মিমিদের বাড়ি গুলশানে। গুলশান-১ এ লেকের পাশে প্রকান্ড একটি দো’তলা বাড়ি। মিমির দাদা এই বাড়িটি করেছিলেন আরও বিশ বছর আগে। পূর্ব দিকের বারান্দায় দাঁড়ালে লেকভিউ দেখা যায়। এই নিয়ে তৃতীয় বারের মত ওদের বাড়িতে আসতে হলো। বারান্দায় দুটো চেয়ার দেয়া আছে। মিমির বাবা শফিকুল ইসলাম ইক্সপোর্ট ইমপোর্টের ব্যাবসা করছেন। মনে হয় ভদ্রলোক রাতে এই বারান্দায় বসেন। বারান্দার এক কোনে বেনসন এন্ড হেজেসের একটি প্যাকেট পরে আছে। ভদ্রলোকের সিগারেটের আসক্তি আছে বোঝা যাচ্ছে। যদি একদিন মিমির বাবাকে বলি,”শফিক সাহেব, নিন একটা সিগারেট ধরান” ভদ্রলোকের চেহারা কেমন দেখাবে? ভাবতেই নিজ খেয়ালে হেসে ফেললাম। মিমি পেছন থেকে চা নিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলো,”হাসছো কেন?”
“নাহ এমনিতেই, তোমার বাবা সিগারেট টানেন?”
“না তো, কেন বলতো?”
“বারান্দায় একটি সিগারেটের প্যাকেট আছে, তাই বললাম।“
“মনে হয় হায়দার চাচা এসেছিলেন, বাবার বন্ধু”
“ওহ আচ্ছা, তোমার বাবার তো চলে আসার সময় হয়েছে, আমি এখন যাই”
“আগে চা খাও, আজ তোমাকে কেন ডেকেছি জানো?”
“ধারনা করতে পারছি, চান্স ফিফটি ফিফটি”
“বলো কেন ডেকেছি তোমাকে?”
“তোমার বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে। কি ঠিক বললাম?”
“হুম তুমি বুদ্ধিমান, আচ্ছা এবার বলো তোমার সাথে পরিচয়ের পরে বাবা তোমাকে নিয়ে কেমন ধারনা পোষণ করবেন?”
“তোমার বাবা আমাকে পছন্দ করবেন, কিন্তু আমাদের ফ্যামিলি সম্পর্কে শুনে তিনি তার ভুরু কুঁচকাবেন। আমাকে হাসিমুখে বিদায় দিয়ে তোমাকে বলবে,”মিমি, তুমি একটু আমার ঘরে এসো তো, জরুরী কথা আছে।“
“তোমার সব ধারনা হয়ত সত্যি নয়, বাবা একজন চমৎকার মানুষ”
“তোমার বাবা চাইবেন তোমার স্বামী যেন ঘর জামাই থাকেন, কিন্তু এই ব্যাপারটা আমার কখনই পছন্দের না। সুতরাং তোমার বাবা তোমার হাত কখনই আমার হাতে দিবেন না। তুমি কি কাঁদছ মিমি?”
“নাহ, তুমি অনেক ইনটেলিজেন্ট রিক।“
মিমির বাবার সাথে দেখা হলো। ভদ্রলোকের ব্যাবহার সত্যিই দারুন। আতিথেয়তার ব্যাপারে জবাবহীন। তার চেহারা দেখে একটা জিনিস স্পষ্টই বোঝা যায় তিনি দারুন বুদ্ধিমান একজন ব্যাক্তি। এই ধরনের লোকেরা আলাদা একটি মুখোশ ব্যাবহার করেন। অধিকাংশ মানুষই এই মুখোশ কে আসল রূপ ভেবে ধোঁকা খায়।
রাতে বাসায় ফিরতে রাত হয়ে গেলো। দড়জা খুলে আব্বু তার চিরচারিত হাসি দিয়ে বললেন,”হ্যালো মাই লিটল ইয়াংম্যান, ইজ এভরিথিং ওকে?” বাবার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে বললাম,”আব্বু আমি আর ছোট নেই, তুমি দিনে দিনে ছোট হয়ে যাচ্ছ।“ আব্বু হাসতে হাসতে বললেন,”তাই হয়ত, যাও ফ্রেস হয়ে টেবিলে এসো, খাওয়া দাওয়া শেষে আমরা দুজনে বারান্দায় আড্ডা দেব আজ।“ বাবা সবসময় এমন হাসিখুশি থাকেন। ছোট বেলা থেকে কখনো তাকে রাগ করতে কিংবা গোমরা মুখে দেখেছি কি না মনে পরে না। ব্যাবসার ব্যাপারে তিনি কখনো বাড়িতে এসে কথা বলেন না। বাবার বারান্দায় আড্ডা দেয়ার অর্থ হচ্ছে ফ্রি ভাবে আমার সম্পর্কে জানতে চাওয়া।
খাওয়া শেষে বারান্দায় ঢুকে দেখলাম আব্বু একটা চেয়ারে বসে হা করে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে ঐটা চাঁদ নয় যেন একটা রসগোল্লা, এক্ষুনি তিনি টপ করে গিলে ফেলবেন আর পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যাবে। আমি আব্বুর পাশের চেয়ারে যেয়ে বসলাম। আমিও আব্বুর মত হা করে চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আব্বু হো হো করে হেসে ফেললেন। ছোট বেলা থেকেই এই কাজটা আমি করি, আব্বু যদি অন্যমনস্ক হয়ে কোনদিকে তাকিয়ে থাকেন তাহলে আমিও তার পাশে সেইরকম করে তাকিয়ে থাকি। একসময় দুজনই হেসে ফেলি। আব্বু আমার দিকে না তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,”তারপরে? তোমার তো ফাইনাল চলে এসেছে। ভার্সিটির শেষে কি করবে কিছু ভেবেছ?”
“হুম কিছুটা, বর্তমানে চাকরি বাকরি তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। ভাবছি তোমার ব্যাবসাটা দেখাশোনা করবো।“
“তুমি কি আমাকে খুশি করার জন্য একথা বলছো?”
“হ্যাঁ বাবা, তুমি ধরে ফেলেছ”
“তুমি যা খুশি করতে পারো, আমি তোমাকে কোন চাপ দেব না।“
“আমি নিজ থেকে কিছু শুরু করতে চাই, ভাবছি টেকনোলজি সাইটে কিছু করবো”
“আমিও তোমার মতই ছিলাম, বাবা দরিদ্র ছিলেন বলে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পড়েছি। তারপরে এখন নিজ চেষ্টায় এই ব্যাবসা দাঁড় করিয়েছি। আমি ছোট একটি দোকান ভাড়া নিয়ে গাড়ির চাকা বিক্রি শুরু করেছি। সেখান থেকে আজ ঢাকা শহরে তিনটা শো রুমের মালিক। মধ্যবিত্ত হলেও আমি তোমাকে সব কিছু দিয়েছি যেসব আমি ডিজারভ করতাম তোমার বয়সে থাকতে। তুমি নিজে কিছু করতে চাইলে সেই পথ খোলা আছে, আর যেকোন হেল্প এর ব্যাপারে আমি আছি তোমার সাথে।“
“আমি জানি আব্বু, তোমার কি মনে পরে তুমি কখনো কোন ব্যাপারে আমাকে “না” শব্দটা বলেছ?”
আবারো দুজনে শব্দ করে হেসে ফেললাম। আমার আম্মাজান ঘাসফড়িং এর মত চুপচাপ দাঁড়িয়ে দড়জার পেছন থেকে আমাদের কথা শুনছিলেন। বিরক্তি নিয়ে বারান্দায় ঢুকলেন যেন জরুরী কিছু খুঁজছিলেন। তারপরে আবার বেরিয়ে যেতে চললেন। আমি বললাম , “আম্মা এসো আজ তিনজনে বসে জোছনা দেখি, আব্বু আজ হা করে আর একটু হলে চাঁদটা খেয়ে ফেলতেন। আমাদের আর জ্যোৎস্না দেখা হতো না ” আম্মা এই সুযোগের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। তিনি হাসি মুখে এসে পাশে বসলেন। আজ রাতটা আমরা জোছনা দেখব, শব্দহীন জোছনা।
দুই বছরে এই প্রথম নীনার ফোন কিংবা মেসেজ না পেয়েই ঘুম ভাঙলো। ব্যাপারটা আসলেই অদ্ভুত। যত কিছুই হোক ও আমাকে ফোন করবেই। ভাবলাম ভার্সিটিতে যেয়ে ওকে ব্যাপারটা বলবো। নীনা আজ ভার্সিটিতে আসেনি। সন্ধ্যায় আনন্দের বাসায় গিয়েছিলাম। আনন্দ আমার সবথেকে ভালো বন্ধু, দুই বছর আগে রোড একসিডেন্টে মারা গেছে। মাঝে মাঝে ওদের বাড়িতে যাওয়া হয় সেজন্যই। ওর মা রাধাদেবী আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন আর টপটপ করে চোখের জল ফেলেন। আনন্দের বাবা আমার গায়ে হাত বুলিয়ে নিজের ছেলেকে ভেবে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন। এই বাড়িতে আসলে আমাদের তিনজনের চোখের জলে বাতাসের আদ্রতা বেড়ে যায়। আশেপাশে মেঘ থাকলে নিশ্চয়ই বৃষ্টি হতে পারতো।
রিকশায় উঠে মোবাইল বের করে ফোন দিলাম নীনাকে। আজকের ব্যাপারটা নিয়ে আমার মাঝে বেশ কৌতহল জন্মেছে। প্রথম বার রিং হয়েছে কিন্তু কেউ ফোন ধরেনি। দ্বিতীয়বার একটি ছোট মেয়ে ফোন ধরলো। আমি জানি নীনা ইচ্ছে করেই ওর ভাগনী আফরিন কে দিয়ে লাউডস্পিকারে ফোন ধরিয়েছে, ও আশেপাশে কোথাও বসে আছে। আমি বললাম,”আফরিন নীনা কি তোমার পাশেই আছে?” আফরিন চুপ করে থেকে বললো,”আসলে আমি মিথ্যে বলতে পারি না, কিন্তু এখন একটা মিথ্যে কথা বলবো, নীনা আন্টি বাসায় নেই।“
“আচ্ছা তাহলে আমি ফোন রেখে দেই”
“ফোন রাখবি কেন গাধা? কেন ফোন করেছিস?” নীনা ফোন ধরেছে।
“নাহ, আজ সারাদিনে তুই ফোন করিসনি, তাই ভাবলাম শরীর খারাপ হয়ত।“
“নাহ সব ঠিক আছে, শোন আমি ঠিক করেছি তোকে আর কখনো ফোন করবো না। আমার বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে গেছে। আগামী মাসে ছেলে বাইরে থেকে এসে এঙ্গেজ করবে। এখন পর পুরুষের সাথে কথা বলা আমার মানায় না, তুই বুঝতে পারছিস গাধা? তাই আমি ঠিক করেছি আর কোন দিন তোকে ফোন করবো না।“
“হুম বুঝতে পারছি, অন্তত তোর জ্বালা থেকে বাঁচলাম। তুই কি আর ক্লাস করবি না?”
“বুঝতে পারছি না, আমার হাজবেন্ড যদি পারমিশন দেয় তাহলে ফাইনাল দেব, নইলে দেব না। তুই এত দুশ্চিন্তা করছিস কেন? আমার প্রতি কি দুর্বল হয়েছিস? শোন এখন আর টাইম নেই। তুই দুর্বল হলেও আর লাভ নেই, আমার বাবাকে তো চিনিস। সে যখন বলেছে তো সেটাই করবে, সুতরাং তোর আর চান্স নেই।“
“খুব ভালো ইনফরমেশন দিলি, আমাকে উদ্ধার করলি। এখন রাখলাম।“
“আরে শোন, ছেলে কি করেছে জানিস? আমার জন্য অলরেডি একটা ডায়মন্ড রিং পাঠিয়েছে। তুই দেখলে পাগোল হয়ে যাবি। আর একটা টেডি বেয়ার পাঠিয়েছে, আচ্ছা আমি কি বাচ্চা? আর শোন......”
ফোন কেটে দিলাম। সারা রাতেও ওর বকবকানি শেষ হবে না। মেয়েরা নাটকীয়তা খুব ভালো জানে। দেখা যাবে কাল সকালেই আবার ফোন করে বকবকানি শুরু করে দেবে। যেখানে বড় বড় মনিষীরা নারীর মন বুঝতে পারেনি সেখানে আমি কিভাবে বুঝব?
(চারপর্বে ১৪ তারিখ ভ্যালেন্টাইন্স ডে -তে সমাপ্ত হবে। পরবর্তী পর্ব থাকছে আগামিকাল)
রোদের পরে মেঘ কেঁদেছে, ইচ্ছে তোমায় ছুটি।
রোদের পরে মেঘ কেঁদেছে, ইচ্ছে তোমায় ছুটি- (দ্বিতীয় পর্ব)