প্রথম পর্ব
রাজনীতি
সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো স্বাধীনতার দশ বছরের মাথায় পাকিস্তান-ফেরত এক কর্মকর্তার ক্ষমতায় আসন গাড়া। তিনি বাংলার লেজেহুমু এরশাদ ওরফে বিশ্ববেহায়া। পাঠক, লেখার প্রথম পর্বেই লিখেছিলাম সেনাবাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তান-প্রত্যাগতদের দুইটি ভাগ ছিলো যেখানে বিদ্যমান ছিলো চরম দ্বন্দ্ব। সে প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে মুক্তিযুদ্ধের দুই প্রধান অগ্রনায়ক জিয়া ও খালেদ মোশাররফ ততোদিনে মৃত। মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ ক্ষমতা থেকে দূরে। ফলে জমে উঠলো পাক-ফেরতদের আসর।
এ জিনিসটি খুবই ছোট মনে হলেও এটিই বাংলাদেশের গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করেছে অনেক দিন। হয়তো ভবিষ্যতেও করবে কারণ রাজনীতিতে এই মানুষগুলোর অযাচিত হস্তক্ষেপ। চলুন দেখে নেয়া যাক, কোন Factor গুলো কলকাঠি নেড়েছে ঘটনার পিছনে
প্রথমত, বাংলাদেশে প্রত্যাগত এসব "মুজাহির"রা প্রায় সবাই ছিলো পাকিস্তান সামরিক অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। সোজা কথায় পাকিস্তানের জল হাওয়া ও তার ভৌগোলিক আশীর্বাদে আশীর্বাদপুষ্ট। বলা বাহুল্য পাকিস্তান জন্মের পর থেকে সেনাবাহিনী ক্ষমতা-বলয়ে চলে আসে। এবং ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিনত হয় সামরিক প্রতিষ্ঠান। ফলে এসব অফিসারদের মধ্যে Subconsciously হলেও প্রভাব বিস্তার করেছে যে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা সেনাবাহিনীর জন্য খুব স্বাভাবিক। ফলে অধুনা বাংলাদেশেও সেই "জমিদারি" প্রচলনে তারা ভূমিকা রাখে। ফলে জায়েজ হয়ে যায় তাদের এসব Interference.
দ্বিতীয়ত, উপমহাদেশের এলাকাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় মিল হলো প্রতিতি ক্ষেত্রে, প্রতিটি অঞ্চলে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ক্ষমতা কতিপয় মানুষের কাছে কুক্ষিগত থাকা। এর ঐতিহাসিক কারণের ব্যাখ্যা ব্রিটিশ শাসন থেকেই পাওয়া যাবে। ব্রিটিশরা নিজদের শাসনকার্যে সুবিধার জন্য একটি বিশেষ শ্রেণিকে সুবিধা প্রদান করে তাদের অনুগত করে তোলে। ফলে ঐ সুবিধাভোগী শ্রেনিটি হয়ে ওঠে সমাজের কর্তাস্থানীয় অংশ। আর ব্রিটিশরাজ যখন বিদায় নিলো তখন তারাই হয়ে দাঁড়ায় সমাজের এক্বমেবাদ্বিতীয়ম শ্রেনি। যার কারণে বাকি বিশাল জনগোষ্ঠী হয়ে পড়লো অসহায়। আর তার প্রভাব পড়লো শিক্ষা, চিকিৎসা, মানবাধিকার প্রভৃতি সামাজিক সূচকগুলোতে। ফলে এসব মানুষ থেকে গেলো অন্ধকারেই।
আর এরই পরিপ্রেক্ষিতে যারা ক্ষমরতা-বলয়ের অন্তর্গত তারা শুরু করলো তাদের ক্ষমতা-চক্র সুরক্ষিত করার। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত বাকি মানুষগুলোকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আর বাকি রাজনৈতিক চক্রকে বন্দুকের নলে রেখে দখল করে নিলো রাজনৈতিক ক্ষমতা। আর রাষ্ট্রক্ষমতায় যখন চলে আসলো তখন আসন গাড়লো রাজনীতিতেও। খুব ছোট্ট একটা উদাহরণ দিয়ে জিনিসটাকে দেখা যায় এভাবে যে, বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি সাবেক দুই সেনাসদস্যের গঠিত গঠিত দল।
প্রশাসন
বাংলাদেশ জন্মের পর থেকেই দেখা যাবে বাঙালি জাতির "স্বরূপ"। "স্বরূপ" বললাম কারন চোর-চোট্টামিতে যে তারা কত এক্সপার্ট তার প্রমাণে। তারপর যাকে গালভরা নামে "দুর্নীতি" নামে ডাকা হয় তার প্রকোপ। শেখ মুজিবুর রহমানের আমল থেকেই চলতে থাকে এর মহোৎসব আর জিয়াউর রহমানের আমলে তার আরো বিস্তার। [বলে রাখা ভালো দুইজনের ক্ষেত্রেই দুর্নীতির ডাইমেনশান ভিন্ন; যদিও এসব কুকর্মে একজন ছিলো নিরুপায় আর একজন সুচতুর ভাবে খেলেছেন দুর্নীতির কার্ড। তবে ব্যক্তি জিয়ার সততা প্রশ্নাতীত]
সে যাই হোক, বাংলাদেশের সবচেয়ে অদক্ষ, স্টুপিড, নোংরা, রাবিশ, দুর্নীতিবাজ, নীতিহীন, থার্ড ক্লাস, গুড ফর নাথিং প্রতিষ্ঠান হলো বেসামরিক প্রশাসন। এই নষ্টরা রাজনীতিবিদদের চেয়েও নষ্ট/ ঘুষ, দুর্নীতি আর অদক্ষতার মহোৎসব সেখানে। কোনো কাজই, কোন প্রকল্পই তাদের দিয়ে ঠিকমত করানো যায় না। আর তার বিপরীতে সামরিক প্রশাসন যথেষ্ট সুশৃংখল, দক্ষ আর সবচেয়ে বড় কথা কম দুর্নীতিবাজ। ফলে মানুষের কাছে বেসামরিক নষ্টদের চেয়ে মন্দের ভালো হয়ে উঠে এই সামরিক প্রশাসন। ফলে জনগনও খুব একটা বেকায়দায় না পড়লে এই এস্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে যায় না। ফলে বেসামরিক নষ্টরা যখন স্বাভাবিক দায়িত্ব পালন করতে পারার কথা সেখানে চলে সামরিকীকরণের খেলা। ফলে বুঝতেই পারছেন পাঠক, বাঙ্গালির মনোজগতে সেনাবাহিনী কি Influential ভূমিকা রাখে। আর যার কারণে যেকোন সরকারই কারণে-অকারনে ক্যান্টনমেন্ট থেকে তাদের বের করে নিয়ে আসে।
আর তার চেয়ে বড় কথা, একজন সামরিক অফিসার যে পরিমান প্রণোদনা পেয়ে থাকেন তা কোনোভাবেই একজন বেসামরিক অফিসার পান না। বাংলাদেশ তার জন্মের পর থেকেই অনেকটুকু সময় কাটিয়েছে জলপাই রঙের ছত্রচ্ছায়ায়। ফলে সামরিক একনায়কেরা যে সামরিক কাঠামো থেকে উঠে এসে তাদের সাহায্য নিয়ে ক্ষমতায় ছিলেন তাদের তুষ্ট করতে ছিলেন সম্পূর্ণ সজাগ। ফলশ্রুতিতে তাদেরকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে অযাচিত সুবিধা প্রদান করা হয় যা আর পরে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় নি কেননা স্বাভাবিকভাবেই কোন সরকারই একবার দিয়ে ফেলা সুবিধাদি ফিরিয়ে নেয়ার "দুঃসাহস' দেখাতে পারে নি। ফলে যেকোন ক্ষেত্রেই তারা অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে থাকেন। আর জাতিসংঘ মিশনে গিয়ে কাঁচা টাকা উপার্জনের সুযোগ তো রয়েছেই। (শান্তিরক্ষার কথা বলে এধরণের কথা না বলা সত্যে রপলাপই হবে।) আর তাছাড়া সিএমএইচে স্বাস্থ্য খাত, ডিওএইচএস নাম দিয়ে আবাসন সুবিধা প্রভৃতির কথা বলাই বাহুল্য। সবচেয়ে বড় কথা সামাজিক যেসব ক্রয়-বিক্রয় হয় তার কতটুকুই বা আমরা জানি। বাংলাদেশের মতো এরকম একটি দেশে একটি বিশেষ শ্রেনিকে এরকম সুবিধা দেয়া কতটুকু যৌক্তিক তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তবে সে ভিন্ন প্রসঙ্গ; তাতে অন্য এক সময় আসা যাবে।
অর্থাৎ যা বোঝাতে চাচ্ছিলাম তা হলো, এভাবে যুগে যুগে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত হয়ে বেড়ে ওঠা সামরিক বাহিনী আমাদের স্বাভাবিক দৈনন্দিন জীবনে অনুপ্রবেশ করে চলেছে প্রতিনিয়ত।
অপরাপর সমাচার
বাংলাদেশের ইতিহাসের গতি-প্রকৃতি দেখেই আমরা বুঝতে পারছি যে সেনাবাহিনী যুগে যুগে নানা কারণে "অযথা" সুবিধাপ্রাপ্ত হয়েছে । একই সাথে তার নিজেরাও নিজেদের কাঠামোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে ক্ষমতার জাল বিস্তার করেছে ক্রমাগত। তাছাড়া উইকিলিকসে প্রকাশ পেয়ে যাওয়া তারবার্তাগুলোর একটিতে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত তার দেশকে জানাচ্ছেন যে বাংলাদেশে অতিরিক্ত সুবিধাভোগী সেনাবাহিনী-কেন্দ্রিক একটি চক্র গড়ে ঊঠেছে যারা শিক্ষা-দীক্ষায় অপরাপর শিক্ষার্থীদের তুলনায় এগিয়ে। বলাই বাহুল্য, এখানে ক্যান্টনমেন্ট ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে; ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ কিংবা ক্যাডেত কলেজ, জিয়াউর রহমানের আমল থেকেই বিস্তার এ সাদা হাতিগুলোর। সত্যি কথা বলতে কি, সামরিক কার্যক্রমকে আরো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য, সেনাবাহিনীর মন রক্ষার্থে বাংলাদেশের মত ছোটো দেশে বিশাল জায়গা দখল করে মাত্র অল্প সংখ্যক শিক্ষার্থীকে এরকম শিক্ষা দান যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ একটি প্রক্রিয়া। বলে রাখা ভালো, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তৎকালীন সেনা-সমর্থিত সরকার দেশে আরো বিপুল পরিমান ক্যাডেট কলেজ স্থাপনের উদ্যগ নেয়। যদিও সেখান থেকে সামরিক অফিসার তৈরি হয় তার চেয়ে আরো বহুগুণে প্রচলিত শিক্ষা-কাঠামোয় যুক্ত হয়। ফলে ক্যাডেট কলেজগুলো সেনাবাহিনীর প্রভাব-বলয় বিস্তার করা ছাড়া আর কোন ভূমিকাই রাখে না। এভাবে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়ে পাকিস্তানি কায়দার বিষবাষ্প; যার শুরু হয়েছিলো সেই সামরিক আমল থেকে; যেটি কিনা সামাজিক সূচকের ভারসাম্যে আনে মারাত্মক Disruption.
ঘরপোড়া গরু মোরা
বাংলাদেশে যেরকম পঁচে যাওয়া রাজনীতি আর ঘুণে ধরা প্রশাসন বিদ্যমান সেখানে সেনাবাহিনী জনমবে অন্তত কিছুটা হলেও শান্তি দিতে পারে। বিগত সেনাসমর্থিত সরকারের আমলেই দেখা যায় সেনাবাহিনীর কল্যাণে দেশে "ছাত্র-নেতা" নামধারী সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্য নেমে আসে শূণ্যের কোঠায়। পাড়াতো যেসব গুন্ডা জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে বেড়াতো তাদের লম্ফঝম্ফ সুদূর অতীতে অবস্থান নেয়। অন্তত শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার্থীরা ছাত্ররাজনীতির ধারালো নখর থেকে মুক্তি পায়। দুর্নীতি দমন অভিযানে অর্জিত হয় বিরল সাফল্য। আর এখন? চারদিকে খালি "মুজিব-সেনা"। ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল, দুর্নীতি আছে সর্বোচ্চ অবস্থানে, গুন্ডা-পান্ডার আক্রমণে জনজীবন বিপর্যস্ত, "বড় ভাই" নামক নষ্টামিতে দেশের শান্তি-শৃংখলা ভেঙ্গে পড়েছে। আর পুলিশও বা করবেটা কি? তারা তো দলের নিবেদিত-প্রাণ কর্মী!! তাছাড়া বিভিন্ন বড় বড় অবকাঠামোগত প্রকল্প ছেড়ে দেয়া হচ্ছে সেনাবাহিনীর হাতে। কারণ??? ঐ যে, আমাদের বেসামরিক নষ্টদের উপর কিছুতেই ভরসা করা যায় না। এবার আপনারাই বলুন, আমরা কেন সেনাবাহিনীতে ভর করবো না? ঘরপোড়া গরু আমরা, রাজনীতির নামে সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পাই। আর তাছাড়া দুর্যোগপ্রবণ এই দেশে সেনাবাহিনীর ভূমিকার কথা ভুললেও চলবে না।
শেষের আগে
সত্যি কথা বলতে কি, আমি কোনোভাবেই কোনোদিন সামরিক কোন ক্ষেত্রে জড়িত ছিলাম না ফলে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমি লাভ করি নি। তবে এবিষয়ে আগ্রহ আর বিভিন্ন বই-পত্রের সাহায্য নিয়ে এবং Intuitive ভাবে জিনিসগুলোকে উপলব্ধি করেই এই লেখা লিখলাম মূলত দেখাতে চেয়েছিলাম আমাদের দেশে ঘটনাচক্রে কিভাবে সামরিক বাহিনী অনেকটা পাকিস্তানি কায়দায় নানাভাবে পুষ্ট হয়ে সামরিক আওতা-বহির্ভূতভাবে জড়িয়ে পড়েছে। তার প্রেক্ষাপট, বিস্তার আর কারণ দেখাতে চেয়েছি এ লেখায়। শুরুতেই বলে নিয়েছিলাম দর্পণেই বিম্ব দেখতে যাচ্ছি কাজেই অসদ বিম্ব তৈরি হবে। সেখান থেলে পাঠক-মতামতেই পরিপূর্ণতা পাবে এ লেখা।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুন, ২০১৫ দুপুর ১:৪৯