কবি বলেছেন, “আমারে তুমি অশেষ করেছো এমনি লীলা তব; ফুরায়ে গেলে আবার ভরেছ জীবন নব নব”। জ্বি হ্যাঁ, কবিগুরু অতি অবশ্যই বাংলাদেশের সমস্যার কথাই এখানে বলেছেন। রবীন্দ্রনাথের এহেন দূরদৃষ্টিতে মুগ্ধ হয়ে কোন শান্তিনিকেতন-ফেরত “রবীন্দ্রনাথের অন্তর্দৃষ্টি ও বাংলাদেশের রাজনীতি” শীর্ষক কোন রচনা এখনো কেন লিখেননি তা নিয়ে গবেষণা হতেই পারে। তা হোক, তাতে কোন আপত্তি নেই। আমি সামান্য “কী-বোর্ড শ্রমিক”। তাতে নিয়মমাফিক না পিষলে পোষায় না। আর তাছাড়া জাতে বাঙালি তো, তাই সমস্যা বিবরণে কোন ক্লান্তি নেই। আমি অনেকটা সেই খাঁজকাটা কুমিরের গল্পের কথকের মতোই। যা-ই বলি না কেন কথা খালি ঘুরে-ফিরে শিক্ষা, সৃজনশীল...ব্লা...ব্লা...ব্লা...এসবেই ঘুরপাক খায়।
অতএব, খাঁজকাটা শুরু করি।
বাংলাদেশে যারা রাজনীতি নিয়ে একটু-আধটু খবর-টবর রাখেন তাদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় একটা মতামত দেখা যায়। মতামতটা আপাতদৃষ্টিতে খুবই সরল। সেটা হলো, আমরা যে দুই নায়িকার কবলে পড়েছি তাতে আসলে দোষটা আমাদেরই। জনগণের ভাষা খুবই সরল, তাদের ভাষায় বললে, “আমরা মাথায় উঠতে না দিলে তারা মাথায় উঠে ক্যামনে”? খুবই হক কথা। মাথা পেতে দেবো আর তাতে কাঁঠাল নিয়ে রাজনীতিবিদরা উঠবেন না তা তো হয় না। কাজেই দোষটা তাদের না, দোষটা আমাদের। আমরা পুড়ছি আমাদের দোষে, আমরা মরছি আমাদের দোষে। কথাটা তো ঠিকই। ভোট দেয়ার সময় তো খালি ধানের শীষ আর নৌকা। আমি নিজেও একথা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি।
প্রথমত, বাংলাদেশে রয়েছে এক অদ্ভুত প্রগতিশীল আন্দোলন। [আমি তাদের প্রকারভেদ কিংবা এত শাখা-প্রশাখার কারণ তেমন গভীরভাবে জানি না; অবশ্য তাদের প্রগতি চেতনার এত শাখা প্রশাখা যে তার আড়ালে গাছই ঢাকা পড়ে!]। তারা অবশ্য বাঁশ এবং কুপি ব্যবসায়ীদের টিকিয়ে রাখার মহান দায়িত্বে অবতীর্ণ। কারণ প্রতিদিন মশাল মিছিল করতে যে এসব অপরিহার্য। আবার তারা সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার পণ্য ফেসবুকের চেতনায় উজ্জীবিত! রাস্তায় ওয়াল দেখলেই তারা চিকা মেরে দেয়। “রামপাল বাঁচাও”, “শিক্ষা বাঁচাও”, “তেল-গ্যাস রক্ষা করো”। তারা শুধু মানুষকে করতে বলে। নিজেরা করে না কিছুই! এক আজব। অবশ্য তাদের আরো Comical কাজকর্ম আছে। তারা নিয়মিত কবিতা পড়ে, গান গায়, গণসংগীত গায়। গান গেয়ে, নেচে নেচে, ফুলের মধু খেয়ে তারা দেশ উদ্ধার করতে চায়। আবার তাদের সাপোর্টাররা আরেক আজব চিজ। তাদের চিন্তাধারার মানুষদের চিন্তাধারা অন্য জগতের। মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যায় তা নিয়ে তাদের মাথা-ব্যাথা নেই, জিডিপি স্লো যাচ্ছে- মাথা ব্যাথা নেই, শিক্ষার নামে কমেডি চলছে-মাথা ব্যাথা নেই, সাম্প্রদায়িক শক্তি ডালপালা মেলে- মাথাব্যাথা নেই। তাদের মাথাব্যাথা হলো, বাংলাদেশে কেনো মানুষ রাস্তাঘাটে চুমু খেতে পারে না টাইপের। কেউ একজন একটু ধর্ম নিয়ে(বিশেষত ইসলাম) বললেই রাজাকার ট্যাগ। সাথে তো ম্যা ম্যা আছেই। ভাবখানা এমন “কী-বোর্ডে পাওয়া দেশ হাতছাড়া হতে দিবো না”। কথা নাই বার্তা নাই- গান কবিতা নিয়ে নেমে যাবে মাঠে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোন কমেডি নাটক কেউ দেখেছে বলে আমি জানি না। সাথে তো নিজেদের মধ্যে মারামারি-কাটাকাটি আছেই।
গ্রামের মানুষ সুধীন্দ্রনাথ দত্ত কিংবা প্রেমেন্দ্র মিত্র চেনে না, তারা দু’বেলা খেতে চায়। গণসংগীত তাদের তৃষ্ণা মেটায় না, মশাল মিছিল তাদের জীবিকার নিশ্চয়তা দেয় না। কাজেই এসব ফাজলেমি দেখে কষে থাপ্পড় মারার প্রবল ইচ্ছা জাগে।
আর বাংলাদেশের মর্দে-মুজাহিদদের নিয়ে কোন কথা হবে না!
এবং অতঃপর দুই নায়িকা! তাদের নিয়েও কোন কথা হবে না।
কিন্তু কেনো? এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে খুবই সরল। হয়তো অদ্ভুতুড়ে। আর সেটা হলো, ক্লাসে পড়া হয় না; তাই বাংলাদেশে এতো ঝামেলা। ব্যাখ্যা অবশ্যই প্রয়োজন; কাজেই ব্যাখ্যায় আসছি।
একজন ছাত্রের পুরো দিনের কার্যতালিকায় প্রথমেই একটা বিরাট অংশ দখল করে থাকে তার স্কুল-কলেজ। প্রায় ৫-৭ ঘণ্টার মত সময় তার ক্যাম্পাসে কাটে। বলাই বাহুল্য, এ সময় সে নিয়মানুযায়ী পাঠ্যকার্যক্রমে অংশ নেয়। এরপর তার বিকেলে হয়তো কোচিং বা এই টাইপের কিছু, তারপর বাসায় আসে প্রায় সন্ধ্যায়। আবার বাসায় হয়তো অন্যআরেকজন টিউটর। তারপর হয়তো ধর্মীয় শিক্ষা বা এইজন্য হুজুর। তারপর হয়তো সে বাসায় নিজে কিছু করে বা পড়ে। আমি একেবারে মূলধারার ছাত্র হিসেবে খুব কাছ থেকে এই নিয়মই দেখে আসছি। তারপর ঘুম এবং লুপ কন্টিনিউজ। কলেজ ছাত্রদের কথা বলাই বাহুল্য। তাদের ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি, ম্যাথ(ইদানীং বাংলা, ইংলিশও) সবেরই কোচিং করতে হয়। অতএব, মাত্রাটা কি ধরতে পারছেন পাঠক??
কাজেই দেখছি সে আসলে চাইলেও খেলা-ধূলা করার সময়টুকু পায় না কিংবা বাবা-মা’রও এই ব্যাপারে আগ্রহ যদি কম বলে ধরেও নিই সেক্ষেত্রে কোন এক্সট্রা-কারিকুলার কাজেও যুক্ত হওয়ার সুযোগ নেই। আর হলেও তাতে কাঠ কিংবা খড় কোনোটাই কম পুড়াতে হয় না। তার জীবন পাঠ্যবইয়েই সীমাবদ্ধ। দুইটা “আউট-বই” পড়া, একটা ভালো মুভি দেখা, নিউজপেপার পড়ে চিন্তা করা, নিজের একটা মতামত গড়ে তোলা, কিংবা ব্লগসাইটে ঘোরাঘুরি করা- সেসব আর হয়ে ওঠে না।ফলে তার মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। পুরো বিশ্বের কাছে সে অপরিচিত মানুষ হয়ে থেকে যায়। অন্তরাত্মা বড় হতে পারে না, ভিতরটা আলোকিত হতে পারে না- ফলশ্রুতিতে তার বয়স বাড়লেও মনের বয়সটি আর বাড়ে না। কারণ তার দার্শনিক সত্তা তখনও ঘুমন্ত, সে তখন ভুল আর ঠিককে আলাদা করে চিনতে পারে না, যুক্তি দিয়ে কোন কিছুকে বিচার করতে পারে না, বিশ্বে কোথায় কি হচ্ছে, ইতিহাসে কখন কি হয়েছে, কে কেমন- অর্থাৎ পাঠ্যবইয়ের বাইরের জগতটা তার কাছে অপরিচিত থেকে যায়। যার কারণে সে যখন বড় হয় এবং বাইরের পৃথিবীর সাথে আর তাল মিলাতে পারে না তখন তার অন্তরাত্মা যার বিকাশ সাধিত হয় নি, যার ফল পরিপক্ব হয় নি, যার মন পরিপূর্ণ হয়ে নিজের কাছেই উপভোগ্য হয় নি- সে চারপাশকে অন্ধের মত বিচার করে। ফলে শিক্ষিত মানুষ তাকে আমরা বললেও, তার সার্টিফিকেট তাকে “গোল্ডেন-বয়” হিসেবে পরিচিত করালেও সে রয়ে যায় অন্ধকারে। আর এ মানসিক দৈন্যতার সুযোগ নেয় উগ্রবাদী দল কিংবা মৌলবাদী, চরমপন্থী সংগঠন। আর বাংলাদেশের দুই স্রোতাবহ নদীতে মিশে কেউ এইভাগে কিংবা কেউ ওইভাগে পড়ে যায়। আর ঠিক এভাবেই সে প্রকৃত অর্থে দেশের উন্নয়ন, আর্থ-সামাজিক খাত এসব নিয়ে ভাবেই না। কারণ সে তো আর ঐভাবে বড় হয় নি! তাই প্রজন্মের পর প্রজন্ম যায় কিন্তু মানসিক দীনতার এই সুযোগে দুই দল চেপে বসে আমাদের ঘাড়ে এবং আমরাও তাদের নিয়ে দিব্যি ঘুড়ে বেড়াই। কারণ আমাদের মধ্যে কোন “শিক্ষিত” সিভিল সোসাইটি গড়ে ওঠে না, কোন দার্শনিক পরিপক্ব মন গড়ে ওঠে না। ফলে আন্দোলন, সমাজ-ব্যবস্থা, রাজনৈতিক অধিকার আদায়- এইসব হয়ে থাকে সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের সংজ্ঞা।
তাহলে উত্তরণের উপায় কি? খেয়াল করলে দেখবো, একজন শিক্ষার্থী যখন কোচিং এ ছুটছে তখন বুঝে নিতে হয় তার কোন কিছু পড়তে কিংবা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে। তাই তার আরেকটি বিকল্প কিছু দরকার। তার মানে কি দাঁড়ালো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জ্ঞান আদান-প্রদানের জায়গাটুকু সীমিত হয়ে আসছে? ক্লাস-নির্ভর শিক্ষা কি তাহলে যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে না? নিজের উদাহরণ দি- আমার ক্লাসে শিক্ষার্থী ১৭০ জন!! কাজেই তিনি যদি আইনস্টাইনও হন আমার মনে হয় না একজন শিক্ষক যথাযথ পাঠদান ক্লাসে করতে পারেন। এইরকম অবস্থা না হয় কলেজগুলোতে। তাহলে স্কুলগুলোর কি দশা। সেখানেও মোটামুটিভাবে ৫০-৬০ প্রতি ক্লাসে। এবার বলতে হয় শিক্ষকদের কথা। আমি আমার জীবনে শিক্ষক হিসেবে দেখি যিনি মনের দর্শনকে জাগাতে পারেন। যেমন তিনিই প্রকৃত শিক্ষক যিনি ক্লাসে নিউটনের সূত্র দিয়ে অঙ্ক করানোর চাইতে এর পিছনের কারণটা বলবেন। নিউটনের জীবন নিয়ে, তার কীর্তি নিয়ে বলবেন, স্বপ্ন দেখাবেন। আমি বলছি না টেকনিক্যাল কারণগুলোর একেবারেই দরকার নেই বরং আমাদের দেশে এই টেকনিক্যাল কারনগুলোকেই যখন একমাত্র করা হয় সেটাই হয়ে দাঁড়ায় সমস্যা। আর শিক্ষক-অবস্থার কথা বলে নিজেকে ছোট মুখে বড় কথা বলতে চাই না। যদিও লিখলে অনেক কিছুই লেখা যায়।
ফলে কি হয়? ছাত্রকে ছুটতে হয় কোচিং এ... যেখানে একটি সুশৃংখল এবং সুস্থ শিক্ষার পরিবেশ একজন শিক্ষার্থীর এ মানসিক এবং শারীরিক ভোগান্তি এবং কোচিং ব্যবসা, গাইড ব্যবসা সব সমস্যার সমাধান করতে পারে সেখানে এতো গভীর থেকে ভাবার সময় কিংবা এমন কোন “র্যা ডিক্যাল” চিন্তা-ধারার মানুষ কি বাংলাদেশে আছেন? আমার জানা নেই। আর উপরি হিসেবে “আজাইরা” সমস্যার উদ্ভব হয়- প্রশ্নফাঁস, বছরে বছরে কারিকুলাম চেইঞ্জ, পলিটিক্যাল টারময়ল। যাবো কই? ফলে শিক্ষা নিয়ে যারা চিন্তা করেন তাদের আসলে এই “হাবিজাবি”গুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। আমূল পরিবর্তনের কথা আর তাদের মাথায় আসে না। ফলে আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থাও থোড়-বড়ি-খাড়া আর খাড়া-বড়ি-থোড় হয়ে থাকে। আর সেই প্রোসেসিং থেকে আমরা যারা বের হই তারা বের হই শিশুসুলভ এবং বাচ্চা-মানসিকতার মন নিয়ে। যার কারণে কোনো সামাজিক প্রেক্ষাপটে থাকে না আমাদের বৃহত্তর অংশগ্রহণ, থাকে না সমাজ নিয়ে কিংবা সিস্টেম নিয়ে কোন মতামত। ফলে নদী খালি একই ছন্দে, একই লয়ে বয়ে যায়। আর তা থেকেই চলতে থাকে “রাজনৈতিক নষ্টামি”।
কাজেই মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন, নূরলদীন কি আদৌ ডাক দিবে না?