যদি একটি শিশুকে বলা হয়, তোমার বাবা আর মায়ের মধ্যে কে বেশি ভালো? শিশু দ্বিধায় পড়ে যায়, কারণ সে বাবা এবং মা-কে আলাদা করে ভাবতে শেখে নি। দু’জনই তার দেহ ও আত্মা জুড়ে বিরাজ করছে, দুজনই তার পরম আপনজন, সে একই সাথে বাবা ও মা উভয়েরই চোখের মণি। বাংলা সাহিত্যের দুই দিকপাল রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল এভাবেই হতে পারতেন বাঙালির দুই চোখের মণি। কিন্তু সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির কারণে আমরা শিশুর সেই সারল্য থেকে চিরবঞ্চিত, ফলে একই সাথে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের অমর সাহিত্যের রসাস্বাদন করার সৌভাগ্য থেকেও আমরা বঞ্চিত। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ এবং বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম আমাদের এমন দু’টি সম্পদ যার মূল্যায়ন যদি আমরা করতে পারি, তবে দেখবো বাঙালি জাতি বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে সম্রাটের আসনে উপবিষ্ট হতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, গত কয়েক শতাব্দী ধোরে এই জাতিকে ইউরোপিয়রা শাসন ও শোষণ করে চলে যাওয়ার সময় বোধবুদ্ধি-কাণ্ডজ্ঞানটুকুও যেন নিয়ে চলে গেছে।
মুসলমানদের মধ্যে যারা মাদ্রাসায় শিক্ষিত এবং যারা ধর্মমনা তারা রবীন্দ্রনাথকে একজন হিন্দু কবি হিসাবে দেখেন এবং বচনে-বাচনে অশ্রদ্ধা প্রকাশ করেন। মুসলিম বংশোদ্ভূত কবি নজরুলের প্রতি প্রীতি প্রদর্শন করতে গিয়েই অনেক ক্ষেত্রে এই অশ্রদ্ধার সূত্রপাত ঘটে। তারা নজরুল ও রবীন্দ্রনাথকে পাল্লার দু’দিকে তুলে ওজন করেন এবং বহু বৈপরীত্যমূলক তুলনা হাজির করে রবীন্দ্রনাথকে হেয় করেন। অপরদিকে তথাকথিত ‘প্রগতিশীল বাঙালী’-রা রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা-ভক্তি করতে গিয়ে একেবারে উপাস্য দেবতার আসনে বসিয়ে দিয়েছেন। আমাদেরই একজন শ্রদ্ধাভাজন কবি বেগম সুফিয়া কামাল বলতেন যে, রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা তার কাছে ‘এবাদততুল্য’। অনেক রবীন্দ্রভক্ত নজরুল ইসলামকে কথায় কথায় তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন অর্থাৎ দু’দিকেই চরম ভারসাম্যহীনতা এবং আবেগের আতিশয্য এসে আমাদের এই দু’জন কবির আসল চেহারাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এটা একটি মানসিক দৈন্য ছাড়া আর কিছু নয়। এই বিতর্ক রজনৈতিক অঙ্গনেও বিস্তার লাভ করেছে। যেমন নজরুল ডানপন্থীদের আর রবীন্দ্রনাথ বামপন্থীদের সম্পত্তি। এর অন্তর্নিহিত কারণ বাংলা সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে পাক সরকার রবীন্দ্র-নজরুল দ্বন্দ্ব খাড়া করে বিভাজন তৈরির অপকৌশল গ্রহণ করেছিল। রবীন্দ্র চর্চা সরকারী ভাবে নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছিলো হিন্দুয়ানী সংগীত বলে, এর পরিবর্তে নজরুল চর্চাকে উৎসাহ দেয়া হয়েছিলো মুসলমান বংশোদ্ভূত হিসেবে।
‘রবীন্দ্র-নজরুল দু’জনই স্রষ্টার নৈকট্য লাভের জন্য আপ্রাণ সাধনা করেছেন। অনেকে রবীন্দ্রনাথকে হিন্দু মনে করে, আসলে তিনি হিন্দু ছিলেন না, মূর্তিপূজারী ছিলেন না, তিনি একেশ্বরবাদী ব্রাহ্ম ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন সেই এক ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের জন্য সঙ্গীতের মাধ্যমে সাধনা করে গেছেন। এদিকে নজরুলও আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের জন্য আকুলপ্রাণ ছিলেন, সাধক ছিলেন। কিন্তু পার্থক্য হোল রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরের সান্নিধ্য চাইতেন ঈশ্বরের সামনে নিজেকে নত, আরও নত, আরও নত করার মাধ্যমে, নিরহঙ্কার হেেয় নিজেকে ক্ষুদ্র করার মাধ্যমে। তার প্রক্রিয়া ছিল,
‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধূলার তলে,
সকল অহঙ্কার হে আমার ডুবাও চোখের জলে।’
অপরদিকে নজরুল ছিলেন ঊর্দ্ধমুখী। আল্লাহর সান্নিধ্যের জন্য তিনি ছিলেন দুর্বিনীত। তার প্রক্রিয়া ছিল:
মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাঁড়ি
চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারা ছাড়ি
ভূলোক দ্যূলোক গোলোক ভেদিয়া
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাত্রীর!
‘আধ্যাত্মিকভাবে আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের অনেক পথ বের করা হয়েছে। নজরুল ইসলামও চেয়েছিলেন আল্লাহর সান্নিধ্য। কিন্তু এর জন্য তিনি এক বিপদ্জনক পথ বেছে নিয়েছিলেন। তার অসুস্থতার পেছনে হয়তো এটা একটি কারণ।’
সুতরাং রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের মাঝে তুলনা করতে যাওয়া নিঃসন্দেহে একপ্রকার অভব্যতা। সাহিত্যকর্ম কোন বস্তুগত সামগ্রী নয় যা সেরদরে ওজন করে তুলনা করা হবে, অনেকসময় একটা গান কিংবা কবিতাই মহাকাব্য হয়ে যায় কিংবা কেবল একটিমাত্র সৃষ্টির জন্যেই কোন কোন কবি অমর হয়ে থাকেন তাই পরিমাণ কিংবা সংখ্যার বিচারে যে তুলনা করা যাবে সেটাও না। রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল দুজনের প্রতিভাই বহুমাত্রিক এবং সেটা অবশ্যই মহান আল্লাহর বিশেষ দান, তাই কোন একটি মানদণ্ডে এদের প্রতিভা কিংবা অবদানের তুলনা করা যাবে না।
কেউ কেউ রবীন্দ্রনাথ জমিদার পরিবারে জন্মেছিলেন বলে খাটো করতে চান। তাদের উদ্দেশ্যে বলবো- বিশ্বের সবচেয়ে বড় ধনীব্যক্তির ছেলেকে বলে দেখুন তো তাকে দিয়ে একটা কবিতা লেখানো যায় কিনা! তাই এইপ্রকার বলাটাও অনুচিত।
নজরুল নোবেল পুরস্কার পান নি বলে কেউ কেউ তাকে ছোট করতে চান। কিন্তু ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য যারা বিপ্লব করে গেছেন (যেমন মহাত্মা গান্ধী) তাদের মধ্যে কেউ কি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন? প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রকাব্যের প্রায় পুরোটাই আধ্যাÍিকতা ও ভাবের মিশ্রণ, এজন্যই গীতাঞ্জলি নোবেল জিতেছিল। পক্ষান্তরে নজরুল তো ভাববাদী ছিলেন না, ছিলেন সমাজবাদী। ব্রিটিশ তাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে তিনি তাঁর গানে-কবিতায় নাড়াতে চেয়েছিলেন সমাজকে। যিনি লিখেছেন: “তোরা এদেশ ছাড়বি কিনা বল? নইলে মোরা কিলের চোটে হাড় করবো জল।” তার তো নোবেল পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এই একটা দিক থেকে নজরুল সবার চেয়ে এগিয়েই থাকবেন, দ্রোহের কবিতায়, তার মতো এমন অগ্নিঝরা গান কিংবা কবিতা আর কেউ লিখেন নি কিংবা লিখতে পারেন নি। তিনি ইংরেজের রুদ্র রোষে জেলে গেলেন, প্রহারের পুরস্কার পেলেন, জেলে অবিচার ও অনাচারের বিরুদ্ধে অনশন করলেন, কত লুকিয়ে বেড়ালেন, তবু তিনি কাপুরুষের মত ইংরেজের সাথে হাত মেলান নি। তার অগ্নিবর্ষক কলমে লিখে চললেন কবিতা, প্রবন্ধ ও গল্প। তার বিখ্যাত বই ‘ভাঙার গান’ ইংরেজের দরবারে কুখ্যাত বলে বিবেচিত হওয়ায় বাজেয়াপ্ত হয় ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু তবু তিনি ভীত হয়ে পড়েন নি অথবা কোন দুর্বলতায় কলমের গতি পরিবর্তন করেন নি। তাই তার ‘যোগবাণী’ বইও বাজেয়াপ্ত হয় এ বছরই। তার ‘চন্দ্রবিন্দু’, ‘বিষের বাঁশি’-ও বাজেয়াপ্ত হলো। তখন নজরুলের প্রচেষ্টা আর সম্পাদনায় যে পত্রিকাগুলি চলত সেগুলি হচ্ছে নবযুগ, ধুমকেতু, লাঙ্গল প্রভৃতি। এ প্রত্যেকটি পত্রিকা অত্যাচারী সরকার নিষ্ঠুর হাতে বাজেয়াপ্ত করেছিল। তাছাড়া তার অগ্নিবীণা বইটিও সরকার বরদাস্ত করতে পারে নি। একজন লেখকের এতগুলি বই বাজেয়াপ্ত হওয়ার ইতিহাস সত্যিই বিরল। ইংরেজ বিরোধিতা ছাড়াও নজরুলের লেখায় আল্লাহর প্রকৃত এসলামের সংগ্রামী চেতনার দিকটি বেশ নিখুঁতভাবে ব্যাক্ত হয়েছে যা বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে চিরকাল অমর হয়ে থাকবে।
নজরুলকে নিয়ে আজ যে মুসলমান ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ সমাজে এত মাতামাতি, ব্রিটিশ আমলে কিন্তু তাদের তেমন কাউকে নজরুলের সমর্থনে খুঁজে পাওয়া যায় নি। কেউ এই মহান প্রতিভার পৃষ্ঠপোষণে এগিয়ে আসে নি। বরং দারিদ্র্য এবং নিজ জাতির অবহেলাই ছিল তার ললাট-লিখন। এর একটি কারণ তিনি হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি চেয়েছিলেন। উপরন্তু ছিলেন ধর্মান্ধতা ও ধর্মব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার। তিনি লিখেছিলেন, “মসজিদ আর মন্দির ঐ শয়তানের মন্ত্রণাগার”। আরও লিখেছিলেন:
তব মসজিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী।
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবী!…
খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা?
সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি শাবল চালা!
হায় রে ভজনালয়,
তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়!
অন্যত্র লিখেছেন:
খোদা খোদ যেনো করিতেছে লয়
পরাধীনদের উপাসনালয়!…
এসব অনলবর্ষী এবং চরম সত্যগুলি হজম করতে না পেরে ‘আলেম মওলানা সাহেবরা’ নজরুলকে কাফের ফতোয়া দিয়েছিল এবং সর্বত্র অপাংক্তেয় করে রেখেছিল।
পরিশেষে বলতে চাই, যে তুলনা করা হয় এদের দুজনের মাঝে তা দেখলে নজরুল নিজেই হয়তো জিভে কামড় দিতেন, আর রবীন্দ্রনাথও নিশ্চিত অস্বস্তিবোধ করতেন, যখন ছেলে তার বাপকে ছাড়িয়ে যায় কিংবা শিষ্য তার গুরুকে ছাড়িয়ে যায় তখন এই বাবা আর গুরু এই দুই শ্রেণীর লোক বরং খুশীই হন, নজরুল হয়তো রবীন্দ্রনাথকে ছাড়িয়ে যেতে পারেন নি তবু এদের দুইজনকে নিয়ে যে নোংরা তুলনাবিচার করা হয় তাতে তারা দু’জনেই বিব্রত হতেন। ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের ক্ষেত্রেও নজরুল রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রেখে লিখেছেন,
“পরোয়া করি না, বাঁচি বা না-বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে,
মাথার উপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে।
প্রার্থনা করো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ! (কবিতা- আমার কৈফিয়ত)
এরা দুজনেই বাংলা সাহিত্যের আকাশের দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র, তাদের একজন যদি বাংলা সাহিত্যের নয়নমণি হোন তবে আরেকজন তার প্রাণ…!!! কবি নজরুলের চেয়ে গীতিকার নজরুল যে অনেক শক্তিশালী তা সবার জানা। গীতাঞ্জলি কাব্যের সব গান নজরুলের মুখস্ত ছিল। এসব গান তিনি ভালো গাইতেও পারতেন। কবিগুরু ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর কাছে এ তথ্য শুনে বিস্মিত হন। বলেন- অদ্ভুত স্মৃতিশক্তি তো! আমার গীতাঞ্জলির গান সব তো আমারই মনে থাকে না।
কে বড়ো কবি- এ প্রশ্নেও বিস্তর তর্ক-বিতর্ক হয়েছে মৌখিক এবং লিখিতভাবেও। ‘তুলনামূলক সাহিত্য’ আলোচনা আধুনিক সাহিত্য-গবেষণার একটি প্রয়োজনীয় অধ্যায়। কলকাতার ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকার আগস্ট, ১৯৮৬ সংখ্যায় প্রকাশিত ড. আহমদ শরীফের এক লেখার জবাব দিতে গিয়ে গবেষক-কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ বলছেন : ‘কিন্তু তুলনা যদি কাউকে ছোটো করার জন্যে, এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের, তখন ব্যাপারটা অশ্লীল ও অরুচিকর হয়ে ওঠে। সাহিত্যে কোনো প্রতিযোগিতা নেই, প্রত্যেকে তার স্বাতন্ত্রিকতায় চিহ্নিত।’
তবে কেন আমরা ‘তুলনামূলক সাহিত্য’ বিচার করতে গিয়ে শুধু সময়ের অপচয় করি? সেই পথ থেকে সরে আসাই কি আমাদের সবার জন্য মঙ্গলজনক নয়?
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মে, ২০১৪ বিকাল ৩:১৯