তবে শুরু করা যাকঃ
ইয়ে...মানে...ভালো লাগে...তাই করি...আসলে...না...হুম...
এসবই হচ্ছে যখন কেউ বিতর্ক নিয়ে জিজ্ঞেস করে তখনকার উত্তর। তবে বেশ অনেকদিন ধরেই বিতর্ক করে আসার ফলে(সত্যি বলতে চেষ্টা করার ফলে) একটা দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে জিনিসটা নিয়ে। তাই অস্বীকার করার কোন জো নেই যে ইয়ে, মানে, হুম- এসব খুবই লেইম উত্তর।
শুরুতেই বলে রাখা ভালো বিতর্ক একটা “টুল”; এর বেশি কিছুই না। আবার বলি এর বেশি একটুও না! আমরা গান করি, আবৃত্তি করি, খেলাধূলা করি, নাচ করি- ঠিক তেমনি বিতর্ক করি। তবে অন্যান্য কো-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিস এর সাথে এর পার্থক্য হলো এটা একটা প্যাকেজ যা থেকে তুমি অনেক কিছুই একই সাথে লাভ করতে পারো। এটা তোমার কথা বলার জড়তা কাটাবে, সবার সামনে নিজেকে উপস্থাপন করার ভীতি কমাবে, তোমার উপস্থাপনাকে সাবলীল করবে, তোমার সুন্দর করে কথা বলার দক্ষতা বৃদ্ধি করবে এবং যারা সত্যিকারের বিতর্ক চর্চা করে কিংবা করতে চায় তাদের “আউট-নলেজ” বিকাশে সহায়তা করে, তাদের যুক্তিকে কিংবা লজিক-সেন্স যাকে আমরা বলি সেটাকে নিয়মিত চর্চার মধ্যে রাখবে, তাৎক্ষণিকভাবে যেকোন সমস্যাকে মোকাবিলা করা শিখাবে এবং তোমাকে প্রত্যুৎপন্নমতি করে তুলবে। অর্থাৎ খুবই লাইফ ওরিয়েন্টেড একটা জিনিস; যেটা অন্য অ্যাক্টিভিটিসগুলোতে হয়তো এভাবে পাওয়া যাবে না। কাজেই এতো সুবিধা যেখান থেকে পাওয়া যায় সেটাকে অস্বীকার করার নিশ্চয় কোন কারণ থাকে না! তবে যারা নিয়মিত বিতর্ক করেন তারা শুধু এতসব কিছুর জন্যেই যে করেন ব্যাপারটা ঠিক তা না; অনেকদিন কোন কিছুর সাথে জড়িত থাকার ফলে সে জিনিসের উপর একধরণের মায়া তৈরি হয় ফলে ভালোলাগা থেকেই মূলত তারা বিতর্ক করেন!
খুব ভালো করলে খেয়াল করলে দেখা যাবে কেউ যদি গান করতে চায় কিংবা নাচতে চায় তাদের মধ্যে সহজাত একটা প্রতিভা থাকতে হয় যেমন- গানের গলা ভালো থাকতে হয়, নাচের যে অনুকরণ-দক্ষতা থাকা দরকার সেটা রপ্ত করার সহজাত প্রবৃত্তি থাকতে হয়, আবৃত্তি করতে গেলে গলার স্বরে ওঠা-নামার মতো খুবই সূক্ষ্ম বিষয়ে দক্ষতা রাখতে হয়। কিন্তু বিতর্ক সত্যি কথা বলতে কি একেবারে সর্বজনীন বিষয়। মানুষ যেমন ভাত খায়, যেমন হাঁটা-চলা করে, যেমন চিন্তা করে ঠিক তেমনি বিতর্ক করতে পারে!! এক্ষেত্রে আমার খুবই প্রিয় একটা উদাহরণ আছে। উদাহরণটি একজন শ্রদ্ধেয় অগ্রজ বিতার্কিকের। তার বক্তব্য অনুসারে একজন মানুষের দিন শুরু হয় বিতর্ক দিয়ে- যেমন, ঘুম ভাঙ্গার পর সে সিদ্ধান্ত নেয় সে কি বিছানা ছেড়ে উঠবে নাকি আরো কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি দিবে। নিজে নিজে অনেক্ষণ নানা যুক্তি-প্রতিযুক্তির পরে সে সিদ্ধান্ত নেয় সে ঘুম থেকে উঠবে কি উঠবে না। খুবই মজার একটা উদাহরণ। ঠিক একইভাবে আমরা প্রতিদিন নানা বিষয় নিয়ে কথা বলি, নানা কথা বলি- সবাই কিন্তু নানা যুক্তি-তর্ক দিয়েই সিদ্ধান্তে উপনীত হই। অর্থাৎ আমরা সবাই জন্ম থেকেই একেকজন বিতার্কিক। কাজেই বিতার্কিক হতে গেলে কোন অতিরিক্ত কিছুরই দরকার পড়ে না। শুধু দরকার একটুখানি শেখার ইচ্ছা। তাতেই কেল্লা ফতে!!
এখন বিতর্কের মাত্রিক বিশ্লেষণ করা যাক! অনেক রকমের, অনেক ধরণের বিতর্ক আছে- সংসদীয় বিতর্কের মতো যেমন নতুন ধারার বিতর্ক তেমনি সনাতনী বিতর্কের মতো পুরনো ধাঁচের বিতর্ক। আবার রম্য বিতর্কের মতো যেমন মজার বিতর্ক তেমনি জাতিসংঘ বিতর্কের মতো সিরিয়াস বিতর্ক। আমার মতে কেউ যদি সত্যিকার অর্থেই একজন বিতার্কিক হত্যে চায় তাকে সব ক্ষেত্রকেই সমান চোখে এবং সমান শ্রদ্ধা দিয়ে দেখতে হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক বিতার্কিককেই চিনি যারা বিতর্কের নানা প্রকার নিয়ে হাসি-তামাশা করে, অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখে। কিন্তু সত্যিটা হলো তারা সেই ধারায় বিতর্ক করতে পারে না; যেটা তাদের ব্যর্থতা আর সেই ব্যর্থতা ঢাকবার জন্যে তারা এসব শঠতার আশ্রয় নেয়। কারণ বিতর্কের যতো প্রকারভেদই আছে সেসবই কোন না কোন প্রয়োজনে তৈরি হয়েছে এবং অতি অবশ্যই উপযোগীতা আছে বলেই তৈরি হয়েছে। অতএব বিতর্ক করতে হলে কিংবা বিতার্কিক হতে গেলে অবশ্যই সেসব দিকে নজর দিতে হবে যাতে করে একজন পূর্ণাঙ্গ বিতার্কিকের মতো সকল ক্ষেত্রেই পদচারণা রাখতে পারো। যেমন, সংসদীয় বিতর্ক তোমাকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রমাণ করতে সহায়তা করবে, আবার বারোয়ারী বিতর্ক তোমার সৃজনশীলতা বিকাশে এবং নান্দনিক উপস্থাপনায় সহায়তা করবে, জাতিসংঘ বিতর্ক তোমাকে বিশ্ব-নাগরিক হিসেবে প্রস্তুত করবে এবং একই সাথে রম্য বিতর্ক এক নতুন মাত্রার সূক্ষ্ম রসিকতার, তোমার সেন্স অফ হিউমার প্রমাণের সুযোগ দিবে। কাজেই, সব ধারাই কিন্তু সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। যারা জিনিসটাকে এভাবে দেখে না হয় তারা হয় অথর্ব নয়তো অর্বাচীন!!
কোমল স্বরে যখন কড়ি লাগাতে হয়ঃ
১. নিজের অভিজ্ঞতায় বিতর্ক মাঝে-মধ্যেই খুবই বিরক্তির উদ্রেক করেছে। নিজের চোখে দেখা, মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে কিছুই জানে না কিন্তু প্যালেস্টাইন-ইজরায়েল নিয়ে বিতর্ক করে যাচ্ছে অথচ কথা-বার্তা সাবলীল! কি সুন্দর উপস্থাপনা, কি সুন্দর বাচনভঙ্গী, কিন্তু মুখসর্বস্ব কথা! অনেক সময় বিতর্ক জিতেও যাচ্ছেন!! কি আশ্চর্য! পৃথিবীর কোন প্রান্তের খবরই রাখেন না কিন্তু সাবলীল বিতর্ক করছেন, বাংলাদেশের সংবিধান নিয়ে কোন ধারণাই নেই অথচ তারা কথা বলে যাচ্ছেন! সোজা কথায় তারা বিতার্কিক ট্যাগ নিয়ে কিছু ভন্ড, বাচাল, আহাম্মক! যাদের মাথায় কিছু নেই যা আছে সবই মুখে! আর মাথা ব্যবহার না করে মুখ ব্যবহার করা যে কত বড় মূর্খতা তা আর কেই-ই বা কাকে বোঝাবে! অর্থাৎ, জানার স্বল্পতা কিংবা জানতে চাওয়ার আগ্রহের স্বল্পতা খুবই বাজে একটা ব্যাপার! তার মানে এই না যে কাউকে চলন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া হতে হবে! ব্যপারটা হলো বিতার্কি হিসেবে সব কিছু নিয়েই একটা স্বচ্ছ কনসেপ্ট থাকতে হবে! আর বিতর্কের থিম কিন্তু খুবই ছোট! ঘুরেফিরে সেই সাম্প্রদায়িকতা, সংবিধান, সংস্কৃতি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্য, ধর্ম- এসবই! কাজেই ধারণা নেয়ার ইচ্ছা থাকলেই কিন্তু ধারণা নেয়া যায়। কিন্তু বাচালেরা তা করতে নারাজ। তারা খালি “স্টেজে কথার মারপ্যাঁচে মেরে দিতে চান”! এই দুঃখ যে কোথায় রাখি!
২. সংসদীয় বিশেষত বাংলায় (ইংরেজিতে হয়তো না!) প্রত্যয় নিয়ে অযথা বিতর্ক টুইস্ট করা হয়। কেউ “ই” প্রত্যয়ের সংজ্ঞা দিতে ভুলে গেল তাতেই প্রতিপক্ষ কোন কিছু না খুঁজেই এক “ই” নিয়েই বিতর্ক শেষ করে দিলো যেটা সুস্থ বিতর্ক চর্চার একটা বড় প্রতিবন্ধক কারণ সেখানে মতবিনিময়ের কিংবা যুক্তি-প্রতিযুক্তির সংঘর্ষ থাকে না, জ্ঞানের দক্ষতা যাচাইয়ের সুযোগ থাকে না। ফলে বিতর্ক আবারো সেই মুখসর্বস্ব বাচলামির জায়গা হয়ে যায় যেটা খুবই অনভিপ্রেত।
৩. মিথ্যা তথ্যের ফুলঝুড়ি তো ইদানীং কালের বিতর্কের একটা ফ্যাশন! অস্বীকার করবো না, নিজেও অনেক দিন এই ফাঁদে ছিলাম! মনে হতো যেন জেনে-শুনে মিথ্যা তথ্য দিতে পারলেই যেন বাহাদুরি!! অথচ ব্যাপারটা যে কতো বড় ভন্ডামি এবং প্রতারণা করার শামিল সেটা বুঝতে যেন ভাবী কোন বিতার্কিকেরই দেরী না হয়। এটা একটা পলিউট্যান্ট! আর সেক্ষেত্রে নিজেদেরই নৈতিকভাবেই বিশুদ্ধ থাকা উচিত যে বিতর্কে মিথ্যা তথ্য দিবো না। নিজে সচেতন না হলে এই ব্যাধি থেকে মুক্ত হওয়া যাবে না। আবারো বলছি খুব খুব খুব নিকৃষ্ট একটা কাজ!!
৪. সংজ্ঞায়ণ ন্যারো করা। এ প্রসঙ্গে অসাধারণ একটা উপদেশ শুনেছিলাম- “দরকার হলে ৫-১০ টা বিতর্ক হারো তবুও বাজে সংজ্ঞায়ণ করো না”! বেশি সত্য একটা কথা। অনেককেই দেখা বিতর্ক করতে গিয়ে সংজ্ঞায়ণ কোন কারণ ছাড়াই সম্পূর্ণ বাজে একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়া! উদাহরণ দিতে পারি- একজন বিতার্কিক “জ্বালানী”র সংজ্ঞায়ণ করেছিলেন “ইন্ডিয়ান সিরিয়াল”!! পরিবেশের সংজ্ঞায়ণ ছিলো “রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি”! বাদবাকি ডিসিশান পাঠকের যে এদেরকে কি করা যায়! তবে এক্ষেত্রে আমার ভাগ্য খুবই ভালো বলা যায়। আমার সহ-বিতার্কিকেরা যাদের সাথেই স্কুলে বিতর্ক করেছি কিংবা কলেজে করছি তারা অসাধারণ কেইস বিল্ডার। অসাধারণ!
৫. অনেককেই দেখেছি সনাতনী বিতর্ক নিয়ে নাক সিঁটকাতে যে সেখানে সুন্দর করে কোটেশান ব্যবহার করতে হয়, নাকী গলায় কথা বলতে হয়। কোটেশান ব্যবহার করার মধ্যে নাক সিঁটকানোর কি আছে? বরং এটা শিক্ষণীয় একটা বিষয় যে বিতর্কের বিষয় নিয়ে বিদগ্ধজনের বক্তব্য এতে জানা যায়, না জানলে শেখা যায়। তাতে অগৌরবের জায়গাটা কোথায়? আর সুন্দর করে কথা বলার চেয়ে বড় কথা হলো সুন্দর করে নিজের যুক্তি উপস্থাপন করা! আর সুন্দর করে কথা বলতে হলেই যে নাকী গলায় কথা বলতে হবে এমন কোন কথা আছে নাকি? স্পষ্টভাবে, সুন্দর উচ্চারণে বলা কথাই সুন্দর করে কথা বলা; তাতে নাকের কোন ভূমিকা নেই!!
৬. বর্তমানে সবচেয়ে প্রচলিত ধারার বিতর্ক হলো সংসদীয় বিতর্ক। আর আমার নিজের ধারণা অনুযায়ী পদ্ধতিটি বেশ কিছু ক্ষেত্রে বিতর্কের পরিধিকে সংকুচিত করে। সংজ্ঞায়ণ নামের এক যাঁতাকলে(হয়তো সৎ উদ্দেশ্যেই করা হয়; কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জিনিসটা বুমেরাং হয়ে যায়!) ফেলে বিরোধী দলকে ঝামেলায় ফেলে বিতর্ক সরকারী দল “জিতে” যায়! আমার মনে হয় এ ব্যাপারে কোন বিধান থাকা উচিত যে সেক্ষেত্রে পেনালাইজ করার মত কোন অপশন এতে থাকে! বিতর্ক সংশ্লিষ্টরা ভেবে দেখবেন আশা করি। এখনকার বিতর্ক কেমন জানি একটু বেশিই বৈষয়িক। ফলে কোটেশান ব্যবহার করা, উদাহরণ দেয়া, বিতর্কে পড়াশুনার একটা জায়গা থাকা অনেকাংশেই অনুপস্থিত। ফলে বিতর্ক কথা বলার জায়গাকে(আমার মতে বাচলামী করার জায়গাকে) উৎসাহিত করলেও মানসিক বিকাশকে প্রকারান্তরে অনুৎসাহিতই করছে বলা যায়।
ট্রফি-ক্রেস্ট বিতর্ক
যখন প্রথম প্রথম বিতর্ক শিখতাম(এখনও যে শিখছি না তা কিন্তু না!) তখন ভাইয়ার প্রায়ই বলতেন “শুধু ট্রফি জেতার জন্য বিতর্ক করবে না”। কথাটাকে আমি অনেকাংশেই গ্রহণ করে কিছুটা নিজের একটা ব্যাখ্যা এতে দাঁড় করিয়েছি। আমার মতে বিতর্কে ট্রফি বা ক্রেস্ট খুবই ভাইটাল কোন পয়েন্ট না হলেও কিছুটা গুরুত্বপূর্ণ বটে। কারণ এতো কিছু করে, এতো কষ্ট করে বিতর্ক করবো তাতে স্মারক কিংবা স্মৃতির কি কোনই ভূমিকাই নেই? কিংবা সাফল্য পাওয়ার কি কোনই আকাঙ্ক্ষা থাকবে না তাতে? সবারই দিনশেষে কিছু না কিছু পাওয়ার ইচ্ছা থাকে, তার জন্য চাওয়া কোনভাবেই অন্যায় হতে পারে না। তবে হ্যাঁ, তার মানে কিন্তু এই না যে যেনতেনভাবে সেটা পেতে হবে। তাতেই সর্বনাশটা বাঁধে এবং সবাই সরলীকরণ করে বলতে শুরু করে যে “ট্রফি-ক্রেস্টের জন্য বিতর্ক করবে না”। যারা খুব ছোট থেকে বিতর্ক করি তাদের এক্সট্রা-কারিকুলার যেকোন কাজেই বাবা-মা’র কিঞ্চিত অসহযোগীতা থাকে কাজেই সেক্ষেত্রে ট্রফি বা ক্রেস্ট তাদের জন্য একটা প্রবোধ কিংবা তাদের হাসিমুখ আর নিজেরও প্রাপ্তি। কাজেই ট্রফির প্রতি আকর্ষণ থাকাটা দোষের তো নয়ই অনেক ক্ষেত্রে প্রতিযোগীতার জায়গাকে অনেক বেশি জমজমাট করে তুলে!
যাই হোক ছোট মুখে অনেক কথাই বলে ফেললাম। যেহেতু বিতর্ক এবং বিতার্কিকদের নিয়ে লেখা কাজেই লেখা নিয়ে বিতর্ক থাকবে না তা কি হয় নাকি? কাজেই বিতর্ক হবে, হয়েছিলো; চলবে এবং চলেছিলো।
কাজেই বিতর্কের জয় হোক এবং বিতার্কিকদেরও জয় হোক!
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই অক্টোবর, ২০১৪ ভোর ৫:৪৫