বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবদুস সালাম, অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ ও জাতীয় সংসদ সদস্য শাম্মী আখতারকে দেখতে আমি ও ডিইউজের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম প্রধান যখন ইউনাইটেড হাসপাতালে পৌঁছলাম তখন দুপুর। আবদুস সালাম ও শাম্মী আখতার নিজ নিজ কেবিনে জীবনমৃত্যুর মাঝখানে দুলছেন, রয়েছেন ডাক্তারদের নিবিড় পরিচর্যায়। আর নজরুল ইসলাম খানকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অপারেশন থিয়েটারে।
গত ৬ মার্চ সন্ধ্যায় নয়াপল্টন জনসমাবেশের ওপর বেপরোয়া ছররা গুলিবর্ষণ ও পরে বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ইতিহাসের যে জঘন্যতম তাণ্ডব চালিয়েছিল পুলিশ তাতে মারাত্মক গুলিবিদ্ধ হন অনেকেই। অনেকেই শিকার হন নারকীয় নির্যাতনের। দ্রুত চিকিত্সা সেবার জন্যই বোধকরি এখনও প্রাণে বেঁচে আছেন নজরুল ইসলাম খান, আবদুস সালাম, অ্যাডভোকেট সালামের মতো ভদ্র সজ্জন মার্জিত রুচির রাজনীতিবিদ। শাম্মীকে তো মাইক্রোবাসের চাকার নিচে পিষ্ট করেই মারার কথা।
অপারেশন থিয়েটারের মূল দরজায় দাঁড়িয়েই একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বললেন, নজরুল ইসলাম খানের সারা শরীরে, মাথায়, পিঠে অসংখ্য গুলি লেগেছে। তার মাথা থেকেই দুই-দুইটি অপারেশন করে ১০টি গুলির টুকরা বের করা হয়েছে। পিঠসহ শরীরের অন্যান্য স্থানে এখনও ৩৭টি গুলি রয়ে গেছে। সেগুলো কোনোদিন বের করা সম্ভব হবে কিনা জানি না। আবদুস সালামের মাথায়ও ১০টি গুলি ঢুকে গেছে। ৫টির মতো বের করা সম্ভব হয়েছে। বাকিগুলো এখনও ভেতরেই রয়ে গেছে। শরীরে আরও অসংখ্য ছিদ্র পাওয়া গেছে। সেখানেও গুলি থাকতে পারে। অ্যাডভোকেট সালামেরও করুণ অবস্থা। তার পুরো পেটজুড়ে শুধু গুলি আর গুলি। ডাক্তার বললেন, এরা যে বেঁচে আছে সে জন্য আল্লাহকে শুকরিয়া জানাই। তবে সারা জীবন তাদেরকে এই কষ্ট বহন করে বেড়াতে হবে।
ডাক্তার নিজে নিজেই স্বগতোক্তি করেন, একটি শান্তিপূর্ণ সমাবেশের ওপর হামলা এবং রাজনীতিবিদদের হত্যার জন্য এইরকম নির্বিচারে গুলিবর্ষণের ব্যাখ্যা কী? কী ব্যাখ্যা সরকারের, যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেশের প্রধান বিরোধী দলের প্রথম সারির নেতাদের বার বার দুষ্কৃতকারী বলে সম্বোধন করেন? আবার তিনি এমন এক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা ব্যয় করেছেন পাক জমহুরিয়াতের সেবায়!
বললাম, ডাক্তার সাহেব এইসব নৃশংসতার কোনো ব্যাখ্যা নেই। বাংলাদেশের সবকিছুই এখন ব্যাখ্যাতীত। সরকার জাতীয় মসজিদের গেট বন্ধ করে দরোজায় তালা লাগিয়ে দিয়েছে। সেখানে হেফাজতে ইসলামসহ ধর্মপ্রাণ মানুষদের মিটিং মিছিল করতে দিচ্ছে না। অথচ শাহবাগের ক্যাডারদের, যারা ইসলাম ও মহানবীকে গালমন্দ করে দেশে গোলযোগ ডেকে এনেছে, তাদেরকে চার স্তরবিশিষ্ট নিরাপত্তা দিয়ে, নিজেরাই আশুলিয়ায় সমাবেশের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। দুই দুমুখো চরিত্রের ব্যাখ্যা কী? ইসলামকে গালমন্দ করলে জামাই আদর; প্রতিবাদ করলে অপরাধ? আমার প্রবাসী এক শিল্পী বোন লিখেছে, ‘দেশের যা অবস্থা তা হচ্ছে অকল্পনীয় এবং অমানবিক অথবা আরেকটু ঠিক করে বললে বলা যায় পাশবিক। কষ্ট হচ্ছে ভীষণ, আমার দেশের এই ভয়াবহ অবস্থা দেখে।’
আরেক প্রবাসী ভাই ই-মেইল করেছে, বাংলাদেশের মানুষের দুর্ভাগ্য, এমন একটা সরকার তাদের ওপর, যাদের নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে বিষ আছে। চোখের মধ্যে বিষ আছে। মুখের লালায় বিষ আছে। এই সরকার যেদিকে তাকিয়েছে পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। অযোগ্য, অদক্ষ, অপদার্থ, অদেশপ্রেমিক, জাতিঘাতী, রাষ্ট্রঘাতী, রক্তপিপাসু এই সরকারের মাত্র দুটি টার্গেট, ক্ষমতায় টিকে থাকা আর ভারতের স্বার্থ রক্ষা করা।
এই কাজ করতে গিয়ে সরকার পুরো বাংলাদেশকে পরিণত করেছে জেলখানায়, পাগলাগারদে। এক অর্থে পুরো দেশটাকে বানিয়েছে বধ্যভূমি। সারাবিশ্বে বাংলাদেশকে করেছে বন্ধুহীন। সবাইকে বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করেছে। এরা যেখানেই হাত দিয়েছে সেখানেই সর্বনাশ হয়ে গেছে। পদ্মা সেতুর দুর্নীতির মাধ্যমে পুরো জাতিকে ডুবিয়েছে পদ্মা নদীতে। হলমার্কের নামে ব্যাংকিং সেক্টরকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। শেয়ারবাজারের ৩৩ লাখ মানুষ আজ পথের ফকির। রাজনীতি রক্তাক্ত। শিক্ষা ও বিচারব্যবস্থা ধ্বংসস্তূপ। পদ্মার মতো তিতাস এখন মৃত। ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে ধর্মদ্রোহী ব্লগারদের উস্কে দিয়ে সারাদেশে ডেকে এনেছে বিপর্যয়। যুদ্ধাপরাধী মানবতাবিরোধীদের বিচার দলীয় বিবেচনায় করতে গিয়ে দেশকে ঠেলে দিয়েছে বিভেদ ও হানাহানিতে। মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলামকে বানিয়েছে পরস্পরের প্রতিপক্ষ। জাতিকে বিভক্ত করে দেশকে নিক্ষেপ করেছে গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। উদ্বেগ উত্কণ্ঠায় অস্থির দেশের মানুষ। পুরো বিশ্ব। তারপরও বিভ্রান্ত, উদ্ভ্রান্ত, দিশেহারা, বেসামাল সরকারের থামার নাম নেই। তারা নিত্যনতুন ঝামেলা বাড়িয়েই যাচ্ছে। শাহবাগিদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেই যাচ্ছে। মঞ্চ বানানো এদের পুরনো ব্যবসা। ‘জনতার মঞ্চ’ বানিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিল প্রশাসন। এবার শাহবাগে ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ বানিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে ইসলামের বিরুদ্ধে। ধ্বংস করে দিতে চাচ্ছে জাতীয় সংহতি। আবার মোল্লাদের আরেক দফা ‘জঙ্গী’ বানিয়ে পাশ্চাত্যের সহানুভূতি অর্জনের জন্য এখানে ওখানে পুড়িয়ে দিচ্ছে মন্দির। আর এর মাধ্যমে জায়েজ করে নিতে চাচ্ছে নিজেদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ।
দুই
এই সরকারের সর্বশেষ ও ভয়াবহতম কীর্তি দেশের ১০ লাখ শিশুকে ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল ও কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়ার নাম করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়ার ব্যবস্থা করা। সারাদেশ তোলপাড় হয়েছে এই ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল নিয়ে। হাজার হাজার শিশু হয়ে পড়েছে অসুস্থ। বহু শিশু ঢলে পড়েছে মৃত্যুর কোলে। তারপরও সরকার এত বড় একটি হৃদয়বিদারক ঘটনার কারণ উদঘাটন বাদ দিয়ে, কোনো তদন্তের ব্যবস্থা না করে, ধামাচাপা দেয়ার জন্য প্রাণান্ত প্রয়াস চালিয়েছে। প্রথমে ভাড়াটে বিশেষজ্ঞ দিয়ে বলানোর চেষ্টা করেছে যে ‘এ’ ক্যাপসুলের জন্য কোথাও কিছু হয়নি। তারপর নিজেরা এবং নিজেদের ‘নিমক হালাল’ মিডিয়া দিয়ে একযোগে প্রচার করেছে যে এটা হলো গুজব। এই গুজব ছড়িয়েছে জামায়াত শিবির। অর্থাত্ ‘কেষ্টা বেটাই চোর’।
অন্যায়ের প্রতিরোধ না করে, দেশের লাখ লাখ শিশুর জীবনকে রক্ষার ন্যূনতম কোনো উদ্যোগ না নিয়ে, উল্টো নিজেদের পাপকে পুণ্য বলে জাহির করার জন্য কেন এই অপচেষ্টা? কোনো অপরাধীদের পাকড়াও না করে, এত বড় ঘটনাকে কেন গুজব বলে চালিয়ে দেয়ার নির্লজ্জ কোশেশ?
দেশের বেশিরভাগ মিডিয়া যদিও সরকারের কাছে বিবেক বন্ধক দিয়ে সাংবাদিকতা করে, তারপরও কেউ না কেউ তো এখনও আছে, যাদের কাছে অর্থ— কীর্তির চাইতে দেশ ও দেশের মানুষই বড়। এই রকম সংবাদপত্রের কল্যাণেই জানা গেছে আসল কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)সহ সংশ্লিষ্ট অনেক প্রতিষ্ঠানের আপত্তি এবং অনিয়মের অভিযোগ সত্ত্বেও, একজন বিশেষ নেতার কারণে, তার প্রতিষ্ঠান জনতা টেডার্সের ‘জনতা হেলথ কেয়ার’কে কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য, ভারতের অলিভ হেলথ কেয়ার নামক একটি অনভিজ্ঞ ও WHO-এর সার্টিফিকেটহীন প্রতিষ্ঠান থেকে সাড়ে ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা হয় ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল। তারপর স্বাস্থ্য দফতরের মাধ্যমে গেলানো হয় দেশের শিশুদের। তারপর যা হওয়ার তাই হয়েছে। সারাদেশের প্রতিটি ঘরের শিশুর জীবন আজ কণ্ঠার কাছে। হাজার হাজার নিষ্পাপ শিশু হয়ে পড়েছে অসুস্থ। মরে বেঁচেছে অনেক শিশু। পিতামাতাদের কান্নায় বাতাস ভারী।
তারপরও সরকার এই জঘন্য অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে আইনের হাতে সোপর্দ করেনি। বন্ধ করেনি ক্যাপসুল খাওয়ানো। কারণ? এই ‘বিশেষ নেতা’ আর কেউ নন, তিনি আমাদের শাসক দল আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, পার্টির মুখপাত্র, অতি বাকমুখর মাহবুব-উল আলম হানিফ। বিরোধী দলকে যা-তা ভাষায় গালাগাল এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলতে বলতে হানিফ সাহেব চোখে-মুখে ফেনা তুলে ফেলেন। ব্যক্তিগত লোভ ও লালসার কারণে হাজার হাজার নিষ্পাপ শিশুকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া মুক্তিযুদ্ধের কোন চেতনার মধ্যে পড়ে তা অবশ্য হানিফ সাহেব বলেননি।
প্রশাসনে হানিফ সাহেবের দাপট কোন পর্যায়ে তা বোঝা যায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের আপত্তিকে পাত্তা না দেয়া থেকে। বিশ্বব্যাংক থেকেও এ ব্যাপারে তদন্ত হয়েছিল। সে তদন্তে দেখা যায়, ক্যাপসুল সরবরাহ করার জন্য যেসব যোগ্যতা লাগে তা ভারতীয় কোম্পানিটির নেই। এমনকি ভারতীয় কোম্পানিটির কাছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা WHO-এর অবশ্য-পালনীয় সার্টিফিকেটও নেই। এসব গুরুত্বপূর্ণ আপত্তি ও অভিযোগকে সামান্যতম কেয়ার করারও প্রয়োজন বোধ করেননি হানিফ সাহেব। তিনি হয়তো তার ক্ষমতার জোরে ভারত থেকেই ওষুধ আমদানির ব্যবস্থা করতে বাধ্য করেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে।
বাংলাদেশের শিশুরা জনাব হানিফের লোভের খেশারত দিচ্ছে জীবন দিয়ে। অনেক শিশু জ্বরে ভুগছে। অনেকে আক্রান্ত হয়েছে বমিতে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয়, সরকারি হাসপাতালগুলো এইসব অসুস্থ শিশুকে ভর্তি করাতে চাচ্ছে না। ফলে বেসরকারি হাসপাতাল বা চিকিত্সকের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে অসহায় পিতামাতাদের। কি পোড়া কপাল, বিষাক্ত ওষুধ খেয়ে শিশুরা মরবে। অথচ তারা চিকিত্সা পাবে না। শুধু একজন নেতার ইমেজ বাঁচাতে এই নিষ্ঠুরতা!
সত্যি হানিফ সাহেব ও তার সরকারের দেশপ্রেম ও মানবপ্রেম অতুলনীয়! চমত্কার!! অতি চমত্কার!!! কার ঘাড়ের ওপর কয়টি মাথা যে হানিফ সাহেবকে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার কথা বলে?
তিন
সরকার দেশের পুলিশ বাহিনীতে যেমন দু’একটি জেলার লোকশক্তি নিয়ে ভেঙে ফেলেছে চেইন অব কমান্ড, তেমনি পরিণত করেছে দলীয় ঠ্যাঙ্গারে বাহিনীতে। তাদের খুনি হতেও ঢালাও সাহায্য করেছে। পুলিশ বাহিনী দিয়ে জন্তু-জানোয়ারের মতো মানুষ খুন করিয়েছে। বিরোধী দল দমনের জন্য তাদের দিয়ে চালিয়েছে ভয়ানক তাণ্ডব। তাদের দিয়ে পিটিয়ে হাড়-হাড্ডি ভেঙে দিয়েছে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের। বাড়ি-ঘর, অফিস-আবাসে চালিয়েছে তুলকালাম কাণ্ড। পরিস্থিতি এমন, পুলিশ দেখলেই ভয়ে আত্মা খাঁচাছাড়া হয়ে যায়। তাদের দেখলেই মনে হয় হালাকু খান কিংবা রক্ষীবাহিনীর নাতিপুতি। পুলিশ বাহিনীও ক্ষেত্রবিশেষে মনের আনন্দে ‘বঙ্গবন্ধুর সৈনিক’ অথবা ‘মখা আলমগীরের’ কৃপা পাওয়ার লোভে আইন ও বিধিবিধান ভেঙে চালিয়েছে দুরমুজ অভিযান। ফলে রক্ষক হয়ে উঠেছে ভক্ষক। তো প্রত্যেক ক্রিয়ারই তো একটা সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে। পুলিশের বেলায় তা থাকবে না কেন? সেজন্যই আমাদের পুলিশ বাহিনীর ওপর এখন নেমে এসেছে প্রাকৃতিক দুঃসংবাদ। এই দুঃসংবাদের কারণ সম্প্রতি পুলিশের বেপরোয়া মারমুখী আচরণ। দুঃসংবাদটি বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো এসেছে জাতিসংঘ থেকে। নিউইয়র্ক থেকে এনা পরিবেশিত খবরে বলা হয় :
‘সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে পুলিশের আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের পুলিশকে বাদ দেয়া হতে পারে বলে উদ্বেগজনক একটি সংবাদ গত বুধবার বাজারে আসা সাপ্তাহিক ঠিকানায় ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে। মানবাধিকার রক্ষায় পুলিশের ভূমিকা এবং নীতি-নৈতিকতা জাতিসংঘসহ বিশ্ব মানবাধিকার পর্যবেক্ষকদের নজরে এসেছে বলেও অনুসন্ধানী এ রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘জাতিসংঘ থেকে বাংলাদেশের পুলিশ প্রত্যাহার হতে পারে’ শীর্ষক ওই সংবাদে বলা হয়েছে, ‘জাতিসংঘের হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটসের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অনেকেই পুলিশের জন্য মানবাধিকারসম্মত আচরণবিধির নিরিখে বাংলাদেশের পুলিশের আচরণ ও তাদের মনোভাব এবং দৃষ্টিভঙ্গি বিচার-বিশ্লেষণ শুরু করেছেন। দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মধ্যে বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুলিশের আচরণ ভয়াবহ।’
খবরে বলা হয়েছে, অন্য আইন প্রয়োগকারীদের মধ্যে সেনাবাহিনী নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে। চলতি বিক্ষোভ দমনে র্যাবের নাম শোনা যাচ্ছে না বা তাদের নিয়োজিত করা হয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বর্ডার গার্ড নিয়োগ করা হলেও তাদের ব্যবহার করা হয়নি। রাজপথে এবং মাঠে একমাত্র পুলিশকেই তত্পর দেখা যাচ্ছে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করে আরেক গোষ্ঠীর ওপর চড়াও হতে, যা বিশ্ব মানবাধিকার পর্যবেক্ষকদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশের বেশকিছু সদস্য কাজ করছেন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে। কিন্তু যেভাবে পুলিশ বাংলাদেশের জনগণের ওপর অমানবিক আচরণ করছে তাতে তারা জাতিসংঘের বিবেচনায় মানবাধিকারের যথার্থ স্ট্যান্ডার্ড ও চর্চার ধারক হওয়ার যোগ্য কিনা তা আবার বিবেচনায় নেয়া হয়েছে বলে ওই সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘এই বিবেচনায় বাংলাদেশের পুলিশের যোগ্যতা প্রশ্নের সম্মুখীন হলে তাদের মিশন থেকে বাদ দেয়া হতে পারে’ এ আশঙ্কা করা হয়েছে ঠিকানার রিপোর্টে।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বর্তমানে বাংলাদেশের ১৭৭০ জন পুলিশ, ৬৯২৭ সেনাসদস্য এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ৮৪ অফিসারসহ আট হাজার ৭৮১ জন কাজ করছেন। অপরদিকে ভারতের ১০২২ পুলিশ, ৬৭৪৩ সেনাসদস্য, অফিসার ৭৫ জনসহ সাত হাজার ৮৪৩ জন কাজ করছেন শান্তিরক্ষা মিশনে। শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ পুলিশ ও সৈনিকদের ভূমিকা অনেক দেশের কাছেই ঈর্ষণীয়। অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশের পুলিশকে আন্তর্জাতিকভাবে হেয় করতে পারলে অনেকের পোয়াবারো। বাংলাদেশের প্রতিবেশী অনেক দেশ এক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী।
জাতিসংঘ হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটসের উচ্চপর্যায়ের এক কর্মকর্তা ঠিকানাকে বলেন, দাতাগোষ্ঠী বাংলাদেশের পুলিশের আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সাধারণ জনগণের ওপর গুলিবর্ষণ, মাত্র কয়েক দিনে শতাধিক বেসামরিক লোক ও কিছু পুলিশ সদস্যের মৃত্যু নিয়ে বাংলাদেশ পুলিশের আচরণ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশের বিক্ষোভ দমাতে পুলিশের আচরণ জাতিসংঘের ‘হিউম্যান রাইটস স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড প্র্যাকটিস ফর দ্য পুলিশ’ গাইডের কী কী ধাপ লঙ্ঘিত হয়েছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গাইড বুকের যেসব ধারা গুরুত্ব পাচ্ছে সেগুলো হচ্ছে : ১. ইউজ অব ফোর্স বা শক্তির প্রয়োগ, ২. অ্যাকাউন্টেবিলিটি ফর দ্য ইউজ অব ফোর্স অ্যান্ড ফায়ার আর্মস বা শক্তি ও আগ্নেয়াস্ত্র প্রয়োগে জবাবদিহিতা, ৩. পারমিসিবল সারকামস্ট্যান্সেস ফর দ্য ইউজ অব ফায়ার আর্মস বা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে অনুমোদিত প্রেক্ষাপট, ৪. প্রসিডিউর ফর দ্য ইউজ অব ফায়ার আর্মস, বিফোর ইটস ইউজ অ্যান্ড আফটার ইউজ অর্থাত্ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের আগে ও পরে প্রক্রিয়া এবং ৫. হিউম্যান রাইটস স্ট্যান্ডার্ড বা মানবাধিকার বিবেচনার মাপকাঠি ইত্যাদি।
এই সংবাদ পাঠের পর আমাদের পুলিশ বাহিনীর ভাইবোনদের মধ্যে যদি শুভবুদ্ধির উদয় হয়, যদি তারা অন্যায়, অন্যায্য ও অসঙ্গত আচরণ থেকে বিরত হয়, যদি তারা দেশের মানুষকে গরু-ছাগলের বদলে আবারও ‘মানুষ’ ভাবতে শুরু করে, তাহলেই আমরা খুশি হব। কারণ আমরা চাই তারা জাতিসংঘ মিশনে কাজ করে নিজের ও দেশের সম্মান বাড়াক।
চার
ভারতীয় গণমাধ্যমে শাহবাগিদের পক্ষে চলছে তুমুল আনন্দ উল্লাস। ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান দীপক কাপুর একবার বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশকে আর কখনও ভারতীয় রাডারের বাইরে যেতে দেয়া হবে না।’ এখন ভারতীয় কূটনীতিক ও বিশ্লেষকরা সেই নিরিখেই শাহবাগের ব্লগারদের কর্মকাণ্ডকে দেখছেন ‘ট্রাম্প কার্ড’ হিসেবে। আসলে ব্লগার-ফ্লগার তো বাত কি বাত। ওখানে চলছে সরকারি দল, তাদের ছাত্রলীগ, সাংস্কৃতিক লাঠিয়াল ও জোটের শরিক ভারতপন্থী বাম দলগুলোর দেশ বিভক্তির আস্ফাালন। চলছে জাতিকে বিভক্ত করে, বাংলাদেশকে ভেতর থেকে দুর্বল করে, তার আত্মপ্রতিরোধ শক্তিকে নির্মূল করে এই মহিমান্বিত জাতিকে চিরকালের জন্য ভারতের পায়ের কাছে উপঢৌকন দেয়ার মরিয়া ষড়যন্ত্র। এই কারণেই ব্রিটেনের প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট তার এক প্রতিবেদনে বলেছে, ৪২ বছর পর যুদ্ধাপরাধ বিষয়কে কেন্দ্র করে বাংলাদেশীরা জাতি হিসেবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়কে কেন্দ্র করে ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ৭ মার্চ হত্যার জোয়ার বইয়ে দেয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে সহিংসতা প্রতিরোধের নামে এ সময়ের মধ্যে হত্যা করা হয় ১০০-রও বেশি মানুষ। ২৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল যুদ্ধাপরাধের তৃতীয় রায় ঘোষণার পর একই অজুহাতে হত্যা করা হয় অন্তত ৬৭ জনকে।
অন্যদিকে শাহবাগের আন্দোলন যদিও শুরু হয়েছিল যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে, পরবর্তী সময়ে তা আর এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। শাহবাগের তরুণ প্রজন্মের আন্দোলন বাঁক নেয় রাজনৈতিক আন্দোলনে। আর এখানে রাজনীতি ঢুকে পড়ায় পরিষ্কারভাবেই দেশ-জাতি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। শাহবাগের আন্দোলনকারীরা মূল জায়গা থেকে সরে এসে জামায়াতের মালিকানায় বলে কথিত ব্যাংক, ব্যবসা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধের দাবি তোলে। এমনকি তারা প্রধান বিরোধী দল বিএনপির প্রতিও নানা সময় নানা তীর ছুড়ে দেয়। শাহবাগের তরুণদের মূল দাবি থেকে সরে আসা এবং রাজনৈতিক যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার বিষয়টি তারাও মেনে নিতে পারেননি, যারা শুরুতে তাদের সঙ্গে ছিলেন, যারা অরাজনৈতিক ভাবনা থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়েছিলেন। এর ফলে যা হয়েছে তা হলো, বিএনপি ও এর সমর্থিতরা পরিষ্কারভাবে তাদের বিরুদ্ধ অবস্থানে দাঁড়িয়ে, যা রূপ নিয়েছে ধর্মবিরোধী-ধর্মসমর্থিতদের মধ্যকার যুদ্ধে। তাই নিশ্চিত করেই বলা যায়, এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশের ভবিষ্যত্ হুমকির মুখে।
এই রকম পরিস্থিতিতে সরকার ব্লগার নামের তাদের দলীয় ক্যাডারদের আসকারা দিয়ে মাথায় তুলেছে। এদের মাধ্যমে শুধু বিরোধী দল নয়, ভিন্নমতাবলম্বী গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করানো হয়েছে। প্রথমে দাবি ছিল ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের। ইসলাম ধর্ম, মহানবী (সা.)-এর বিরুদ্ধে ছড়ানো হয় কুিসত আক্রমণ। এখন আবার সেখান থেকে সরে এসেছে মূলত হেফাজতে ইসলাম বা ধর্মপ্রাণ মানুষের আন্দোলনের মুখে। তারপরও তারা আছে সরকারের অঢেল আদর আপ্যায়নের মধ্যে। তারা সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম আল্লামা শফিকে বলছে দুর্বৃত্ত। মৌলবাদী দুর্বৃত্ত। অথচ স্বাধীনতাবিরোধী ও ১০০ মানুষের হত্যার আদেশ দানকারী মখা আলমগীরের গ্রেফতার দাবি করছে না।
হেফাজতে ইসলাম কোনো রাজনৈতিক দল নয়। তারা ধর্মকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তারা দাবি করেছিল ধর্মদ্রোহীদের চট্টগ্রাম না আসতে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু সরকার তার নিজ গৃহে লালিত-পালিত ফ্রাংকেনস্টাইনের দানবদের বিরুদ্ধে কীভাবে ব্যবস্থা নেবে? ফলে তাদের খাদ্য, বাসস্থান, অর্থ ও নিরাপত্তা দেয়া রাখে অব্যাহত। ব্যবস্থা তো নেয়ইনি, উল্টো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, ধর্মকে পুঁজি করে কোনো ধর্মগোষ্ঠীকে মৌলবাদ প্রচার করতে দেয়া হবে না। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ধর্মীয় রাজনীতি নয়, আমরা ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করতে দেব না। ধর্ম নিয়ে ব্যবসা কারা করে তা অবশ্য মন্ত্রীদ্বয় বলেননি। এসব কথার পরিষ্কার অর্থ হলো, যারা ইসলাম ও মহানবীকে অপমান করেছে তারা কোনো দোষ করেনি। তারা বীর। কিন্তু ধর্মপ্রাণ হেফাজতে ইসলামীরা হলো শত্রু, তারা মৌলবাদ প্রচার করছে। আর ইমরান নামের ছেলেটি সরকারি চার স্তর, তিন স্তরবিশিষ্ট নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে বসে, ধর্মপ্রাণ মানুষদের প্রতিনিয়ত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে সরকার হুজুরদের সঙ্গে চালাকি করে চট্টগ্রামে তাদের সাংস্কৃতিক লাঠিয়াল দলের ‘হেড চাপরাসি’ নাসির উদ্দিন ইউসুফকে পাঠিয়ে, তাকে দিয়ে ওয়াজ করাচ্ছে হুজুরদেরকে তার দলে ভিড়ানোর জন্য। আলেম-ওলামাদের বিরুদ্ধে শাহবাগ থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে সমাবেশের ঘোষণা দিয়েই যাচ্ছে। অর্থাত্ উত্তেজনা দূর করা নয়, উত্তেজনা যাতে বাড়ে সেদিকেই সরকারের নজর। অর্থাত্ জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা কিংবা সংঘাত প্রশমনের ব্যাপারে সরকার মোটেই উদগ্রীব নয়। বরং সংঘাত যাতে জিইয়ে থাকে তার জন্য চালাচ্ছে নানা কর্মকাণ্ড। আসলে ভারতের শাসকরা যা চায় সেটা প্রকাশ পাচ্ছে সে দেশের গণমাধ্যমে। আর সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যই যেন কাজ করছে আমাদের সরকার।
বাংলাদেশের ভারতের সাবেক হাইকমিশনার দেব মুখার্জি, ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব কানওয়াল শিবাল, সিনিয়র সাংবাদিক সুবীর ভৌমিক এবং করণ থাপার সম্প্রতি সে দেশের এক টিভি অনুষ্ঠান ‘দ্য লাস্ট ওয়ার্ড’-এ যে কথা বলেছেন, তার সারাংশ হলো, দৃশ্যত বাংলাদেশ দু’ভাগে বিভক্ত। ভারত এটাই চেয়েছিল। একদিকে বিএনপি-জামায়াত, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও শাহবাগ। এটা হলো ১৯৪৭ ও ১৯৭১-এর চেতনার বিভক্তি। ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয়। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ হয় ধর্মনিরপেক্ষ ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার ভিত্তিতে। শাহবাগে দৃশ্যত ’৭১ -এ ফিরে এসেছে। সেজন্য বাংলাদেশে এখন মুসলিম পরিচয়ের চাইতে বাঙালি পরিচয় অনেক শক্তিশালী। ১৯৭১-এ যে ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি সংস্কৃতির জয় হয়েছিল সেই চেতনাই ফিরে এসেছে শাহবাগে। বাংলাদেশ তার শিকড়ে ফিরে গেছে। এই মহেন্দ্রক্ষণে ভারতের উচিত শেখ হাসিনার সমর্থনে সবকিছু করা। প্রণব মুখার্জির ঢাকা সফর ছিল সেই সমর্থন জানানোর জন্য। শাহবাগকে সমর্থন জানানোর জন্য। ভারত যে তাদের পাশে আছে এই বার্তা দেয়া হয়ে গেছে।
ভারতীয় বুদ্ধিজীবী ও কূটনীতিকরা বাংলাদেশে মুসলমানিত্বের সঙ্গে বাঙালিত্বের সংঘাত বাধিয়ে ফায়দা তুলতে চাচ্ছে। সরকার তাতে জোগান দিচ্ছে শক্তি। ফলে এটা আরও পরিষ্কার, এই সরকার বাংলাদেশের মানুষের সরকার নয়। এই রকম একটি ভারতনির্ভর, ভারত সমর্থিত সরকারকে ক্ষমতায় রাখা বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্যই মঙ্গলজনক নয়। দেশের নিরাপত্তা ও সংহতি হুমকির সামনে পড়বে। কার্যত পড়েছেও। ভারতকেও বুঝতে হবে, বাংলাদেশের মানুষের এই উপলব্ধির অর্থ তাদের সঙ্গে যুদ্ধ বাধানো নয়।
আমি অত্যন্ত সরল সহজ ও দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই, এটা আমার কথা নয়, আমাদের বিচক্ষণ ব্যক্তিদের গভীর পর্যবেক্ষণের ফল। বাংলাদেশে ধর্মের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের কোনো বিরোধ নেই। কোনোদিন ছিল না। ৪৭-এর চেতনার সঙ্গে ৭১-এর চেতনারও কোনো বিভক্তি নেই। ধর্মই আমাদের শিখিয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দঁড়াতে; যারা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান এনেছিল, তারা এবং তাদের সন্তানরাই ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন করেছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করে প্রতিষ্ঠা করেছে স্বাধীন বাংলাদেশ। আমার একথার সমর্থনে ভূরি ভূরি মতলবি বই পড়ার কোনো দরকার নেই। আমি প্রিয় পাঠকদের বলবো মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পাঠ করার জন্য।
ভারতের পশ্চিম বাংলা যদি তার হিন্দুত্বকে একমাত্র অবলম্বন ধরে, মহাভারতে বিলীন হওয়ার জন্য ১৯৪৭ সালে গো না ধরতো, তাহলে তারাও আজ বাংলাদেশের মতোই স্বাধীন দেশের মানুষ হতো। বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের মানুষকে জ্ঞান দিতে আসতো না।
পশ্চিম বাংলার লেখক, শিল্পী, গবেষকরা আজ ঢাকার ওপর ভাগাড়ের শকুনের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সে তো শুধু এই কারণে যে, পরাধীন পশ্চিম বাংলায় আর কিছু নেই। ওটা এখন বৃহত্ ভারতের ডাস্টবিন। পশ্চিম বাংলার লোকেরা নিজ গৃহে পরবাসী। ওরা পরাধীন। ওরা ভারতের চাকর-বাকর। এইসব ভিটেছাড়া হাড়হাভাতে জ্ঞানীদের প্রচারণা এবং তাদের মতলব আমাদের তরুণদের বুঝতে হবে। ওরা হলো খাঁচার ঘুঘু। ওরা আমাদেরকেও ওই খাঁচায় ঢোকানোর জন্য মিথ্যা মমতা ও আদর্শের বুলি কপচায়। ওদের বাণীর ফাঁদে পা দিলেই বাংলাদেশ অর্থহীন হয়ে যাবে। স্বাধীনতা থাকবে না। বৃহত্ ভারতকে অক্ষুণ্ন রেখে ‘দুই বাংলা এক হও’ স্লোগান তাই ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের অগ্রভাগ। এটা অতি বিপজ্জনক বিষয়।
পাঁচ
গত ১১ মার্চ বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পুলিশ যে নারকীয় তাণ্ডব ও ভাংচুর চালায়, তা পরিদর্শনে এসে ১৩ মার্চ দলটির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ‘মঞ্চফঞ্চ বানানো বন্ধ করুন। মঞ্চ বানিয়ে বাঁচতে পারবেন না। জনগণের মঞ্চ তৈরি হলে পালানোরও পথ পাবেন না। এ সরকারকে আর সময় দেয়া যায় না—মন্তব্য করে তিনি বলেন, এখনও সময় আছে অবিলম্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে পদত্যাগ করুন। তা না হলে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানো হবে। বর্তমান সরকার গণহত্যা চালিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করছে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে এর জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এ সরকারের এক নম্বর থেকে শুরু করে সবার বিচার করা হবে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।
এর আগের দিন ১২ মার্চ পুলিশের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে বিএনপি কার্যালয়ে এসে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বিএনপি কার্যালয়ের ওপর টর্নেডো বয়ে গেছে। তছনছ করা হয়েছে পুরো কার্যালয়। এজন্য সরকারকে চরম মূল্য দিতে হবে।
এই চরম মূল্যের অর্থ একেকজনের কাছে একেক রকম হতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে ‘পীড়ন করিলে সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই।’ সেজন্যই মির্জা ফখরুলের কথার সঙ্গে দ্বিমত করার অবকাশ নেই। তবে মাত্রা নিয়ে, রূপ নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে।
আমি নিজে বিশ্বাস করি, যে গণতন্ত্রের জন্য শেখ মুজিব সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন, ক্ষমতায় এসে যদি সেই গণতন্ত্রকে হত্যা করে, সব রাজনৈতিক দল ও সংবাদপত্র (৪টি সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা বাদে) নিষিদ্ধ করে, একদলীয় বাকশালী স্বৈরতন্ত্র কায়েম না করতেন, যদি নির্মম নিষ্ঠুর পন্থায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের পথে না যেতেন, তাহলে ১৫ আগস্টের বেদনাবিধুর ঘটনা ঘটতো না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ ভারতপ্রেমে যতই অন্ধ হন, তবুও একথা বলতে আমি নির্দ্বিধ যে ভারতের জ্ঞাতসারেই ঘটনাটি ঘটেছিল।
তো যারা শেখ মুজিবের ঘাড়ে চেপে তাকে প্রভাবিত করে, তার দ্বারা হত্যা করিয়েছিল গণতন্ত্র, প্রতিষ্ঠা করিয়েছিল ‘বাকশাল’, সেই মনি-মোজাফফর চক্র তথা সিপিবির বালবাচ্চা, ছাও-আণ্ডারাই কিন্তু এখন শেখ হাসিনার চারপাশে। আমার মতো অনেকেরই ধারণা, এই পরগাছাগুলোই শেখ হাসিনাকে আড়াল করে আছেন জনগণ থেকে। এদের জন্যই আওয়ামী লীগের খাঁটি নেতাকর্মীরা তার ধারে-কাছে যেতে পারছে না। এরাই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ইসলামের বিরোধ বাধিয়ে দিতে চাচ্ছে। এরাই শাহবাগের মূল নিয়ন্ত্রক। এরাই জাতীয় সংহতি বিনাশ করে উস্কে দিয়েছে বিভেদ ও বিভক্তি। যার পরিণামে ঘটছে রক্তপাত। দেশ দ্রুত গড়িয়ে পড়ছে গৃহযুদ্ধের দিকে। এরা বার বার আগ-বাড়িয়ে বেশি করে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির কথা বলেন। এই অতি প্রগলভ লোকদের জন্যই বোধকরি শ্রদ্ধেয় বদরুদ্দীন উমর বলে রেখেছেন, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি আর এখনকার সপক্ষের শক্তি এক নয়। অবস্থার পরিবর্তন হয়ে গেছে অনেক। সেদিন যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছিলেন তাদের অনেকেরই অবস্থান স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের পক্ষে নেই। আবার যারা পকিস্তানকে সমর্থন করেছিলেন, তাদের অনেকেই কিন্তু এখন স্বাধীনতা রক্ষার জন্য প্রাণ দিতে পারেন।
ইতিহাসের সহজ সরল ব্যাখ্যাকারদের ভণ্ডামি ও ধূর্ততার স্বরূপ বুঝতে হবে। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে নানান পথ পরিক্রমণের জটিল অঙ্কগুলো অনুধাবন করতে হবে। ভাবাবেগে ভেসে যাওয়া আর আমাদের মানায় না। পরগাছাদের কুবুদ্ধি ও কুযুক্তি শুনে সম্প্রীতি ও সমঝোতার ময়দান ত্যাগ করা কিছুতেই কাণ্ডজ্ঞান ও দায়িত্ব বোধসম্পন্ন মানুষের কাজ হতে পারে না।
সরকারের চোখে বিষ মুখে বিষ নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে বিষ= আবদুল হাই শিকদার
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
ভিসা বন্ধ করায় ভারতকে ধন্যবাদ।
ভারত ইদানীং ভিসা দিচ্ছেনা; তারা ভিসা না দিয়ে আমাদেরকে শিক্ষা দিতে চায়! তাদের করদ রাজ্য হাতছাড় হওয়া খুবই নাখোশ, এতোই নাখোশ যে মোদী মিডিয়া দিনরাত বয়ান দিচ্ছে এই দেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন
ভারতের চিকিৎসা বয়কট এবং
ভারতের এক হাসপাতাল ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশের কোন রুগিকে তারা চিকিৎসা দিবে না। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো যে হাসপাতাল থেকে এই ঘোষণা দেয়া হয়েছে সেই হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার জন্য বাংলাদেশের... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। চামচা পুঁজিবাদ থেকে চোরতন্ত্রে পরিণত হয়েছিল দেশ
চামচা পুঁজিবাদ থেকে দেশ চোরতন্ত্রে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, আমলা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা মিলে চোরতন্ত্র করেছে।
সোমবার... ...বাকিটুকু পড়ুন
শেখ হাসিনাকে ভারত ফেরত পাঠাবে তবে............
শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে বিচারের জন্য ভারতের কাছে ফেরত চাইতে হলে অবশ্যই বাংলাদেশকে প্রতিহিংসামূলক বিচারপদ্ধতি বাদ দিতে হবে। বিচারে শেখ হাসিনা যাতে ন্যায় বিচার পান বাংলাদেশকে আগে তা নিশ্চয়তা... ...বাকিটুকু পড়ুন
ভারত সোনার ডিম পাড়া হাঁস হারিয়েছে
শেখ হাসিনা ভারতে বসে ষড়যন্ত্র-অপপ্রচার করছেন। ভারত চাচ্ছে বাংলাদেশে একটি অশান্তি হোক। কারণ ভারত একটি মসনদ হারিয়েছে। সোনার ডিম পাড়া হাঁস হারিয়েছে।
আওয়ামী লীগ প্রতিদিন একটি সোনার ডিম পেড়ে নরেন্দ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন