বৃহস্পতিবার থেকে নিখোঁজ ছিলেন নড়াইল পৌরসভার কাউন্সিলর ইমরুল কায়েস। এ সময় থেকেই উদ্বিগ্ন ছিল পরিবার। অজানা আশঙ্কায় ছিলেন তারা। অবশেষে পুলিশের মাধ্যমে সন্ধান পেলেন তার। কিন্তু ততক্ষণে তার ঠিকানা হয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে।
সোমবার রাত সাড়ে ৩টার দিকে মতিঝিলের এজিবি কলোনির কাঁচাবাজার এলাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হয়ে অজ্ঞাত হিসেবে সেখানে ছিল তার লাশ। একটি নয়, দুটি নয়, ১০টি বুলেটে বিদ্ধ হয়েছে তার বুকে। ক্ষত-বিক্ষত হয়ে রক্তে ভেসে গেছে পুরো শরীর। এর আগে ভোরে তার সঙ্গে থাকা মোবাইলফোন থেকে পরিবারকে জানায়, এই ফোনের মালিক এক্সিডেন্ট করেছেন। তিনি এখন ঢাকা মেডিক্যালে আছেন। এ সংবাদ পেয়ে ছুটে আসেন স্বজনরা। এসেই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। সুদর্শন, সুঠাম ও সদা হাস্যোজ্জ্বল মানুষটির নিথর দেহ এখন মর্গে। নিহতের স্বজনদের অভিযোগ, ইমরুলকে পরিকল্পিতভাবে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা হত্যা করেছে। তারা এ ঘটনার বিচার দাবি করেছেন।
নিহতের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস জানান, গত সপ্তাহে ঢাকায় আসেন ইমরুল কায়েস। ঢাকার আসার পরেই গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে তার খোঁজ পাচ্ছিলেন না পরিবারের সদস্যরা। স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌসের ধারণা ওই দিন রাতে ইমরুলকে ডিবি পুলিশ আটক করেছিল। তিনি অভিযোগ করেন, ইমরুল কায়েস একজন জনপ্রতিনিধি। জনপ্রিয়তার কারণেই ডিবি পুলিশকে দিয়ে যে কোন একটি মহল তাকে হত্যা করিয়েছে। তিনি স্বামী হত্যার বিচার দাবি করে বলেন, যদি ইমরুল কোন অপরাধ করেন আইন অনুযায়ী তার শাস্তি হবে। স্বাধীন দেশে বিচার বর্হিভূতভাবে কেন একজন জনপ্রতিনিধিকে হত্যা করা হলো? প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, আমাদের তিন বছর বয়সী একমাত্র সন্তানকে যারা এতিম করছে আমি তাদের বিচার চাই, আমি তাদের শাস্তি দেখতে চাই।
সড়ক দুর্ঘটনায় ইমরুল নিহত হয়েছেন এমন খবর পেয়ে ঢাকায় ছুটে আসেন নিহতের খালাতো বোনের স্বামী আইনজীবী জাহিদুর রহমান। তিনি জানান, ইমরুল কায়েস জনপ্রতিনিধি হিসেবে সামাজিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি কোন নাশকতায় জড়িত নন। এমনকি কোন রাজনৈতিক দলের কোন দায়িত্বে তিনি নেই। ঢাকা এলে তিনি রাজধানীর ওয়ারী এলাকার দক্ষিণ মুন্সীদি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে একটি বাসায় থাকতেন। গত সপ্তাহে তিনি ঢাকায় আসেন। এরপর বৃহস্পতিবার নিখোঁজ হন।
পুলিশ জানিয়েছে, সোমবার ভোর রাতে মতিঝিলের এজিবি কলোনির ১০ নম্বর ওয়ার্ড কাঁচাবাজার এলাকায় একদল নাশকতাকারী অবস্থান করছে এমন সংবাদের ভিত্তিতে রাত ৩টার দিকে ডিবি পুলিশের একটি দল সেখানে অভিযান চালায়। এসময় পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে দুর্বৃত্তরা গুলি ছুড়লে পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। একপর্যায়ে অন্য দুর্বৃত্তরা পালিয়ে গেলেও ইমরুল কায়েস বুকে গুলিবিদ্ধ হন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে ঢামেক হাসপাতালে নিলে ভোর সাড়ে ৪টার দিকে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরবর্তীকালে লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালের মর্গে পাঠায় মতিঝিল থানা পুলিশ। ঘটনাস্থল থেকে একটি পিস্তল, দুই রাউন্ড গুলি এবং অবিস্ফোরিত ৫টি হাতবোমা উদ্ধার করে ডিবি। গোলাগুলিতে ডিবি পুলিশের ১৭ রাউন্ড পিস্তলের এবং ২৩ রাউন্ড শর্টগানের গুলি খরচ হয়েছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (পূর্ব) জাহাঙ্গীর হোসেন মাতব্বর জানিয়েছেন, ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের আগে নড়াইলে সহিংসতায় জড়িত ছিল ইমরুল কায়েস। তার আগের বছর ডিসেম্বরে নড়াইল থানায় পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় তিনি জড়িত ছিলেন বলে জাহাঙ্গীর হোসেন মাতব্বর জানান। তিনি আরও জানান, ক্রসফায়ারে কায়েস নিহত হওয়ার পর তার কাছে থাকা মোবাইলফোন থেকে তার স্বজনদের কাছে কল দিয়ে নিহত হওয়ার বিষয়টি পুলিশ জানিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিহত ইমরুল কায়েস এলাকায় জামায়াত সমর্থক হিসেবে পরিচিত থাকলেও জামায়াতের সাংগঠনিক কোন দায়িত্বে ছিলেন না। গত বছরের ২০শে সেপ্টেম্বর নড়াইলে জামায়াত-পুলিশ সংঘর্ষের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় তিনি ছিলেন ৩৯ নম্বর আসামি। ওই মামলার পর থেকে তিনি পলাতক ছিলেন। পলাতক অবস্থাতেই নিখোঁজ হন এই জনপ্রতিনিধি। নিখোঁজ হওয়ার তিন দিন পর লাশ পাওয়া গেল। ঢাকা মেডিক্যাল সূত্রে জানা গেছে, নিহতের বুকের ডান দিকে ১০ গুলি বিদ্ধ হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় প্রতিটি গুলিই বুক বিদ্ধ করে বের হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে সোমবার সন্ধ্যায় নিহতের লাশ তার স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। নিহত ইমরুল কায়েস নড়াইল পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর। তার গ্রামের বাড়ি নড়াইলের দুর্গাপুর উপজেলায়। আনারকলি নামে তার তিন বছর বয়সী একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। তার পিতার নাম আনোয়ার মোল্লা।