গণিত অলিম্পিয়াড থেকেই শুরু। তারপর নানা ধারণের প্রশংসনীয় উদ্যোগ আমরা দেখেছি এবং দেখছি। ভাষা প্রতিযোগ, ফিজিক্স অলিম্পিয়াড, কেমিস্ট্রি-বায়োকেমিস্ট্রি, আর্থ অলিম্পিয়াড, ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াড- আমাদের মতো ছাত্রদের খেলার ছলে কিংবা উৎসবের ছলে এসব বিষয় জানানো, উৎসাহ গড়ে তোলা, দক্ষ করে তোলা। আসলে আমরা সৃজনশীল বাংলাদেশ কিংবা তারুণ্যের প্রাণোচ্ছলে ভরপুর বাংলাদেশের যে স্বপ্ন দেখি অহরহ তারই বাস্তব তুলির আঁচড় এই অনুষ্ঠানগুলো।
সে যাই হোক, বেশ কয়েকবছর ধরে আমরা আরো দুটি এরকম অনুষ্ঠান দেখে আসছি- ইন্টারনেট উৎসব আর ডেইলি স্টার-এইচ এস বি সি জুনিয়র ক্লাইমেট চ্যাম্পিয়নশিপ। দুটোর কথা আলাদাভাবে একারণেই বললাম কারণ আজকে এ দুইটা অনুষ্ঠানকে খানিকটা ব্যবচ্ছেদ করে দেখা আমার উদ্দেশ্য। আমি ঠিক জানি না আমি কোন প্রশ্নটি করতে যাচ্ছি- উৎসব দুইটি অকার্যকর নাকি উৎসব দুইটি আদতে লোক-দেখানোর ফাঁকে দিয়ে বিজ্ঞাপণ। আমাদের এই পুঁজিবাদী সমাজে পণ্যের আজ এতই রমরমা দশা(?) যে বিজ্ঞাপণ শব্দটা শুনলেই কেমন যেন অসততার গন্ধ পেয়ে বসে।
শুরুতেই “প্রথম আলো- গ্রামীণফোন ইন্টারনেট উৎসব”। তাদের ইচ্ছা সবার মাঝে ইন্টারনেট ছড়িয়ে দেয়া টাইপ। সেই বহু দূরের নরওয়ে দেশ পাড়ি দিয়ে তারা আমাদের এই অজপাড়া গাঁয়ে(?) ইন্টারনেট বিলি করতে এসে গেছে এদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখতে। “Advertisement is a legalized lying”- কথাটা জেনেও না বলে শান্তি পাচ্ছিলাম না। যাই হোক, এখন দেখা যাক অনুষ্ঠানের ধরণটা কেমন। (নিজে অংশগ্রহণ করেছি কাজেই ভুল-ভ্রান্তি না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।) শুরুতেই একটা বিশেষ বুথে চারজন করে প্রতিযোগী ঢুকিয়ে চারটি ট্যাবে পৃথকভাবে ৪-৫ টি প্রশ্ন থাকে যেসব প্রশ্ন করা না করা সমান। এরই মধ্যে যে যত তাড়াতাড়ি উত্তর দিতে পারবে এরকম করে ৫০ জনকে বেছে নেয়া হয়। তারপর সে ৫০ জনকে নিয়ে অপেরা মিনি দিয়ে ব্রাউজ করা শিখানো হয়!!! আর তারপর স্টেজে ৭-৮ জনের গ্রুপ করে যেকোন একটি প্রশ্ন করা হয় যেখানে অংশগ্রহণকারীদের গুগল ঘেঁটে উত্তর দিতে হয়। যে যত তাড়াতাড়ি “ব্রাউজ” করতে পারবে সেই বিজয়ী। অর্থাৎ, জানলেই চলবে না- অপেরা মিনি ব্রাউজ করে জানতে হবে!!! অদ্ভুত নিয়মই বটে!!
আর ঠিক এই ব্রাউজিং করার খেলাটিকে তারা রং-টং চড়িয়ে বিজয়ীকে “আই-জিনিয়াস” নাম দিয়ে দেয়, প্রথম আলোতে দুই পাতার বিশেষ পৃষ্ঠা করা হয়, “আই-মাস্টার” নামের আলাদা কলামে ব্লগ নাম দিয়ে “ব্রাউজিং” শিখানো হয়। দেখে হয়তো মনে হতে পারে- না জানি কি হাতি-ঘোড়া কি শিখিয়ে ফেলছে!! আদতে এই ব্রাউজিং (শুধু অপেরা মিনি দিয়ে) শিখানোকেই তারা উৎসব নাম দিয়ে এই ক্রমাগত ভন্ডামি করে যাচ্ছে। উদ্দেশ্য আরো কিছু গ্রাহক বানানো, অপেরা মিনির আরো প্রসার, তাদের নেটওয়ার্কের প্রচার। অনেকে হয়তো বলতে পারেন আমি শহুরে এলাকায় থাকি তাই জানি- প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ জানে না। তবে তারা সেসব অঞ্চলেই তাদের এফর্ট দিতো কিংবা ইন্টারনেট প্রসারের আরো কত ডাইমেনশান আছে সেসবে কাজ করুক। কিন্তু না! তারা খালি মোবাইল ইন্টারনেট নিয়েই কাজ করবে; কারণ মোবাইল ইন্টারনেট না হলে যে তাদের পকেট ভরে না!! এক্ষেত্রে খুব চটকদার একটি যুক্তি আছে, “কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিজের লাভ অবশ্যই দেখবে; তারা তো আর দাতব্য প্রতিষ্ঠান নয়”। এখানে ব্যাপারটি হলো তাদের এ কার্যক্রমের যে উদ্দেশ্য সেটিই প্রশ্নবিদ্ধ; কারণ যেসব তরুণ বড় হচ্ছে তাদের মাথায় ইন্টারনেটের বিশাল জগতকে “মোবাইল ইন্টারনেট, অপেরা মিনি আর গ্রামীণফোনে” সীমাবদ্ধ করে দেয়া হচ্ছে কারণ আর কয়েকদিন পরেই তারা ভোক্তা অর্থাৎ গ্রাহকে পরিণত হবে। ভবিষ্যৎ বাজার ধরার কি এক অনুপম দৃষ্টান্ত!!! অন্য অনেক ক্ষেত্রেও কর্পোরেট ফার্মগুলো স্পন্সর করে তবে সেখানে এরকম মাছ ঢাকা হয় না; নিজেদের বিজ্ঞাপণের পাশাপাশি শিখার কিংবা সৃজনশীলতার কিছু জায়গা থাকে। এরকম নির্লজ্জভাবে না। প্রশ্নটা বিজ্ঞাপণের সীমা অতিক্রমের; তরুণ সমাজের সাথে ক্রমাগত “মাত্রাতিরিক্ত ”ভন্ডামির; আবারো বলছি “মাত্রাতিরিক্ত ভন্ডামির”।
এবার জুনিয়র ক্লাইমেট চ্যাম্পিয়নশিপ নিয়ে। কারো জানা বাকি নেই যে আসলে বর্তমানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু যেটা কিনা আমাদের অস্তিত্বের সমার্থক সেটি অতি অবশ্যই জলবায়ু। কোন সন্দেহই নেই। আর এ জলবায়ুর সাথে সংশ্লিষ্ট পরিবেশ, এনার্জি কনজার্ভেশন, গ্রিন টেকনোলজি, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স, মিটিওরলজিক্যাল সায়েন্স এসব। মোটামুটি এসব ব্যাপারে ঝাপসা জ্ঞান থাকলে এবং সেসব মেনে চলার সদিচ্ছা থাকলেই যে কেউ-ই পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ, কার্বন ফুটপ্রিন্ট জিনিসটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কার্বন ফুটপ্রিন্ট হলো সোজা কথায় গড় বা মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণের মাত্রা। সেক্ষেত্রে কেউ যদি নিজে থেকে উদ্যোগী হয়ে এব্যাপারে সচেতন হয় তাহলে শক্তি সংরক্ষণ অনেকহারে বৃদ্ধি পাবে আর পরিবেশ রক্ষায় সেটা এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত হতে পারে।
আর ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে এ নিয়ে সচেতন করতে শুরু হয়েছিলো জুনিয়র ক্লাইমেট চ্যাম্পিয়নশিপ। এপর্যায়ে অনুষ্ঠান নিয়ে কিছু বলা যাক। তিনটি ভাগ থাকেঃ প্রথমটি হলো কুইজ, দ্বিতীয়টি উপস্থিত বক্তৃতা আর সর্বশেষ সংযোজন বিজ্ঞান প্রজেক্ট। আসলে কুইজের মতো বিষয়ে নির্দিষ্ট কোন সিলেবাস না থাকায়(সিলেবাসের কথা বলছি এ কারণে যে, মাধ্যমিক পর্যায়ে আমাদের দেশে এ ব্যাপারে কোন সঠিক গাইডলাইন নেই যাতে করে আমরা সঠিক রেফারেন্স পেতে পারি। ফলে একেবারে আমাদের অন্ধকার থেকে শুরু করতে হয় কিংবা অন্ধের মতো ইন্টারনেটে হাতড়ে বেড়াতে হয়; ফলে তাতে কোন ফললাভ হয় না।)জ্ঞানের ছিটেফোঁটাও এতে অর্জিত হয় না কারণ অসীম সাগরে পানি ঘেঁটে আর কতই বা মুক্তো বের করা যায়?!? এরপর আসা যাক উপস্থিত বক্তৃতা নিয়ে। আসলে এই বক্তৃতার মাধ্যমে কতোটুকু পরিবেশ রক্ষা হচ্ছে আমার ঠিক জানা নেই। কারণ এ ধরণের প্রতিযোগীতায় প্রতিযোগীর সর্বাধিক মনোযোগ থাকে বাকশৈলীতে কিংবা কথার মাধুর্য বাড়ানোতে। ফলে জানা-শোনার সুযোগ সেখানে একেবারেই কম। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় একজন বক্তৃতার আগে আমাকে এসে জিজ্ঞেস করেছিলো “ভাইয়া, গ্রীন হাউস গ্যাস মানে কি?”। আমি তার প্রশ্ন শুনে হতভম্ভ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম!! (হতভম্ভ হওয়াই উচিত!!) আর পরে শুনেছি সে উপস্থিত বক্তৃতায় নির্বাচিত হয়ে ঢাকা যাওয়ার জন্য সিলেক্টেড হয়েছে। এরপর তাকে জুনিয়র ক্লাইমেট চ্যম্পিয়ন বলে ডাকা হবে অথচ যে কিনা “গ্রীন হাউস গ্যাস” নিয়েই জানে না!!! এরকম উদাহরণ আরো অনেক। ফলে এই এক্সটেম্পোর স্পিচ একধরণের তামাশায় পরিণত হচ্ছে!! কোন কিছু ছাড়াই প্যাটপ্যাট করা যাকে আমি “বাচলামি” বলে থাকি!! আর বিজ্ঞান প্রজেক্ট নিয়ে বলার কিছু নেই। এ ধরণের প্রজেক্টগুলোতে যদি ভালো কিছু থেকে থাকে তবে সেটাকে আরো অধিক গবেষণা কিংবা আরো সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সেটাকে ইমপ্লিমেন্ট করার ব্যবস্থা যেন রাখা হয় যেন আমাদের সবুজ মন সবুজ পরিবেশ নির্মাণে ভূমিকা রাখে। নতুবা এধরণের বিজ্ঞান প্রজেক্ট কোনভাবেই পরিবেশ রক্ষায় অবদান তো রাখতেই পারবে না বরং ভবিষ্যৎ বিপর্যয়ে ব্যর্থতার দায়ভার একটু বেশিই নিতে হবে। অতএব, সাধু সাবধান!!
এমন কোন উদ্যোগ সেটা যত সাদামাটাই হোক না কেন যেটাতে মানুষ লাইট জ্বালিয়ে রাখতে দু’বার ভাববে, পানির ট্যাপ বন্ধ করতে নিজেই উদ্যোগী হবে, গ্যাসের অপচয় করবে না- সে আয়োজনই কাম্য। আর তাতেই পরিবেশ যতোটা উপকৃত হবে ততোটা কুইজে ৩০/৩০ পেয়ে হবে না কিংবা উপস্থিত বক্তৃতা দিয়েও হবে না। অতএব, জাগো, বাহে কোনঠে সবাই!!!!
পুনশ্চঃ কেউ যেন ভেবে না বসেন “আঙ্গুর ফল টক” দেখেই হাবিজাবি বকলাম। আঙ্গুর ফল আমার জন্য যথেষ্ট মিষ্টি-ই ছিলো!!!!