মারিয়ানা ট্রেঞ্চের বেশিরভাগ অংশই এখন U.S. protected zone হিসেবে গণ্য।
মারিয়ানা ট্রেঞ্চে প্রথম অভিযান:
সাধারণ ডাইভিংয়ে যে সরন্জাম প্রয়োজন, ডীপ সী ডাইভিংয়ে তা একদমই অচল। কারণ উপরে বলা পানির চাপ যা কিনা প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে ৮ টন! মানুষের চেষ্টার শেষ নেই। ১৯৬০ সালে জ্যাকুয়েস পিকার্ড আর নেভী লে: ডন ওয়ালশ মারিয়ানা ট্রেঞ্চের নীচে পৌঁছাতে সক্ষম হন। যে যানে চড়ে তারা গভীর সাগরে ডুব দেন তার নাম Trieste (ত্রিয়েস্ত)। এটি একটি নেভী সাবমার্সিবল।
ছবি: সাবমার্সিবল Trieste (ত্রিয়েস্ত)
সাগরের উপর থেকে মারিয়ানা ট্রেঞ্চের তলদেশে নামতে তাদের ৫ ঘণ্টা সময় লাগে। তারা ১০৯১৫ মিটার নীচে নামেন! তারা মাত্র ২০ মিনিট সেখানে থাকেন তারপর আবার উপরে উঠে আসেন।নীচের পানিতে তাদের সাবমার্সিবলের কারণে সৃষ্ট কম্পণে পানি ঘোলা হয়ে যাওয়ায় তারা কোনো ছবি তুলে আনতে পারেননি। তবে পিকার্ডের ভাষ্যমতে তিনি সেখানে "flatfish" দেখেছিলেন, যদিও তখনকার বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করত পানির অত নীচে কোনো প্রাণী থাকতে পারেনা।
ছবি: ওয়ালশ আর পিকার্ড (অভিযান শেষে ফিরে আসার পর)
পরবর্তীতে পিকার্ড তার জীবনীতে লিখেন, “Here, in an instant, was the answer that biologists had asked for the decades,” Piccard wrote. “Could life exist in the greatest depths of the ocean? It could!”
মারিয়ানা ট্রেঞ্চে দ্বিতীয় অভিযান:
পরিচালক জেমস ক্যামরনের নাম শুনেনি এমন ব্লগার সামুতে খুব কমই আছে । টাইটানিক আর এ্যাভাটার ছবিটার সৌজন্যে সবাই তার নাম জানে। ও বলে রাখা ভাল, ওয়ালশ আর পিকার্ডের পর গত ৫২ বছরে তিনিই হলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি মারিয়ানার তলদেশে পৌঁছিয়েছেন। তবে এর আগে গবেষণার কাজে বিজ্ঞানীরা দু'বার মনুষ্যবিহীন যান পাঠিয়েছেন মারিয়ানা ট্রেঞ্চে৷ এর একটি পাঠিয়েছে জাপান, ১৯৯৫ সালে৷ আর অন্যটি অ্যামেরিকা, ২০০৮ সালে৷ ক্যামেরনের অভিযানে ব্যবহৃত যানটির নাম "ডিপ সি চ্যালেঞ্জার"
ডিপ সি চ্যালেঞ্জার:
জেমস ক্যামেরন ৭ বছর ধরে প্রস্তুতি নিয়েছেন সাগর অভিযানের। আর এর জন্য সবচাইতে জরুরী যে জিনিস, তা হল অভিযানে ব্যবহৃত সাবমেরিন কিংবা সাবমার্সিবল। এমন একটি সাবমেরিন যা তার ভেতরে একজন মানুষকে নিয়ে পৌঁছাতে পারবে সাগরের সবচেয়ে গভীরে। যার ভেতরে ডাটা কালেকশন, স্যাম্পল সংগ্রহ এবং থ্রি-ডি ছবি তোলার ব্যবস্হা থাকবে এবং নির্বিঘ্নে আবার ফিরে আসতে পারবে সাগরের উপরিভাগে। এতগুলি সুবিধা সংবলিত সাবমেরিন তৈরি করাও ছিল সময়সাপেক্ষ। অবশেষে তৈরি হল ডিপ সি চ্যালেঞ্জার:
এটি অস্ট্রেলিয়াতে তৈরি করা হয়। এটির ওজন ১১ দশমিক ৮ টন।এটি টর্পেডো আকৃতির।এটি দৈর্ঘ্যে ৭ দশমিক ৩ মিটার। আর প্রস্হ সাড়ে ৩ ফুট মাত্র ।এটি খুব পুরু ইস্পাত আর ‘সিনট্যাকটিক ফোম' নামের উপাদান দিয়ে তৈরি করা হয়েছে।এটি তৈরিতে নেতৃত্ব দেন অস্ট্রেলিয়ান প্রকৌশলী Ron Allum৷ বেশ কয়েক ধরণের ক্যামেরা ও লাইট ছিল ঐ ডুবোজাহাজে৷ যেটা দিয়ে সাগরের একেবারে তলদেশের ছবি তোলা হয়েছে৷ এছাড়া ডুবোজাহাজে ছিল ‘রোবটিক হাত' যেটা দিয়ে পাথর ও মাটি জোগাড় করা হয়েছে৷ এছাড়াও ছিল তাপমাত্রা, লবণাক্ততা ও পানির চাপ মাপার যন্ত্র। সাবমেরিনে লাগানো ছিল একাধিক থ্রি-ডি ক্যামেরা ও এলইডির ৮ ফুট লম্বা টাওয়ার।
জেমস ক্যামেরনের অভিযান:
২৬শে মার্চ ২০১২ জেমস কামেরন ইতিহাস লিখলেন নতুন করে। স্হানীয় সময় সকাল সোয়া ৫ টায় শুরু করেন যাত্রা। নীচের ছবিতে ক্যামেরন ডিপ সী চ্যালেন্জারে যাত্রা শুরুর আগে হাত মেলাচ্ছেন ১৯৬০ সালের সফল অভিযাত্রী ডন ওয়ালশের সাথে।
নীচের ছবিতে: ডীপ সী কে নামানো হচ্ছে:
মারিয়ানা ট্রেঞ্চ বিষুবরেখার কাছে অবস্থিত বিধায় সেখানকার সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা এমনিতেই বেশি। আর সাবমেরিনের ককপিটের তাপ ছিল তার চেয়েও বেশি। ক্যামেরনের মনে হচ্ছিল তিনি যেন স্টিম বাথ নিচ্ছেন। কিন্তু সাগরগর্ভে নামতে শুরু করার সময় সাবমেরিনটি অতি দ্রুত নিচের দিকে ধাবিত হয়। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে তিনি জলরাশির এমন স্তরে পৌঁছান যেখানে পানির তাপমাত্রা ছিল মাত্র ২.২ ডিগ্রী সেলসিয়াস। অল্পসময়েই তাঁর পায়ের পাতা দুটি ঠাণ্ডায় জমে যেতে থাকে। মাথার পিছন দিকটাও জমে যায়। তবে শরীরের মাঝখানটা তখনও উষ্ণ ছিল। এরপর মিনিট দুয়েকের মধ্যে সম্পূর্ণ অন্ধকার তাঁকে গ্রাস করে নেয়। ড্রাইভের বেশিরভাগ সময় তিনি অন্ধকারে ছিলেন। কাজেই সাবমেরিনটিও অতিমাত্রায় শীতল ছিল। গায়ে গরম কাপড় দেয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল। চারপাশের দেয়াল ঠাণ্ডায় এমন ঘনীভূত হয় যে তা থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি গড়িয়ে ক্যামেরনকে সর্বক্ষণ ভিজিয়ে দিচ্ছিল। শারীরিক এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও সাগরের গহীনতম স্থানে পৌঁছানোর অভিজ্ঞতায় ক্যামেরন বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলেন।
ছবি: ডীপ সী এর ভেতরে ক্যামেরন
২ ঘন্টা ৩৬ মিনিট পর তিনি মারিয়ানা ট্রেঞ্চের তলদেশ স্পর্শ করেন। ডিপ সী চ্যালেঞ্জার মারিয়ানা ট্রেঞ্চের তলদেশে যখন অবতরণ করে ক্যামেরনের মনে হয়েছিল ওটা যেন খুবই নরম, প্রায় জিলেটিনের মতো। নরম সমতল ভূমির উপর নেমেছে। একটু ধাতস্থ হয়ে নেয়ার পর তিনি বেশ কিছুদূর সাবমেরিনটি চালিয়ে নিয়ে যান। স্পেশাল আন্ডারওয়াটার রেডিও টেকনোলজীর মাধ্যমে তিনি যোগাযোগ করছিলেন। এমনকি তিনি Twitter এ Twit ও করেন তলদেশে পৌঁছিয়ে!
মারিয়ানা ট্রেঞ্চের তলদেশে পৌঁছে তার মনে হয়েছিল তিনি যেন চন্দ্রপৃষ্ঠে আছেন। ঠিক সেরকমই এক একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতাবোধ তাকে গ্রাস করে নিয়েছিল। মনে হচ্ছিল তিনি যেন এক দিনের মহাকাশ অভিযানে নেমেছেন। আরেক গ্রহে গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে ফিরে এসেছেন। পৃথিবীর সর্বনিম্ন বিন্দুতে পৌঁছে প্রাথমিকভাবে 'অল সিস্টেমস ওকে' নামক একটি সংকেত প্রেরণ করেন তিনি। মহাসাগরের সর্বনিম্ন বিন্দুতে পৌঁছানোর এক ঘণ্টা পর তিনি আরও বলেন, 'তলানিতে ঠেকে কখনও এত ভালো লাগেনি। আমি কী দেখি তা জানার জন্য আপনারা অপেক্ষা করতে পারেন।'
তলদেশের ছবি
এরপর তিনি জীব আর উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের জন্য বিভিন্ন স্যাম্পল কালেকশন শুরু করেন। এছাড়া তিনি পাথর আর প্রাণীদের স্যাম্পলও যোগাড় করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ঘণ্টাখানেক সময় সেখানে কাটানোর পর তিনি লক্ষ্য করলেন, ডুবোযানটির হাইড্রোলিক অয়েল লিক করে ককপিটের মধ্যে চলে আসছে। এ রকম পরিস্থিতিতে পানির এত গভীরে অবস্থান করা নিরাপদ হবে না ভেবে ক্যামেরন তার অভিযান শেষ করলেন। ৭০ মিনিট লাগল তার উপরে উঠে আসতে। তার অভিযানটি ছিল ৭ ঘন্টার।
ছবি: ফিরে আসার পর
যদিও সময়ের আগেই ফিরে আসতে হয়েছিল, তবুও তিনি যে ভিডিও, ছবি আর স্যাম্পল এনেছেন, তা দেখার জন্য জীব আর উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন।তিনি যে জিনিসগুলো নিয়ে এসেছেন সেগুলো গবেষণা কাজে লাগানো হবে বলে জানা গেছে৷ ফিরে আসার পর ক্যামেরন বলেন, ‘‘মনে হচ্ছে আমি অন্য কোনো পৃথিবীতে চলে গিয়েছিলাম, যেখানে কেউ নেই৷ আশপাশ ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার৷'' তবে চিংড়ির মতো এক ধরণের প্রাণীর দেখা তিনি পেয়েছেন বলে জানান ক্যামেরন৷
এদিকে বিজ্ঞান ছাড়াও পর্যটকদের আকর্ষণ করতে ডুবোজাহাজ বানাচ্ছে মার্কিন আরেক কোম্পানি৷ তারা প্রায় আড়াই লক্ষ ডলার করে একেকজন উৎসাহী পর্যটককে সমুদ্রের তলদেশে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে৷আরো বিস্তারিত লেখা যেত, অনেক কিছু বাদ দিতে হল। তা নাহলে অনেক বড় হয়ে যেত।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই নভেম্বর, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:৪৯