দ্বিতীয় পর্ব
গৌড়চন্দ্রিকা
প্রতিরক্ষা মানব ইতিহাসের অন্যতম প্রাচীন ধারণা। আদিমকালের মানুষেরা নিজের আত্মরক্ষার তাগিদে সেই গুহাকালে যে হাতে পাথর নিয়েছিলো, যুগে যুগে তার উত্তরসুরীদের হাতে শোভা পেয়েছে বল্লম, বর্শা, তীর, রাইফেল, গ্রেনেড, আণবিক বোমা- আরও কত কি! আর এর দায়িত্বে থাকা মানুষগুলো হয়ে উঠেছে সমাজের অতন্দ্র প্রহরী- উর্দি পড়া সামরিক বাহিনী! তবে উর্দির আলাদা একটা উত্তাপ আছে। যে গায়ে দেয় সে-ই খালি টের পায়। আর তার উত্তাপে যুগে যুগে সংঘটিত হয়েছে নানা অনর্থ! আর বাংলাদেশের সাপেক্ষে সেই অনর্থ কিংবা তার প্রকৃত স্বরূপ দেখা যাক আয়নায়! দর্পণ হয়তো Mirror Image দেখাবে। তবে আশা করি পাঠক সেটাকে নিজ দায়িত্বেই শুধরে নিবেন।
ইতিকথা
৭১’র বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধকালীন সেনাবাহিনী বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নামে আত্মপ্রকাশ করে। তবে তাতেই শেষ নয়। এ দলে যোগ দেয় পাকিস্তান-ফেরত সামরিক কর্মকর্তারাও। তাদের অনেকে স্বেচ্ছায় আবার অনেককে নিয়তির পরিহাসে থেকে যেতে হয়েছিলো “ভিনদেশে”। ফলে শুরু থেকেই বিভক্তি মাথা-চাড়া দিয়ে ওঠে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই মুক্তিযোদ্ধা দলটিই হয়ে ওঠে ডমিন্যান্ট পাওয়ার। আর শুরু হয় প্রতিরক্ষা খাতের “স্নায়ুযুদ্ধের”। চারদিকে তখন দেনা-পাওনা মিটাবার হিসাব। কারণ সদ্য দেশ স্বাধীন হয়েছে। সকলেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে নিজের সুন্দর সোনালী দিনের জন্য। কিন্তু যুদ্ধের পরে সেই দিন গেলো কই? চিরকালই অধৈর্য বাঙালি! ফলে চাওয়া-পাওয়ার দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়তে লাগলো মুক্তিযোদ্ধা দলেই। কে ফোর্স, এস ফোর্স, জেড ফোর্সের যথাক্রমে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের মধ্যে শুরু হলো নতুন এক মেরুকরণ। ফলে বিভক্তি বাড়তে লাগলো জ্যামিতিক হারে যা কিনা সদ্যস্বাধীন একটি দেশের জন্য দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছুই নয়। ফলে সেনাপ্রধানের, চীফ অফ স্টাফের পদ নিয়ে শুরু হলো মিউজিক্যাল চেয়ার। তিনজনই রণাঙ্গনের পরীক্ষিত সৈনিক। দেশের তিন সূর্যসন্তান। কিন্তু তাদের ক্ষমতার মোহ দেশকে নিয়ে গেলো এক চোরাগলিতে। সে প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে।
এবার তাকানো যাক সাধারণ অফিসারদের দিকে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে শুরু হয় এক অরাজক পরিস্থিতি। বারুদের ঝাঁঝ পেয়ে গেছে বাঙালি। আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। দেশে কায়েম হলো মগেদের মুল্লুক। ফলে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসতে হয় তাদের। সীমান্তরক্ষা, আইন-শৃংখলা নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি রুটিন-মাফিক কাজে নিয়োগপ্রাপ্ত হন তারা। বলাই বাহুল্য, দেশে তখন আওয়ামী লীগের দোর্দন্ড প্রতাপ। নামে-বেনামে শেখ সাহেবের নামে চলছে দুনিয়ার “আজাইরাগিরি”! ফলে অফিসাররা বিরোধে জড়িয়ে পড়লো সেসব নেতা-পাতিনেতাদের সাথে। আর তার ফলাফল ভালো হলো না মোটেও। মুজিবুর রহমানের চোখে পড়িয়ে দেয়া হয়েছে কালো টুপি। তাকে ঘিরে মোসাহেবরা ক্রমাগত ভুল পথে চালনা করছেন তাঁকে। ফলে মধ্যম সারির অফিসারদের মধ্যে দানা বাঁধলো আসন্তোষ। এরই মধ্যে বেশ কিছু ঘটনা, যেমন- মেজর ডালিম কিংবা টঙ্গির মেজর নাসেরের এসব কাহিনী হুমায়ূন আহমেদ এর “দেয়া;ল” সূত্রে অনেকেই জানেন। কাজেই তার বিবরণে যাচ্ছি না। ফলে ঘাড়ির কাঁটা ঘুরতে লাগলো উল্টোদিকে। কেউ জানতেও পারলো না।
তবে মোটামুটি এ বিষয়ক বই-পত্র ঘেঁটে যা সত্য বলে প্রতীয়মান হলো তা হচ্ছে, চূড়ান্ত পরিণতিতে জাতির জনকের মৃত্যু কোনভাবেই পুরো সেনাবাহিনীর অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ না মোটেও। বরং মেজর ফারুক এবং মেজর রশিদ নামের দুই ভায়রা ভাইয়ের আকস্মিক আঘাতের পরিণতি যেটাতে জড়িয়ে পড়েন “বিপথগামী কতিপয় সামরিক কর্মকর্তা”। আর তারপরেই ঘটতে থাকে “অদ্ভুত” সব পরিণতি। দেশে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নামলো না রাজনীতিকেরা না সেনাবাহিনী। বরং বঙ্গভবনে আসন গেড়ে ক্রমাগত রঙ্গ করে যেতে লাগলো মেজর রশিদ এবং মেজর ফারুক। মীরজাফরের রক্ত বয়ে নিয়ে চলা খন্দকার মোশতাক বসলেন মসনদে। পিছনে দুই মেজর। সাথে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম, এ, জি, ওসমানী। এ এক করুণ সময়। এদিকে জিয়াউর রহমানের ক্ষোভ ছিলো শেখ মুজিবের প্রতি। ফলে মেজরদের “অ্যাডভেঞ্চার” তিনি জানলেও উদ্যোগ নেন নি কিছুই। আর তলে তলে তার পরিকল্পনা চলছিলো মুক্তিযুদ্ধের আরেক বীর কর্নেল তাহেরের সাথে। চারদিকের জল ঘোলা। যদিও শেষমেশ জিয়াউর রহমানই হয়ে ওঠেন আলটিমেট মৎস্য শিকারী। সে আরেক প্রসঙ্গ। কিন্তু বসে নেই খালেদ মোশাররফ ও তার আরেক সহযোগী কর্নেল শাফায়েত জামিলও। মেজরদের কর্মকাণ্ডে তারা ত্যক্ত-বিরক্ত। ফলে ঘটনা ক্রমে রূপ নিলো আরেকটি অভ্যুত্থানে। এরই মধ্যে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয় জেলের ভিতরে। দেশ হয়ে পড়লো রাজনৈতিকভাবে নেতৃত্বশূণ্য। আর কথিত সিপাহী-জনতার বিপ্লবে ভেঙ্গে পড়ে সেনাবাহিনীর মূল স্তম্ভ “Chain of Command”! অফিসাররা পালাতে লাগলেন দিগ্বিদিক। ক্রাচের কর্নেল জানলেনও না কি চক্রে এনে দেশকে ফেলছেন, এমনই যখন পরিস্থিতি ঘটনার আবর্তনে সেনাবাহিনী প্রধানের ভূমিকায় আসেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান (বীর উত্তম)।
বাংলাদেশের চলার পথ বাঁক নিলো এক অন্য মহাসড়কে!
স্বাধীনতা একি তবে নষ্ট জন্ম?
মূলত দেখা যায় এ পর্যন্ত বাংলাদেশে যাবতীয় সামরিক পদক্ষেপ পরিচালিত হয়েছে মুজিব বিরোধীতায় কিংবা আওয়ামী অপশাসনে। ফলে নিজেদের কোন বিকল্প কাঠামো না থাকায় এবং একই সাথে শুধু মাত্র একটি ব্যক্তি বা দলের বিরোধীতা করেই সামনে আগানোর ফলে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয় তা পূরণ করা যায় নি এতো সহজে। সবাই চেয়েছিলো নিজ নিজ স্বার্থ। সেদিক বিবেচনায় জিয়াউর রহমান চেয়েছিলো নিজের সর্বময় ক্ষমতা। তাকে যিনি উদ্ধার করতে ভূমিকা রেখেছেন তাঁকেই তিনি ঝুলিয়ে দিলেন ফাঁসিতে। অগণিত সৈনিক প্রহসনের কাঠগড়ায় দাঁড়ালো। মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপটি সরে যেতে লাগলো ক্ষমতার ফালক্রাম থেকে। জিয়াউর রহমান নিজের স্বার্থেই তাদের একঘরে করে দিলেন। আওয়ামী বিরোধীতা এবং ভারত-জুজু শুধু দেশেই নয় বরং পুরো ক্যান্টনমেন্টে তৈরি করলো আদর্শিক শুণ্যতা। আর সে শূণ্যতা পূরণ করতে এগিয়ে এলো পাকিস্তানি মনোভাব। এরশাদের মত নিকৃষ্ট অফিসার উঠতে লাগলো ক্ষমতার শীর্ষচূড়ায়।
বলে রাখা ভালো দেশ মাত্র সদ্য স্বাধীন। সেখানে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ ছাড়া গড়ে ওঠে নি কোন রাজনৈতিক দল। আর যে জাসব জিয়াকে সামনে রেখে রাষ্ট্র দখলে মত্ত ছিলো সুচতুর জিয়া তাদের করে দেন নিশ্চিহ্ন। প্রকৃতি তার নিয়মে শূণ্যতা পছন্দ করে না। ফলে রাজনৈতিক দল গঠন করা অপরিহার্য হয়ে উঠলো। উল্লেখ্য্, দেশে তখন আওয়ামী ও ভারত বিরোধীতার ঢল। একেই জিয়া কাজে লাগালেন। এবার রণাংগনের বীর সেনানী শুরু করলেন স্বাধীনতা-বিরোধীদের ক্ষমতার কেন্দ্রে আনা। সেসব সর্বত্র সুবিদিত। কাজেই সে বিবরণে আর গেলাম না। তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেসব তার নজরে থাকলেও তার পর শুরু হয় তাণ্ডব।
তার মৃত্যুর পর শৃগাল এরশাদ দখল করে রাষ্ট্রক্ষমতা। ক্ষমতা সুসংহতকরণের স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করেন তিনি ট্রাম্প কার্ড হিসেবে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করে তিনি দেশের মানুষকে বুঝিয়ে দেন তিনি একজন “ইসলাম-বান্ধব” নেতা। ফলে মানুষ হলো বিভ্রান্ত। তাছাড়া অধিকাংশ সেনাসদস্যের মধ্যেও ধর্মীয় মনোভাব ছিলো প্রকট। ফলে নিজের পেশাগত কর্তব্যের পাশাপাশি ধর্মকে একত্র করে ফেলাতে সামরিক বাহিনী হারায় তার ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র। আর ভারত-বিরোধী শূণ্যতা পূরন করে নেয় পাকিস্তানি মনোভাব!
এদিকে জামায়াতে ইসলামী নামক বিষবৃক্ষ শুরু করে তাদের ডালপালা বিস্তার। সুকৌশলে ছড়িয়ে যায় সমাজের প্রতিটি স্তরে। গড়ে তোলে তাদের স্বকীয় সার্কেল। সমাজ, অর্থনীতি, ব্যবসা, শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে ছড়িয়ে দিতে থাকে তাদের আদর্শ। ফলে মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী এই দলটি এখন বাংলাদেশের একটি বিরাট অংশের জনসমর্থনভোগী। একটি স্বাধীন দেশের জন্য লজার এর চেয়ে আর কি হতে পারে। তার চেয়ে বড় লজ্জার যখন মুক্তিযুদ্ধের দল আওয়ামী লীগ একে নিয়ে রাজনীতি করে। বিতর্কযোগ্য বিষয় কোনটি সবচেয়ে বড় নৈতিকতার স্খলন?
আর সেই জামায়াতে ইসলামী যেটি কিনা যুগে যুগে মানুষকে বিভ্রান্ত করে চলেছে সুকৌশলে তার দায়ভারও কি এ “সেনা-দশক” নিবে না।
কাজেই একটি প্রশ্ন সামনে চলে আসে, “স্বাধীনতা একি তবে নষ্ট জন্ম?”
চলবে...........................
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুন, ২০১৫ বিকাল ৫:৫৪