কমিকস পড়ায় প্রথম হাতেখড়ি হয়েছিল চাচা চৌধুরী দিয়ে । সে-ই ১৯৯৫ সালের কথা , আমি তখন ক্লাস টু-তে পড়ি । ভারতের “ডায়মন্ড কমিকস” প্রকাশিত কমিকস গুলো বাজারে সহজলভ্য , মূল্যও হাতের নাগালে । প্রাণের জনপ্রিয় চরিত্র চাচা চৌধুরী , বিল্লু , পিংকী , রমন , চান্নি চাচী , শ্রীমতীজী কোন-টাই বা পড়িনি তখন ! ছিল ফ্যান্টম , হী-ম্যান , ডায়নামাইট , অগ্নিপুত্র-অভয় , শক্তিমান , ক্যাপ্টেন ব্যোম , লম্বু-মোটু । “ডায়মন্ড কমিকস” থাকায় কমিকস পড়ায় তেমন কষ্ট হয়নি । পশ্চিমবঙ্গ হতে প্রকাশিত নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচিত নন্টে ফন্টে , হাঁদা ভোঁদা , বাঁটুল দি গ্রেট , ইন্দ্রজাল কমিকস , সুদীপের ইয়ো ইয়ো , নাগরাজ , ডোগা-র কমিকস গুলোও শৈশবকে করেছে আনন্দময়। মূল্য বেশী হবার কারণে হার্জের টিনটিন অথবা এসটেরিক্স হাতে এসেছে অনেক পরে।
তবে একটা কষ্ট ছিল সবসময় । বাংলাদেশী কোন মনমত কমিকস চরিত্রের দেখা পাইনি । আহসান হাবীবের পল্টু বিল্টু , সরদার জয়নুল আবেদীন এর শুঁটকু মোটকু, তরিকুল ইসলাম শান্তর পটলাদা স্বল্প পরিসরে বের হলেও পুরোপুরি মন ভরাতে পারেনি । টিনটিন, চাচা চৌধুরী বা নন্টে ফন্টে-র ঝকঝকে ড্রইং দেখা অভ্যস্ত চোখে আহসান হাবীবের কলমের কয়েক দাগে আঁকা কার্টুন কমিকসগুলো দেখে আঁশ মেটেনি । বাংলা কার্টুনের অন্যতম কর্ণধারের কাছে আরো শ্রমসাধ্য কাজ আশা করেছিলাম । সরদার জয়নুল আবেদীনের শুঁটকু মোটকু-র ড্রয়িং আর কাহিনী ছিল নজরকাড়া , কিন্তু বইগুলো সহজলভ্য ছিল না ।
তারপর এলেন শাহরিয়ার । একে একে হাতে পেলাম লাইলী , বাবু , বেসিক আলী-র মত চরিত্রগুলো । বাবু বা বেসিক আলী পত্রিকার কার্টুন স্ট্রীপ হলেও গল্পের মত এগিয়েছে কাহিনিগুলো , একটা ক্রম বজায় ছিল গল্পের মাঝে । মনে হল , না আমাদের দেশেও সম্ভব । তারপরও একটা অভাব ছিল – হাস্যরসাত্মক কমিকস চরিত্রের দেখা মিললেও কোন একশন চরিত্র বা সুপারহিরো-র খোঁজ পেলাম না ।
বছর কয়েক ধরে ফেসবুকে-অনলাইনে চোখে পড়ছিল DHAKA Comics নামটি । এদের প্রকাশিত কয়েকটি কমিকসের স্যাম্পল পৃষ্ঠা দেখে মন আনন্দে নেচে উঠলো । এত সুন্দর ড্রইং , প্লট পড়েও মনে হচ্ছিল কাহিনীগুলো হবে দেখার মত। সময়-সুযোগের অভাবে এতদিন সংগ্রহ করতে পারিনি । অনলাইনে Book Shop – এর বিশাল ডিসকাউন্ট দেখে শেষ পর্যন্ত বেশ কিছু কমিকস অর্ডার করে ফেললাম । যথাসময়ে হাতেও চলে এল। ঝকঝকে নজরকাড়া গেট-আপ আর মেকাপ দেখে খুব ভালো লাগলো । একদিনেই শেষ করে ফেললাম সবগুলো কমিকস ।
মেহেদী হক-এর ‘মীনপিশাচ’ আর তৌহিদুল ইকবাল সম্পদ-এর ‘দুর্জয়’ সবচেয়ে ভালো লেগেছে । ইলাস্ট্রেশন আর কাহিনী দুইদিক দিয়েই কমিকস দু’টো সবার সেরা । নিহিলিন ক্লাবের দুই চরিত্রের এডভেঞ্চার নিয়ে লেখা মীনপিশাচ-এর সিক্যুয়েল এর অপেক্ষায় রইলাম । ২০১৩ সালে প্রকাশিত কমিকসটির সিক্যুয়েল এখনো কেন বের হয়নি তা আমার বোধগম্য নয় । আশা করি মেহেদী হক আর ঢাকা কমিকস বেশীদিন অপেক্ষা করিয়ে রাখবে না । দুর্জয় কমিকসের মুখ্য চরিত্র দুর্জয়-কে খুব ভালো লেগেছে । অবশেষে দেশীয় একজন সুপারহিরো নায়কের উদয় হল । ডায়লগ আর গল্পের সাথে সাথে অসাধারণ আর্টওয়ার্ক মন ভরিয়ে দিয়েছে । এই কমিকসটি না পড়লে জানতাম না আমাদের দেশেও এই লেভেলের কমিকস লেখা ও আঁকা সম্ভব ।
আরাফাত করিম-এর ‘অপারেশন BREAKDOWN’ অসাধারণ লেগেছে । ঢাকা কমিকস প্রকাশিত সবগুলো চরিত্রের মাঝে আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় লেগেছে এই বইয়ের সি,কে, জাকি-কে । গল্প খুব চমকপ্রদ আর এই কমিকস-এও একি কথা – কাহিনী শেষ না হওয়ায় সিক্যুয়েল এর জন্য অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে ।
নাভিদ হোসেইনের গল্প এবং মেহেদী হক ও আসিফুর রহমান রাতুল-এর আঁকা ‘রিশাদ’ ট্রিলজি-র কাহিনী গড়ে উঠেছে রিশাদ নামে এক তরুণকে নিয়ে । সাই-ফাই একশন কমিকস গুলোও ভালো লাগার মত , দারুণ গল্প আর কিছু ট্যুইস্ট আছে প্রতি পর্বেই । জাপানী মাঙ্গা স্টাইলে আঁকা কমিকসগুলো নিয়ে একটাই অভিযোগ – প্রথম পর্বটি খুব বেশী ছোট , সবগুলো পর্ব একসাথে হাতে না পেলে খুব বিরক্ত লাগত । সব মিলিয়ে সংগ্রহে রাখার মত একটি সিরিজ ।
ড্রয়িং বাদে সৈয়দ রাশাদ ইমাম তন্ময় এর ‘নাইমা না রাইমা’-র আর কিছু ভালো লাগেনি । কাহিনী খুব খাপছাড়া লেগেছে , গল্পের পরিণতিও বোধগম্য নয় ।
সবশেষে একটি কমিকসের কথা বলবো- শাহরিয়ার শরীফের ‘ডাকাবুকো কাকু আর ক্যাপ্টেন কিডের গুপ্তধন’ দারুণ মজার একটা বই ছিল । অনেকদিন পর মজাদার একটি কমিকস পড়ে অনেক হেসেছি । শাহরিয়ার শরীফ ভাইয়ের কাছে ভবিষ্যতে এমন আরো কমিকসের অপেক্ষায় রইলাম ।
স্টকে না থাকায় বেশ কিছু কমিকস কিনতে পারিনি- রহস্যময় চুম্বক দ্বীপ , ডিনয়েডঃ32 , ব্যাকবেঞ্চার্স ক্লাব ; বাকী বইগুলোও ভবিষ্যতে কেনার ইচ্ছে আছে । একটি পরামর্শ থাকবে – রিশাদ ২-এ যে বাঁধাই দিয়েছেন পরবর্তী বইগুলোতেও একই বাঁধাই দেয়া যায় কিনা ভেবে দেখার অনুরোধ রইল ।
ঢাকা কমিকসের কাছ থেকে ভবিষ্যতে এমন অসাধারণ আরো কমিকস আশা করছি ।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা এপ্রিল, ২০১৬ দুপুর ১:২৫