২০১৩ সালে প্রথমা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত “উইকিলিকসে বাংলাদেশ” বইটি তোলপাড় করেছিল তৎকালীন অ্যাকাডেমিক মহল। তবে ব্যুরোক্রেসি কিংবা ডিপ্লোম্যাসি যা-ই বলি না কেন এ বিষয়ে আগ্রহের কারণে এ অধমেরও মনোজগতে দাগ কেটেছিলো বইটি। নানা কারণে এতদিন পড়া হয় নি। অবশেষে...
বইটি নিয়ে এককথায় বলতে গেলে ফেলুদার লালমোহন বাবুর ভাষায় বলতে হয় “হাইলি সাসপিশাস”! সত্যি বলতে কি নিষিদ্ধ, গোপনীয়- এসব শব্দ যেকোন মানুষকেই আগ্রহী করে তুলতে যথেষ্ট আর এ বইটি সেসবেই ভরপূর! চোখের সামনে ভেসে উঠবে এক যাযাবরের জীবনগাঁথা, বাংলাদেশে রাজনীতির নামে দেশকে কিভাবে বিকিয়ে দেয়া হয় সস্তায়, কিভাবে দিনের পর দিন আমাদের সাথে প্রতারণা করে যাচ্ছেন রাজনীতিবিদেরা, কিভাবে ষড়যন্ত্রের জাল বুনন হয় নিপুণ সুতোয়! (অবশ্যই প্রমাণ সাপেক্ষে!) কাজেই পড়ার মত যথেষ্ট রসদই আছে বইটায়।
প্রথম আলোর সাংবাদিক মশিউল আলমের অনুবাদ, সংকলন এবং সম্পাদনায় ছাপা হওয়া এই বইটির মূলত দুটি ভাগ। প্রথম ভাগে লেখক উইকিলিকসের কর্ণধার জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের ব্যক্তিগত জীবন কিংবা উইকিলিকসের উত্থান-পতন আর বর্তমান প্রেক্ষিতে এর অবস্থান নিয়ে আলোচনা করেছেন যেটা কিনা সমগ্র বইয়ের খুব ছোট্ট একটি অংশ! উল্লেখ্য, লেখাটি এতটাই সুখপাঠ্য যে আমি নিজেই লেখার সময় এ থেকে সরাসরি উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারি নি।
আর তার পরেই আছে বাংলাদেশ নিয়ে ২০০৩-২০১০ সাল পর্যন্ত মার্কিন দূতাবাস থেকে পাঠানো তারবার্তার সংকলন যা সবই “Confidential” কিংবা “Secret” নাম দিয়ে আড়ালে রাখা হয় সবার। ফলে এরকম গোপন সব দলিলগুলো নিঃসন্দেহে ইতিহাসের যেমন সাক্ষ্য দেয় তেমনি পাঠককে করে তোলে শিহরিত, রোমাঞ্চিত!
ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকা ২০১০ সালের এক সকালে তার পাঠকদের উদ্দেশ্যে শিরোনাম করে, “World’s biggest leaks”! হঠাৎ করে উইকিলিকস নামের এক ওয়েবসাইট সকল নিয়মের প্রতিবাদ করে ড্যান ব্রাউনের বইয়ের গুপ্ত সংঘের মত “প্রচলিত বিশ্ব ব্যবস্থাকে” চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসে। সাথে সাথে সব মুখোশ খসে পড়ে। কার মুখোশ? অসীম ক্ষমতাধর সরকার, প্রবল ক্ষমতাশালী সামরিক বাহিনী, ধুরন্ধর গোয়েন্দা দল, মুনাফাতাড়িত কর্পোরেশন, প্রতারণাপ্রবণ ধর্মভিত্তিক দল- অর্থাৎ আমাদের চেনা বিশ্বব্যবস্থার নাটের গুরু যারা তাদের। আর বিগ বস আমেরিকা কলকাঠি নাড়তে থাকে “কাল্ট”এর নেতা অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে। শুরু হয় এক অসম যুদ্ধ। পৃথিবী প্রত্যক্ষ করলো এক টারময়েল এবং সাধারণ মানুষের কাছে উন্মুক্ত হয়ে গেলো নগ্ন আন্তর্জাতিক রাজনীতি। সে এক বিশাল লজ্জার ইতিহাস।
অ্যাসাঞ্জ তথ্যের স্বাধীতনতায়, তার অবাধ প্রাপ্যতায় বিশ্বাস করেন। পৃথিবীব্যাপী যে “বিগ বস” আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সরকার রয়েছে, তারা যে প্রতারণার মায়াজালে আমাদের মত সাধারণ জনগণকে আচ্ছন্ন করে রেখেছেন “টম সয়ার” তা মানতে পারলেন না। কারণ যে “ডেটা” লুকিয়ে আছে প্রাচীরের আড়ালে তা কোনভাবে প্রকাশ পেয়ে গেলেই বেরিয়ে পড়বে শাসকদের নির্লজ্জ মিথ্যাচার, তাদের নব্য-মধ্যযূগীয় কর্মকাণ্ড। কিভাবে আমাদের প্রতিটি কোষরস শুষে নিয়ে ভ্যাম্পায়ারের মত পান করছে উন্মত্ত নেশায়।
অতএব, ভাঙ ভাঙ ভাঙ তালা, আঘাতে আঘাত কর/ আজ কি গান গেয়েছে পাখি; এসেছে রবির কর।
ঠিক এমনই একটি চিত্রকল্পে রচিত হলো উইকিলিকস নামের এক ইতিহাস। “একনায়ক” মার্কিন ব্যবস্থায় আঘাত হানলো ডিজিটাল এ রবিনহুড। এবার সে শুরু করলো পুরো পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ২৭৪ টি মার্কিন কনস্যুলেটের গোপন দলিল প্রকাশ যা রাষ্ট্রদূতেরা পাঠাতেন তাদের দেশে! বিভিন্ন দেশগুলোতে। গণতন্ত্র রপ্তানির নামে কি পরিহাসপূর্ণ খেলায় মেতেছে এ নাটের গুরু তা ধাঁধিয়ে দেয় পুরো বিশ্বকে। তবে সবচেয়ে আলোড়ন তোলা দলিলগুলো আফগান যুদ্ধ নিয়ে। সে দেশে চালানো মার্কিন বাহিনীর নৃশংসতা, পৈশাচিকতার পরিচয় বহন করা এ দলিলগুলো অন্তত একবার হলেও কাঁপিয়ে যাবে মানবসভ্যতার ভিত।
এসমস্ত দলিল তৈরি হয়েছিলো অনেকটা অ্যাডভেঞ্চারের মতো করে। বিশ্বের শীর্ষ পাঁচটি ভাষার পাঁচটি প্রধান দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান, লে মঁদ, ডের স্পিগেল, আল-পাইস, নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে জাঁদরেল সব সাংবাদিক আর বিশেষজ্ঞ জড়ো হয়েছিলেন গার্ডিয়ান পত্রিকার কার্যালয়ে। “নো-আন অথরাইজড অ্যাক্সেস” লেখা এক কামড়ায় কয়েক মাস টানা খাটা-খাটুনিতে প্রকাশের প্রস্তুত করা হয় এসব ডকুমেন্ট। বিস্তারিত তথ্য পাঠক বইয়েই পাবেন!
সবশেষ, বাংলাদেশ বিষয়ক যেসমস্ত তারবার্তা রয়েছে সেসব বিষয়ে বলতে গেলে এই বইয়ের ভাষায় বলতে হয় “তারবার্তাগুলো দেখিয়ে দেবে বাংলাদেশের স্বাধীন-সার্বভৌম সত্তার ধারণাটি কি পরিহাসপূর্ণভাবে অলীক”।
অতএব, শুরু হোক গোপনীয়তার নিকুচি করা......
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুন, ২০১৫ রাত ১:৩৫