অনেকদিন আমাদের আলাপে বোর্হেসের কোনো নামগন্ধ নাই। একটা সময় ছিল যখন বেশি দিন ধরে আমাদের বৈকালিক কি সান্ধ্য-আলাপে বোর্হেস-প্রসঙ্গ না উঠলে কেউ আশঙ্কাপ্রকাশের উচ্চারণে বলতো, আহা! বোর্হেসকে নিয়ে আমরা অনেকদিন কোনো কথা বলছি না। ইদানীং আমার চারপাশে যারা আছে, তাদের কারোরই বোর্হেস-ব্যাপারে আগ্রহ নেই। কিছুদিন আগে একবার আড্ডার মাঝখানে আকস্মিকভাবে প্রসঙ্গ উঠে গেলে একজন জানালো, বোর্হেসকে নিয়ে আমার কোনো হেডেক নাই। আমি একেবারে দমে গেছিলাম তার কথায়, হঠাৎ আমাদের বন্ধু জুলিয়া আগ্রহের আতিশয্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, আমিতো বোর্হেসকে খুব পছন্দই করি। আমি অবাক। যে-মেয়ে কবিতার কথা শুনলে হাই তোলে কী বলছে সে? তাকে এই পছন্দের কারণ জিজ্ঞাসা করার আগেই সে জানালো, অন্ধ হয়ে যাবার আগে বোর্হেসের সঙ্গে তার পিতামহের সাক্ষাৎ হয়েছিল এবং পারিবারিকভাবে তারা বোর্হেসকে মনে রেখেছে। এই আত্মীয়তা যে কতখানি গভীর তার প্রমাণও সে দিয়েছে, বোর্হেসের যে বইগুলো বাংলাদেশে পাওয়া যায় না মিনেসোটায় গিয়ে ফিরতি পথে ফেবার এন্ড ফেবার থেকে সেসব বই সে আমাকে কিনে এনে দিয়েছে। কিন্তু এতকিছুর পরও তার সঙ্গে আমার বোর্হেস-আলাপ আগায় নাই।
সুতরাং আমি বোর্হেসকে নিয়ে আর কারো সঙ্গেই আলাপের সুযোগ পাই না। যদিও কদিন ধরে একটা ভাবনা কোত্থেকে এসে আমাকে খুব উত্যক্ত করছে; আমি কেবলই ভাবছি, যে-সব চিন্তার সৌন্দর্য বোর্হেসকে মুগ্ধ করতো সে-সব চিন্তার উৎস কোথায়। অন্যদের অনেক সুন্দর চিন্তার প্রতি মুগ্ধতাবশে তিনি কবিতা বা ফিকশন লিখেছেন কিন্তু সেই অন্যদের মনেই বা সুন্দর চিন্তাগুলো ঠিক কিভাবে আসতো। সেইসব আশ্চর্য জানালার কথা আমি ভাবছিলাম। ভাবছিলাম অদ্ভুত সুন্দর স্বপ্নগুলো ঠিক কোথা থেকে এসে দরজার পাশের করিডোরটাকে ভরে তোলে। আমি তা জানি না। বোর্হেস কি তা জানতেন? জানলে তিনি মুগ্ধ হতেন না। আমরা জানি না বলেই মুগ্ধ হই। অজ্ঞানতা কী যে এক আশীর্বাদ হয়ে আসে কবিতায়! যিনি সব জানেন তিনি কবি নন। ঈশ্বর সব জানেন।
২.
ঈশ্বরের ভাবনা মাথায় আসা পর্যন্ত আর কিছু ভাবি নাই। তবে ভাবতে হবে। কিন্তু যেহেতু বোর্হেসকে নিয়ে আলাপ তাই তার একটি সুন্দর চিন্তা, এক অনুচ্ছেদের এক গল্পে, ওই বিষয়ে, তুলে দিচ্ছি এখানে। কারো কারো মনে পড়বে এ প্রকার চিন্তা ক্যান্টরবেরির সন্ত আনসেল্ম, সন্ত আগুস্তিন, প্লোটিনাস প্রমূখের মধ্যে ছিল কিন্তু যে চিন্তাটি বোর্হেস করেছেন, সেটি কারো নয়। কোথা থেকে এসেছে ভাবনাটা, বোর্হেসও তা বলেন নাই। না বলাটা দোষেরও নয়। গল্পটা এরকম:
পক্ষিবিজ্ঞান সম্মন্ধীয় যুক্তি
আমি চোখ বন্ধ করি এবং পাখির ঝাঁকটিকে এক ঝলক দেখে নিই। এই দেখার কাল এক সেকেন্ড বা হয়তো তারও কম; কতগুলো পাখি দেখলাম সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত না। পাখিদের সংখ্যা কি নির্দিষ্ট নাকি অনির্দিষ্ট? এই সমস্যাটি ঈশ্বরের থাকা না থাকার বিষয়টিকে সামনে আনে। ঈশ্বর যদি থাকেন, সংখ্যা তবে নির্দিষ্ট, কারণ ঈশ্বর জানেন কতগুলো পাখি আমি দেখেছি। ঈশ্বর যদি না থাকেন, সংখ্যা তবে অনির্দিষ্ট, কেননা সেক্ষেত্রে কারো গণনার ভেতর সেটা থাকছে না। ধরা যাক, এতে দশের কম সংখ্যক এবং একের বেশি সংখ্যক পাখি আমি দেখেছি। আমি কিন্তু নয়টি দেখিনি কিংবা দেখিনি আটটি, সাতটি, ছয়টি, পাঁচটি, চারটি, তিনটি বা দুইটি। আমি দেখেছি দশ এবং একের মাঝের কোনো সংখ্যক পাখি, যা নয়, আট, সাত, ছয়, পাঁচ ইত্যাদি না। সমাকলন করলে দাঁড়ায়-- না-নয়, না-আট, না-সাত, না-ছয়, না-পাঁচ ইত্যাদি-- যা অচিন্ত্যনীয়। সুতরাং ঈশ্বর আছেন।
৩.
বিষয়টার উপর আলো ফেলতে পারে, সে-জন্যে আরও একটা নাতিদীর্ঘ গল্প, বোর্হেসের, এখানে তুলে দিচ্ছি। গল্পটা এরকম:
কিংবদন্তি
আবেলের মৃত্যুর পর কাইনের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হলো। তারা মরুভূমির ভেতর দিয়ে হাঁটছিল, দূর থেকে দেখেই একজন আরেকজনকে চিনতে পারলো, কেননা তারা দুজনেই ছিল দীর্ঘদেহী। দু'ভাই বসলো মাটিতে, আগুন জ্বাললো এবং গ্রহণ করলো খাবার। তারা বসে ছিল চুপচাপ, ক্লান্ত মানুষ যেমনটা করে গোধূলি নামার সময়। আকাশে একটি তারা মিটমিট করলো, যদিও এখনও তার কোনো নাম দেয়া হয় নাই। আগুনের আলোয় কাইন দেখলো, আবেলের কপালে পাথরের দাগ, আর রুটির যে টুকরাটি সে মুখে পুরতে যাচ্ছিল সেটা পড়ে গেল, এবং সে তার ভাইয়ের কাছে ক্ষমা চাইলো।
"তুমিই কি খুন করেছ আমাকে, নাকি আমি খুন করেছি তোমাকে?" আবেল জবাব দিলো,
"আমি ঠিক মনে করতে পারছি না; এখানে আমরা বসে আছি, একসঙ্গে, আগে যেমন করে আমরা বসে থাকতাম।"
"এখন বুঝতে পারলাম, তুমি সত্যিই আমাকে ক্ষমা করেছ," কাইন বললো, "কেননা বিস্মৃতির অর্থ হলো ক্ষমা। আমিও চেষ্টা করবো ভুলে যেতে।"
"হ্যাঁ," আবেল বললো ধীরে ধীরে, "যতদিন থাকে অনুশোচনা আর অপরাধবোধ।"
৪.
স্বপ্ন বোর্হেসের কাছে বিস্ময়ের বড় এক উৎস, আর এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অতল অনির্ণেয় এক 'আমি'। যখন আমরা বোর্হেসের বই খুঁজে বেড়াচ্ছি, এবং পাচ্ছি না, সেরকম একটা সময়ে আমি একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম। 'সময় সিরিজে'র গল্পের দ্বিতীয়টিতে সেই স্বপ্নটাই হুবহু লিখেছিলাম। এরকম:
সময় সিরিজের দ্বিতীয় গল্প
আমরা কয়েকজন বসে আছি সেখানে, পথের একপাশে। জায়গাটাতে অন্ধকার জমে উঠেছে ক্রমশ। পিচ সড়কটা কোনোমতে বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু আমরা বুঝতে পারি, কোথাও সবার অবকাশ শুরু হয়ে গেছে, দীর্ঘ দিনের জন্য ছুটি হয়ে গেছে সবার। একটু পরে ওই পথে হুমা আর রিনি এলো।
হুমা এসেই আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো, আমি তার হাত ছুঁলাম আর রিনিকে সৌজন্য চুমু খেতে গিয়ে বেশি সময় নিয়ে ফেললাম। আমার বন্ধুরা তা নিয়ে খুব অস্বস্থিতে পড়লো। কিন্তু হুমা বিষয়টা নিয়ে কিছুই ভাববে না, সেটা আমি বুঝতে পারি, তবু খানিকটা অস্বস্থি আমাকেও ঘিরে ধরলো। হুমাকে আমি জিগ্যেশ করলাম,
: বোর্হেসের ল্যাবিরিন্থটা আছে আপনার কাছে?
: আমার কাছে নেই, তবে সন্ধান দিতে পারি।
অন্ধকার বাগানের ভিতর দিয়ে পথ। কোথাও থেকে কোড়া পাখির ডাক ভেসে আসছিল। আমি তখন একটা ভগ্নপ্রায় প্রাসাদের এক ঘরে বসে আছি। হুমা আর রিনি আমাকে ওইখানে রেখে চলে গেছে। আমি কারো জন্যে অপেক্ষা করছি। কোনো পথে ঝাপসা আলো এসে পড়লো ওই ঘরে, দেখলাম ঘরভর্তি বই। দুস্প্রাপ্য এবং মূল্যবান বইপত্রে সাজানো ঘরটা। আমি একটার পর একটা বই হাতে নিয়ে দেখি আর অভিভূত হয়ে পড়ি। সন্ত আগুস্তিনের 'কনফেশনস'টা হাতে নিয়ে দেখি, কিন্তু ল্যাবিরিন্থ কোথায়? কারো ছায়া পড়লো দেয়ালে, পেছন ফিরে তাকে জিগ্যেশ করলাম:
: কখন আসবে?
: কে?
: যার জন্য আমি অপেক্ষা করছি।
: এখুনি এসে পড়বে।
তখুনি সে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো। আমি বললাম, ল্যাবিরিন্থটা ধার চাচ্ছিলাম। লোকটা তাক থেকে তুলোট কাপড়ে মোড়া একটা বই নামিয়ে এনে দিলো। খুলে দেখলাম ভেতরটা ঝাপসা, পড়া দুঃসাধ্য। জিগ্যেশ করলাম, মূল বইটা কোথায় পাবো? সে বললো, এটাই মূল। এসময়ে হুমা আর রিনি ফিরে এলো। বাইরে সাইকেলের বেল বাজালো কেউ। আমরা বেরুলাম। রিনি আর হুমা চলে গেল। আমি সাইকেলে করে অন্ধকার পথে ছুটলাম। বাঁশঝাড় আর বাগান দুদিকে। অন্ধকারে হ্যারিকেন জ্বালিয়ে কোথাও একটা কবর খোঁড়া হচ্ছিল।
বাবাকে আঙিনা দিয়ে আসতে দেখলাম, তার হাতে একজোড়া রাজহাঁস ডানা ঝাপটাচ্ছে। আমি ঘরে গিয়ে বইটা খুলে দেখলাম, ভেতরটা এতো ঝাপসা যে পড়া অসম্ভব, কোনো কোনো পৃষ্ঠা একেবারে শাদা। একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটতে শুরু করলো তখন থেকেই। বইটার অস্পষ্ট আর ঝাপসা অবস্থাটা সবদিকে যেন ছড়িয়ে পড়েছে, তখন কোনোদিকে কিছুই ভালোভাবে দেখতে পাচ্ছিলাম না।
কোথাও একটা বইয়ের দোকানে ঢুকেছি, খুব সংকীর্ণ জায়গাটা, কাঁচের দরোজা ঠেলে ঢুকতে হয়। অস্পস্ট অবস্থাটা কিছুতেই যাচ্ছে না, যেন ঘুমের ভিতর হাঁটছি। অনেকেই দোকানটাতে বই খুঁজছে। তাদের মধ্যে তিনজন তরুণীকে আমার খুব চেনা মনে হলো। তারা আমার দিকে এগিয়ে এলো, কিন্তু আমি তাদের লক্ষ না করে বই খুঁজতে লাগলাম। শেল্ফে একটা পরিচিত বই দেখে সেটা নামালাম। দেখলাম আমার বইটাই। প্রথম পৃষ্ঠার কোণায় নাম স্বাক্ষর করা-- রায়হান রাইন, ৪ঠা জানুয়ারী, ২০০০ খ্রী.। দোকানদারকে বললাম, বইটা আমি এবছরই জানুয়ারীর চার তারিখে কিনেছিলাম। গতকাল ভুল করে কাউন্টারে ফেলে গেছি। মনে পড়লো, আগের দিন আমরা তিনজন নদীপাড়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম। গাঁয়ের পথে হেঁটেছি, নদী পার হয়ে শর্ষে ক্ষেতের আইল ধরে। অস্পস্টভাবে মনে পড়লো, নদীপাড় থেকে ফেরার পথে আমরা দোকানটাতে ঢুকেছিলাম, নভেরা কিংবা শামীম বইটা ফেলে গিয়েছিল কাউন্টারে। ততক্ষণে পরিচিত মনে হওয়া একটি মেয়ে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো: কাল আপনি নদীপাড়ে গিয়েছিলেন?
: হ্যাঁ।
মেয়েটি কিছুক্ষণ চুপ থেকে ঠোঁটের কোণে একটা রহস্যময় হাসি ঝুলিয়ে বললো: আপনার উদ্বেগগুলোর ধরন আমি বুঝতে চাই।
আমি বিমূঢ় বোধ করছিলাম। এ সময়ে দ্বিতীয় মেয়েটি এগিয়ে এলো: ওহ্ আপনার অনিশ্চয়তাবোধগুলো কোথা থেকে আসে? আর কোন্ রহস্যপথ দিয়ে আসে আপনার ভয়?
আমি কিছু বলতে যাবো কিন্তু কোনো শব্দ মুখ ফুটে বেরুলো না। তখন তৃতীয় মেয়েটি কাছে সরে এলো। আমি এই প্রথম মেয়েটির মুখ স্পষ্টভাবে দেখতে পেলাম। খুব অচেনা মনে হলো। সে বললো, সময় সম্পর্কে আপনার...?
: সৌজন্য চুমুর সময়ে...?
: না না, সন্ত আগুস্তিনের সময় নিয়ে ভাবতে গিয়েই আপনি প্রথম টের পেলেন।
: হ্যাঁ, আমার ভেতরে যা ভয় পেতে থাকে, ভীষণ উদ্বেগগুলো যেখান থেকে আসে... আমি পুড়ে যেতে থাকি!
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুলাই, ২০১১ দুপুর ২:৩২