি শান্তি ভাব ছড়িয়ে আছে চারিপাশটায়। দুই পাশে সুশৃংখলভাবে সাজিয়ে রাখা পাথরগুলো পাহাড়-পর্বতের প্রতীক। মাঝের নুড়ি পাথরের পথটুকু যেন বয়ে চলা খরস্রোতা নদী। আর সারি সারি গাছগাছালি যেন প্রকৃতির রক্ষাকবচ হয়ে অতন্দ্রপ্রহরীর মত সটান দাঁড়ানো জওয়ানের দল। জেন বাগানের এই প্রতীকী রহস্যের কথা আমার নিরেট মাথায় খেলার কথার না। তথ্যগুলো পথ চলতে চলতে মারাত্মক বই পড়ুয়া হাদী ভাই পেশাদার ট্যুরিস্ট গাইডের মত করে বলছিলেন দেখে জানলাম। নইলে আলাদা করে এর সৌন্দর্য সাদা চোখে ধরা পড়ত না। কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝলাম না। বাগানের ধ্যানমগ্ন আবেশ ভেঙ্গে গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা স্পিকার থেকে এলভিস প্রিসলির গান ভেসে আসছে। এমন গুরুগম্ভীর পরিবেশে টুংটাং পুংপাং জেন সংগীত মানে ধ্যান সংগীত আশা করছিলাম। তবে, এলভিসের হার্টব্রেক হোটেল লাগছে মন্দ না। পুংপাংয়ের চেয়ে উত্তম।
প্রচন্ড ঝমঝম ঝংকারে বুঝলাম ঝরনার কাছে চলে এসেছি। এই ঝরনা এসেছে গার্দা হ্রদ থেকে নয়, বরং আরেকটা হ্রদ, নাম যার, লাগো ডি টেনো বা Lake of Tenno-সেখান থেকে। পানির ঝাপটা উপেক্ষা করে সবাই যতদূর কাছে যাওয়া যায় গেল। শুধু আমি দূর থেকে ঝরনা দেখলাম। সৌন্দর্য কাছ থেকে দেখার চেয়ে সামান্য তফাতে থেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতেই ভাল লাগে কারো কারো। খুব কায়দা করে নিচ থেকে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। উজ্জ্বল নীল আলোয় নেমে আসা ঝরনাটাকে বুনো ময়ূরের ময়ূরকন্ঠী নীল পেখম বলে ভুল হচ্ছে। তার চেয়েও চমৎকার লাগলো, শত বর্ষের অবিরাম ধারা কিভাবে পাষানের নিশ্ছিদ্র হৃদয় গলে আপন সুরঙ্গ খুড়ে বয়ে গেছে। সাধনা থাকলে অসাধ্যও মুঠোয় এসে ধরা দেয় একদিন। রবার্ট ব্রুসের মাকড়শার কথা মনে পড়ে গেল। সাত বারের বার সে বেচারা কার্নিশের এক ঝুল থেকে আরেক ঝুলে যেতে পেরেছিল। ঠিক করলাম, ভারোনের এই ঝরনা কিংবা ব্রুস সাহেবের মাকড়শা-জীবনে এ দু’টোর একটা হতে হবে। হতাশাগুলো এক ফুঁ দিয়ে না পারি, সাত ফুঁয়ে ধূলোর মত উড়িয়ে দিতে হবে। তাতেও কাজ না হলে আজীবন হতাশার গায়ে শকুনে ঠোকর মেরে যাব। টেনো লেকের ঝরনার মতন।
পায়ে পায়ে ফিরে আসলাম ফিরতি পথে। বাসে ওঠার আগে ঢুকে পড়লাম ছিমছাম একটা ক্যাফেতে। ভেতরটা তত ছিমছাম লাগলো না। দরজায় প্রমান সাইজ মদের পিপে আমাদের অভ্যর্থনা জানালো। দেয়ালের ঢাল-তলোয়ার তাদের শান শওকতের ঝিলিকে চোখ ধাঁধিয়ে দিল। এই জলদস্যুর জাহাজের খোলের ভেতর কফি খাব কি করে ভাবছি। হাতের কব্জিতে ভয়ংকর উল্কি আঁকা অথচ ভীষন বিনয়ী সুদর্শন ওয়েটার জানতে চাইলো কি খাব। ইতস্তত করে কেউ হট চকলেট, কেউ কেক-কফির জন্যে বলে এসে বসেছি ফায়ারপ্লেসের আড়াআড়ি রাখা মখমলের গদি আটা পুরু সোফাটায়। অভিজাত ইটালিয়ান বিলাস আর কাকে বলে। এমন মজার জায়গা পেয়ে সাথের শিশুরা মেঝেতে গড়াগড়ি শুরু করেছে। গড়াগড়ির চোটে কাঠের তকতকে মেঝে আরো আয়নার মত মসৃন হয়ে উঠছে। তাদের বাধা না দিয়ে প্রায় গলে পড়া চকলেট কেকের টুকরোয় লোলুপ চামচ বসালাম। (চলবে)
ছবি কৃতজ্ঞতায়ঃ হাদি ভাই
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই এপ্রিল, ২০১৯ বিকাল ৩:৩১