গ্রহের চারপাশে হন্যে হয়ে ঘোরা উপগ্রহের মত সেই তখন থেকে রাজবাড়ির মত দেখতে এই হাসপাতালের চারিদিকে অর্থহীন ঘুরপাক খাচ্ছি। কিন্তু চাইলেও চলে যেতে পারছি না। পা বাড়াতেই গেলেই কিসের এক অদৃশ্য সুতার টানে বারবার ফিরে আসছি। ফিরে এসে আবার বসেছি বিশাল করিডোরে রাখা বেঞ্চটায়। না, ঠিক বসে নেই; বেঞ্চে শুয়ে আছি। হাতের ওপর মাথা রাখা। রাত বাজে সাড়ে এগারোটা। দেয়ালে টাঙ্গানো বিশাল ঘড়িটার সেকেন্ডের কাটার টিক টিক বড্ড কানে বাজছে। ধূ ধূ ফাঁকা করিডোর আর খোলা জানালার বাইরে নক্ষত্রের রাত। শার্টে এখনও লতার রক্ত। আজকে রাতে ঘুম নেই। রাশিয়ান ফ্ল্যাটমেট ভ্লাদিমিরকে ফোনে জানিয়ে দিয়েছি আজকে ফিরছি না। অবাক হয়েছে ছেলেটা, কিন্তু কিছু আর জানতে চায় নি গায়ে পড়ে।
লতার বিপদ একরকম কেটে গেছে, খুব সংক্ষেপে খবরটা বিকালেই বলা হয়েছে। তবু আইসিইউতে পড়ে থাকা মেয়েটার এই হালের জন্যে কিছুইতেই নিজেকে ক্ষমা করা যাচ্ছে না। পুরো ঘটনাটার জন্যে নিজেকে দায়ী মনে হচ্ছে। লতা নামের এই মেয়ের সাথে আজকে আমার দেখা না হলে কি আসতো যেত? যে যার কাজ সেরে নির্ঝঞ্ঝাট বাড়ি চলে গেলে তো এমনটা হত না। কফি খেতে গিয়ে এত দেরিই বা করলাম কেন? লতাকে আগে ছেড়ে দিলে তো কুকুরটার দৌড়ে এসে ধাক্কা দেয়া থেকে বেঁচে যেত। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এসবই ভাবছি খালি।
ডক্টর ক্লাউডিয়া এগিয়ে আসতে দেখে এক ঝটাকায় সোজা হয়ে বসলাম। বসা থেকে তড়াক করে উঠে দাঁড়ালাম। “অনিক, ঘুমাচ্ছ নাকি? ভাল খবর আছে। মাথার চোটটা অল্পের উপর দিয়ে গেছে বলতে হবে। আমরা তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। গোটা দশেক সেলাই দিতে হয়েছে অবশ্য। তবে পা সারতে বেশি সময় লাগবে, ভাঙ্গা পায়ে আবার আঘাত, বোঝই তো।“ বলেই ডক্টর ক্লাউডিয়া খুব উৎসুক চোখে তাকালো প্রতিক্রিয়া বোঝার আশায়। “ওহ, আচ্ছা”। মুখচোরা আমি এছাড়া আর কিছুই বলতে পারলাম না সেই মুহূর্তে। শুধু মনে হল যেন বুক থেকে পাথর সরে গেছে। আবার যেন ঠিকঠাক মত শ্বাস নিতে পারছি। খানিকটা ইতস্তত করে ক্লাউডিয়া হতাশ হয়ে ফিরে গেল।
এই এক বেলায় ফ্রাউয়েন ক্লিনিক মাইষ্ট্রাসে নামের এই হাসপাতালের অর্ধেক ডাক্তার-নার্সদের নাম মুখস্থ হয়ে গেছে। সবাই নিজে যেচে এসে খুব কৌতুহল নিয়ে কথা বলেছে আমার সাথে। আমি কে, কি, কোথা থেকে, কেমন করে ইত্যাদি। কারন, লতা কাকতালীয়ভাবে এই হাসপাতালের রেসিডেন্ট ডাক্তার। এর আগে তারা লতার কোন বন্ধু-বান্ধবের হদিস পায় নি। তাই আজকের এই দুর্ঘটনার পর সবে ধন নিলমনি আমাকে দেখে কৌতুহল আর ধরছে না এদের। ‘রেসিডেন্ট’ নামকরনের সার্থকতা প্রকাশের জন্যে লতা নাকি দিন কি রাত এই হাসপাতালেই পড়ে থাকত। বাড়ি টাড়ি যাবার বিশেষ তাড়া তার কখনই ছিলো না। তাই বন্ধু-বান্ধব হবে কোথা দিয়ে? অন্তত কার্ডিয়াক ওয়ার্ডের নার্স ফ্রাউ আনার অভিযোগ শুনে তো তাই মনে হল।
কিন্তু এখন যে নার্স হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে আসছে, তাকে ঠিক চিনলাম না। খুব উত্তেজিত ভঙ্গীতে সে আমার দুই হাত পেতে কি যেন একটা গছিয়ে দিয়ে বলে উঠল, “গ্রাতুল্যিয়েরে হের আখ্মেদ। অভিনন্দন, আহমেদ সাহেব। একদম বাপকা বেটা হয়েছে, যেমন রাজা, তেমন রাজপুত্তুর। খালি গালের টোলটা ছাড়া।“ কিছু বুঝে ওঠার আগেই মহিলা উধাও। গছিয়ে দেয়া বস্তুটা আরেকটু হলে হাত গলে পড়েই যেত। ভাল করে তাকিয়ে দেখি, ইয়া মাবুদ! এই গ্যাদা বাচ্চা আমার হাতে ধরিয়ে দেবার মানে কি? নিশ্চয়ই কোথাও একটা ভুল হয়েছে। মরিয়া হয়ে চারপাশে কাউকে খুঁজলাম। কারো টিঁকিও দেখলাম না। তার বদলে চোখ পড়ল কোণার দেয়ালে টাঙ্গানো ছোট্ট ব্ল্যাকবোর্ডটায়। লেখা “মোহাম্মদ এলফিকি/আহমেদ পরিবার, জন্মঃ রাত এগারোটা চল্লিশ”। তার মানে ভুল আখ্মেদকে ভুল মোহাম্মদ ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। তাছাড়া কাছে পিঠের কোন সময় কোন কর্ম বা অপকর্ম মনে পড়ছে না যার জন্যে মাঝ রাতে এভাবে কর্মফল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কি ভালো যন্ত্রণায় পড়া গেল। আমি এখন কই যাই, কাকে ডাকি? জিন্দেগীতে কোনদিন বাচ্চা কাচ্চা কোলে নেই নি। তার উপরে প্রচুর হাত ঘামছে। বাচ্চারা বোধহয় নার্ভাসনেস বুঝতে পারে। হাতের ভেতর মোহাম্মদ সাহেব গলা কাঁকিয়ে চিৎকার দেয়া শুরু করল। আমি তার কম্পমান আলা-জিহ্ববা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। ভয় হচ্ছে এখনি হাত গলে পড়ে যবে আর মাথা টাথা ফেটে বিতিকিচ্ছিরি একটা কান্ড ঘটবে। তাহলে নবজাতক গুম আর নির্যাতনের দায়ে আগামী দশ বছর জার্মান জেলে বসে আলু সেদ্ধ আর ঘ্যাট জাতীয় স্যুপ খেয়ে কাটাতে হবে। আর লতা ততদিনে একটা মাঝবয়সী খিটখিটে, ক্ষ্যাপা পাগল ডাক্তার হয়ে এই হাসপাতালের অলিগলিতে দিনরাত ঘুরতে থাকবে।
খোদার কি দয়া। করিডোরের নীরবতা ভেঙ্গে চারিদিক আলো করে যে ব্যক্তিটা উদয় হল, তাকে দেখে অন্য সময় আরেকদিকে হাঁটা দিতাম। কিন্তু এখন এই দুহাত জোড়া জাপানী হরফ, গোলাপ ফুল থেকে শুরু করে মেরিলিন মনরোর উল্কি আঁকা, দুই কানে আধ ডজন দুল ঝোলানো লোকটাকে দেখে আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম। কারণ, এই ভীম পালোয়ান গোছের লোকের চেহারাই ছোটে মোহাম্মদের মুখে কেটে বসানো। কোনমতে কোল থেকে আলা-জিহ্ববা সমেত চিজটা নামিয়ে ভীম বাবার হাতে ধরিয়ে চাবি দেয়া কলের পুতুলের মত আউড়ে গেলাম, “গ্রাতুল্যিয়েরে হের আখ্মেদ। আমি গাইনীর ব্রাদার অনিক।“ তারপর চোঁ করে ছুটলাম সিড়ির দিকে। মানির মান আল্লাহ রাখে। বড় বাঁচা বেঁচে গেছি। উফফ্!
সিড়ি ভেঙ্গে হুড়মুড় করে নামতেই আবার ডক্টর ক্লাউডিয়ার সাথে দেখা হয়ে গেল। আমাকে দেখে মুখ উজ্জ্বল করে বলল, “অনিক, লতাকে কেবিনে পাঠিয়ে দিয়েছি আমরা। কড়া ডোজে ঘুমাচ্ছে বেচারা। তুমি কি একবার দেখতে চাও? কিন্তু দূর থেকে দেখতে হবে, ভেতরে যাওয়া বারণ। ভিজিটিং আওয়ার তো সন্ধ্যায়ই শেষ, তাই।“ লতাকে আজকেই দেখতে পাবো, ভাবি নি। ভুল শুনছি কিনা ভাবলাম। একটা হৃতস্পন্দন বোধহয় ঠিকমত পড়তে পারল না। তারপর কোন উত্তর না দিয়ে অন্ধের মত ডক্টর ক্লাউডিয়ার পিছু পিছু পৌঁছে গেলাম লতার কেবিনে।
দেখতে না আসলেই হয়ত ভালো হত। কেবিনের সাদা বিছানায় লতার শুয়ে থাকার দৃশ্যটা নিতে পারলাম না। মাথায় অনেকগুলো সেলাই পড়েছে। ওরা সেলাই দেবার জন্যে বাম পাশের চুল কামিয়ে দিয়েছে। আর আরেক পাশে ঠিকই সোনালি চুলের ঘন মেঘ। ব্যাণ্ডেজ মোড়ানো ভাঙ্গা পা উঁচু করে ঝোলানো। ছেলে হিসেবে আমি শক্ত স্নায়ুর নই। ঘাবড়ে গেলে হাত ঘামে, রক্ত দেখলে মাথা ঝিমঝিম করে ইত্যাদি ইত্যাদি। ঘুমন্ত লতাকে দেখে বুকের ভেতরটা মুচড়ে মুচড়ে আসতে লাগল। আজকে বৃষ্টির ভেতর রাস্তার ওপর লতাকে নিয়ে এ্যাম্বুলেন্সের জন্যে অপেক্ষা করার সময়েও এত কষ্ট লাগে নি। একটা দীর্ঘশ্বাস অজান্তেই বেরিয়ে গেল পাজরের কোন ভেতর থেকে। ডক্টর ক্লাউডিয়াকে কোন কিছু না বলে ফাঁকা করিডোর ধরে আনমনা হাঁটতে শুরু করলাম।
বাসায় ফিরে যাবো ভাবছি। কাল সকাল সকাল চলে আসবো। এক তোড়া ফুল পেলে কি লতার ভালো লাগবে? মেয়েটার মন ভাল করা দরকার। অচেনা একটা রিংটোনের শব্দে ভাবনার সুতো কেটে গেল। পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখি লতার ফোন। রয়ে গিয়েছে আমার কাছে। স্ক্রিনে রাত বাজে প্রায় সাড়ে বারোটা। কেন যেন ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলল, খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে ওপাশে। অস্বস্তি লাগছে। ফোনটা কি ধরব?
(চলবে), ১৩.১১.১৮
--ডঃ রিম সাবরিনা জাহান সরকারঃ মিউনিখ, জার্মানি
আগের পর্ব এখানে