সেমি-ফাইনালে উঠলাম। মনের মধ্যে শান্তি টাইপের অনুভূতি। দিন শুরু হলো আগের দিনগুলোর মতোই। আমরা তখন ক্যাফেটেরিয়ার কাছাকাছি। আম্মু ফোন দিলো। জানালো সরকারী সৃজনশীল প্রতিযোগিতা টাইপের দেয়ার জন্য আমি যেন এখনই রওনা দিয়ে দিই। মাথা খারাপ হওয়ার যোগাড়!! বলে কি এইসব! সেমি-ফাইনালে টীম আর আমি নাকি এখন সবাইকে ছেড়ে দিয়ে সৃজনশীলতা দেখাতে যাবো। বুঝানোর অনেক চেষ্টা করলাম। কিছুতেই কিছু বুঝে না।
এরই মধ্যে ঘুরাফেরা করতে গিয়ে সবাই দেখলাম অনুপম ভাই মুক্তমঞ্চে বসে আছে। অত্যন্ত উচ্চমার্গীয় হাসি দিয়ে তিনি জানালেন তার টীমমেটরা পুরনো স্কুলের বন্ধুদের সাথে। তবে আমরা এসে গেলাম। অতঃপর তিনিও তার পুরনো স্কুলের জুনিয়রদের সাথে। মানসিব আর তাকে বিশেষ আলোচনার সুযোগ দিয়ে আমরা কেটে পড়লাম। অবশেষে আমি ফোন দিলাম শাহেদ স্যারকে। স্যারের সাথে কথা বলে জানা গেল প্রোগ্রাম পিছানো হয়েছে। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পুরো ক্যাম্পাসকে সুবাতাসে ভরিয়ে দিলাম!
কলেজ ডিবেটের ড্র। এর মধ্যেই শুনলাম ঢাকার সাকিব ভাই নাকি আমাকে খুঁজছেন। সৌম্যের কাছ থেকে এই খবর পেয়ে আমি নিজেও তাকে খোঁজা শুরু করলাম। ভাইয়াকে তার আগে কখনোই দেখি নাই। হঠাৎ করে দেখি সুপারম্যানের টি-শার্ট পরা একট ভাইয়া, “আররে রিয়াসাত” বলে কোলাকুলি করে ফেললেন। আমি বুঝে গেলাম ইনিই সেই সাকিব ভাই!! ভাইয়া ইন্টার পরীক্ষার মধ্যেও ঢুঁ মারতে এসেছেন।
এরই মধ্যে কলেজ ডিবেটের ড্র হয়ে গিয়েছে। আমি পূর্বপরিকল্পনামত অনুপম ভাইয়াদের ডিবেট দেখার জন্য গেলাম। রাজুকের সাথে ঢাকা কমার্স কলেজের ডিবেট। যথারীতি অত্যন্ত উচ্চমার্গীয় ট্রেডমার্ক অনুযায়ি সংজ্ঞায়ণ করলেন এবং হেরে গেলেন। সে যাই হোক তার পর সবাই মিলে আবারো ক্যাফেটেরিয়ার সামনের ছাতার নিচে বসলাম। এভাবে রাজা-উজির মারতে মারতে সময় যে কখন চলেই গেল। এরই মধ্যেই জানলাম আমাদের সেমি ফাইনালের ব্যাপারে প্রেপ টাইমের ঘোষণা হয়ে গেলো। আবারো পুরনো আলাপী। মতিঝিল মডেল হাই স্কুল। তারা গভর্নমেন্টে। তাদের সংজ্ঞায়ণ জ্বালানী মানে ইন্ডিয়ান সিরিয়াল টাইপের। আমরা ভয়ের মত পেলাম। তবে শক্ত একটা ডিফেন্স বের করাতে সে টেনশান আর থাকলোই না।
এবং বাই দ্য ওয়ে, ডিবেট হচ্ছিল জাবির টিএসসি-তে। আর আমরা আবিষ্কার করে ফেললাম টেবিল-টেনিস আর ক্যারাম খেলার বোর্ড। যথারীতি ক্যারাম আর টেবিল-টেনিস নিয়ে পড়ে গেলাম। সৌম্য আবার টেবিল টেনিসে ওস্তাদ মানুষ; কাজেই একে তো তিনি ক্রেডিটবাজ আবার খেলাও পারেন অতএব তার ভাবের ঠ্যালা কিছু সামলাতেই হলো! তবে মানসিব টীম স্ট্র্যাটেজি অনুসারে বলতে লাগলো, “আমাদের যে কি অবস্থা; অপজিশন হয়েও টিটি খেলতেসি!!”। যাহোক, অপনেন্ট যাতে ভয় পায় তাই একটা মেন্টাল প্রেশার ক্রিয়েট করার উদ্দেশ্যে আমরা আরো বেশি ইনডোর স্পোর্টস স্পেশালিস্ট হয়ে গেলাম।
উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে কথাবার্তা। তাদের ট্রেডমার্ক অনুযায়ীই সংজ্ঞায়ণ পেলাম। তাদের পক্ষ থেকে জিনিসটা ছিলো তারা ধর্মীয় উন্মাদনাকে আনবে স্বাভাবিকভাবে কিন্তু কৌশলে তারা স্বার্থকেও নিয়ে আসলো কিন্তু চতুরতার অভাবের জন্যই হোক কিংবা সময়ের অভাবেই হোক জিনিসটাকে ঠিক প্যাঁচ লাগাতে পারে নাই। যথারীতি আমরা স্বার্থ নিয়ে আসলাম এবং জাজরাও ব্যাপারটা ধরতে পারলেন। তবে আমার দিক থেকে আমি সরাসরি অপোজ করার কিছু কথা বলে ফেলি এবং কিছু বার্ডেন অফ প্রুফ চাপিয়ে দিই যেগুলা রিবাটেড হয় নাই দেখে জিতে গেলাম।(যদিও হারার সম্ভাবনা ছিলো পুরোপুরি)।
[ডিবেটীয় কচকচানীর জন্য দুঃখিত। কিন্তু বিতং করে বললাম কারণ...ইয়ে...মানে...]
তারপর ডিবেট শেষের দিকে খাওয়াদাওয়া শেষে বিকেলের দিকে আমরা গিয়ে দেখলাম মিলনায়তনের সামনের দিকে টি-শার্টের ছোটখাট মেলা টাইপের বসেছে। জিনিসগুলো তো ভালোই তার উপর দামও ডিসকাউন্ট রেটের। কাজেই আমরা সবাই টি-শার্ট গুলোর জন্য আহা-উঁহু করলাম কিছুক্ষণ।
তারপর যথারীতি রওনা দিলাম ভাসানী হলের দিকে। শহীদ মিনার ধরে এগুনোর আগেই কে জানি জাবির সেই বিলের কথা বললো আর আমাদের মনে হলো সেদিকে একটু ঢুঁ মারা যায়। এরই মধ্যে আমরা মানে আমি, সৌম্য, মাহিন আর মানসিব সিএসডিএস নিয়ে গভীর আলোচনায় মেতে উঠলাম। বলে রাখা ভালো সিএসডিএস(CSDS)মানে কলেজিয়েট স্কুল ডিবেটিং সোসাইটি(Collegiate School Debating Society). আমাদের স্কুলের বিতর্ক ক্লাব। সেই ক্লাবের কিছু সাবস্টিটিউট টীম দরকার। নাম ঠিক হলো- অনিকেত, আরণ্যক আর কি একটা জানি। (যদিও সে নামের টীমের এখন কোন অস্তিত্বই নাই!!)। তারপরের বিষয়বস্তু আরো গুরুতর। টীম কিভাবে সেটাপ হবে তা নিয়ে কারণ তারপরে ঢাকায় আইডিয়াল স্কুলের ফেস্ট, আমাদেরই স্কুলের পায়োনিয়ার নামের আরেকটা অর্গানাইজেশানের ফেস্ট। যা হয় আর কি, একই স্কুলে দুইটা ক্লাব; সোজা কথায় রাইভালরি!! ওইটাতে টীম যাবে কি যাবে না। এইসব। শেষমেশ সন্ধ্যা নামলো। আমরা আবার হাঁটা শুরু করলাম। কৈশোরে এরকম সন্ধ্যা ছাড়া একদল কিশোরের আর কি-ই বা চাওয়ার থাকতে পারে!
প্রায় সন্ধ্যার দিকে আমরা বটতলায় এসে পৌঁছলাম। পাঠক, বটতলার কথা মনে আছে নিশ্চয়! সেই খাওয়ার জায়গা। অবশ্য শুধু খাওয়ার জায়গা বলে ঘোরতর অন্যায় করেছি কারণ জায়াগটাতে আরো বিশেষ কিছু আছে বলেই আমার ধারণা। স্পেশাল কিছু একটা।
আমরা চায়ের অর্ডার দিলাম। যথারীতি আমি আবারো ফান্টা খুঁজে ব্যর্থ হলাম। কিন্তু চা হাতে নিয়ে আবারো আলোচনায় বসলাম কিভাবে আমাদের ক্লাবকে স্কুলের মধ্যে ভালো একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায় টাইপের হাবিজাবি। মাঝখানে আমি হলের দিকে চলে গেলাম আর মানসিব, সৌম্য আর মাহিন আবার জহির রায়হান মিলনায়তনের দিকে গেলো নটরডেমের সাথে মোস্ট প্রোব্যাবলি ঢাকা কলেজের ডিবেট দেখতে।
গিয়ে দেখলাম রুমে কেউই নাই। আবার শহীদ মিনার ক্রস করে যাওয়ার মত তেলও গায়ে ছিলো নাহ। অতএব সামনের বাঁধানো পুকুর পাড়ে বসলাম। বাই দ্য ওয়ে, মাহিনকে বললাম ডিবেট শেষ করে চলে আসতে। এদিকে আমি বসলাম ফোন নিয়ে যে কাকে কাকে ফোন করা যায়। মে বি ফোন দিলাম তকবির ভাইকে তারপর নাদিয়া আপুকে। নাদিয়া আপুর সাথে কথা বলতে বলতেই জানলাম তিনি তার পরদিন রাতেই রওনা দিবেন ঢাকার উদ্দেশ্যে।
তারপর যথারীতি রাত হলো। স্বপ্নীল ভাই আমাদের নিয়ে চললেন বটতলায়। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আমরা পাশের আরেক দোকানে চা খাওয়ার জন্য বসলাম আর সেখানেই ঘটলো আমাদের ট্যুরের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা।
স্বপ্নীল ভাই, আমি, মাহিন আর সৌম্য বসে আছি একটা বেঞ্চে। ফিবা আপু কার্ড নিয়ে নাড়াচাড়া করতেসিলো পাশে। আর আমাদের বেঞ্চে মেহেদী ভাই আর একজন ভাইয়া সাথে একটা আপু।
মেহেদী ভাই সিগারেট ধরিয়ে বললেন “মাইন্ড কইরো না”। আমি মাহিন আর সৌম্যের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি দিলাম। ঠিক তারপরই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা খাইসো”? আমি প্রবলবেগে মাথা নাড়লাম, “না না ভাইয়া খাই নাই”!!! আমি ধরেই নিয়েছিলাম ভাইয়া সিগারেট খাওয়ার কথা বলছেন!! আরা আমি তো সিগারেট খাই না। সৌম্য, মাহিন আর স্বপ্নীল ভাই তিনজনই আমার দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। এরই মধ্যে ঘটনা বুঝতে পেরে আমি লজ্জায় বললাম, “না...মানে...ইয়ে...আমি মনে করসিলাম...হ্যাঁ হইসে”!!! এই জিনিস যে কি ছিলো নিজ চোখে না দেখলে বোঝানো কষ্ট।
হঠাৎ ফেস্টের লোগো নিয়ে কথা হচ্ছিলো আর এমন সময় সৌম্য বললো, “ব্যানারে রুচি জাতীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতা জিনিসটাকে রুচিহীন বানায় ফেলসে”। আমি যোগ করলাম, “তবে স্লোগানটা জটিল হইসে”। স্লোগানটা ছিলো, “যুক্তি আমার তরুণ প্রাণে অরূণ আলোর দীপ্তি”। আমি আগে থেকেই জানতাম স্লোগানটা দিয়েছিলেন কৌশিক আজাদ প্রণয় নামের এক ভাইয়া। আমি স্বপ্নীল ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা, কৌশিক আজাদ প্রণয় ভাইয়া কে?” স্বপ্নীল ভাই মুচকি হাসি দিয়ে পাশের ভাইয়াটাকে বলে, “রিয়াসাত আমারে জিজ্ঞেস করতেসে কৌশিক আজাদ প্রণয় ভাইয়াটা কে?” তখনই পাশের ভাইয়া তার চেয়ে আরো সুন্দরভাবে মুচকি হেসে হাত নেড়ে জানিয়ে দিলো যে তিনি-ই কৌশিক আজাদ ভাইয়া!! আমার লজ্জার সীমা রইলো না।
পরে জানলাম সাথে রেহনুমা আপুর বাড়ি/ বাসা চিটাগাং। তিনি হালিশহরে থাকতেন। দুইজনই এত্তগুলা ফ্রেন্ডলি আমরা মুহূর্তেই তাদের বিরাট ভক্ত হয়ে গেলাম। সৌম্য উক্তি করলো, “মানুষ ক্যামনে এত্ত জোস হয়!” আমি আর মাহিন দুইজনই মাথা নেড়ে মানুষ যে এরকম জোস হয় না তার সাক্ষ্য দিয়ে দিলাম।
সেদিন রাতে বেশি ঘুরাঘুরি তেমন একটা হয় নাই। সৌম্য ব্যালকনির ধারে কতক্ষণ আমার ফোন নিয়ে টানাটানি করে ফেসবুক চালায় ঘুমাতে গেলো। আমি আর মাহিন জেগে ছিলাম বেশ অনেক্ষণ। তারপর ঘুমাতে গেলাম।
অতঃপর রুম নাম্বার ১৪৫ এর আরেকটি পর্বের সমাপ্তি ঘটলো।
“এই লভিনু সঙ্গ তব
সুন্দর হে সুন্দর”..................
তৃতীয় পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:৪৫