আগের পর্ব (-১, ২)
পর্ব-৩
ক্রাচের পতন অনুসরন করে ক্রাচের মালিকও হেলে পড়ে যাচ্ছে আলোর গতিতে। হাতের লাঠি ছাড়া একেবারে অসহায়। পুরো ছবিটা আমি যেন স্লো মোশনে ঘটে যেতে দেখছি। যেন কোন কোরিয়ান সিনেমার রূপক দৃশ্য। ক্রাচ মাটিতে পড়ে শূন্যে ডিগবাজি খাচ্ছে। নীল টুপি মেয়েটা তাল হারিয়ে পড়ে যেতে যেতে আকাশে হাত বাড়িয়েছে অদৃশ্য খড়কুটো ধরবে বলে। সব দেখেশুনে আমি কেমন হতবিহ্বল হয়ে গেলাম এক মুহূর্তের জন্যে। কিন্তু মুহূর্তটা শেষ হবার আগেই নিজের অজান্তেই অদ্ভূত ক্ষ্রিপ্ততায় ছ’ফুটি শরীরটা সামনে ছুড়ে একটা ঈগল ছোঁ মেরে ধরে ফেললাম মেয়েটাকে। যেন জন্টি রোডস স্টাইলের দুর্দান্ত ফিল্ডিংয়ে আটকে দিলাম ভয়ংকর এক বাউন্ডারি। স্বস্তির নিঃশ্বাস্টুকু ফেলার সময় পেলাম না। কারণ আমি এবার তাকে সহ একসাথে পড়ে যাচ্ছি। আজকের পপাৎধরণিতল ঠেকাবে কোন ভূতে। কিন্তু ভূতকে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে ফুটপাথ ফুড়ে গজিয়ে উঠলো প্রাচীন এক ল্যাম্পপোস্ট-যেটাকে একটু আগেও এখানে দেখে নি। নিজেকে মনে হল রুপকথার জ্যাক নামের যুবক আর ল্যাম্পপোস্টটা তার সেই গগনবিদারী শিম গাছ। বিস্ময়ে বিমূঢ় আমি পড়ে যেতে যেতে এক হাত বাড়িয়ে মরিয়া হয়ে তা-ই আঁকড়ে ধরে ফেললাম। আরেক হাতে তখনো প্রায় ঝুলন্ত, প্রায় পড়ন্ত অচেনা বিদেশিনী। নাকি সে-ই এদেশে দেশী আর আমিই বরং বিদেশী। এই বিপদের ভেতরও মাথাটা এত আগড়ুম-বাগরুম ভেবে যাচ্ছে দেখে অবাক হলাম। যাহোক, আমি নিজেকে সামলে নিয়ে আতঙ্কে নীল হয়ে যাওয়া মেয়েটাকে ধরে দাঁড় করিয়ে দিলাম বটে, কিন্তু দেখলাম যে, ক্রাচের অভাবে দুই পায়ে ভর দেয়া অসম্ভব। আমি সংকোচ ঝেড়ে বলে বসলাম, “অসুবিধা নেই, আপনি আমার কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়ান।“ জার্মান ভাষাটায় আবার বাংলার মত আপনি, তুমি আছে। সেও কিছুটা ধাতস্থ হয়ে আমাকে ধরে দাঁড়িয়েছে বটে কিন্তু আচমকাই আমার হাতঘড়িটায় তার নীল টুপিটা আটকে গিয়ে বেরিয়ে এল এক রাশ সোনালি চুলের বন্যা। ভীষণ অপ্রস্তুত আমি আলপটকা টুপিটা ছুটিয়ে এনে কোনমতে মেয়েটার হাতে গুঁজে দিয়ে এই প্রথম তার দিকে ভালো করে তাকালাম। সবুজ চোখের সাথে পিঠ ঢেকে নেমে আসা সোনালি চুলের স্রোত মিলিয়ে তাকে মনে হচ্ছে যেন ভূমধ্যসাগর থেকে উঠে আসা এক জলকন্যা। আমি এই অতি সৌন্দর্য্যে কাছে আড়ষ্ট হয়ে দ্রুত চোখ নামিয়ে নিলাম। আরেক দিকে তাকিয়ে বললাম, “আপনি এই ল্যাম্পপোস্টটা ধরে একটু কষ্ট করে দাঁড়ান, আমি চট করে আপনার ক্রাচটা এনে দিচ্ছি।“
আমার কথা শেষ হবার আগেই দেখি এক লোক হন্তদন্ত হয়ে ক্রাচ কুড়িয়ে নিয়ে চলে এসেছে। তার মাথার হলুদ হেলমেট আর গায়ের ফ্লোরোসেন্ট রঙের জ্যাকেট দেখে বুঝলাম যে, ফুটপাথ মেরামতের লোক হবে। ক্রাচটা সে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ক্রাচের মালিকের কোথাও লেগেছে নাকি, সব ঠিক আছে কিনা ইত্যাদি ঝটিকা কুশলাদির একটা ঝটিকা ঝাঁপটা মেরে এক দৌড়ে কোত্থেকে একটা ফোল্ডিং চেয়ার নিয়ে আসলো। চেয়ারের হতচ্ছাড়া চেহারাটা দেখে মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। এতে বসলে হিতে বিপরীতের আশংকাই প্রবল। স্বর্ণকেশী এতক্ষনে নিজেকে পুরোপুরি গুছিয়ে নিয়েছে। আমার হাত থেকে ক্রাচ নিয়ে, চুলের রাশি আবার নীল টুপির শাসনে পুরে বেশ স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃতজ্ঞতার একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে খুব নম্রভাবে লোকটাকে জানিয়ে দিলো সে একদম ঠিক আছে, আর বসে বিশ্রাম নেবার দরকার নেই। লোকটাও ভদ্রতায় মাথা ঝাঁকিয়ে তার ফোল্ডিং সিংহাসনটা বগলদাবা করে বিদায় নিল।
আমিও তার পিছু পিছু সটকে পড়ব কিনা ইতস্তত করছি। এত “পথে হল দেরি” করে কি লাভ। বরং আমার এত সাধের ডাক্তারের টারমিনটা ছুটে যেতে পারে। তখন আরেক বিপদ। সটকে পড়ার জন্যে পা বাড়াতে গিয়েছি আর স্বর্ণকেশী এবার ঝকঝকে একটা হাসি দিয়ে কিশোরীর সারল্য নিয়ে আমার দিকে তাকালো। সেই হাসির সুর কাঁচের চুড়ির রিনিঝিনির মত কানে বেজে কেমন করে যেন আমার পালিয়ে যাওয়া থামিয়ে দিলো। বাধ্য হয়ে ধরা পড়ে যাওয়া চোরের মত দাঁড়িয়ে পড়লাম। “উফ, আপনি যে আজকে কোথা থেকে দেবদূতের মত আসলেন। আমাকে ওভাবে সেকেন্ডের ভেতর খপ করে না ধরে ফেললে আজকে আমার ভাঙ্গা পা’টা আবার ভাঙ্গতো।“ বলেই সে একটা অদৃশ্য দুর্ঘটনার কাল্পনিক দৃশ্য দেখে শিউড়ে উঠল। “আমি কি ধন্যবাদ হিসেবে আপনাকে এক কাপ কফি খাওয়াতে পারি, প্লিজ না বলবেন না?” আমি সলজ্জ হাসিতে ধন্যবাদটা ফিরিয়ে দিয়ে বললাম, “আরে না, না এতো এমন কিছু না। আর মাফ করবেন, আমার একটা টারমিন আছে, আজকে কফি খেতে পারছি না, সাবধানে চলবেন, আমি চলি।“
আসলে আমি পালিয়ে বাঁচতে পারলে বাঁচি, ভীষন অস্বস্তি লাগছে। আর তাড়া তো আছেই। পা বাড়িয়েছি যাবো বলে, অমনি শার্টের হাতায় টান পড়ল। চমকে থেমে গেলাম। এই মেয়ে তো ভয়ানক! “আমারো টারমিন আছে, আমারটাও ডাক্তারেরই। তাহলে কি যে যার কাজ সারার পর কাছের একটা কফি শপে আসতে পারি না। এই তো রাস্তার ওপারেই একটা ক্যাফে আছে। আর আমি...”। এই বলে সে ক্রাচটা হাতবদলের বিরতি নিল। বুঝলাম সে তার নামটা বলতে যাচ্ছে। শূন্য আগ্রহ অনুভব করলাম। জার্মান এই তরুণীর নাম আবার কি হবে। হয় ক্যাথরিন, নয় আনা। আর ছেলে হলে হত স্টেফান কিংবা মুলার। নামকরনের মত একটা মামুলি ব্যাপারে এদেশের মানুষের আগ্রহ বা সময় কোনটাই নেই। এরা ফক্সওয়াগন, বিএমডাব্লিউ বানিয়ে আর ফুটবল খেলেই কুল পায় না, তায় আবার বাচ্চাকাচ্চাদের নতুন নতুন নাম খোঁজা তো একেবারেই বাহুল্য। আমি অধৈর্য্য নিয়ে ক্রাচকন্যার বৈচিত্র্যহীন নামটা শোনার অপেক্ষায় অনিচ্ছায় দাঁড়িয়ে আছি। “আমি লতা।” চমকে গেলাম। পরক্ষনেই সে বলল, লতা, শার্লতা।“ আমি চমক কমে গেল। খালি একটু অবাক হলাম আর কি। জার্মান উচ্চারনে খটোমটো শার্লট হয়ে যায় শার্লতা। আর তাও সংকুচিত হয়ে এসে থামে লতায়। এখানে সব শার্লতার ডাকনাম লতা। কি আশ্চর্য! আর কি কোমল। আমাকে ভাবনা থেকে বের করে নিল লতার বাড়িয়ে দেয়া হাতটা। আমি হাতে হাত মেলানো এড়াতে এলোমেলো চুলে উদ্দেশ্যবিহীন হাত চালিয়ে বললাম, “আমি অনিক।”
(চলবে)
১৬.০৯.১৮
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ১:১২