বেশী-জ্বরের সঙ্গে চোখ-মাথা-শরীরে ব্যথা হলে সন্দেহ করুন ডেঙ্গু ।ডেঙ্গুর ব্যতিক্রমী কিছু উপসর্গ দেখে সহজেই এটিকে অন্য জ্বরের থেকে আলাদা করা যায়। এর মধ্যে রয়েছে চোখের পিছনে ব্যথা অনুভব, মাথা ব্যথা আর শরীরের গাঁটে গাঁটে অসহ্য ব্যথা। অত্যধিক জ্বরের (১০২-১০৪ডিগ্রি) সঙ্গে গায়ে ব্যথা হলে বিষয়টি ডেঙ্গু বলে প্রাথমিক সন্দেহ করতেই হবে। রক্তের প্লেটলেট কাউন্ট বা প্যাক্ট সেল ভলিউম পরীক্ষা করলে ডেঙ্গু কতোটুকু মারাত্মক হচ্ছে তা সনাক্ত করা যায়। বেশি জ্বরের সঙ্গে অনুচক্রিকা কমে গিয়ে প্যাক্ট সেল ভলিউম বেড়ে গেলে বুঝতে হবে, রোগীর ডেঙ্গু মারাত্মক হচ্ছে।
ডেঙ্গু সাধারণত চার রকমের। মানে ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি প্রজাতি (সেরোটাইপ) রয়েছে। প্রথমবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে তেমন কোনো চিন্তা নেই। কেননা মানবদেহের নিজস্ব রোগ প্রতিরক্ষাতন্ত্র ওই ভাইরাসকে মেরে ফেলে। সে ওষুধ পড়ুক আর না-ই পড়ুক। প্রথমবার আক্রমণ হলে তাকে প্রাইমারি ডেঙ্গু বলে। কিন্তু যদি একবার হয়ে যাওয়ার পরে আবার হয়, তখন সেই সেকেন্ডারি ডেঙ্গু নিয়েই ঘটে জটিলতা। তখন শরীরের নিজস্ব প্রতিরক্ষাতন্ত্র ঠিকঠাক কাজ করতে পারে না। দ্বিতীয়বার আক্রমণই যত নষ্টের মূল। এক্ষেত্রে রোগীর রক্তের অনুচক্রিকা অস্বাভাবিকভাবে কমতে থাকে। রোগীর বাড়তি সংক্রমণ এড়াতে অ্যান্টিবায়োটিকও দিতে হয়। শরীরের অবস্থা বুঝে কিছু বাড়তি ওষুধও দেন চিকিৎসকরা। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা(WHO) বারবার চিকিৎসকদের সতর্ক করেছেন ওষুধ নির্বাচনের বিষয়ে। বলা হয়েছে, ডেঙ্গুতে কখনই অ্যাসপিরিন বা আইবিইউ ব্রুফেন জাতীয় ওষুধ খাওয়া চলবে না। এতে হিতে বিপরীত হয়। এমন কোনো ওষুধই দেওয়া চলবে না, যা রক্তে অনুচক্রিকার সংখ্যা কমাতে পারে।
প্রথম অবস্থায় সেকেন্ডারি ডেঙ্গুর খোঁজ পেলে ভালোভাবে প্রতিকার করা যায়। কিন্তু হেমারেজিক ফিভার বা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হলে রোগীর অবস্থা আশংকাজনক হয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজন। কারণ সঙ্গে সঙ্গে রোগীর শরীরে পানির পরিমাণ বাড়াতে স্যালাইন দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। এই হেমারেজিক ডেঙ্গুতেই রোগীর রক্তনালী ফেটে রক্ত চুঁইতে পারে। চামড়া ফেটেও রক্ত পড়তে দেখা যায়। তবে প্রাইমারি, সেকেন্ডারি দুই রকমের ২০০টি ডেঙ্গুর মধ্যে হেমারেজিক ডেঙ্গু হওয়ার আশঙ্কা মাত্র ১টি।
বিদেশের সমীক্ষা উল্লেখ করে ডেঙ্গু নিয়ে যেসব কথা বলা হচ্ছে, তা অবশ্য অনেক বিশেষজ্ঞ মানতে নারাজ। বলা হচ্ছে ম্যালেরিয়া কম হচ্ছে, ডেঙ্গু বেশি হচ্ছে। ডেঙ্গু ভাইরাস এডিস মশার জিনগত পরিবর্তন করে দিয়েছে। এই মশা বেশি রক্তপিপাসু। ডিম পাড়ার সময়ই বেশি রক্তপিপাসু হয়ে ওঠে। জিন পরিবর্তন অনেক পরের বিষয়। জলাবদ্ধ স্থানে এরা ডিম পারে। আর ডেঙ্গুবাহী এডিস ইজিপ্টাই প্রকৃতিগতভাবেও অন্য মশাদের থেকে অনেকটা এগিয়ে।
এডিস ইজিপ্টাই মশাটি দারুণ শক্তপোক্ত। বাঁচে দীর্ঘদিন। সর্বাধিক আয়ু ২২৫দিন। পিউপা দশা থেকে পূর্ণতা পাওয়ার তিনদিন পরেই এডিস স্ত্রী মশা কামড়াতে শুরু করে। জীবদ্দশায় স্ত্রী মশারা তিন তিনবার ডিম পাড়ে। এতেই সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটে যাচ্ছে দ্রুত। এডিস মশা ২০০মিটার পর্যন্ত উড়ে যেতে পারে। এক জায়গা থেকে যানবাহনে চেপে অন্যত্র যাওয়ার প্রবণতা রয়েছে এই মশার। তাই এক জায়গায় ডেঙ্গু হওয়ার পরে আবার অন্য জায়গায় একইভাবে এই রোগ ছড়াতে দেখা যায়। ডিম পাড়ার জায়গা থেকে ৪৫মিটার দূর পর্যন্ত গিয়ে কামড়াতে থাকে এডিস মশা। তবে এডিস মশা দিনের বেলাতেই বেশি কামড়ায়। সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের দুই ঘণ্টার মধ্যে কামড়ানো শুরু করে। বিকাল ৫ থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এদের বেশি কামড়াতে দেখা যাচ্ছে।
কামড়ানোর দিক থেকেও এডিস মশা অন্য প্রজাতির মশাকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। এটির লুকিয়ে থাকার প্রবণতাটা মারাত্মক। এদের খাটের নিচে, ঘরের ছবির পিছনে, বাথরুমে, অন্ধকার জায়গায় লুকিয়ে থেকে আক্রমণ করতে দেখা গেছে। একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে, এডিস মশার ৯০ শতাংশেরই মানুষের রক্তের উপর লোভ বেশি। এডিস মশার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এরা আক্রমণ করে পিছন থেকে। ওড়বার সময় অ্যানোফিলিস বা কিউলেক্স মশার মতো এদের শব্দ হয় না বলে আক্রমণের আগে বোঝা যায় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কামড়ানোর পরে বোঝা যায়, মশা কামড়েছে। তবে আসল কথা এডিস মশা কামড়ালেই ডেঙ্গু হয় না। ডেঙ্গুর ভাইরাস মশার লালাগ্রন্থিতে বাসা না বাঁধলে ছড়ানোর ভয় নেই।
কীভাবে হয় ডেঙ্গু ?
• ডেঙ্গু ভাইরাসবাহী মশা কামড়ালে।
সাধারণ ডেঙ্গুর উপসর্গ:
• অত্যধিক জ্বর। কখনও কম, কখনও বেশি।
• শরীরে গাঁটে গাঁটে ব্যথা, অবসন্নতা।
• প্রস্রাবে জ্বালাভাব। পরিমাণ কম হওয়া।
• খাবারে অনীহা। ভাতে অরুচি।
হেমারেজিক ডেঙ্গুর উপসর্গ:
• হাতের তালু, গায়ে লাল ছোপ।
• চোখ জ্বালা করা। চোখ লালচে হয়ে থাকা।
• পেটে যন্ত্রণা, অনেক সময় বমি। পাতলা পায়খানা।
• হাত ফেটে রক্ত পড়া।
• মারাত্মক দুর্বলতা। কপালে অসহ্য ব্যথা।
শনাক্তকরণ:
• উপসর্গ দেখা দিলে অবশ্যই রক্ত পরীক্ষা করতে হবে।
চিকিৎসা:
• পরিমিত পরিমাণে প্যারাসিটামল চলতে পারে। তাড়াতাড়ি চিকিৎসকের কাছে যাওয়াই ভালো।
• এমন ওষুধ চলবে না, যা রক্তে অনুচক্রিকা কমিয়ে দিতে পারে।
প্রাথমিক শুশ্রূষা:
• প্রাথমিক পর্যায়ে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট।
• প্রচুর পরিমান পানি খেতে হবে। সঙ্গে তাজা ফল।
• দিনে রাতে মশারির মধ্যে থাকা।
প্রতিরোধ:
• বাড়ির চারধারে জল জমতে না দেওয়া।
• ফুলদানি, চৌবাচ্চার জল নিয়মিত পালটানো।
• বাড়ির আশপাশের নোংরা জিনিস পরিষ্কার করা।
• রাতে মশারি টাঙিয়ে শোয়া।
• দিনে মশা তাড়ানোর ম্যাট, কয়েল, লিক্যুইড ব্যবহার।
• পা ঢাকা পোশাক পরা।
মশা নিয়ে কথা:
• এডিস মশা ডেঙ্গুর ভাইরাস বহন করে।
• ডেঙ্গুর মশা সাধারণত দিনে কামড়ায়। তবে সাধারণত ভোরের সূর্য উঠার আধ ঘণ্টার মধ্যে এবং সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের আধ ঘণ্টা আগে বেশী কামড়ায়। বর্ষাকালে ভোর ও সন্ধ্যাবেলা সাবধান থাকতে হবে ।
• চলতে ফিরতে থাকা মানুষকে আক্রমণ করে।
• সাধারণত কামড়ায় হাঁটুর নিচে।
• একনাগাড়ে কামড়ায় না। হঠাৎ হঠাৎ আক্রমণ করে।
• এডিস মশার উপাঙ্গে সাদা ছোপ থাকে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ১২:৪৪