আজ থেকে প্রায় তিন বছর আগে সামহোয়্যারইনব্লগ-এ একই নামে একটি পোস্ট দিয়েছিলাম। এফিলিয়েট মার্কেটিং নিয়ে বাংলা ভাষায় কার্যকরী প্রথম পোস্ট সম্ভবতঃ সেটাই। পোস্ট প্রকাশের পরে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছিলাম। ইচ্ছে ছিল এফিলিয়েট মার্কেটিং টিউটোরিয়াল নামে একটি সিরিজ লিখবো। কিন্তু পেশাগত ব্যস্ততার কারনে আর লেখা হয়ে ওঠেনি।
এফিলিয়েট মার্কেটিং জিনিসটা তখন খুব একটা পরিচিত ছিলো না। অনেকেই সেসময় ফোনে যোগাযোগ করেছেন। পরামর্শ নিয়েছেন। নিজেরা লাইভ টিভি স্ট্রিমিং সফটওয়্যারের মার্কেটিং করে সফলও হয়েছেন।
সন্দেহও করেছেন অনেকে। এখন আর সেই সময় নেই। বাংলাদেশে অন্তত বিশ হাজারেরও বেশী এফিলিয়েট মার্কেটার কাজ করছে। প্রত্যেকেই তাদের চেষ্টা ও যোগ্যতা দিয়ে কম-বেশী রোজগার করছে।
গত কয়েকদিন ধরেই বেশ কিছু পরিচিত ছোট ভাই এফিলিয়েট মার্কেটিং শেখার জন্য যোগাযোগ করছে। তাই অনেক চিন্তা ভাবনার পর আবার নতুন করে লিখতে বসা। মার্কেটিং ট্রেন্ড বদলে গেছে, বদলে গেছে অনেক কৌশল। পুরাতন যারা কাজ করছেন, তাদের আর নতুন করে হয়তো কিছু শেখার নেই। নতুনদের জন্য তাই আবার নতুন করে লেখা।
তাহলে শুরু করা যাক। প্রথমেই জেনে নেই, এফিলিয়েট মার্কেটিং জিনিসটি আসলে কি?
খুব সহজ ভাষায়, অনলাইন মার্কেটপ্লেসের কোনো প্রোডাক্ট আপনি প্রোমোট করবেন, বিক্রি হলে আপনি একটি নির্দিষ্ট পরিমান কমিশন পাবেন। এটাই এফিলিয়েট মার্কেটিং।
এই কথাটাই আমি তিন বছর আগে খুব একটা সহজ ভাবে বোঝাতে পারিনি। কারন, অনলাইন মার্কেটপ্লেস ব্যাপারটা বাংলাদেশে খুব একটা পরিচিত ছিলনা। কিন্তু রকমারি.কম, চালডাল.কম, আজকেরডিল.কম, সহজ.কম, এসো.কম ইত্যাদি ওয়েবসাইটগুলোর কারনে অনলাইন মার্কেটপ্লেস কনসেপ্ট এখন এদেশে বেশ পরিচিত। তাই ব্যাখা করাটাও হয়তো সহজ হবে।
ধরা যাক আজকেরডিল.কম-এর কথা। এটা আমাদের সবার পরিচিত বিডিজবস.কম-এর একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান। এখান থেকে আপনি আপনার পছন্দ মত প্রোডাক্ট কিনতে পারবেন। আমি নিজেও গত বছর এখান থেকে একটি ২৪ ইঞ্চি সনি ব্রাভিয়া টিভি কিনেছি (যেটা আমার বেডরুমের দেয়ালে ইনস্টল করা আছে)। কিন্তু কেনার সময় টিভি-টি আমার বাসায় দিয়ে গেল এলিফ্যান্ট রোডের মাল্টিপ্ল্যান সুপারমার্কেটের চৌধূরী ইলেকট্রনিক্স-এর একজন টেকনিশিয়ান। এর মানে কি?
এর মানে, আজকেরডিল.কম একটি প্লাটফর্ম, যার মাধ্যমে চৌধূরী ইলেকট্রনিক্স তার ইলেকট্রনিক পন্য বিক্রি করে। তাহলে টিভি (বা অন্য যেকোনো কিছু) হলো প্রোডাক্ট, চৌধূরী ইলেক্ট্রনিক্স হলো ভেন্ডর, আর আজকেরডিল.কম হলো মার্কেটিং বা সেলস্ প্লাটফর্ম। এখানে আজকেরডিল.কম ভেন্ডরের কাছ থেকে প্রতিটি প্রোডাক্ট বিক্রির জন্য একটি নির্দিষ্ট কমিশন লাভ করে। ধরা যাক, আমি টিভি-টির দাম দিয়েছি ৩০০০০ টাকা, আজকের ডিল এখান থেকে ১০০০ টাকা নিয়েছে। বাকি ২৯০০০ টাকা ভেন্ডরের, এই ক্ষেত্রে চৌধূরী ইলেক্ট্রনিক্স-এর।
এখন, চৌধূরী ইলেকট্রনিক্স আজকেরডিল.কম-কে এই এক হাজার টাকা কেন দিল? কারন, এই প্রোডাক্টটার মার্কেটিং আজকেরডিল.কম করে দিয়েছে। আমি বাসায় বসে ফেসবুকিং করার সময় আজকেরডিল.কম-এর একটি পোস্ট দেখতে পাই, যেটাতে একটি লোভনীয় অফার ছিল, ১০ হাজার টাকা ডিসকাউন্টে ব্রাভিয়া টিভি কিনতে পারার, আমি সেই পোস্ট পড়ে সিদ্ধান্ত গ্রহন করি টিভি-টি কিনব, তারপর আজকেরডিল.কম-এ ফোন করে যোগাযোগ করে অর্ডার দেই।
এখন, এই যে মার্কেটিং-টি হলো, এটি করলো আজকেরডিল.কম-এর নিজস্ব মার্কেটিং টিম। এটি ডাইরেক্ট মার্কেটিং। কিন্তু যদি এমন হতো, আজকেরডিল.কম আপনাকে, আমাকে বা রহিম অথবা করিম কে মার্কেটিং-এর দায়িত্ব দিত একটা কমিশনের বিনিময়ে, তবে সেটাই হতো এফিলিয়েট মার্কেটিং।
ব্যাপারটি তাহলে কিরকম হতো? আপনি আপনার ওয়েবসাইট, ফেসবুক পেজ কিংবা ইমেইলের মাধ্যমে আমাকে বলতেন যে, আজকেরডিল.কম-এ খুব ভালো টিভি পাওয়া যাচ্ছে। আমি আপনার রেফারেন্স-এ আজকেরডিল.কম-এ যোগাযোগ করে ৩০০০০ (তিরিশ হাজার) টাকা দিয়ে টিভি-টি কিনলাম। চৌধূরী ইলেকট্রনিক্স-এর লোকজন নিজেরা সরাসরি অথবা আজকেরডিল.কম-এর মাধ্যমে টিভি-টি আমার বাসায় এসে দিয়ে গেল। এখন টাকার ভাগ হলো এরকম-
ভেন্ডর - চৌধূরী ইলেকট্রনিক্স - ২৯০০০ টাকা
মার্কেটিং প্লাটফর্ম - আজকেরডিল.কম - ৫০০ টাকা
এফিলিয়েট মার্কেটার - আপনি - ৫০০ টাকা
টাকার পরিমানটা কমবেশী হবে। নির্ভর করবে আজকেরডিল.কম, চৌধূরী ইলেকট্রনিক্স এবং আপনার মধ্যে কি রকম রফা হয়েছে তার উপর।
আমি কি একটা পরিস্কার উদাহরন দিতে পারলাম?
এখন বাস্তব উদাহরনে আসি।
এফিলিয়েট মার্কেটিং-এর সবচেয়ে বড় উদাহরন আমাজন.কম, ইবে.কম কিংবা ক্লিকব্যাংক.কম। হাজার হাজার ভেন্ডর কোম্পানী এই সাইটগুলোতে তাদের পন্য বা প্রোডাক্ট জমা দেয় বিক্রির জন্য। ইবে কিংবা আমাজন এই প্রোডাক্টগুলো নিজেরা বিক্রি করার পাশাপাশি এফিলিয়েট মার্কেটারদের সাহায্য নেয়। ক্লিকব্যাংকের মতো সাইটগুলো পুরোটাই বিক্রি করে আমাদের মতো এফিলিয়েট মার্কেটারদের মাধ্যমে। উপরের মতো, বিক্রির টাকার ৩%-৫% পায় ইবে, আমাজন বা ক্লিকব্যাংক। এফিলিয়েট মার্কেটাররাও পায় কমিশন। কত, সেটা নির্ভর করে প্রোডাক্টটি কি, তার উপর।
প্রোডাক্টটি যদি ফিজিক্যাল প্রোডাক্ট হয়, যেমন, ওষুধ, ফুল, বই, ফার্নিচার, মোবাইল ফোন, চশমা, অলংকার, কাপড় ইত্যাদি, তাহলে কমিশন হয় ৩% থেকে ২০% এর মতো। কিন্তু যদি হয় কোনো ডিজিটাল প্রোডাক্ট, যেমন, সফটওয়্যার, গেমস, ইবুক, কোনো ওয়েবসাইটের মেম্বারশিপ, তবে কমিশন হতে পারে ৫০% থেকে ১০০% পর্যন্ত।
কি বিক্রি করা যায়না এফিলিয়েট মার্কেটিং এর মাধ্যমে? সবই যায়। হিরের গহনা থেকে শুরু করে ব্যাংক লোন বা ক্রেডিট কার্ড পর্য়ন্ত সবই বিক্রি হয়। বাংলাদেশে এফিলিয়েট মার্কেটিং শুরু হয়েছিল ২০০৯ সালে, টিভিপ্রসেসিং.কম নামের একটি সাইটের মাধ্যমে আমরা একটি সফটওয়্যার বিক্রি করতাম, যেটা দিয়ে খেলা লাইভ দেখা যেত। সফটওয়্যারটি কিনতে লাগতো প্রায় ৫০ ডলার, আমাদের কমিশন থাকতো ৩০ ডলারের মত। মনে আছে, রাজশাহীর একটা ছেলে (নামটা না হয় গোপনই থাক) ফুটবল বিশ্বকাপের সময় ইএসএ-র একটি খেলার দিন একরাতে কাজ করে ৭১৪ কপি সফটওয়্যার বিক্রি করেছিল, বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ১৫ লক্ষ টাকার উপরে। ভাবা যায়?
যায়। আমরা ওই সময় প্রায় সবাই প্রতি মাসে ২/৩ লাখ টাকা রোজগার করেছি। অবশ্য প্রতিযোগিতাও কম ছিল। এখন প্রতিযোগিতা অনেক বেশী। তারপরও এখনও সম্ভব। অনেক ভালো প্লাটফর্ম আছে। ব্যাংকে টাকা আনা অনেক সহজ। এই কাজ করার জন্য যেসব লজিস্টিক সাপোর্ট লাগে, আগের তুলনায় সেসব এখন অনেক সহজে পাওয়া যায়। এখন অনলাইনে এফিলিয়েট মার্কেটিং করে খুব ভালো উপার্জন করা খুবই সম্ভব।
সবাই কি পারে? না। কেন? প্রথম কথা, সবাই উপায় টা জানে না, দ্বিতীয় কথা, ধৈর্য্য।
টাকা উপার্জন কখনই সহজ নয়। এর জন্য চাই মেধা, আর পরিশ্রম। আমি না হয় শিখিয়ে দেব, পরিশ্রম তো আপনাকেই করতে হবে, তাইনা?
একটা কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, এটা কোনো পিটিসি-র ক্লিকবাজী না, এটা ফরেক্স-এর মত ফাটকাবাজীও না। তবে হ্যাঁ, নিজে ফরেক্স ট্রেড না করে যদি আপনি এই সাইটগুলোতে ফরেক্স ট্রেডার ঢোকান, তবে সেটা এফিলিয়েট মার্কেটিং। এটাও খুব প্রফিটেবল। ব্যাখ্যা করি। ধরা যাক, আপনি কোনো এক ফরেক্স ট্রেডিং সাইটের এফিলিয়েট মার্কেটার। আপনি এই সাইটটি প্রমোট করলেন। আমি আপনার রেফারেন্সে ঐ সাইটের মেম্বার হয়ে ফরেক্স ট্রেড করলাম। তাহলে আপনি একটি ফিক্সড কমিশন কিংবা আমার কাছ থেকে ঐ সাইট যে পরিমান লাভ করবে তার একটা শতকরা ভাগ পাবেন।
মোট কথা, এটা কোনো জোচ্চুরি নয়, কোনো জুয়া নয়। এটা শতকরা একশতভাগ সৎ, এবং কঠোর পরিশ্রমের কাজ। কিন্তু রোজগারটা ডলারে হওয়ায় উপার্জন অনেক বেশী।
আজকে এ পর্যন্তই। এর পরের আর্টিকেল-এ আমরা ভালো এফিলিয়েট মার্কেটিং প্লাটফর্ম কোম্পানিগুলো নিয়ে আলোচনা করব।
আমার এই লেখাটি যদি আপনার ভালো লাগে, বা একটু হলেও উপকারে আসে, তবে শেয়ার করতে ভুলবেন না প্লিজ। সাথে থাকতে পারেন আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ -এর মাধ্যমেও।
যদি কোনো প্রশ্ন থাকে, যদি কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়, কিংবা কোনো কিছু বলার থাকে, কমেন্ট করুন। অবশ্যই উত্তর পাবেন।
** এই লেখাটি আমার সাইট http://bd-online.net তে প্রকাশিত হয়েছে।
সবাইকে ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জানুয়ারি, ২০১৫ সকাল ৭:১২