বিভাগে যে ঘরটাতে বসি, সেখানেই বসে কাজ করছিলাম। সন্ধ্যার পরে সচরাচর যেভাবে নির্জন ঐ কম্প্লেক্সে যাই, সেভাবেই গেছি, কিছু লিখব ভেবে হয়তো কাগজ-কলম সামনে নিয়েই বসেছিলাম; ততক্ষণে রাত নেমেছে, সে সময়ে তো নয়ই, সন্ধ্যা নাগাদও করিডোরে কারো পায়ের শব্দ কখনো শুনি না। কিন্তু খুব তাৎক্ষণিকভাবে আমার ঘরে দুই যুবক ঢুকে পড়ল। তাদের কাউকেই আমি চিনলাম না। অবশ্য দুজনের কেউই আমাকে তাদের চিনবার অবসরটুকুও দিলো না। একজন যা করল তাতে আমি যারপরনাই বিস্মিত। সে ঐ ঘরে ঢুকে খুব স্বাভাবিক হাঁটার ভঙ্গিতে দরজার বিপরীত দিকের দেয়ালের মাঝের জানালা পার হয়ে বাইরে চলে গেল। ঘটনাটা ভৌতিক, কেননা মানব দেহের পক্ষে জানালার গ্রিল অতিক্রম করে যাওয়া অসম্ভব। তখন ভাবলাম, আমি হয়তো স্বপ্ন দেখছি। এই যখন ভাবছি, তখনই অন্য যুবকটি আমার দিকে এগিয়ে এলো। খুব কাছে এসে বসে থাকা আমার চোখের দিকে ঝুঁকে এলো। বেশ বুঝতে পারলাম সে আমার চোখজোড়া উপড়ে নিতে প্রস্তুত। এরপর হলো তাই যা হবার ছিল। আমার ঘুম ভাঙল আর ঐ নিষ্ঠুর যুবকের ছুরির নিচ থেকে আমি আমার চোখজোড়া বাঁচাতে পারলাম।
ফ্রয়েড ডাক্তার আর ইয়ুঙের খাবনামা যাই বলুক, এই স্বপ্নে আমার কোনো ইচ্ছাপূরণই হয় নাই। বরং কদিন ধরে মনের মধ্যে যে আতঙ্কের একটা খুব নীরব নাট্য যুক্তিবোধের সঙ্গে কুস্তিলড়াইয়ের মহড়া দিচ্ছিল তারই কয়েকটি স্ন্যাপশট দেখা গেল স্বপ্নে। বাস্তবে গত কদিনের আতঙ্কটা যে খুব সরাসরি ছিল তা-ও না। সন্ধ্যার পর যখন বিভাগে বসে কাজ করি এমনিতে কোনো ভয় তখন আমার মধ্যে কাজ করে না। কিন্তু দু'তিন দিন আগে ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক ড. এমরান জাহান বলছিলেন, একা একা বসে কাজ করেন, ভয় পান না? আমি বলি, না তো; আপনি কি ভয় পান? উনিও দোতলায় তার ঘরে রাত দশটা এগারোটা অব্দি বসে কাজ করেন এবং ভয়ে ভয়ে থাকেন। এই কথা হওয়াটা যে আমার মনে আতঙ্কের জন্ম দিয়েছিল তা না। গত কয়েক সপ্তার খবর কাগজ বরং একটা ভূমিকা রেখে থাকবে। খবরগুলো কাগজেই পড়েছিলাম, ড. এমরান জাহানও পড়ে থাকবেন। সেই যে একজন নকশাদার ভোরবেলা অফিস যাচ্ছিলেন, দুজন লোক জোর করে তাকে তুলে নিল মোটর সাইকেলে, তারপর নিয়ে কোথায় একটা বাড়ির গেটের ভেতর ঢুকিয়ে গুলি করে মেরে ফেলল। আবার সেই খবরটাও তো পড়েছিলাম, ড. এমরান জাহানও হয়তো পড়েছিলেন; সেই যে বিজ্ঞাপনী সংস্থার একজন প্রকৌশলি, অফিসে বসে আছেন হঠাৎ সেই অফিসে ঢুকে কয়েকজন সশস্ত্র লোক গুলি করল সেই প্রকৌশলিকে। আবার সেই যে বাজার গিয়েছিল একজন, হঠাৎ সেইখানে...। কিন্তু চোখ, চোখ কেন? সেটাও এসেছে খবর কাগজ থেকে, অনুমান করি। ফরিদপুরে, সমাজের মাতবরেরা এক হতভাগ্য পিতাকে ছেলের চোখ উপড়ে ফেলতে বাধ্য করল। খবরটা পড়েছিলাম, শত শত লোক সেখানে উপস্থিত ছিল। স্ন্যায়ুর দরজাগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়া শত শত লোক, জনতা, যারা রাষ্ট্র কর্তৃক এক হাজারের বেশি মানুষকে বিচারের বাইরে মেরে ফেলার খবর বিভিন্ন সময়ে শুনেছে বা দেখেছে, প্রতিদিন নানা ভাবে লাশ দেখে যারা। কত না কারণে বিপদের মধ্যে থাকে; এরকম মানুষের মধ্যকার হাজার কয়েক লোকের সামনে চাঁপাইনবাবগঞ্জে, সেই যে চুরির স্বীকারোক্তি করাতে গাছে ঝুলিয়ে পেটাল, সকাল থেকে ইউপি অফিস থেকে মাইকিং করাও হয়েছে, জনতা পুলিশকে কাছ ঘেঁষতে দেয়নি নাকি।
এ বাবদে কুন্ডেরার আইডেনটিটি উপন্যাসটার কথা মনে পড়ছে। শাঁতাল নামের অপেক্ষাকৃত বেশি বয়েসের একটি মেয়ে ও তার প্রেমিক জাঁ মার্ক-- এই দুজনের কাহিনি সহযোগে উপন্যাস শুরু হয় এক সমুদ্র উপকুলে আর শেষ হয় লন্ডনে শাঁতালের আত্মগোপনের ভেতর দিয়ে। কাহিনির যেখানে শেষ সেটি স্পষ্টত এবং আক্ষরিক অর্থেই এক দুঃস্বপ্ন। শাঁতাল জাঁ মার্ককে ছেড়ে ট্রেন ধরে চলে গেল লন্ডন এবং জাঁ মার্কও তাকে অনুসরণ করে সেখানে গিয়ে হাজির। কিন্তু স্টেশনে নেমে একটা শুটিং হচ্ছিল বিধায় ধাক্কাধাক্কি করে ক্যামেরাম্যানের লাথি ও পুলিশের প্যাদানি খেয়েও অবশেষে শাঁতালকে সে হারিয়ে ফেলে; স্ট্রীটলাইটের আলোয় বেঞ্চিতে বসে অদূরের উজ্জ্বলআলোজ্বলা এক বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে মার্ক। ওই বাড়িটিতে জোর করে ঢুকতে গিয়ে পাহারাদারের মার খেয়ে ফিরে আসে। শাঁতাল যৌনউৎসবের এক পর্যায়ে বাড়িটিতে নিজেকে এক বৃদ্ধের সঙ্গে আবিস্কার করে যে তাকে অন্য একজনের নামে সম্বোধন করে, এবং সে কোথায় যাবে জানতে চায়। নগ্ন হবার আগে পোশাক রেখে এসেছে যে জায়গাটায় সেখানেও যেতে পারছে না সে, অন্য মেয়েরা সবাই চলে গেছে। কাঠে পেরেক আটকাবার শব্দ শোনে সে। বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। পরের অধ্যায়ে জাঁ মার্ক শাঁতালকে জেগে উঠতে বলছে। কিন্তু কখন তারা এই দুঃস্বপ্নটি দেখতে শুরু করেছে? উপন্যাসের গল্প এই স্বপ্নে পৌঁছেছে বাস্তবের সঙ্গে পরম্পরা রক্ষা করে। দুঃস্বপ্নটি কি শুরু হয়েছিল স্টেশন থেকে, নাকি তারও আগে মার্ক যেদিন প্রথম চিঠি লিখতে শুরু করে শাঁতালকে, নাকি এই উপন্যাসের শুরুতে? উপন্যাসে বাস্তব আর দুঃস্বপ্নের সীমারেখাটি লুপ্ত।
ভেদটা এইখানে যে আমার স্বপ্নটাতে বাস্তবের উত্তরণ পরম্পরা রক্ষা করে ঘটে নাই, ঘটেছে ঘুমের মধ্যস্থতায়। কিন্তু কোথাও একটা যৌক্তিক উত্তরণ আছে বলেও মনে হয়।