শুরুর কথাঃ
আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম দ্বিতীয় পেশাগত পরীক্ষা শেষে ছয় বন্ধু মিলে দেশভ্রমণে বের হব। অনেক ভেবে স্পট ঠিক করি- একবারেই কক্সবাজার, বান্দরবন, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম ঘুরে আসবো। পরীক্ষা শেষে বাড়ি চলে আসাতে কোনমতেই তারিখ ঠিক করতে পারছিলাম না। ভেবে-চিন্তে রোজার ঈদ শেষে ঢাকা হতে সবাই যাবো বলে স্থির হলাম।
যেই কথা সেই কাজ। ২০১০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর রোজার ঈদ। ১৪ সেপ্টেম্বর রাতে যাত্রাক্ষণ ঠিক হল। বন্ধুবর রায়হান আর বাবু মিলে আগেই টিকেট করে ফেলেছে। রাত ১০টায় আদাবরের নানুবাড়ি হতে শ্যামলী সিনেমা হলের সামনে এসে দাঁড়াই। বন্ধু দুলদুল মিরপুর হতে গাড়ি নিয়ে এদিক দিয়ে যাবার সময় আমাকে তুলে নেয়। কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছে যাই। তপু, বাবু, রাজন চলে এসেছে। ওদিকে রায়হান ফেণীতে ঈদ করছে। ও পরে আমাদের সাথে চট্টগ্রামে যোগদান করবে।
১১-৩০ টার তূর্ণা এক্সপ্রেসে এসি কম্পার্টমেন্টে রওনা দিই। রওনা দেবার আগে উন্মাদ ঈদসংখ্যা কিনে নিই, বই পড়ি আর মাঝে ট্রেন জুড়ে পায়চারী করি। প্রায় আট বছর পরে ট্রেন জার্নি করছি। তাও নোয়াখালীর উপকূল এক্সপ্রেসের সাথে এই ট্রেনের তুলনাই হয়না। সত্যি বলতে কি মনে হল এসি কম্পার্টমেন্টের টিকিট করে ভুল করেছি। ট্রেনের সবচেয়ে মজা জানালা খুলে বাইরে দেখা আর বাতাস খাওয়া। যদিও রাতের বেলা তবুও জানালা খুলতে পারিনাই এই দুঃখে মনটাই খারাপ হয়ে গেল। এসি-তে যাত্রার কারণে সেই মজাকে বিসর্জন দিতে হল। তারপরও ট্রেন জার্নিটা ভালোই লেগেছে।
সকাল ৮ টা নাগাদ চট্টগ্রাম পৌঁছে যাই। স্টেশন হতে সিনেপ্লেক্স। এখান থেকে সৌদিয়ার মিনিবাসে করে কক্সবাজার রওনা দিই। কক্সবাজার চট্টগ্রাম হতে ১৫২ কি মি দূরে অবস্থিত। ১২০ টাকা করে ভাড়া। মাঝপথে গাড়ি বিরতি দিলে নাস্তা করে নিই। বেলা ১২ টায় কক্সবাজার পৌঁছে যাই।
কক্সবাজার-সমুদ্রের শহরঃ
ঈদ পরবর্তী মৌসুম হওয়ায় প্রায় সব হোটেল রুম ভরাট। তাতে আমাদের কি যায় আসে! যেকোন ভ্রমণে তিন খাতে খরচ হয়- থাকা, খাওয়া আর ঘোরাঘুরি। আমরা থাকার পিছনে খুব বেশী খরচ করতে রাজী নই। মোটামুটি রাতে মাথা গুঁজতে পারলেই হল। আর খাওয়াও মোটামুটি লেভেলের করবো, শুধু একদিন জেলার নামকরা কোন রেস্টুরেন্টে ভুরিভোজ করা হবে। সুতরাং বেশ খুঁজে বীচ হতে একটু দূরে লালদীঘির পাশে বিলকিস হোটেলে উঠলাম। ২ বেডের একটা রুম পেয়ে গেলাম। ১ জন ফ্লোরিং করলেই চলবে।
গোসল করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বিকাল ৫ টায় সমুদ্র সৈকতে চলে যাই- পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমুদ্রসৈকত (১২০ কি মি)। আমার এই প্রথম কক্সবাজার আসা। ঈদের ছুটিতে সমুদ্রসৈকত লোকে লোকারণ্য। অনেক ভীড় থাকায় তেমন ভালো লাগলো না, সৈকতও প্রচন্ড কোলাহল আর ময়লা-আবর্জনায় বিরক্তিকর লাগলো। তাও সূর্য ডোবা দেখতে দেখতে আর ছবি তুলতে তুলতে কখন যেন সময় পেরিয়ে গেল। সন্ধ্যা নামার পর সৈকতে কিছুক্ষণ হাঁটলাম। তখন কিছুটা সুনসান হয়ে এলে ভালো লাগলো
কক্সবাজার সীবিচ - কলাতলী পয়েন্ট
লাবণী পয়েন্ট সংলগ্ন মার্কেট হতে কক্সবাজারের ট্রেডমার্ক বিভিন্ন রকমের বার্মিজ আচার কিনি। তারপর হোটেলে ফিরে আসি। রাতে শহর ঘুরতে বের হলাম। বার্মিজ মার্কেট ঘুরে দেখি- প্রায় সব দোকানে উপজাতীয় রাখাইন মেয়েরা সেলসগার্ল হিসেবে কাজ করছে। কক্সবাজার শহরকে ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে যতটা গোছানো আশা করেছিলাম ততটা লাগলো না। বরঞ্চ অনেক হিজিবিজি, পুরো শহরজুড়ে অপরিকল্পনার ছাপ স্পষ্ট। রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে হোটেলে ফিরে আসি।
রাতটা কোনমতে ঘুমিয়ে সকাল ৮ টায় আবারো বেরিয়ে পড়ি। নাস্তা শেষে ৯ টায় কলাতলী পয়েন্ট হতে মিনিবাসে প্রায় ৩১ কি মি দূরে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম হাইওয়ের পাশে দুলাহাজরা সাফারী পার্ক। টিকেট কেটে ঢুকতে হয়। কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায় ২২২৪ কি মি এলাকা জুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে বাংলাদেশের প্রথম এই ইকোপার্ক। এখানে গর্জন, তেলসূর, চাপালিশ সহ অনেক লতা-গুল্ম গাছের সমাহার এবং ১৪৫ প্রজাতির প্রায় ৪০০০ পশু-পাখির বেশ সমৃদ্ধ সংগ্রহ আছে। বানর, হরিণ, বাঘ, সিংহ, ময়ূর, শকুন, ইমু, অজগর, কুমির, চিতল, জলহস্তী, ভালুক, খরগোশ, বনবিড়াল, হাতী- প্রায় দুই ঘন্টা লাগলো পুরো পার্ক ঘুরে দেখতে। পার্ক ঘুরে দেখার জন্য বাস অথবা জীপ পাওয়া যায়, আমরা হেঁটেই দেখবো বলে স্থির করি। পার্কের মাঝে প্রায় দশ তলা সমান উঁচু একটা ওয়াচ টাওয়ার আছে- সেখানে উঠলাম। পুরো পার্ক এখান হতে দেখা যায়। ঘুরতে ঘুরতেই একটা জাপানীজ পরিবারের সাথে পরিচয় হল। একসাথে ছবি তুললাম। ঘোরা শেষে মাইক্রোতে বেলা ২ টার দিকে কলাতলী পয়েন্টে আবার ফিরে আসি।
ইনানী বীচে লেখক
কলাতলী পয়েন্টের একটা হোটেলে লাঞ্চ করে সিএনজি ভাড়া করে ইনানী বীচে রওনা হই। কক্সবাজারের দক্ষিণে ৩৫ কি মি দূরে উখিয়া থানায় ইনানী বীচ অবস্থিত। ইনানী বীচের বিশেষত্ব হল সৈকতের সাথে পাথর এবং প্রবালের খোঁজ পাওয়া যায়। ইনানী বীচে কিছুক্ষণ সময় কাটালাম। এরপর ফিরতি পথে হিমছড়ি পাহাড়। পাহাড়ের চূড়ায় উঠার জন্য সিঁড়ি আছে। চূড়া হতে সৈকতের দৃশ্য অসম্ভব সুন্দর লাগে। বিকেলবেলার সমুদ্র আর সূর্যের অপার্থিব রূপ উপভোগ করলাম। হিমছড়ির পাশেই একটা ঝর্ণা আছে, দেখে এলাম। সবচেয়ে ভালো লেগেছে কলাতলী পয়েন্ট হতে ইনানী বীচ যাওয়ার পথে যাত্রাটুকু। এই রাস্তার আরেক নাম হল মেরিন ড্রাইভ সড়ক। সেনাবাহিনী সদস্যরা সমুদ্রপাড়ে বাঁধ দিয়ে এই রাস্তা তৈরী করেছে। রাস্তার একপাশে সুউচ্চ পাহাড় অন্য পাশে বালুকাবেলা। পাহাড়ের মাঝে মাঝে ঝর্ণাধারা। আবার বালুকাবেলার মাঝে মাঝে ঝাউবন। যাত্রাপথ দারুণ উপভোগ করেছি। মনে হল এরকম একটা জায়গায় একটা বাড়ী করে স্থির হলে মন্দ হত না। কক্সবাজার মূল শহরের চেয়ে এই এলাকা অনেক সুন্দর।
হিমছড়ি - পাহাড়,আকাশ ও সমুদ্রের অপরূপ মেলবন্ধন
রায়হান ফেণী হতে সন্ধ্যার দিকে ফিরে। ও কক্সবাজার আগে ঘুরেছে। তাই একটু পরেই আমাদের সাথে যোগ দিল। ওকে নিয়ে বার্মিজ মার্কেটে কেনাকাটা সেরে রাতে কক্সবাজারের একটা নামকরা রেস্তোরাঁয় ডিনার করি- রুপচাঁদা মাছ দিয়ে। কক্সবাজারে খাবার সহ দৈনন্দিন যেকোন জিনিসের দাম তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী। খাওয়া শেষে হোটেলে ফিরি। আগামীকাল বান্দরবন যাবো।
বান্দরবন-হাতের মুঠোয় মেঘ
পরদিন সকাল ৮ টায় কলাতলী বাসস্ট্যান্ড হতে বাসে উঠি। পূর্বালী সার্ভিস- কক্সবাজার টু বান্দরবন। বেলা ১২-০০ টা নাগাদ পৌঁছে যাই। পাহাড় কেটে কেটে রাস্তা বানানো হয়েছে। পাহাড়ের মাঝে রাস্তা দিয়ে বাস চলছে। কিছুক্ষণ পাহাড়ের ঢাল বেয়ে বাস উঠছে আবার নিচে নামছে। রাস্তার একপাশে পাহাড় অন্যপাশে গভীর খাদ। দারুণ রোমাঞ্চকর যাত্রা!
ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ সহপাঠী উচিং এখানকার স্থানীয়। ও আগে হতেই হোটেল পূরবী-তে বুকিং দিয়ে রেখেছিল। নাহলে কোনমতেই রুম পেতাম না। ট্যুরিস্ট মৌসুম হওয়ায় সব রুম বুকড। দুই রুম নিই। কিছুক্ষণ ফ্রেশ হয়ে বান্দরবন সেন্ট্রাল মসজিদে জু’মা-র নামাজ পড়ি।
নামাজ শেষে বান্দরবনের গুলশানে উচিংদের বাসায় যাই। এখানেই লাঞ্চ করি। লাঞ্চে একটা মজার আইটেম ছিল কচি বাঁশের সবজি। আগে অনেক বইতে এই খাবারটার নাম পড়েছি আজ নিজে খাবার সৌভাগ্য হল। বিকাল ৪ টার দিকে এখান হতে বৌদ্ধ জাদি স্বর্ণমন্দির যাই। এই মন্দির বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বৌদ্ধ মন্দির এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম বুদ্ধ মূর্তি আছে। পাহাড়ের চূড়ায় মন্দির, রঙ গাঢ় সোনালী- দূর হতে দেখলে মনে হয় স্বর্ণের তৈরী। মন্দিরে সর্বসাধারনের ঢোকা নিষেধ। ঘুরে দেখার সময় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল।
পাহাড়চূড়ায় স্বর্ণমন্দির
সন্ধ্যায় শহরে ফিরি। রাতে বান্দরবন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের অডিটোরিয়াম-এ আদিবাসি পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখি। তারপর রাতের বান্দরবন শহর ঘুরে দেখি। বান্দরবন শহরটা খুবই ছোট। রাস্তাঘাট যাচ্ছেতাই। তবুও কক্সবাজার শহরের চেয়ে ভালো লাগলো। বার্মিজ মার্কেটে ঢুঁ মারি।
পরদিন সকাল ৮ টায় হোটেল হতে জীপ নিয়ে বেরোই। এই জীপগুলোকে স্থানীয়রা চাঁদের গাড়ী বলে। আর্মির ফোর হুইল ড্রাইভ জীপ রিজেক্ট করে বিক্রি করার পর মেরামত করে এই এলাকায় যাত্রী পরিবহনে ব্যবহৃত হয়। বান্দরবন শহর হতে ৩৮ কি মি দক্ষিণে নীলগিরি পাহাড়ে যাবো। সাথে উচিং-এর দুই কাজিন-রুমী, সং(মামা) আর বান্ধবী মাও যায়। যাত্রাপথে আদিবাসি জীবনযাত্রার দেখা মেলে। আগে বইতে ছবি দেখতাম-এবার বাস্তবেই দেখলাম আদিবাসি মায়েদের মাথায় পেঁচিয়ে বিশেষ থলেতে বাচ্চাদেরকে পিঠে নিয়ে কাজ করার দৃশ্য। পাহাড়ের এমন সব জায়গায় ঘর-বাড়ি দেখলাম, ওখানে মানুষ থাকে কি করে তাই ভেবে আমার ভয় ধরে গেল!
নীলগিরি - ছবির মত
নীলগিরি পাহাড় সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ২৪০০ ফুট উপরে। নীলগিরিতে আর্মি পরিচালিত রিসোর্টসহ পর্যটনকেন্দ্র আছে। একটা হেলিপ্যাড-ও আছে। আর্মি জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ এই পর্যটনকেন্দ্র উদ্বোধন করেছিলেন। নীলগিরিতে পাহাড়ের উপরে মেঘের খেলা দেখি। অসম্ভব সুন্দর মনভোলানো দৃশ্য। পাহাড় হতে দূরে রাস্তাগুলোকে মনে হচ্ছিল সাপের মত এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে। গাড়ীগুলোকে মনে হচ্ছে খেলনা গাড়ী। দূরে সাঙ্গু নদী দেখা যায়। একপাশে দেখলাম বিশাল উপত্যকা জুড়ে কোথাও মেঘের ছায়া আবার কোথাও ভয়াবহ রোদ। দূরে এক পাহাড়ের চূড়ায় মেঘ জমাট বেঁধে আছে, একটু পরেই ওইটুকু জায়গা জুড়ে বৃষ্টি শুরু হল। নিজেকে পৃথিবীর রাজা মনে হতে লাগলো, আমি যেন এক লহমায় সব দেখতে পাচ্ছি।
চিম্বুক পাহাড়ের বাংলোর সামনে
নীলগিরি হতে চিম্বুক পাহাড় যাই। সেনাবাহিনীর অনির্বান ২১ ক্যাম্পের পরিচালিত রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাবার খেয়ে চিম্বুক পাহাড়ে উঠি। রেস্তোরাঁয় গলাকাটা দাম, আবার ৩৫% ভ্যাট দিতে হয়। চিম্বুক পাহাড়কে বাংলাদেশের দার্জিলিং বলা হয়। তবে দুপুরবেলা যাওয়ায় নামের প্রতি সুবিচার করে এমন কিছু দেখতে পাইনি।
এমন বিল কি কেউ দেখেছে কোথাও?
চিম্বুক পাহাড় হতে শৈলপ্রপাত যাই। বান্দরবন শহর হতে থানচির পথে মাত্র ৪ কি মি দূরে মিলনছড়িতে শৈলপ্রপাত অবস্থিত। শৈলপ্রপাতে পাথরের মাঝ দিয়ে পানি বয়ে যাচ্ছে। একটা ডেঞ্জার সাইন দেখলাম-এই জায়গায় এর আগে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। পাথরের উপর দিয়ে পানি যাওয়ার পথটা খুব পিচ্ছিল। এখানে ঘন্টাখানেক থাকি।
শৈলপ্রপাত
শৈলপ্রপাত হতে চলে যাই মেঘলা পর্যটন কেন্দ্রে। মেঘলায় মিনি চিড়িয়াখানা, দুইটি ঝুলন্ত সেতু আছে। এখানে পাহাড়ী পেয়ারা আর কমলা খাই। মেঘলা ঘুরে অবশেষে চলে যাই নীলাচলে। নীলাচল বান্দরবনের সবচেয়ে নিকটতম ট্যুরিস্ট স্পট, এখান হতে বান্দরবন শহর পুরোটা দেখা যায়। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে প্রায় ২০০০ ফুট উচ্চতায়। নীলাচলে আরেকটা মজার ব্যাপার হল আমরা মেঘের মাঝে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমাদের লেভেল হতে নিচে বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি মুখ হাঁ করে মেঘ খাবার চেষ্টা করে দেখলাম। আকাশে আবার দুইটা রংধনু। বর্ণিল আকাশ আর পেঁজা মেঘের ভেলা মনটাকে ভালো করে দিল। সারাদিন ভ্রমণের ক্লান্তি একনিমেষে উবে গেল। দিনশেষে অসাধারন অনুভূতি নিয়ে শহরে ফিরে আসি।
নীলাচল হতে তোলা
রাঙ্গামাটি-পাহাড় আর হ্রদের দেশেঃ
পরদিন সকাল ৮-৩০ টার পূরবী বাসে রোয়াংছড়ি স্টেশন হতে রাঙ্গামাটি রওনা হই। রাস্তা খুবই সংকীর্ন। পাহাড়ের মাঝে বিশাল পাতাসমৃদ্ধ অজানা গাছের দেখা মেলে। বেশ অনেকগুলো লোহার ব্রীজ পার হতে হয়। বেলা ১২-৩০ টায় রাঙ্গামাটি নামি। রাঙ্গামাটির সবচেয়ে নামকরা হোটেল সুফিয়া-তে উঠি। রায়হানের ছোটমামা আগেই এই হোটেলকে রিকমেন্ড করেছিলেন। হোটেলে গোসল সেরে আবার বের হয় হই। রাস্তার উল্টোপাশেই শিংঘবা রেস্টুরেন্ট-এ লাঞ্চ করি। শিংঘবা শব্দের অর্থ বসার ঘর। রেস্টুরেন্টের মালিক অনেক আন্তরিকতা দেখালেন। তাঁর সহায়তায় ৭০০ টাকায় একটা বোট ভাড়া করে বেলা ৩ টার দিকে কাপ্তাই লেকে ভ্রমণ করি। রাঙ্গামাটি শহরে সাপের মত ছড়িয়ে আছে কাপ্তাই লেক। কাপ্তাই লেক রাঙ্গামাটির প্রধান ট্যুরিস্ট আকর্ষন। কর্ণফুলী নদীতে পানিবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বাঁধ দেয়া হলে মানুষের হাতে কেটে এই লেক তৈরী করা হয়। প্রথমে সবচেয়ে দূরে শুবলং ঝর্ণা যাই। ফেরার পথে বাকী স্পটগুলো দেখবো। প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। তাই আমরা ছাড়া আর কোন ট্যুরিস্টের দেখা মিললো না। ঝর্ণা দেখতে গিয়ে পুরো গোসল হয়ে যাই।
পেছনে শুবলং ঝর্ণা
শুবলং হতে ফিরতি পথে বরকল উপজেলার টিকটিক পাহাড়ে যাই। তারপর আবার যাত্রা- এবার কর্ণফুলী নদীর মাঝে একটা দ্বীপমত এলাকায় চাং পাং রেস্টুরেন্টে যাই। যথারীতি প্রচন্ড বৃষ্টির কারণে লোকশূণ্য। মোটা অংকের টাকা খরচ করে এখানে কফি খাই- এসেছি যখন কিছু না খেয়ে গেলে কেমন দেখায়! তারপর বোটে করে আরেকটা ছোট দ্বীপ- পেদা টিং টিং। ঘন গাছে ভরা এলাকা- গাছের ডালে এত পাখি যে পাতা বলে বিভ্রম হয়। পাখির কিচির মিচিরে পাশের বন্ধুর কথাও শুনা যাচ্ছিল না। সন্ধ্যানাগাদ যেখান হতে যাত্রা শুরু করেছিলাম বোটে করে আবার সেখানেই ফিরে আসি।
পেদা টিং টিং - পাতা নাকি পাখি?
কাপ্তাই লেক ভ্রমণে সবচেয়ে আনন্দ লেগেছিল বৃষ্টি আসার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে। আমাদের মাথার উপরে আকাশ তখনো পরিষ্কার আর বোটের একটু পেছনে আকাশ কালো হয়ে গেছে। একটু পর আকাশ একটা অপার্থিব বর্ণ ধারণ করলো। পেছনে কালো মেঘ হতে বৃষ্টি নামছে। আস্তে আস্তে মেঘ আর বৃষ্টি আমাদের দিকে এগোচ্ছে। ঠিক যেন বোট আর বৃষ্টির মাঝে রেস হচ্ছে- কে কার আগে যেতে পারে। আকাশ যে এমন বর্ণ নিতে পারে তা নিজের চোখে না দেখলে হয়তো কখনো বিশ্বাস করতাম না।
বরকল উপজেলার টিকটিক পাহাড়ে
আকাশের বর্ণ এমনও হয়!!
রাতে রাঙ্গামাটি শহরে কেনাকাটা করি। হোটেল সুফিয়ার উপরে রেস্টুরেন্ট হতে অর্ডার দিয়ে আমাদের রুমে রাঙামাটির স্পেশাল ব্যাম্বু চিকেন নিয়ে যাই। বাঁশের ভেতরে মুরগী রেখে রান্না করা হয়েছে।
ব্যাম্বু চিকেন-খেতে আর তর সইছে না!
সারাদিনের ক্লান্তিতে আগের রাতে রাজ্যের ঘুম ঘুমিয়েছি। পরদিন সকাল সাড়ে ৯ টায় হোটেল সুফিয়ার রেস্টুরেন্টে নাস্তা করি। হোটেলের গেস্টদের জন্য নাস্তা ফ্রী। রাঙ্গামাটিতে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের জুনিয়র ডায়না-র বাসা (এফ-১৮)। ওদের বাসায় যাই। কিছু সময় কাটিয়ে রাজবন বিহার- বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান এবং উপাসনাস্থল। হেঁটে বিহার পার হয়ে একটা নদী তীরে চলে আসি। এই নদী নৌকাতে পার হয়ে অন্য পাড়ে নামলেই চাকমা রাজবাড়ী। চাকমা রাজার আসল বাড়ী এখন পানির নিচে। কাপ্তাই বাঁধ তৈরীর সময় বাড়ীটা পানির নিচে চলে গেলে নতুন আরেকটি বাড়ী তৈরী করা হয়। এখানে চাকমা রাজার কার্যালয় আর সংলগ্ন চাকমা জাদুঘর দেখে হোটেলে ফিরে আসি।
চাকমা রাজবাড়ী
যাত্রা হল শেষঃ
২-৩০ টার সৌদিয়া বাসে চট্টগ্রাম রওনা হই। এই বাস ঢাকা যাবে- আমরা চট্টগ্রাম নেমে যাবো, সেখান হতে আবার নতুন যাত্রী উঠবে। বিকাল ৫-৩০ টায় চট্টগ্রাম পৌঁছে যাই। আমি আলাদা হয়ে যাই, বাকীদের রাতে বাস। ওরা শহর একটু ঘুরে দেখবে। আমি সন্ধ্যা ৬-৩০ টার বাঁধন বাসে নোয়াখালী রওনা হয়ে রাত ১১ টায় পৌঁছাই।
শেষ হল আমার সাতদিনের মহাভ্রমণ। সময়াভাবে খাগড়াছড়ি আর চট্টগ্রাম ঘুরতে পারিনি, তাও যা ঘুরেছি আর দেখেছি তা কম কিসে? আমার জীবনের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে আনন্দের স্মৃতি হয়ে আছে এই ভ্রমণ। আমরা ছয়বন্ধু এই প্রথম একসাথে কোথাও ঘুরতে যাই। এই ভ্রমণ আমাদেরকে অনেক কাছে নিয়ে আসে, আমি অনেক ভালো কিছু বন্ধুকে পাই। সাথে বেড়ানোর বোনাসটা তো আছেই। এর পরে আমার একে একে আরো অনেক ভ্রমণ করি- যে গল্প হয়তোবা আরেকদিন বলবো।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১১:২৬