আজকে ফাইনাল। যথারীতি ঘুম থেকে উঠে দেখলাম স্বপ্নীল ভাই নাই।
আমরা অবশ্য সেদিন ঘুম থেকে দেরি করেই উঠলাম। প্রায় ১১ টা। সকালের খাওয়া-দাওয়া করতাম সাধারণত ডেইরি গেইটের বাইরের দোকানগুলোতে। তবে সেদিন কেন জানি ডেইরি গেট পর্যন্ত যাওয়ার কোন ইচ্ছা ছিলো না। অতএব, বটতলায় যাওয়া স্থির হলো। এদিকে মাহিন আর সৌম্যের টানাটানি করে অবস্থা এতোই খারাপ যে পকেটে তাদের ফুটা পয়সা ছাড়া আর কিছুই নাই। কাজেই দায়ভার আমি গ্রহণ করলাম।
এদিকে দুপুর হই হই করছে। প্রায় ১২ টা। অতএব, ভাত খাওয়াই ঠিক করলাম। কিন্তু কি খাওয়া যায়- মাছ নাকি মাংস- এই বিতর্কে আমি মাংসের পক্ষে ভোট দিলাম তবে তার আগে অবশ্যই গ্যাস্ট্রিক নিয়ে কচকচাইলাম। এবং মাংসে দেখি এত্তগুলা তেল।
খাওয়ার পর হাতের অবস্থা হইসে দেখার মত। এরই মধ্যে মানসিবের চলে আসার কথা। সে জানালো ক্যাম্পাসে। তার আবার ভাই-বেরাদরদের সাথে “কানেকশান” ভালো। ওখানেই কার সাথে জানি দেখা হয়ে গেলো। অতএব আসতে আসতে তার দেরিই হলো। খাওয়া-দাওয়া প্রায় শেষ; এরই মধ্যে দেখি মিফতাহ ভাই বটতলায়। মিফতাহ ভাই ইস্পাহানী স্কুলের ডিবেটার ছিলেন। এখন পড়ছেন এআইইউবিতে। তিনি অবশ্য ক্লাবের হয়ে এবারে ডিবেট করেন নাই। খালি ঘুরতে এসেছেন। আমরা তাকে দেখে খুব খুশি হলাম।
এরই মধ্যে মানসিব চলে এল। আমরা আরেক দোকানে চা খেতে বসলাম। চা খেতে খেতে বেশ অনেকক্ষণ আড্ডা দিলাম। ঠিক সে জায়গায় যেখানে আমি আর মাহিন এক রাতের ৪ টা বাজে চা-নাস্তা করেছিলাম। সকালের নাস্তা হিসেবে না; রাতের পাগলামি হিসেবে!
সে যাই হোক, আমরা সবাই অন্য আরেক রাস্তা ধরে অনেকক্ষণ হাঁটলাম। কিভাবে কিভাবে যেন ডেইরি গেট পৌঁছে গেলাম। তারপর এরকম করতে করতে অনেকক্ষণ হয়ে গেল। আমি, নাদিয়া আপু, মানসিব, সৌম্য, মাহিন চারজনই সেই টিএসসিতে গেলাম। উদ্দেশ্যহীন ভাবেই অবশ্য। তবে গিয়ে টেবিল টেনিস নিয়ে লাগলাম। নাদিয়া আপু অসাধারণ খেলোয়াড়!! টেবিল টেনিস খেলতে গিয়ে তার মধ্যে ক্রিকেটীয় চেতনা জেগে উঠলো। তিনি বল কোর্টের বাইরে মারতে লাগলেন। বল খালি বাইরে পাঠায় দেয়!!
আর মানসিব, সৌম্য, মাহিন কোথায় জানি গেলো। রুমে আমি আর নাদিয়া আপু রয়ে গেলাম সাথে। ওহ! তার আগেই আমরা টিএসসিতে জুডোর দুইটীমের ডিবেট দেখলাম। ডিবেট দেখে আমরা চারমূর্তি ঘোষণা দিলাম, “এই ডিবেট দেখার পর WUDCর কোন ডিবেট আমাদের গায়ে লাগবে না”। জুডোকে আমরা অবিসংবাদী শ্রেষ্ঠ ক্লাব হিসেবে ঘোষণা দিয়ে দিলাম!
স্বপ্নীল ভাইরা হেরে গেলো অবশ্য। তাতে কোন দুঃখ নাই কারণ এরকম ডিবেট করা তো করাই দেখাও সাত জনমের ভাগ্য।
আগের কথায় ফিরে আসি। এরই মধ্যে আমাদের টপিক দিয়ে টসও হয়ে গেলো। আমরা হেরে গেলাম। টপিক শুনে অবশ্য হতাশ হলাম। তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে ডিবেট। আমাদের জ্ঞান শূন্যের কোঠায়। বাই দ্য ওয়ে, অপোজিশনে সেন্ট গ্রেগরি’স স্কুল। তারা আমাদের এক বছরের জুনিয়র তবে এরই মধ্যে তাদের সংজ্ঞায়ণের “কুখ্যাতি” ছড়িয়ে গিয়েছে পুরো টুর্নামেন্টে। আমকে জাম বলতে তাদের কোন জুড়ি নাই। আমরা পড়লাম টেনশানে। আমরা চারমূর্তি টিএসসির সামনের আঙ্গিনায় আশ্রয় নিলাম। কোনভাবে কিছু মিলাতে পারি না। লজিকে ফাঁক থেকেই যাচ্ছে। যা নিয়েই চিন্তা করি না কেন ভালো অ্যান্টি লজিক থেকে যাচ্ছে। ধরতে পারলে হেরে যাবো। এই যখন অবস্থা তখন আমাদের ডাক পড়লো।
এ ফাঁকে বলে রাখা ভালো যেদিন জাবিতে পৌঁছাই সেদিনই আমি “সেলীম আল দীন মুক্তিমঞ্চ”র প্রেমে পরে যাই। আমি নাটকের ফাঁক-ফোকড় বুঝি না। কিভাবে কি হয় তাও জানি না। সত্যি বলতে কি- গল্প, উপন্যাস, কবিতা, এমনকি গীতিনাট্য পর্যন্ত পড়লেও নাটকটা কেন জানি আমি খুব একটা আগ্রহ নিয়ে পড়ি নাই। তবে এটুকু জানি এই মুক্তমঞ্চ জাতির এক শ্রেষ্ঠ সন্তানের নামে। যে সন্তান একাই বাংলাদেশের নাটকের প্রতিমূর্তি। এসব ব্যাপারে আমার সেন্টিমেন্ট একটু বেশিই কাজ করে। সেদিনই আমি ঘোষণা দিয়েছিলাম মুক্তমঞ্চে ডিবেট করার জন্য হলেও ফাইনালে উঠতে হবে।
আর এখন অবস্থা দেখে যা মনে হচ্ছে এই মুক্তিমঞ্চে ডিবেট হেরে মুক্তমঞ্চের কাছ থেকে ছ্যাঁকা খাবো। মন খারাপ হয়ে গেলো। তবে মুক্তমঞ্চে গিয়ে বেশ পোজ-টোজ দিয়ে ছবি তুললাম। আফসোস হলো, প্রায় দুই-তিন হাজারের মত ছবির কিছুই আমাদের হাতে নেই কারণ ছবিগুলো ছিলো আমার আর মাহিনের কাছে এবং দুইজনেরই উইন্ডোজ সেটাপে সব চলে গিয়েছে। এই দুঃখ যে আমি কোথায় রাখি?!
তারপর স্বপ্নীল ভাইকে ধরলাম তার সাথে ছবি তুলার জন্য। তবে ভাইয়া অনেক বিজি। তবুও তাকে ধরে-বেঁধে ছবি তুলে ফেললাম। তারপর আর কি!! ফাইনাল শুরু।
তাদের ডেফিনেশন ছিলো অনেকটা আজগুবি যেটা আসলে আমাদের জন্য ভালই ছিলো। সেটা এস্টাবলিশ করার আগেই তারা কাউন্টার অ্যাটাকে হেরে গেলো এবং বিনয়ের সাথে জানাচ্ছি আমরা ডিবেট জিতে গেলাম। অবশ্য ডিবেট শেষ হওয়ার আগেই আমরা মোটামুটি সিওর ছিলাম যে ডিবেটটা জিততে যাচ্ছি।
তারপর ভার্সিটি ডিবেটের ফাইনাল। নর্থ-সাউথ ভার্সেস জুডো। টপিক মোস্টলি মেটফর টাইপের ছিলো। রাহাত ভাই পিএম। আমরা উনার ওপেনিং শুনে পুরা থ। ওব্বাপ!! বিশেষ করে আমি পুরা তব্দা। এরকম অমানুষিক ডিবেট কেমনে করে। তারপর মুশফিক ভাইয়ের এক্সপ্লেনেশানে পুরা ডিবেট এস্টাব্লিশ। তবে নর্থ-সাউথও ভালোই জবাব দিচ্ছিলো। তারপর সীমান্ত ভাইয়ের স্পীচ। এখানে বলি রাখি আমাদের সেমি-ফাইনালে ভাইয়া যখন জাজ ছিলো তখন তার এক্সপ্লেনেশানে মুগ্ধ হয়ে আমরা সেদিন থেকেই তার গুণমুগ্ধ ভক্ত। এদিকে সীমান্ত ভাই স্পীচ শুনে দ্বিতীয়বারের মত আমরা টাশকি খেলাম। পুরো ডিবেটে “জুডো, জুডো” করে চিৎকার করে গেলাম।
এরই মধ্যে অনুষ্ঠানে তথ্য-প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী আসলেন বক্তব্য দিতে। তার কথা শুনে আমরা হতবাক! অসাধারণ লেভেলের স্মার্ট মন্ত্রী। বাংলাদেশের সরকারী সেক্টরে এরকম স্মার্ট মন্ত্রী আছে আমাদের ধারণাতেই ছিলো না। মনে মনে তাকে শ্রদ্ধা না করে পারলাম না।
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান আমার জন্য স্পেশাল ছিলো। নাদিয়া আপু পুরো সময় গলা ফাটায়ে গেলেন। বলে রাখা গেলো তার বন্ধু-বান্ধব সবাই চলে গেলেও তিনি আমাদের জন্যই থেকে গেলেন। এরপর আর কি!! জাবির ক্যাফেটেরিয়ার উপরের তলায় গ্র্যান্ড ডিনার। আমরা খেতে বসলাম। বেশ মজা করেই খাওয়া-দাওয়া হলো। এত্তগুলা প্রাইজ আমাদের সবার!! ট্রফিটা জাবির শহীদ মিনারের আদলে বানানো। আমরা ট্রফি দেখে যারপরনাই খুশি। কিছুক্ষণ পর পর এহাত ওহাত করি। মাহিন ট্রফির উপর দাবি করে বসলো। আমরাও তার দাবির যৌক্তিকতায় রাজি হলাম। যদিও ট্রফি শেষমেশ আমি বাসায় নিয়ে আসি!!
যা হোক, তারপর বের হয়ে হলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়াবো আমি আর নাদিয়া আপু ঠিক তখনই কুকুরের পাল্লায় পরে বেশ কিছুক্ষণ কমেডি করলাম দুইজন। ইচ্ছা ছিলো তারপর শহীদ মিনারে অনেকক্ষণ থাকবো। আমি আর নাদিয়া আপু মোস্ট প্রব্যাবলি বাংলা ডিপার্টমেন্টে বসে ছিলাম বাকিদের আসার জন্য। এদিকে আমরা অনেকগুলা ট্রফি নিয়ে বসে আছি খালি পায়ে। আহা! সেই রাত!!
তারপর নাদিয়া আপু চলে গেলো; অবশ্য তারও আগে আমি কাপড়-চোপড় পালটিয়ে আবার শহীদ মিনারে আসলাম। এসে সবার সাথে দেখা হলো। মাহিনের হাতে একশ টাকা ধরায় দিলাম ফান্টা নিয়ে আসার জন্য। কারণ টানার জিনিস আনতে তাদের বাইরে যাওয়ার কথা। এদিকে আবার মানসিব সিদ্ধান্ত নিলো আজকে সে আমাদের সাথে ক্যাম্পাসে থাকবে। এতোদিন সে ঢাকা থেকে যাওয়া-আসা করতো।
আমি শহীব মিনারে অনেকক্ষণ আকাশের তার গুণে কাটিয়ে দিলাম। এদিকে তাদের দেখা নাই। দেখলাম বেশ কয়েকজন পাঙ্ক টাইপের ভাইয়া হইহুল্লোড় করে কাটিয়ে দিলো; আমি আর থাকতে সাহস করলাম না। হলে এসে ঘুমিয়ে পড়লাম। সারাদিন প্রচুর ধকল গেছে। আর শরীর টানতে পারলাম না। ঘুমিয়ে গেলাম। উল্লেখ করার মত ব্যাপার হলো আমি আমার চ্যাপস্টিক শহীদ মিনারে ফেলে আসি এবং দশ ঘণ্টা কাটায়ে যখন তারা আমাকে খুঁজতে আসে তখন সেই চ্যাপস্টিক আমার পুণ্য স্মৃতির(?) উদ্দেশ্যে তারা নিয়ে আসে। পরে মাহিন আমাকে জানায় আমার একশ টাকার শ্রাদ্ধ হয়েছিলো তাদের জিনিসপত্র কেনায়। মেজাজ যথেষ্ট খারাপ হলো।
পরে শুনলাম মানসিব ভোর ছয়টায় ঢাকা চলে যায় আর তারা এসে শোয় ৬ টার দিকে। আমরা ঘুম থেকে উঠলাম ১১ টায়। তার আগেই স্বপ্নীল ভাই এক জরুরী কাজে সায়েদাবাদ চলে গিয়েছে সকালেই। যাবার সময় আর দেখা হলো না তার সাথে। অবশ্য আসার আগে আমরা স্বপ্নীল ভাইকে একটা চিঠি লিখি আসি।
“আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনি
লীলা তব
শুকায়ে গেলে আবার ভরেছ জীবন
নব নব”।
পঞ্চম পর্ব