তার আগের দিনই আমাদের দল ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। আমাদের ফতোয়াবাজ কবি ভাই, টেলি মুজাহিদ আর শহিদুল পৌঁছে গেছে চিটাগাং। তবে মাহিনের ভাব-সাব সবসময়ই আলাদা। সে আমাদের সাথে থেকে গেলো। উদ্দেশ্য জাহাঙ্গীরনগরের সৌন্দর্য উপভোগ করা নাকি তার গুরু সৌম্যের সাথে টানাটানি করা তা নিয়ে কোনই সন্দেহ নাই! কাজেই হলে আমরা এখন তিন মাস্কেটিয়ার্স।
রাত প্রায় ১২ টা। আমরা খাওয়ার পর রুমের সেই ব্যালকনিতে; আমি আধশোয়া, মাহিন কুঁজো হয়ে বসা আর সৌম্য পেশাদারী কায়দায় ফেসবুকে ব্যস্ত। হঠাৎ সৌম্য কি এক কাজে হলে ঢুকলো আর আমি আর মাহিন গুরুতর আলোচনায় বসলাম। বিষয়বস্তু মানব-মানবীর ভালোবাসা। আমি এব্যাপারে অত্যন্ত নিরামিষ তবে আমার থিওরি বেশ সোজাসাপ্টা। আর মাহিনকে ঝাড়া এক ঘণ্টার মত আমি আমার তত্ত্ব গিলালাম। ইট ওয়াস রিয়ালি লাইক প্রাচীন গ্রীক ঠিক যেন সক্রেটিস তার শিষ্যদের তত্ত্ব দিচ্ছেন। তবে মাহিনের কথা আলাদা। সে খুব ভালো শ্রোতা তবে অবশ্যই ভালো শিষ্য নয়। কারণ জীবন বিষয়ে তারই আলাদা থিওরি আছে। তবে আমি কথার মানুষ। তাকে থিওরি শুনিয়েই ছাড়লাম। এরই মধ্যে সৌম্য চলে আসলো। সেও আমার থিওরির আংশিক অনুসারী!! অতএব, দুইজন মিলে মাহিনকে আলোর পথে আনার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালালাম! ঠিক কেন জানি না, আমাদের থিওরির ঠ্যালতেই হয়তো তার ২ টা বাজার আগেই ঘুম পেয়ে গেলো। আমরা তাকে ঘুমানোর সুযোগ দিলাম
সে চলে গেলে আমরা দুইজন ঠিক করলাম আজকে আমাদের একদিন কি ক্যাম্পাসের একদিন। তন্দ্রা-বিলাসের মায়া কাটিয়ে আমরা জেগে রইলাম। সাথে কিছু ঝিঁ ঝিঁ পোকা আর তাদের গুঞ্জন। আর বুনো ফুলের গোত্রহীন সৌরভ। এদিকে স্বপ্নীল ভাইয়াকে বললাম আমরা ঘাটের বেশি দূর যাবো না। ভাইয়া আমরা ঘুম থেকে উঠার আগেই বের হয় আর বাসায় রাত্রে আসে বিধ্বস্ত হয়ে। তাই আর ঘাঁটালেন না। আমরা সারারাত নানা পোকা-মাকড়ের মাঝে জেগে রইলাম। প্রায় ভোরের দিকে ঠিক করলাম অনেক্ষণ বসে থাকা হলো আর এবার না হয় একটু হাঁটা যাক। হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে এলাম।
ওহ! বলাই হলো না যে, পরদিন বারোয়ারী বিতর্কের একটা প্রোগ্রাম আছে। আমার ঢাকার দিয়ে যাওয়ার কোন ইচ্ছা ছিলো না। আর তাছাড়া আসার সময় যেহেতু বাসার অনেক প্রেশার ছিলো তাই ইচ্ছা ছিলো ট্রফি একটা এক্সট্রা নিয়ে যাওয়া। তাই বারোয়ারী করার প্রিপারেশান ছিলো। জাবি আসার আগেই জুনায়েদ ভাইকে ফোন করে এ নিয়ে আমি বেশ কাহিনী করেছিলাম। অতএব, আমি ডিটারমাইন্ড যে করবো। সৌম্যের করার ইন্টেনশান ছিলো না কারণ “ঋণ শোধ করুন” প্রকল্পের অংশ হিসেবে তার ঢাকায় এক ভাইয়ার সাথে দেখা করার কথা। এদিকে আমি কেন করছি তারও মাথায় ভূত চাপলো সেও বারোয়ারী করবে। অবশ্য তার যুক্তি ফেলে দেয়ার মতো না, “আসছি যখন, একটা প্রাইজ পেলে ক্ষতি কি”। আমি সায় দিলাম। টপিক আগের দিনই দেয়া ছিলো, “আমি তোমাকেই বলে দিবো”। সে হঠাৎ আমাকে বললো, “সঞ্জীব চৌধুরীর গানটা ছাড়তো”। আমি গান ছাড়লাম। ভোরবেলার রোদ অনেকটা লাজুক মেয়ে। মুখ ফাটে তো বুক ফাটে না টাইপের; আমরা একলা পিচঢালা রাস্তায়; সঞ্জীব চৌধুরীর মোহময় কণ্ঠ, “আমি তোমাকেই বলে দিব...ছুঁয়ে কান্নার রঙ, ছুঁয়ে জোছনার ছায়া”।
অনেক্ষণ আইডিয়া ঘাঁটাঘাঁটি করলাম। লাভ হলো না। কোনটাই মনপূতঃ হয় না। প্রায় ৬ টা বাজে ঘড়িতে। এরই মধ্যে তার মানসিবকে ফোন করা জরুরি হয়ে পড়লো। কিন্তু তিন ফোনের একটাতে ব্যালেন্স নাই, একটাতে চার্জ নাই আর আরেকটাতে নেটওয়ার্ক নাই। ফলে তার আর “জরুরি” ফোন করা হয়ে উঠলো না।
আমরা ঘুমাতে গেলাম। সকাল নয়টায় ঘুম ভাংলো। আমরা কোনমতে রেডি হলাম। এর মধ্যে মানসিব ফোন দিলো তাদের কাজের জন্য। আজকে দুপুরে তাদের ক্যাপ্টেন আমেরিকা দেখার কথা সিনেপ্লেক্সে। এদিকে মানসিবকে জানানো হয় নি যে প্রোগ্রাম চেঞ্জ করেছে। তার সাথে কথা-বার্তা শেষ হলো। আমরা পাগলের মত বের হলাম। কারণ টাইম দেয়া তারও আগে। এবারে আর নাস্তা করলাম না।
মিলনায়তনে বসে আছি। এই সেই করতে করতে ১১ টা মনে হয়। তারপর বলা হল টিএসসিতে ডিবেট হবে। আমরা টিএসসিতে গেলাম। প্রতিযোগী খুব একটা বেশি না। ১২-১৫ জন। সবার কথা-বার্তা শুনলাম। অত্যন্ত বিনয়ের সাথে জানাচ্ছি আমি ফার্স্ট আর সৌম্য সেকেন্ড হলো। আমাদের মিশন সফল। এরই মধ্যে আমিও ঢাকার দিকে যাবো। মহাখালী হয়ে বাড্ডা। আর তারা নামবে ফার্মগেট। যেহেতু ক্যাম্পাসে কেউ নাই কাজেই মাহিনও আমাদের সাথে যাবে। আমরা ভার্সিটির বাস ধরার জন্য দৌড় দিলাম। কিন্তু শুনলাম বাস নাকি ২ টায়। কাজেই বাইরের বিআরটিসি’র জন্য ডেইরি গেট দিয়ে বের হলাম।
*****************************************
খালামণির বাসায় গেলাম। অনেক দিন শান্তিমত ঘুম হয় নাহ। এক ঘুমে পুরো দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা কাবার করে দিলাম। তারপর সে, আমি আর হীরা মামা মানে খালুসহ একটা সিনেমা দেখলাম; সিনেমা দেখা খুব একটা উল্লেখ করার মত ঘটনা না। তবে এটা উল্লেখ করার মত কারণ এই সিনেমা আমার সবচেয়ে প্রিয় সিনেমাগুলোর একটা যেটা নিয়ে পরে আমি রিভিউও লিখি। “গিফটেড হ্যান্ডস”। বস্তাপচা হলিউডি সিনেমার বাইরে এধরণের ফিল্ম আমার সবচেয়ে পছন্দের। আমার স্বভাব-চরিত্র তার ভালোই জানা। অতএব, সিনেমা দেখে ঘুমালাম। বেশ রাত হয়ে গেল।
তার পরদিন শুক্রবার। আমার ক্যাম্পাসে ব্যাক করার কথা। কিন্তু লিঙ্কন ভাই নামের এক ভাইয়ার সাথে দেখা করার কথা। ভাইয়া থাকেন মহাখালী। খালামণির কথামত নসিমনে উঠে দেখি আমাকে মহাখালী ফেলে আরো নিয়ে আসছে। এ ধরণের পরিস্থিতে আমার একটা থিওরি আছে। সেটা হলো “হন্টন থিওরি”। অতএব, ব্র্যাক সেন্টারের উদ্দেশ্যে হাঁটা দিলাম। অনেক্ষণ হাঁটার পর অবশেষে দেখা মিললো। ভাইয়া হয়তো কোন একটা কাজে ব্যস্ত ছিলেন তাই আসতে আসতে দেরি হলো। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। পরে দেখা হলো।
যাবার সময় ভাইয়া তিতুমীর কলেজ পর্যন্ত এগিয়ে দিতে আসলেন। সেখান থেকেই বাসে উঠলাম। কানে ইয়ারফোন গুঁজে দিলাম, “একবার বল নেই তোর কেউ নেই; কেউ নেই”... আসলে মধ্যদুপুরে জুম্মার সময়ে কোন মানুষজন নাই- এ টাইপের গান ফীল আনার মত। বাই দ্য ওয়ে বলে রাখা ভালো, এই গানটা আমার জাহাঙ্গীরনগরের থিম সং।(এই ফাঁকে আমার স্বভাব একটু বলে রাখা ভালো। আমি কোন নতুন জায়গায় গেলে দেখা যায় বিশেষ কিছু গান ছাড়া আর তেমন কিছুই কানে লাগে না। পরে স্মৃতিচারণ টাইপের ব্যাপার আসলে সেসব গান আমার কানে বাজতে থাকে। অটিস্টিক ব্যাপার-স্যাপার!!)।
পৌঁছলাম জাবি। ডেইরি গেট দিয়ে আবারও ঢুকে দেখলাম পরিচিত কেউ নাই। কারণ সৌম্য, মাহিনরা এখনো পৌঁছায় নাই। আজকে নাদিয়া আপুদের মানে চিটাগাং থেকে প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির আসার কথা। এদিকে নাদিয়া আপু ফোন ধরে নাহ। ডেস্কে খবর নিয়ে জানলাম প্রিমিয়ারের ডিবেট সোশ্যালজি ডিপার্টমেন্টে। গিয়ে দেখলাম শুভাশীষ ভাই, তানভীর ভাই ভিতরে শুয়ে আছে আর আনিস ভাই আর তুর্য ভাই বাইরে দাঁড়িয়ে। পরে নাদিয়া আপুর দেখা পেলাম। গ্রীন ইউনিভার্সিটির সাথে ডিবেট। নাদিয়া আপুরা জিতে গেল। আমরা মিলনায়তনের দিকে গেলাম।
এরই মধ্যে সৌম্যরা ক্যাম্পাসে ব্যাক করলো। নাদিয়া আপুদের আরেকটা ডিবেট। এবার বোধহয় মানারাতের সাথে। দ্য বেস্ট পার্ট- উনারা ডিবেট বানানোর সময় আমি তাদের সাথে ছিলাম আর মাঝে মাঝে তন্ময় ভাইকে মেসেজ করে লজিক পাঠাচ্ছিলাম!!
উনারা এই ডিবেটেও জিতলো। এরপর প্রায় সন্ধ্যা। কিভাবে কিভাবে যেন সময় কেটে গেল। সন্ধ্যায় আবারো ডিবেট। এটাতে আমি ছিলাম না। এটাতেও তারা জিতলো। এদিকে মানারাতের সাথে আরেক ডিবেটে প্রিমিয়ার-১ হেরে গেলো। পরে আমি, সৌম্য, নাদিয়া আপু, মাহিন একসাথে ঘুরতে ঘুরতে কোথায় যে চলে আসলাম নিজেরাও জানি না। মানুষজন আমাদের খুঁজে হয়রান। এরই মধ্যে নাদিয়া আপুর কাছ থেকে আমি বিরাট শক খেলাম। নিজ চোখে দেখার পরও বিশ্বাস করি নাই পরে ধাক্কা খাওয়ারটা ঠিকই খেলাম!!!!(কি নিয়ে হক তা জাতিকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করছি না!)
সে যাই হোক, আমরা অনেকক্ষণ আড্ডা দিলাম। রাত হয়ে আসলো। আমরা হলের উদ্দেশ্যে হাঁটা দিলাম। প্রায় রাত। মেহেদী ভাই কার সাথে যেন সাইকেল নিয়ে টানাটানি করতেসিলো আমরা দেখে হাসতে হাসতে শেষ। (খুব ছোটোখাটো ব্যাপার আমি লিখে রাখছি খুব ইচ্ছা করে কারণ মাথায় যা আসছে তা যদি লিখে রেখে দিই পরে পড়ে দেখতে যেন ভিজুয়ালাইজ করতে সুবিধা হয়!)
আমরা শহীদ মিনারে গেলাম। কিন্তু আফসোস! রাত বারোটা বেজে যাওয়ায় মৌসুমী আপু নাদিয়া আপুকে নিয়ে দৌড়ানি দিলো। সবাই মিলে আই মীন, সব ভার্সিটির সবাই প্লাস সব অর্গানাইজাররা খেতে গিয়ে দেখলাম দোকান সব বন্ধ! পরে কৌশিক আজাদ ভাই খাওয়া কম দেখে আমাদের আগে আগে বসায়া দিলো। এবং আমরা খাওয়া শেষ করে উঠলাম। পরে মাহিন আর সৌম্য “কিছু” কিনতে গিয়ে দেখলাম হাওয়া। পরে অনেকক্ষণ বসে থাকলাম। এদিকে স্বপ্নীল ভাই টেনশানে অস্থির। আমি স্বপ্নীল ভাইকে নিয়ে হলে গেলাম।
এদিকে সৌম্য আর মাহিন বটতলায় কাউকে না পেয়ে হলে ফেরত গেলো। আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম।
******************[এই তারকাচিহ্নিত অংশে আমাদের ট্যুরের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডির মুখোমুখি হই আমরা। সে বিষয়ে একটা লাইনও আমি লিখি নি। সুখস্মৃতি হিসেবে যখন লিখতে বসেছি তখন দুঃখ- বিলাস শোভা পায় না। তাছাড়া অন্ধকারের নায়কদের আলোয় আনতে হয় না। তাদের আলোয় আনা পাপ। তাদের নিয়ে লেখার কথা চিন্তা করা আরো বড় পাপ।]
“আমি এ প্রাণের রুদ্ধ দ্বারে
ব্যাকুল কর হানি বারে বারে,
দেওয়া হল না যে আপনারে
এই ব্যথা মনে লাগে
চতুর্থ পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:৪৪