গল্প-উপন্যাসে আমরা প্রায়ই মর্মান্তিক কাহিনী পড়ে থাকি। ট্রাজেডি উপন্যাস পড়ে চোখের পানি ফেলি। লেখকরা এসব অতিরঞ্জিত করে লেখেন। শব্দচয়নের দক্ষতায় পাঠককে মায়ার জালে জড়িয়ে কাঁদিয়ে ছাড়েন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে লেখকরা বাস্তব ট্র্যাজেডি নিয়েও লেখেন। কিন্তু এসব গল্প উপন্যাসের আড়ালে বাস্তব জগতেও কিছু মর্মান্তিক ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। যা গল্প উপন্যাসকেও হার মানায়। এতটাই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে যা জানামাত্র যে কেউই নির্বাক হয়ে যাবেন। এমন এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়ার ধানতলা নামক এলাকায়। ওই এলাকার মাপি নামের ৬ষ্ঠ শ্রেণীর এক ছাত্রী এ ঘটনা ঘটিয়েছে। সে আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যা মামুলি ব্যাপার। প্রতিনিয়ত ঘটে চলছে। তবে মাপির আত্মহত্যার অন্তরালে লুকিয়ে আছে মর্মান্তিক এক ঘটনা।
আত্মহত্যার কয়েকদিন আগে থেকেই মাপির ভীষণ মন খারাপ ছিল। বাবার চোখ নষ্ট। কিডনি প্রতিস্থাপন না করলে ভাইকে বাঁচানো যাবে না। এতসব সমস্যায় বাব-মা'র বিষণ্ন মুখের দিকে তাকালে কার না মন খারাপ হয়। মাপি বড়দের আলোচনা থেকে জানতে পারে একটি অপারেশন করে চক্ষু প্রতিস্থাপন করলে তার বাবার চোখ ভালো হতে পারে। কিডনি প্রতিস্থাপন করলে তার ভাই সুস্থ হয়ে উঠবে। কিন্তু সেজন্য লাগবে অঢেল টাকা। আর তাদের সে টাকা নাই বলেই এত দুঃখ। এ দুঃখ মাপিকে নাড়া দিয়েছে। প্রচণ্ড কষ্ট অনুভব করতে থাকে সে তার অন্ধ বাবা ও অসুস্থ ভাইয়ের জন্য। তাদের জন্য কিছু করার ইচ্ছে জাগে। কিন্তু এতটুকু বাচ্চা মেয়ের কিইবা করার থাকে। বড়রা কোনো উপায় বের করতে না পারলেও মাপি পারে। তার মনে আইডিয়া আসে। আত্মহত্যা করলে কেমন হয়। সে ভেবে দেখে আত্মহত্যা করলেই তার চোখ দিয়ে বাবা দেখতে পাবে। তার কিডনিতে সুস্থ হয়ে উঠবে আদরের ভাই। এটাই একমাত্র উপায়। তার এ সিদ্ধান্তের কথা সে বড় বোন মনিকাকেও জানায়। কিন্তু মনিকা তার কথায় কান দেয়নি। হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। অবশেষে থায়োডান নামক কীটনাশক পান করে মাপি আত্মহত্যা করে। রেখে যায় একটি সুইসাইড নোট। যাতে তার ইচ্ছার কথা লেখা রয়েছে।
বিষপান করেই মাপি ছুটে যায় তার বাবার কাছে। তার বাবা তখন বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরে ছিলেন। বাবাকে গিয়ে বলে, আমি স্বপ্নে দেখেছি কে যেন আমার মুখে বিষ ঢেলে দিয়েছে এবং পেটে প্রচণ্ড ব্যথা করছে। একথা শুনে তার বাবা তাকে প্রথমে একটি ওষুধের দোকানে নিয়ে যান। সেখানে মাপিকে কিছু ওষুধ দেয়া হয়। কিন্তু তার শারীরিক অবস্থা আরও খারাপের দিকে যায়। পরে তাকে স্থানীয় হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানেও তার অবস্থার অবনতি ঘটলে আনুলিয়া হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিন্তু ততক্ষণে সময় শেষ। ডাক্তার মাপিকে মৃত ঘোষণা করে।
এরপর ময়না তদন্ত শেষ হয়। শশ্মানে নিয়ে তার দাহ সম্পন্ন করা হয়। পরিবার শোকে বিহ্বল। ট্রাজেডির সূত্রপাত হয় এখান থেকেই। মাপির আত্মহত্যা কোনো কাজে আসেনি। দাহ করার একদিন পরে মাপির বিছানায় তার বাবা একটি চিরকুট দেখতে পায়। চিরকুটে লেখা তার ইচ্ছার কথা। চক্ষু ও কিডনি দানের কথা। কিন্তু একদিন আগেই তার উইল করা চক্ষু ও কিডনি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পরিবারে শুরু হয় নতুন শোকের মাতম। এই শোকে সান্ত্বনার কোনো ভাষাই যেন কারো নেই। বাবার চোখ ও ভাইয়ের কিডনি রক্ষায় জীবন দানের কথা যথাসময়ে কেউই জানতে পারেনি। এ দুঃখ তারা কীভাবে ভুলবেন।
মাপির পিতা মৃদুল সরকার জানান, আমরা আমাদের কলিজার টুকরা মাপির মনের ইচ্ছা বুঝতে পারিনি। এ দুঃখ আমরা কীভাবে ভুলবো।
ধানতলা পঞ্চায়েত প্রধান তাপস তরফদার জানান, মাপির পরিবার আমাদের নিকট সাহায্যের জন্য এসেছিল। আমরা কিছু টাকা দেয়ার ওয়াদাও করেছিলাম। কিন্তু এরই মধ্যে এই ট্রাজেডি ঘটে গেল।