................................................................
ছোটোগল্প: একটি গল্পের খসড়া ।। রেজা ঘটক
................................................................
সেদিন ছিল বুধবার। যেমন পরিস্কার আকাশ তেমনি ফকফকা চাঁদনি রাত। অযুত লক্ষ নিযুত কোটি তারা রাতের আকাশে দূর সন্যাসীর মতো মিটমিট করছিল। ফুরফুরে কামিনী হাওয়া আপন মনে বসন্তের আগমনী গান গাচ্ছিল- আহা আজি এ বসন্তে, কতো ফুল ফোটে, কতো পাখি গায়...। সারা দেশেই তখন কোরবানির ঈদের ছুটির আমেজ। টানা দু’দিন অনেক খাটুনির পর কোনোমতে দোতলা লঞ্চের কেবিনের সামনে গোশতের বাকশোটা রেখে পাশেই শোবার মতো করে শরীরটা এলিয়ে দিলেন খোরশেদ মিঞা। এই বয়সে এমুন মহাখাটুনি কী আর শরীরে সহে? কিন্তু উপায় নেই যে মহাকাল। কোরবানীর গোশতো তো আর হেঁটে হেঁটে আসবে না। পাঁচকুলে খোরশেদ মিঞার আর কে এমন আছে শুনি যে, বাড়িতে কোরবানীর গোশতো দিয়ে যাবে? তাই মন্টুর মা’র সাথে পরামর্শ করে কোরবানীর ঈদের একদিন আগেই খোরশেদ মিঞা ঢাকায় এসেছিলেন। ফুলির মায় গ্যাছেবার দুই পাতিল গোশতো পাইলো, মাইয়া মাইনষের এ্যাততো ঠ্যালা! মন্টুর মা, তুমি মাইয়াগো খবর দেও; মুই আইজ-ই ঢাকায় রওনা হইলাম।
এবার বেশ মনের জোর নিয়েই খোরশেদ মিঞা ঢাকায় এসেছিলেন। আর গোশতে যাতে পচন না লাগে সেজন্য মন্টুর মা যেভাবে যতো ফরমাস দিয়েছিলেন সবই অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন খোরশেদ মিঞা। আল্লাহর ইচ্ছায় গোশতোও ভালোই কুড়ানো হয়েছে। দেড় হাত বাই দুই হাত কাঠের বাকশো’র পুরোটাই এখন গোশতে ভরতি। বাকশোটা আরেকটু বড় বানালে আরো গোশতো ধরতো। কিঞ্চিত আফসোস তবু লেগে থাকে খোরশেদ মিঞার চোখেমুখে। ঢাকার মানুষে যে এভাবে সবাইরে গোশতো দেয় খোরশেদ মিঞা এখনো বিশ্বাস করতে পারেন না। গোশতের বাকশোর দিকে মাথা দিয়ে ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিয়ে নির্বাক চাঁদের অথৈ হাসি দেখতে থাকেন খোরশেদ মিঞা। এতোক্ষণে মন্টুর মায়ের নিশ্চয়ই মশলা-টশলা বাটাবাটি শেষ। কতো দিন যে মাইয়াগুলারে বাড়িতে আইনা একটু ভালোমন্দ খাওয়ানো হয় না। এইবার মাইজা জামাইরে একটা উচিত শিক্ষা দেওন যাইবো। হালার পোয় সুযোগ পাইলে খালি খাওয়ার খোটা মারে। মোর মাইয়াডা ঘরে তুইলা কয়দিন গোশতো খাইচস হারামির পো? জানি না বুঝি! চাচার ধনে পোদ্দারি মারোস? নিজের পোন্দের লুঙ্গি কোই, হারামজাদা? ব্যাটা চামার কোথাকার? এমন অনেক কথাই একসাথে উজানের মতো মনে পড়ল খোরশেদ মিঞার। লঞ্চ গলাচিপা পৌঁছালেই এসবের এবার একটা যুতসই জবাব দেওয়া যাবে বলে কিছুটা স্বস্থি তখন খোরশেদ মিঞার অন্তরে।
অথচ সাত পুরুষ ধরে খোরশেদ মিঞারা সবাই মোসলমান। আগে বাড়িতেই কতো উৎসব করেই না গোয়ালের সবচেয়ে বড় দামড়াটাকে কোরবানী দেওয়া হতো। সারা গ্রামের মানুষ কোরবানীর দিন খোরশেদ মিঞাদের বাড়িতে দাওয়াত খেতো। গোলখালী ইউনিয়নের শুধু পারডাকুয়া গ্রাম ছাড়াও গোটা গলাচিপায় তখন যে কয় ঘর ধনী গৃহস্থ বাড়ি ছিল, তাদের মধ্যে খোরশেদ মিঞার বাপ-দাদাদের নাম আসতো সবার আগে। কিন্তু সংসারে যখন মরা কাটালের আকাল লাগে তখন এভাবেই বুঝি ভাটির মতো সব শেষ হয়ে যায়। সেই যে ভাটার শুরু তা আর গত পঞ্চাশ বছরে থামেনি। আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছরের আগের কথা এখনো দিব্যি মনে আছে খোরশেদ মিঞার। তখন খোরশেদ মিঞার কতোই বা বয়স? তেরো, চৌদ্দ কী পনেরো। দাদীজান কইতো- এইবার কোরবানীর লগে মোগো রাঙাভাইরেও শোবাইয়া দিমু। ওটাই ছিল পারিবারিক ব্যবস্থাপনায় খোরশেদ মিঞাদের বাড়িতে সর্বশেষ কোরবানীর উৎসব।
দাদীর পছন্দের মেয়ে সালেহা বেগমই সেই ঈদে বউ হয়ে আসলো খোরশেদ মিঞার ঘরে। দু’বছর পর খোরশেদ মিঞা আমেনা’র বাবা হলেন। আর সালেহা বেগম হলেন আমেনার মা। তারপর পিঠাপিঠি মর্জিনা, মোমেনা, কুলসুম আর জরিনা হওয়ার পর যখন বংশে বাতি দেওনের আর কেই নেই, তখন মায় একদিন কইলো- জাত দেইখা একটা কালা মাইয়া অইলেও আন, বাপ। এই কুল পুড়ানি মাগীর প্যাটে পোলাপাইন নাই। বছর ঘুরলে দ্যাহিস আবার মাইয়া ফুটাইব। কিন্তু সালেহা যে আমার কে, এই কথা মায়রে কেমনে বুঝাই? চুপিচুপি সালেহারে নিয়া হাজির হইলাম চরমোনাইর বড় হুজুরের কাছে। আল্লাহর অসীম দয়া আর বড় হুজুরের সহি দোয়ায় পরের বছর সালেহা আবার পোয়াতি হইলো। সেই বছর চৈতমাসের কড়া গরমের সর্বনাশা কলেরায় দিন দুপুরে সবার সামনেই মা আমার ছটফট করতে করতে মরলো। আর বছর ঘুইরা কার্তিক মাসে গিয়া সালেহার কোলে আইলো মন্টু। পোড়া কপাল আমার। মায় আমার মন্টুরে দেইখা যাইতে পারলো না। হঠাৎ একমাত্র ছেলে মন্টুর কথা মনে পড়ায় খোরশেদ মিঞার মেজাজ কী কিছুটা খারাপ তখন? নইলে শোয়া থেকে উঠে বসে চারদিকে রহস্যময় চোখে কী খোঁজেন খোরশেদ মিঞা?
রামপুরা টিভি সেন্টারের পাশে বস্তির মতো এক খুপরিতে দ্বিতীয় বউ নিয়ে বেশ আরাম আয়াসেই আছে খোরশেদ মিঞার একমাত্র ছেলে সালেহার নাড়ি ছেড়া গৌরব পারডাকুয়ার দামড়া নাদান মন্টু। তিন বছর ধরে সে গলাচিপা যায় না। বেশি আয় রোজগার আর সংসারের উন্নতির আশায় দুই মেয়ে আর পোয়াতি বউটা বৃদ্ধ বাপ খোরশেদ মিঞার ঘাড়ে ফেলে মন্টু তখন ঢাকায় এসেছিল। পরের তিন মাসেও বাড়িতে আর কোনো খবর নেয় নাই। ছয় মাস না যেতেই গলাচিপায় কারা যেন খবর রটালো হারামজাদা মন্টু আরেকটা বিয়া করছে। এইডা গার্মেন্টসের মাইয়া। মন্টু রিকশা চালায়। দ্বিতীয় বউ বিউটি ভারি পরিপাটি। মন্টুর আগের বউয়ের খবর সে কিছুই জানে না। গার্মেন্টসের চাকরি থেকে বাসায় ফিরতে অনেক রাত হয় বিউটির। সকালে আবার অফিস। দুপুরে মন্টু কোনো দিন বাসায় ফিরলে নিজে রান্না করে। না ফিরলে সারাদিনই এক খোপের বারো বাই নয় ফুটের বাসায় ঝোলে আড়াই ইঞ্চি চাইনিজ তালা। খোরশেদ মিঞা সোর্স মারফত তখন একবার ঢাকায় এসেছিলেন বটে। সরাসরি তখন রামপুরায় মন্টুর বাসায়ও গিয়েছিলেন। সকাল বেলায় মন্টুর বউ বিউটির তখন অফিসে যাবার ভারী ব্যস্ততা। খোরশেদ মিঞাকে ছালাম করে পুত্রবউ বিউটি গার্মেন্টসে চলে গেল। তারপর মন্টু বৃদ্ধ বাপকে যেভাবে পারলো অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করলো। মন্টুর অমন অবজ্ঞা খোরশেদ মিঞা হজম করতে পারলেন না। সোজা এসে আশ্রয় নিলেন কাকরাইল মসজিদে। কতো কথা যে আজ একসাথে মনে পরছে খোরশেদ মিঞার। মনে মনে আবারো একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন খোরশেদ মিঞা। দামড়া পোলার কামাই খামু, সেই কপাল নাই আমার।
কাকরাইল মসজিদে খোরশেদ মিঞার আগে আরো দু’বার আসার অভিজ্ঞতা রয়েছে। খোরশেদ মিঞার তখন যৌবনকাল। বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরা ট্রলারের তিনি তখন নামকরা সুদক্ষ সারেং। কুয়াকাটা থেকে রোজ সারেং খোরশেদ মিঞা মাছ ধরা ট্রলার চালিয়ে বঙ্গোপসাগরের উথাল পাথাল ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গগণ বিদারী গান ধরেন- কে যাস রে ভাটির গান গাইয়া, আমার ভাইজানরে বলিস নাইয়র নিতন ...। এছাড়া তৈয়াব, জয়নুদ্দিন, হাশেম, আমির আলীদের জাল তোলা আর মাছ ধরার কাজে স্বেচ্ছায় বাড়তি সাহায্য করে তখন যুবক খোরশেদ মিঞা। দরিয়ার মর্জি নাকি আকাশের গায়ে লেখা থাকে। সেদিনের আকাশের সেই দুর্বোদ্ধ ভাষা খোরশেদ মিঞারা যতোটুকু আন্দাজ করেছিল, দরিয়া সেদিন তার চেয়েও অনেক বেশি মাতাল হলো। এক একটি ঢেউ যেনো আসমান কাঁপিয়ে জমিনে আছরে পরলো। কয়েক মুহূর্ত মাত্র খোরশেদরা ট্রলারে থাকতে পেরেছিল। তারপর কে কোথায় ভেসে গেল জানার কোনো উপায়ই ছিল না।
দু’দিন পরের ঘটনা। সুন্দরবনের চরদুবলার চরে অজ্ঞান অবস্থায় খোরশেদ মিঞাকে আবিস্কার করলো অচেনা অজানা অন্য মাছধরা জেলেরা। জ্ঞান ফিরলে খোরশেদ মিঞা শুধু পারডাকুয়া গ্রামের কথা কইতে পারলো। আর কিছু তার মনে নেই। দীর্ঘ এক মাস হারান মাঝির বাড়িতে কাটানোর পর খোরশেদ মিঞা পারডাকুয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। সেই দিনও পারডাকুয়া গ্রামে খোরশেদ মিঞার বাড়িতে উজানের মতো মানুষ ভীড় করেছিল। সেদিন সবাই শুধু খোরশেদ মিঞাকে এক নজর দেখতে এসেছিল। আর সারা ঘরে তখন খোরশেদ মিঞার বয়োবৃদ্ধা মায়ের আহাজারি- ওরে আমার বাজানরে, তুই জ্যান্দা আছোস! কতো হানে যে তোর লাশ বিছরাইছি। হেয়া মুই কারে কমু, আমার খসু, আয় আমার বুকে আয়...। সে বছর অন্য কয়েকজন গ্রামবাসীর সঙ্গে খোরশেদ মিঞাও খোদার নামে চেল্লায় বের হয়েছিল। কাকরাইল মসজিদে সে বছর সতের দিন ছিল খোরশেদ মিঞারা। কাকরাইল মসজিদ তখন একতলার উপরে ঢেউটিনের ছাউনি।
রাত যতো গভীর হচ্ছে খোরশেদ মিঞা যেনো ততোই আজ চাঁদের মায়ায় পরতে থাকেন। রাত, চাঁদ আর পানি এই তিন মিলে খোরশেদ মিঞার গোটা জীবন। টানা দু’দিনের গোশতো কুড়ানির খাটুনির পরে বৃদ্ধ খোরশেদ মিঞার ক্লান্ত শরীর জুরে যেখানে লঞ্চে ওঠার পরপরই ঘুম নামার কথা, সেখানে মায়াবি চাঁদের রহস্যময় নির্বাক জোসনার দুর্বোদ্ধ খপ্পরে কেমন অলৌকিক সব ঘটনা ঘটতে লাগলো। কোথায় গেল আজ খোরশেদ মিঞার ঘুম? দক্ষিণ-পশ্চিম দুর্বোদ্ধ আকাশের একখণ্ড কালো মেঘের আড়ালে কী খোরশেদ মিঞার ঘুম তখন পালিয়ে গেল? আজ কেন পুরো জীবনের সকল ঘটনা একে একে সব মনে পড়ছে খোরশেদ মিঞার? জীবনের সকল পাওয়া না পাওয়ার হিসাব বুঝি আজ এই দোতলা লঞ্চের কেবিনের সামনে শুয়ে শুয়ে চিরুনী চালানোর মতো হিসাব কষে কষে মিলানোর গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত? আকাশকে কেনো আজ আবার ভারী দুর্বোদ্ধ লাগছে খোরশেদ মিঞার? খোদার কুদরত বোঝার সাধ্য কী আর কারো আছে?
জীবনটা নিয়ে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছে খোরশেদ মিঞার। দরিয়াই তাকে যেনো বারবার ডাকে। যৌবন বয়সে ট্রলার ডুবির সেই ঘটনার পর পেশা বদল করে কিছু দিন কাঁচা তরকারীর খুচরা কারবারি করেছিল খোরশেদ মিঞা। সংসারে তখন পাঁচ পাঁচটি খাবারের মুখ। তিন মেয়ে আমেনা, মর্জিনা ও মোমেনা। আর নিজেরা স্বামী-স্ত্রী দু’জন, সালেহা আর খোরশেদ মিঞা। কাঁচামালের ব্যবসায় কী আর এমন লাভ থাকে? কিছু দিন পরে আমেনা আর মর্জিনার স্কুল বন্ধ হয়ে গেল। মোমেনার জন্য একটু দুধ কিনবে সেই পয়সাও থাকে না হাতে। তাই জীবন সংগ্রামের কঠিন বাস্তবতার গ্যারাকলে অনেকটা বাধ্য হয়েই খোরশেদ মিঞা আবারো পেশা বদল করলো। সুন্দরবনের চোরাইকাঠ পাচারকারীদের দলে নাম লেখালো খোরশেদ মিঞা। ট্রলার চালানোর অভিজ্ঞতা আর দক্ষতার বাহাদুরি দেখে দলের সবাই তখন খোরশেদ মিঞাকে মাস্টার ডাকতে শুরু করলো। সারেং খোরশেদ মাস্টার। সুন্দরবন থেকে আমতলী পর্যন্ত এক ভরা চোরাইকাঠ আনতে পারলেই পুরো মাসের খোরাক হয়ে যায়। যাওয়া আসা তিন-তিন মিলে ছয় দিন। মাঝখানে এক দুই বা তিন দিন। ব্যাস, তারপর আর কোনো ঝামেলা নেই। রুস্তুম তালুকদারের আড়তে মাল নামলেই কাম খালাস। সুন্দরবনের অবাধ কাঠ এভাবে চোরাই করাটা যে ভারী অবৈধ সেটা খোরশেদ মিঞার দলের সবাই জানতো। রুস্তুম তালুকদার টাকা দিয়ে বন বিভাগের কর্মকর্তা, নিরাপত্তারক্ষী, পুলিশ, আনসার সবাইকে হাত করেন। ফরেস্ট অফিসার টাকা খেয়েছে মানে হলো খোরশেদ মিঞা দিনের বেলায় হাই স্পিডে ট্রলার ছেড়ে মনের সুখে তখন গান ধরে। কখনো কখনো রুস্তুম তালুকদার ফরেস্ট বিভাগের কাউকে টাকা দিতে চাইতো না। বলতো- কাঠের দাম নাই। চালানই টিকবো না। তখন খোরশেদ মিঞাকে প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যেও সাগর পথে রাতের অন্ধকারে চোরাইকাঠ বোঝাই ট্রলার নিয়ে পাড়ি দিতে হতো।
এমুনি এক দুর্ভাগ্যের অমাবশ্যার রাতে ট্রলার বোঝাই চোরাইকাঠ নিয়ে খোরশেদরা ঝড়ের কবলে পরলো পায়রা নদী যেখানে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে মিশেছে ঠিক সেই মোহনায় এসে। তোফাজ্জেল, মানিক, সাত্তার, আউয়াল, কামালদের তখন একটাই ভরসা। উপরে আল্লাহ আর নিচে খোরশেদ মিঞা হিল্লা। দোহাই আল্লাহ। বাঁইচা থাকলে মোরা আর কাঠ চোরাই করমু না। তোমার কাছে শুধু প্রাণ ভিক্ষা চাই, খোদা। উত্তাল সেই দরিয়ার ঝড়ে কে কোথায় গেল কেউ জানে না। সেবারও কোনো এক অলৌকিক কারণে খোরশেদ মিঞা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল।
সূর্য তখন মধ্য গগণে। চোখ মেলে দেখলো কেওড়া গাছের ডগায় পরনের লুঙ্গি জড়িয়ে কলাগাছের মতো ভেসে আছে খোরশেদ মিঞা। পাথরঘাটার চর মহিষপুর গ্রাম সেটা। পরে বাড়িতে এসে খোরশেদ মিঞা তওবা করলো দরিয়ায় আর কোনো কাজ করবে না সে। খোদার নামে সেই বছরও একবার চেল্লায় বের হয়েছিল খোরশেদ মিঞা। কাকরাইল মসজিদে সেই বছর এক মাসেরও বেশি অবস্থান করেছিল খোরশেদ মিঞা। কী বিচিত্র জীবন মানুষের! ঘুম আজ কিছুতেই আসছে না খোরশেদ মিঞার। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জীবনের নানা ঘটনাকে যেনো এফোর ওফোর করার সময় এখন খোরশেদ মিঞার। ঘুরে ফিরেই আবার মনে পড়ে একমাত্র ছেলে মন্টুর কথা। বিয়া কইরা তুই বউ পোলা মাইয়ার কথা এইভাবে ভুইল্লা গেলি, হারামীর পো? এই দামড়া পয়দা দিছি মুই? আল্লাহ তুমি আমারে আর কী কী দেখাইবা কও? অথচ কোরবানীর গোশতো টোকানোর জন্য পরসু যখন ঢাকার সদরঘাটে লঞ্চ থেকে নেমেছিলেন খোরশেদ মিঞা তখনো মনের মধ্যে বারবার খচখচ করছিল সালেহার একটা কথা- পারলে একবার মন্টুরে দেইখা আইসেন।
কিন্তু ঠিকানা ছাড়া এত্তো বড় ঢাকা শহরে মন্টুরে খুঁজে পাওয়া কী চাট্টিখানি কথা? সদরঘাট থেকে নানান কথা চিন্তা করতে করতে হাঁটতে হাঁটেতে এক সময় এসে ওই কাকরাইল মসজিদে ওঠেন খোরশেদ মিঞা। তাছাড়া সালেহার ফরমায়েস অনুযায়ী, হাতেও তখন অনেক কাজ। কোনটা কখন করবে খেই হারানোর মতো দশা। গোশতো যাতে পচন না ধরে সে ব্যবস্থার জন্যে লবন, চা পাতা, রশি, কাঠের বাকশো ইত্যাদি যোগাড় করতেই যোহরের আজান পরলো। যারা কোরবানীর গোশতো টোকাতে ঢাকায় এসেছে তাদের অনেককেই খোরশেদ মিঞা পেলেন কাকরাইল মসজিদে। যোহরের নামাজ পড়ার পর রমনা পার্কে একা একা কিছুক্ষণ পায়চারী করলেন খোরশেদ মিঞা। সালেহার কোনো ইনস্ট্রাকশান যাতে ভুল না হয় সেই দিক সব যাচাই বাছাই করলেন। ঠিক তখন খোরশেদ মিঞার মনে পড়লো বড় হুজুরের সেই অলৌকিক গাছের কথা। এত্তো গাছের মধ্যে হেই গাছ মুই কেমনে পামু? বড় হুজুরে তো কইছিল- কাকরাইল মসজিদ রাইখা সোজা পশ্চিমে আগাইলে একটা পুরানা কালবার্ট। কালবার্ট না পারাইয়া উত্তর দিকের খালপাড় লইয়া আগাইলে পরে একটা লাল ইটের দালান। লাল দালান ফেলাইয়া পশ্চিম-উত্তর কোনাকুনি আগাইলে ইটের রাস্তা যেখানে শেষ, ঠিক তার ডানদিকে সেরাটন হোটেলের দেওয়াল। বামদিকে আগাইলে শাহবাগ মেইন রাস্তায় যাওয়ার পথ। ঠিক পশ্চিমে ছোট দেওয়ালের ওপাশে টেনিস কোর্ট। শতবর্ষী বটগাছ রাইখা দেওয়াল বরাবর পশ্চিমে ঠিক কুঁড়ি পা আগাইলেই যে গাছটা দেখবা, তার থেইকা ছাল-বাকল-পাতা যা যা পারো সব লইবা। মাইনষে যেনো না দ্যাখে। খুউব সাবধান।
দোতলা লঞ্চের কেবিনের সামনের খোলা জায়গায় তখন ঠাণ্ডা বাতাসের হিমেল পরশ। খোরশেদ মিঞার কী একটু শীত শীত লাগছে? নাকী বড় হুজুরের গাছের কথা মনে পড়ায় একটু গা ছম ছম করছে? বড় হুজুরে এই গাছের সন্ধান পাইলেন কেমনে? কাইল বড় হুজুররে ডাইকা গোশতো দিয়া খাওয়ামু। আর সুযোগ পাইলে একবার জিগামু- হুজুর ওই গাছের তো ছাল-বাকল-পাতা পোতা হক্কল মাইনষে শ্যাষ কইরা ফেলাইছে। আপনে কন তো গাছটা আসলে কীসের? কারা নিল ছাল-বাকল-পাতা-পোতা শিকড় শুদ্দা? ওই গাছ দিয়া কী করে, হুজুর?
রূপালী নির্বাক চাঁদের বুক জুড়ে তখন দু’এক টুকরো মেঘ। বাইরে হু হু শীতল ঠাণ্ডা হাওয়া। আকাশ কেনো জানি ধীরে ধীরে ভয়ংকর রূপ নিতে লাগলো। খোরশেদ মিঞার চোখে তখন আবারো আতঙ্ক। নড়ে চড়ে শোয়া থেকে উঠে বসেন খোরশেদ মিঞা। ভালো করে আকাশ পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। আকাশের এই ভয়ংকর রূপ খোরশেদ মিঞা ঠাওর করতে পারেন। যৌবনকালে প্রথম যেদিন বঙ্গোপসাগরে ট্রলার ডুবি হয়েছিল সেদিনও চাঁদের গায়ে অমুন উড়ো মেঘ ছিল। আকাশ ছিল অমুন ভয়ংকর দুর্বোদ্ধ নির্বাক। সময় গড়িয়ে হঠাৎ দরিয়া সেদিন ফুঁসে উঠেছিল। কিন্তু আজ আর খোরশেদ মিঞার ভয়টা অমন পিলে চমকানোর মতো নয়। সঙ্গে বড় হুজুরের নির্দেশ মতো রহস্যময় সেই দুর্লভ গাছের ছাল-বাকল কিছুটা তো আছে! আর সঙ্গে আছে কোরবানীর গোশতো। পবিত্র জিনিস। কতো বছর পর যে পেট ভইরা গোশতো খামু। আল্লাহ তো মানুষের সব আশাই পূর্ণ করেন। আইজ আর ভয়ের কিছু নাই। জীবনে এইবার-ই প্রথম বায়তুল মোকাররমে ঈদের নামায পড়ছি। এক্কেবারে প্রথম জামাত।
তারপর সে কী ব্যস্ত দিন গেল। যে দিকে যাই শুধু গোশতো আর গোশতো। কে কতো খাবে? দুপুর, সন্ধ্যা, রাত, পরদিন সকাল আর দুপুর মোট পাঁচবার শুধু গোশতো টুহাইলাম। যে বাড়িতে যাই খালি গোশতো আর গোশতো। কেউ কেউ আবার রানধা গোশতো দিবার চায়। ঢাকার মাইনষে যে এইভাবে গোশতো দেয় ফুলির মা না কইলে কেমনে জানতাম? মনে মনে ফুলির মাকে একটা ধন্যবাদ দেয় খোরশেদ মিঞা। আবার নিজেকে এই বলে প্রবোদ দেয়- আমার পোলা মন্টু ঢাকায় থাকবো না তো কোই থাকবো? পারডাকুয়ায় কী জন্য যাবে মন্টু? না খাইয়া মরতে? আমাগো খোঁজ না করুক, পোলা মোর খাইয়া পইরা তো ভালো আছে। থাকুক, মন্টু ঢাকায়ই থাকুক।
কোরবানীর ঈদের পরদিন দুপুর পর্যন্ত গোশতো সংগ্রহের অভিযান শেষে খোরশেদ মিঞা যখন দেখলেন- এত্তো গোশতো সে কোথায় রাখে! তখন মন্টুর কথা তার বারবার মনে পড়েছিল। এমন কি আজ সন্ধ্যায় সদরঘাট থেকে গলাচিপার লঞ্চে ওঠার সময়ও খোরশেদ মিঞার বুকটা মন্টুর জন্যে বারবার ঢিবঢিব করেছিল। ‘এমভি আসা-যাওয়া’র দোতলায় কেবিনের সামনের খোলা জায়গায় গোশতোর বাকশো রাখার পর লঞ্চ যতোক্ষণ না বুড়িগঙ্গার চীন বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু ছাড়ালো ততোক্ষণ খোরশেদ মিঞার বারবার শুধু মন্টুর কথাই মনে পড়েছিল। মন্টু তুইও আমারে ভুইলা গ্যালি, এইভাবে... হারাম খোর। সালেহার প্যাট পোছা অতি আদরের ধন, আমার কলিজার টুকরা। হারামীর পো, তুই আমারেও ভুইলা গেলি...
ধীরে ধীরে চাঁদের বুকে কুয়াশার মতো খণ্ড খণ্ড মেঘ জমে জমে যেনো পাহাড় বানাচ্ছিল। বাতাসের ঝাপটাও একটু বাড়ছিল। কেমন থেমে থেমে ঠাণ্ডা শীতল বাতাস বারবার হামলা করছিল। খোরশেদ মিঞার আবার তখন বাড়ির কথা মনে পড়লো। আমেনারা ঈদের দিনেই আসার কথা। মোমেনা খবর পাইলে আইজ আইবো। মর্জিনারে নিজে গিয়া গোশতো দিয়া আসমু। খোদা এইবার মর্জিনার যেনো একটা পোলা হয়। আল্লাহ তোমার কাছে হাজার শুকুর। ওর কপালডা সালেহার মতোন। পরপর পাঁচ মাইয়া মর্জিনার। আল্লাহ মর্জিনারে এইবার একটা ছাওয়াল দিও। কুলসুমরা আসবে না। ওগো আল্লাহ ভালো রাখছে। জরিনাগো কেমনে পাঠামু গোশতো? সালেহারে যেভাবে সব কইছি ঠিকমতো সব জোগাড় করতে পারছে তো? কতো দিন পরে সক্কলে মিল্লা গোশতো খামু। আল্লাহরে অনেক শুকরিয়া। মন্টু, তুই মানুষ অইলি না। পোলা মাইয়ার মুখ দেহোনেরও তোর সময় হয় না। পাণ্ডার পো গুণ্ডা কোথাকার?
এমনি দুনিয়ার সকল কথাই মনে পড়তে থাকে খোরশেদ মিঞার। ছোট্ট জীবনের অনেক ঘটনা। অনেক ঘটনার সঙ্গেই ছোট্ট এই জীবন জড়িত। খোরশেদ মিঞার কাছে কোনোটাই ফেলনা না। সকল ঘটনাই আজ আবার নতুন করে মনে পড়ছে তাঁর। খোলা আকাশের মিটমিট তারার মতো জীবনের ফেলে আসা সকল টুকরো টুকরো ঘটনাই আবার নতুন করে জ্বল জ্বল করছে খোরশেদ মিঞার সামনে। কতো দরিয়ার পানি যে এতোদিনে কোথায় কোথায় গড়ালো। অথচ খোরশেদ মিঞার জীবনে সেই কঠিন দুঃখের সাগর কখনোই ফুরালো না। আকাশের দিকে তাকিয়ে খোরশেদ মিঞা আল্লাহর কাছে নালিশ দেয়। খোরশেদ মিঞা কী সত্যি সত্যিই আজ বড় ক্লান্ত? খোরশেদ মিঞা কী ঘুমিয়ে পড়েছেন? খোরশেদ মিঞা কী জেগে আছেন? খোরশেদ মিঞা কী এখনো নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখছেন?
‘এমভি আসা-যাওয়া’ তখন চাঁদপুর থেকে ফুল স্পিডে পদ্মা পাড়ি দিচ্ছিল। খোরশেদ মিঞার মাথার পাশে বাকশো ভরতি কোরবানীর গোশতো। লঞ্চে যাত্রী মাত্র গুটিকয়েক। ঢাকা থেকে ঈদের পরে এই সময়টায় যাত্রী হয় না। সবাই ফিরতি পথে বেশি যাত্রী পায়। ফুল স্পিডে ‘এমভি আসা-যাওয়া’। কোনো মতে গলাচিপা পৌঁছাতে পারলে ফিরতি পথে লঞ্চ বোঝাই যাত্রী মিলবে। ঢাকা থেকে যারা বাড়িতে গিয়েছিল কোরবানীর ঈদ করতে তারা আবার ঢাকায় ফিরবে। কেবিনগুলো প্রায় সবই ফাঁকা আর তালাবন্ধ। কয়েকটায় কয়েকজন মাত্র যাত্রী। যারা ঈদের আগে যেতে পারেননি তাঁরা এখন যাচ্ছেন। গোটা লঞ্চের ডেক মোটামুটি বোঝাই। যাত্রীরা সবাই নিম্ন আয়ের মানুষ। কোরবানীর ঈদের গোশতো সংগ্রহ করতে এরাই ঈদের আগে ঢাকায় এসেছিল। এখন ঈদ শেষ। এরাই গোশতো সংগ্রহ শেষ করে আপনজনদের জন্যে কোরবানীর গোশতো নিয়ে এখন বাড়ি যাচ্ছে। বড় আশা নিয়ে এরা সবাই গোশতো নিয়ে বাড়িতে যাচ্ছে। সবার মধ্যেই আত্মীয়স্বজন আপনজনদের নিয়ে একসঙ্গে গোশতো খাবার ভারী আকাঙ্খা। সবার মধ্যেই অনেক দিন পরে গোশতো খাবার অনেক স্বপ্ন। মানুষগুলো স্বপ্ন দেখতে দেখতে কী এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো? ডেক, মেঝে, পাতাটন সবখানেই যে যেভাবে পেরেছে গোশতোর বাকশো রেখে তার পাশেই ঘুমিয়েছে।
এসময় ঢাকামুখী লঞ্চগুলো আবার অনেকটাই যাত্রী বোঝাই। দু’একটা লঞ্চ ‘এমভি আসা-যাওয়া’কে অতিক্রমের সময় বোঝা যায় ঢাকাগামী লঞ্চ পুরোপুরি যাত্রী বোঝাই। সবাই পরিবারের সঙ্গে ঈদ শেষে আবার কর্মস্থল ঢাকায় ফেরত যাচ্ছেন। সবাই ঈদের আনন্দের তাজা স্মৃতি নিয়ে ফিরছেন। এইতো জীবন। আসা আর যাওয়া। কখনো ঢাকা থেকে বাড়ি। কখনো বাড়ি থেকে ঢাকা। কোথায় এই ছোট্ট জীবনের অবসর?
তখন মধ্যরাত্রি। তখন দুর্বোদ্ধ আকাশ। তখন নির্বাক বোবা জোসনায় ঢাকা রাতের মেঘনা নদী। তখন রহস্যময় কুয়াশায় ঘেরা মেঘনার তীর। তখন নিশ্চিন্তে ঘুমের রাজ্যে শান্ত প্রকৃতি। দুঃখ জরা ক্লান্তিতে অভুক্ত মানুষগুলো তখনো ‘এমভি আসা-যাওয়ায়’ ঘুমিয়ে। পাশে ছড়ানো ছিটানো গোশতোর বাকশো। কোরবানীর পবিত্র গোশতো। বরিশালের হিজলা উপজেলার কাইছমা চর এলাকায় মেঘনা নদীতে তখন পৃথিবীর অসুখ। বরিশাল থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা বিলাসবহুল লঞ্চ ‘এমভি সাত্তার খান’ তখন ঢাকা থেকে গলাচিপামুখী লঞ্চ ‘এমভি আসা-যাওয়া’র মুখোমুখী। শুধু কী মুখোমুখী? কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ সেই গগণ বিদারী সংঘর্ষ। তারপর পৃথিবী জেগে উঠলো। মেঘনা নদী জেগে উঠলো। ঘুমন্ত স্বপ্ন দেখা মানুষগুলো কেউ কেউ জেগে উঠলো। কেউ কেউ কী জাগতে পেরেছিল আর? আকাশ ফেঁটে তখন জীবনের চিৎকার। নদীতে তখন মৃত্যুর উথাল পাতাল ঢেউ। চাঁদ তখন নির্বাক মুখ লুকালো ধেয়ে আসা দক্ষিণা কালিয়া মেঘের ভাসানো ডালার আড়ালে। তারপর চারদিকে শুধু খবর আর খবর। লাশের খবর।
মাঝরাতের ওই লঞ্চ সংঘর্ষের ভয়াবহ দুর্ঘটনার খবর সংবাদ মিডিয়ায় প্রচার পায় পরদিন। ‘এমভি সাত্তার খান’ আর ‘এমভি আসা-যাওয়া’র সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই মারা যায় ৩৫ জন। ৮৯ জন লঞ্চযাত্রী চরমভাবে আহত। অনেক যাত্রী নিখোঁজ বলে ধারণা করা হয়। নিহতের মধ্যে ১২ জন মহিলা ও ৪ জন শিশু। শুধু খোরশেদ মিঞার খবর কেউ বলতে পারলো না।
ওদিকে সালেহা বেগমের মশলা বাটা শেষ। আমেনা আর মোমেনা আগেই বাবার বাড়িতে এসেছিল। কারা যেনো টেলিভিশনের খবরে লঞ্চ দুর্ঘটনার খবর শুনলো। টেলিভিশনের খবর শুনে কে বা কারা যেনো সালেহা বেগমকেও খবরটা পৌঁছালো। পারডাকুয়া গ্রামের যে যেখানে ছিল, যেভাবে ছিল, যে ড্রেসে ছিল সেই অবস্থা থেকেই সবাই গলাচিপা লঞ্চঘাটের দিকে উর্দ্ধশ্বাসে ছুটলো। মন্টুর মা সালেহা বেগমও লঞ্চ দুর্ঘটনার খবর শোনামাত্র যেভাবে পারলো গলাচিপা লঞ্চঘাটে ছুটলো। পিছন পিছন আমেনা, মোমেনা, তাদের ছেলেমেয়েরা ছুটলো। পারডাকুয়া গ্রামের অনেকেই এবছর কোরবানীর গোশতো সংগ্রহ করতে ঢাকায় গিয়েছিল। টেলিভেশনের খবর শোনার পর মুহূর্তে গোটা পারডাকুয়া গ্রাম গলাচিপা লঞ্চঘাটে যেনো আছড়ে পরলো। পারডাকুয়া গ্রামের স্বজনদের আহাজারীতে তখন গলাচিপা লঞ্চঘাটে শোকের বন্যা। কেউ কারো খবর জানে না। কার ভাগ্যে কী ঘটেছে কেউ জানে না। কোরবানীর গোশতো খাবার ইচ্ছে তাদের তখন কোথায় উড়ে গেছে কেউ বলতে পারে না। অন্য অনেক আগন্তুকের সাথে তখন মন্টুর মা সালেহা বেগম, মন্টুর বড় বোন আমেনা, সেজো বোন মোমেনারা অসহায় অপেক্ষা করতে থাকে। বুকে তাদের মন্টুর বাবা খোরশেদ মিঞার জন্যে গভীর উৎকণ্ঠা।
ওই দিন রাতেই খোরশেদ মিঞার মেজো মেয়ে মর্জিনার হঠাৎ প্রসব ব্যথা ওঠে। জরুরী অবস্থায় তাকে নেওয়া হয় গলাচিপা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে। ডাক্তাররা রোগীর সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারলো না। শেষ রাতে ডাক্তাররা রোগীকে বাঁচাতে অপারেশান করতে বাধ্য হলেন। মর্জিনার পেট কেটে ডাক্তাররা যা বের করেলো তা দেখতে অনেকটা কাঁচা লাল লাল থোঁক থোঁক মাংস। নাকী খোরশেদ মিঞার ঢাকায় কুড়ানো সেই কোরবানীর গোশতো? যা সে চা-পাতা মিশিয়ে অর্ধসিদ্ধ করে বাকশো বন্দি করে ‘এমভি আসা-যাওয়া’ লঞ্চের দোতলা কেবিনের খোলা জায়গায় রেখে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন? সেই কুড়ানো গোশতের সঙ্গে মর্জিনার পেট কেটে বের করা মাংসের মধ্যে কী কোনোই তফাৎ আছে? সেই দুর্বোদ্ধ লাল লাল মাংস দেখার জন্যে তখন গলাচিপা হাসপাতালে উৎসুক জনতার আরেকটা ঢল নামে। কোরবানীর গোশতো খাবার কথা কেউ আর মনে করে না।
------------------------
২৭ জুন ২০০৪
কাঁঠালবাগান, ঢাকা
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ৩:১৬