শেষের পূর্বে
হাসপাতালে ঢুকেই নিষাদ বুঝে গেল সব শেষ।তার খুব কষ্ট হচ্ছিল এমন বলা যাবে না।কারন হারিয়ে ফেলার অনুভূতিটা নিষাদের মধ্যে কাজ করছিল না।মানুষ যখন বুঝতে পারে সে তার জীবনের খুব মূল্যবান কিছু একটা হারিয়ে ফেলেছে তখন না পাওয়ার দুঃখবোধ তাকে আক্রান্ত করে ফেলে।কিন্তু নিষাদ শুরুতেই যা হারিয়ে ফেলেছিল তার জন্য নতুন করে দুঃখ পাবে কেন?তাই তাকে কেমন যেন অস্থির লাগে।খাচা থেকে বের হলে পাখি যেমন হঠাৎ করে খুব অস্থির হয়ে যায় তেমন।যে অস্থিরতায় একই সাথে আনন্দ এবং অনিশ্চয়তার ভয় কাজ করে।
ইরার সাথে তার খুব কথা বলতে ইচ্ছা করছে।কিন্তু সে জানে তা আর কখনো সম্ভব হবে না। ইরাকে তার অনেক কিছুই বলার ছিল।কিন্তু ইরা তাকে ছেড়ে এখন অন্য জগতে চলে গেছে। সেই অন্য জগতে ইরার সাথে কোন ভাবেই নিষাদ যোগাযোগ করতে পারবেনা।মাঝেমাঝে নিজের সীমাবদ্ধতার কাছে মানুষ নিজেই পরাজিত হয়।প্রবল ভাবেই হয়।
প্রথম যেদিন নিষাদ লুকিয়ে ইরার ডায়েরী পড়েছিল সেদিন সে একই সাথে শিহরিত এবং বিস্মিত হয়েছিল।সেদিন তার মনে হয়েছিল সে ইরাকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করেছে।এবং নিষাদ সেদিন বুঝেছিল একজন মানুষের খুব কাছাকাছি থেকেও আসলে তাকে চিনা যায়না।অভিনয় করার এক সহজাত ক্ষমতা নিয়েই হয়ত প্রতিটি মানুষ জন্মগ্রহন করে।এবং এক সময় অভিনয় করতে করতেই মানুষ বাস্তব এবং ভ্রান্ত জীবনের আবর্তে বিলীন হয়ে যায়।তখন আর সেই ভ্রান্তি থেকে তাকে আলাদা করা যায়না।নিষাদ কখনই আসল ইরাকে আবিষ্কার করতে পারেনি।ইরা কি পেরেছে নিষাদকে?নিষাদের কাছে মনে হয় সে নিজেও ইরার কাছে একধরনের ভ্রান্তি ছিল।
ইরার ডায়েরী থেকে
তোমাকে যখন খুব করে ভালোবাসি তখন মনে হয় তোমায় খুন করে ফেলি!আবার যখন খুব ঘৃণা হয় তোমার প্রতি মনে মনে কত হাজারবার তোমাকে খুন করি।তুমি কি জান?তুমি কি জানতে চেয়েছ? সেদিন যখন তোমার বুকে মাথা রেখে তোমার হৃদস্পন্দন অনুভব করছিলাম, হঠাৎ আমার কি ইচ্ছে হলো জান?ইচ্ছে হলো তোমার হৃদয়টাকে একটানে ছিঁড়ে আমার হাতের মুঠোয় নিয়ে আসি!
তুমি যখন আমাকে ভালোবাস তুমি কি শুধুই আমাকে ভালোবাস?তুমি যখন আমাকে চুমো খাও কেন যেন মনে হয় তুমি অন্য কারো ঠোঁটের স্পর্শ খুঁজে ফির। তখন মনে হয় তোমার ঠোঁট দুটো কামড়ে ছিঁড়ে রক্তাক্ত করে দেই।আমার শরীরে আমি তখন অন্য কাউকে অনুভব করি। সেই অন্য একজনকে আমি হত্যা করতে চাই। হত্যা করতে চাই। হত্যা করতে চাই। হত্যা করতে চাই...........
তোমার কবিতা পড়ে সেদিন আমার খুব রাগ লাগছিল। তুমি বলেছিলে এ কবিতা তুমি আমাকে নিয়ে লিখেছ।কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছিলাম কবিতার মেয়েটি আমি না।সে অন্য কেউ। সে তোমার কল্পনা। তুমি আমার চেয়েও তোমার কল্পনায় আঁকা মেয়েকে অনেক বেশী ভালোবাস। তোমার সে কবিতা আমি একশবার প্রিন্ট করে একশবার ছিঁড়ে ফেলেছিলাম। মনে হচ্ছিল তোমার কাল্পনিক নায়িকাকে আমি বারবার হত্যা করছি!
ডিলেমা
ইরার ডায়েরি পড়ার পর থেকেই নিষাদের মনোজগতে একধরনের ঝড় চলতে থাকে।সে ইরাকে ভালোবাসে। একজন স্বাভাবিক মানুষের ভালোবাসা যেমন ঠিক তেমন ভাবেই ইরার প্রতি তার ভালোবাসা কাজ করে।নিষাদ ভাবছিল ইরাকে সন্তান নেওয়ার কথা বলবে।ঘরে একটা শিশুর জন্ম হলে জীবন অনেক আনন্দময় হবে।আর দশটা স্বাভাবিক পরিবারের মতই মধ্যবিত্ত সুখে নিমজ্জিত হতে চেয়েছিল নিষাদ। কিন্তু যে ইরাকে সে চিনত, যে ইরার সাথে একই ছাদের নিচে বসবাস করে তার সব সুখ দুঃখ শেয়ার করত সেই ইরা ভুল।সেই ইরা ভ্রান্তি। সেই ইরা পাকা অভিনেত্রীর মত এতদিন তার সাথে স্বাভাবিক মানুষের অভিনয় করে গেছে।ইরা কখনোই তাকে বুঝতে দেয়নি সে তাকে কত তীব্র ভাবে ভালোবাসে। ইরার তীব্র ভয়ংকর সুন্দর ভালোবাসার কাছে নিষাদের নিজেকে অসহায় মনে হয়। নিষাদ খুব দ্রুত অবচেতনভাবেই ইরার সাথে অস্বাভাবিক আচরন করা শুরু করে।ইরা তার আশেপাশে থাকলেই নিষাদ কেমন যেন ভয়ে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। সে অনেকবার ইরাকে বলার চেষ্টা করেছে যে, আমি তোমার ডায়েরী পড়ে ফেলেছি।কিন্তু কখনোই বলতে পারেনি। যদিও ইরার আচরনে কোন পরিবর্তন হয়নি। সে ঠিক আগের মতই অভিনয় করে যাচ্ছে।কিন্তু নিষাদ দিনে দিনে মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে যেতে থাকে।
একদিন ইরা খুব স্বাভাবিক ভাবেই নিষাদের পাশে এসে বসল।নিষাদের হাত তার নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,কি হয়েছে তোমার?অনেকদিন থেকেই তোমাকে কেমন যেন বিষণ্ণ মনে হচ্ছে।কতদিন তুমি আমার কাছে আসনা! আমাকে আগের মত আদর করনা!এখন আর আমাকে ভালো লাগেনা! তাই না? নতুন কেউ এসেছে নাকি তোমার জীবনে? সে কে?আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে না? সে কি আমার চাইতেও সুন্দরী?আমার চাইতেও মায়াবতী?হাসি মুখেই দুষ্টামি করার ছলে কথাগুলো বলছিল ইরা।কিন্তু নিষাদের তখন মনে হচ্ছিল ইরার ভিতরের অন্য এক ইরা তখন অন্য কিছু বলছে।এক ইরা অভিনয় করে যাচ্ছে।অন্য ইরা ডায়েরিতে নিজের মনের কথা লিখছে।কোন ইরা সত্য?ঠিক তখনই নিষাদের অর্কের কথা মনে পড়ল।সব কিছু কেমন যেন নিষাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ধরা দিল।অর্ক কেন আত্মহত্যা করল?
অর্ক এবং ইরা একে অপরকে পাগলের মত ভালোবাসত।নিষাদ ছিল দুজনেরই ভালো বন্ধু।কিন্তু একসময় অর্ক কেমন যেন হয়ে যায়।তাকে সবসময় বিষণ্ণ দেখাত।কেমন যেন পাগল পাগল লাগত।ইরা স্বাভাবিক ছিল।নিষাদ ইরাকে জিজ্ঞাসা করেছিল অর্কের কি হয়েছে!ইরা খুব স্বাভাবিক ভাবেই জবাব দিয়েছিল অর্কের সাথে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা তার পক্ষে সম্ভব না!অর্ক নাকি ড্রাগ নেওয়া শুরু করেছিল।অর্ক নিষাদকে কিছু একটা বলতে চাইত।কিন্তু কখনো বলে যেতে পারেনি।কিন্তু অর্ক আত্মহত্যা করার আগে নিষাদকে একটা ডায়েরী দিয়ে যায়।তখন নিষাদ জানত না অর্ক আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে।সেদিন রাতেই অনেকগুলো ঘুমের ঔষধ খেয়ে অর্ক অন্তিম ঘুমের দেশে চলে গিয়েছিল।অর্কের মৃত্যুই নিষাদ আর ইরাকে কাছাকাছি নিয়ে আসে।সেই ভয়ংকর সময়ে ইরার দরকার ছিল একটা নির্ভরযোগ্য হাত।নিষাদ ভালোবেসেই পরম মময়ায় নিজের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল।ইরাও বিশ্বাস করে সে হাত ধরে নতুন জীবন শুরু করেছিল।
কিন্তু অর্কের সেই ডায়েরী নিষাদ পড়েনি।যতবারই সেই ডায়েরী হাতে নিয়েছে তার কেমন যেন ভয় লাগত। সে পড়ার সাহস পেতনা। আর ইরাকে বিয়ে করার পর তার কাছে মনে হয়েছিল এই ডায়েরী পড়া ঠিক হবেনা। হয়তোবা অনেক কিছুই সে সহ্য করতে পারবেনা। ইরাকে এই ডায়েরীর কথা সে কখনোই বলেনি। কিন্তু হঠাৎ করেই নিষাদের মনে হতে লাগল ইরার সব রহস্য অর্কের ডায়েরী পড়লেই বুঝতে পারা যাবে।অর্ক তাকে আত্মহত্যা করার আগে কিছু একটা বলতে চেয়েছিল।তাই সে সেদিন তাকে ডায়েরীটা দিয়ে গিয়েছিল।
অর্কের ডায়েরী থেকে
ইরার চিঠি এবং কবিতাগুলো আমাকে পাগল করে দিচ্ছে।এই ইরার সাথে আমি বাস্তবের ইরাকে মিলাতে পারিনা।ইরার সাথে আমার একটা চুক্তি হয়েছে।আমারা সামনাসামনি কখনোই আমাদের চিঠি এবং কবিতাগুলো নিয়ে কথা বলবনা।এটা ছিল অনেকটা খেলার মত।এই খেলায় আমারা কেউ কখনো হারতে চাইতামনা।কিন্তু ক্রমশই আমার কাছে ইরাকে বহুরূপী মনে হতে লাগল।চিঠিতে সে যা লিখত বা যে ভাবে ভালোবাসার অনুভূতি প্রকাশ করে বাস্তবে ঠিক তার বিপরিত।চিঠিতে ইরা অনেক বেশী আবেগী এবং আগ্রাসী। কিন্তু বাস্তবে ঠিক তার উল্টা। কোন ইরা সত্য?ইরার কোন অন্যভুতিকে আমি সত্য ভেবে নিব?নাকি সবটাই অভিনয়?সবটাই খেলা?
ইরা লিখেছে আমি নাকি আজকে তার পাশে বসে অন্য কোন মেয়ের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।তখন নাকি তার আমার চোখ দুটো গেলে দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল। তার মনে হচ্ছিল আমি তার দিকে তাকিয়ে সেই মেয়েকেই খুঁজছিলাম। কিন্তু ইরার পাশে বসে থাকার সময় এমন কিছুই মনে হয়নি।বরং তাকে খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল।সে আমার সাথে মজাও করছিল।কিন্তু সে সময় তার আমার চোখ গেলে দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল?কোনটা সত্য?এই ডিলেমা আমি আর নিতে পারছিনা।
ইরাকে একদিন চুমু খেতে চেয়েছিলাম।সে আমায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিল।বলেছিল এই তোমার প্রেম! না?বিয়ের আগে এসব কিচ্ছু হবে না! তারপর থেকে আমি ইরার হাত ধরতেও অনুমতি নিয়েই ধরি! কিন্তু আজ ইরার চিঠি পেয়ে আমি অবাক। সে লিখেছে কতদিন ভেবেছি তুমি আমাকে আদর করছ।ভেবে শিহরিত হয়েছি। পুলকিত হয়েছি। কিন্তু তুমি আমাকে কখনো ভালোবেসে স্পর্শ করনি । তুমি আমাকে ভালোবাসনা।বলে কি এই মেয়ে? তার কোন চাওয়াটা সত্য?এ দেখি আমাকে পাগল বানিয়ে ছাড়বে।
অর্কের ডায়েরীর পাতায় পাতায় এমন অনেক কথাই লিখা আছে।নিষাদ এক নিশ্বাসে সব পড়ে ফেলে।শেষের দিকে অর্ক আর কিছু লিখতে পারত না।একটা লাইনই বারবার লিখে রাখত।যেমন এক পাতায় লিখা আছে,
তুমি কে?তুমি কে? তুমি কে? তুমি কে?তুমি কে?তুমি কে?তুমি কে?তুমি কে?তুমি কে?তুমি কে?তুমি কে?তুমি............
আবার পরের পাতাতে লিখা,
পারছিনা পারছিনা পারছিনা পারছিনা পারছিনা পারছিনা পারছিনা পারছিনা পারছিনা পারছিনা পারছিনা............
নিষাদ ডায়েরী পড়া শেষ হলে এক ধরনের ঘোরের মধ্যে চলে যায়।শেষদিকে অর্কের বিষণ্ণ চেহারার কথা তার মনে পড়ে।অর্ক সেসময় যে অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল এখন সে ঠিক একই ভ্রান্তিতে আবর্তিত হচ্ছে।কোন ইরা সত্য?কি দরকার ছিল এমন অসহ্য সুন্দর তীব্র বহুরূপী ভালোবাসার?
শেষ
হাসপাতালের বেডে শায়িত নিষাদের মৃত মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইরা।নিষাদ এখন স্মৃতি হয়ে গেছে। অর্কও একদিন এভাবে স্মৃতি হয়ে গিয়েছিল। ইরার খুব স্মৃতি পছন্দ।স্মৃতিকে নিজের মত করে ভালোবাসা যায়, নিজের মত করে লিখে ফেলা যায়!ইরার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রু নিষাদের মৃত মুখে গড়িয়ে পড়ে।সে কি শিহরিত হচ্ছিল?কে জানে? কেউ কি জানে?
শায়মা আপু মেঘ না চাইতেই জলের মত এ গল্পের প্রথম অংশ আবৃতি করে দিয়েছেন।
শায়মা আপুর আবৃতি
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:২৬