১
তোমাকে আমরা নিয়ে যেতে এসেছি!
-না……………আমি কোথাও যাব না!
তোমার চাওয়া পাওয়া সব কিছুকে অগ্রাহ্য করতে আমরা বাধ্য।আমাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তোমাকে নিয়ে যেতে হবে।আমরা নির্দেশ পালনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
-আমার কাছে তোমরা কি চাও???
আমাকে নিয়ে কি করবে তোমারা???
আমাদের কাজ হচ্ছে তোমাকে ওদের কাছে পৌঁছে দেওয়া।তোমাকে নিয়ে ওদের পরিকল্পনা আমাদের জানতে দেওয়া হয়নি।
মাশা হঠাৎ করেই বুঝতে পারে, অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া তার সামনে অন্য কোন উপায় নেই।
২
এলান খুব শান্তভাবে বসে থাকার চেষ্টা করছে।সে জানে, এখন অস্থিরতার সময় নয়। কিন্তু তার চিন্তা জগতে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষন পূর্বে ঘটে যাওয়া ব্যাপারটির কোন যৌক্তিক ব্যাখ্যা এলান খুঁজে পাচ্ছে না।প্রকৃতিতে অনেক কিছুই ঘটা সম্ভব।যদিও সব রহস্যের ব্যাখ্যা মানুষ এখনো জানতে পারেনি।হয়তোবা কখনো জানতেও পারবে না।কিন্তু এমন কিছু ঘটতে পারে এলান তা কখনো কল্পনাও করতে পারেনি।এলান খুব দ্রুত চিন্তা করতে গিয়ে সবকিছু জট পাকিয়ে ফেলছে।কারন কোন কিছুই তার নিয়ন্ত্রনে নেই।নিজেকে এমন অসহায় কখনো লাগেনি তার।
কয়েকদিন পূর্বে ঘটে যাওয়া কিছু মুহূর্ত
সকালে যখন আলতো রোদের একটা স্নিগ্ধ ভাব থাকে তখন মাশা কিছু সময় তার বারান্দায় বসে থাকে।দোলনায় হালকা দুলতে দুলতে মাশা এ সময় নিজ মনে অনেক কিছু ভাবে।নিজের শৈশবের প্রিয় অপ্রিয় অনেক স্মৃতি মনের কোনে ভেসে বেড়ায়।এমন সব সময়ে মাশার মনে হয় বেঁচে থাকাটা খুব একটা খারাপ কিছু না।অথচ এই মাশাই এক সময় মরে যেতে চেয়েছিল।সে ছিল এক ভিন্ন সময়।যখন মাশার কাছে জীবন মনে হত শুধুই না পাওয়ার আক্ষেপ।তাই একদিন ঘুমের ঔষধ খেয়ে নিজের সব কষ্টগুলোকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার চেষ্টাটাই তার কাছে একমাত্র সমাধান বলে মনে হয়েছিল।কিন্তু মাশা শেষ পর্যন্ত মরতে পারেনি।ডাক্তাররা তাকে ক্লিনিক্যালি ডেড ঘোষণা করে দিয়েছিল। কিন্তু কোন এক রহস্যময় উপায়ে মাশা আবার জীবিত হয়ে ফিরে এসেছে।মেডিক্যাল সাইন্স তার এই ফিরে আসার কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেনি।তারপর থেকেই মাশার চারপাশের মানুষ বিচিত্র কারনে তাকে ভয় পেতে শুরু করল।যদিও মাশা কখনই কোন অস্বাভাবিক কাজ করেনি, তবুও তাকে নিয়ে মানুষজনের মধ্যে অনেক ভয়াবহ গল্প প্রচলিত আছে।তার মধ্যে কিছু গল্প খুবই হাস্যকর এবং কুৎসিত।নিজের সম্পর্কে সেইসব গল্প শুনলে মাশার হাসি যেমন পায়, তেমনি রাগও লাগে।
মাশা সম্পর্কে সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্পটির রুপকার তারই একসময়ের প্রিয় রহিমা বুয়া।মাশা ছোটকাল থেকেই একা ঘুমাতে পারেনা।এই বড়বেলাতেও একা এক রুমে ঘুমাতে ভয় পায় মাশা। তাই রহিমা বুয়া মাশার সাথে একই রুমে ঘুমাত।রহিমা বুয়ার বকবক করার স্বভাব আছে।মাশা আবার প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। তাই মাঝেমাঝে বিরক্ত হয়েই রহিমা বুয়ার আজগুবি সব গল্প মাশাকে শুনতে হত।কিন্তু কিছুদিন পরেই মাশা দেখল রহিমা কেমন যেন চুপ হয়ে গেছে।রাতে ঘুমাতে আসার সময় সে আতঙ্কে থাকত।তাকে দেখে মনে হত খুব ভয়ংকর কোন পরিনতির জন্য সে অপেক্ষা করছে।
একদিন রহিমা খালা বলল, তার পক্ষে আর মাশার সাথে থাকা সম্ভব নয়!তারপর সে যা বলল তা শুনে মাশা এতটাই অবাক হয়েছিল যে কিছুক্ষন কোন কথাই বলতে পারেনি।মাশার সাথে নাকি রাতে আরেকজন থাকে।এক মধ্যবয়স্ক পুরুষ মানুষ নাকি সারারাত মাশার মাথার পাশে বসে থাকে।সেই পুরুষ মানুষ নাকি রহিমা বুয়াকে বলেছে তার ভয়ের কোন কারন নেই।সে মাশাকে ঘুমের সময় পাহারা দেয়।মাশাকে নাকি কারা যেন অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।রহিমা বুয়া এই গল্প বাইরে সবাইকে বলে দিয়েছে।তখন অনেকেই বলাবলি করা শুরু করল যে, তারাও মাশার পাশে প্রায়ই কাকে যেন দেখে।কিন্তু রহিমা বুয়া যাওয়ার আগে মাশাকে সেই পুরুষের একটা দৈহিক বর্ণনা খুব স্পষ্ট ভাবে দিয়েছিল।সেই বর্ণনার সাথে একজনের খুব মিল খুঁজে পায় মাশা।তার জীবনের খুব গোপন এক অধ্যায়!যা অনেক চেষ্টায় মাশা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল।কিন্তু সেইসব কুৎসিত দিনগুলোর স্মৃতি না চাইলেও মাশার মনোজগতে আবার ভীড় জমাতে থাকে।
সেই রহস্যময় পুরুষ
মাশা যখন স্কুলে পড়ত তখন তাকে পড়ানোর জন্য একজন গৃহশিক্ষক রাখা হয়েছিল। শান্ত স্বভাবের সেই মধ্যবয়স্ক মানুষটির মধ্যে একধরনের সম্মোহনী ক্ষমতা ছিল যা খুব সহজেই মানুষকে আকৃষ্ট করত।তার নামটাও ছিল খুব অদ্ভুত।তার নাম ছিল ফানা।একজন মানুষের নাম কখনো ফানা হতে পারেনা। নিশ্চয়ই তার অন্য কোন নাম ছিল।কিন্তু জন্মের সময় মা মারা যাওয়ায় সবাই নাকি তাকে ফানা নামেই ডাকত।ফানা মাশাকে অনেক মজার মজার ম্যাজিক দেখাত।মাশা মন্ত্রমুগ্ধের মত ফানার কথা শুনত।সে খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারত।বয়োঃসন্ধিকালের সেই সময়ে মাশা খুব দ্রুতই ফানার প্রেমে পড়ে যায়।সে বিভিন্ন ভাবে ফানাকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করতে থাকে।কিন্তু ফানার নির্লিপ্ততা মাশাকে খুব যন্ত্রণা দিত।
ফানার একটি গোপন ব্যাপার ছিল, যা মাশা ছাড়া অন্যকেউ জানত না। ফানার ঘরে অনেক শামুক থাকত।সে শামুক নিয়ে খেলা করত, তাদের সাথে মাঝেমাঝে ফিসফিস করেও কিসব যেন কথা বলত যার কিছুই মাশা বুঝত না।তবে সেইসব কথা মাশা কখনো কারো সাথে শেয়ার করেনি।তাকে ব্যাপারটি গোপন রাখতে বলা হয়েছিল।তবে একটি দৃশ্য মাশার মনোজগতকে উলটপালট করে দিয়েছিল।একদিন ফানার রুমে ডুকে সে এক ভয়ংকর দৃশ্য দেখেতে পায়।ফানা নগ্ন হয়ে শুয়ে আছে এবং তার শরীরে শতশত শামুক হেটে বেড়াচ্ছে।ফানার নাক, কান, মুখ দিয়ে শামুক ঢুকছে এবং বেড় হয়ে আসছে।এই অপার্থিব দৃশ্য মাশার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি।সে সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল।
ফ্ল্যাশব্যাক
এই ঘটনার পর মাশা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।তাকে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়।ইংল্যান্ডের বিখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এলান মাশাকে দিনের পর দিন কাউন্সেলিং দিয়ে সুস্থ করে তুলেন।এলান বুঝতে পারে ফানার প্রতি তীব্র আকর্ষণ এবং তার রহস্যময় জীবন মাশার মনোজগতে তীব্র প্রভাব ফেলে।তার ফলেই মাশার হ্যালুসিনেশন হয়।এলান ফানার ব্যাপারেও কিছু খোঁজ খবর নেওয়ার চেষ্টা করে।কিন্তু সেই ঘটনার পর ফানাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি।তার অতীত সম্পর্কেও কেউ কিছু জানেনা।ফানা রহস্যের কোন সমাধান এলান করতে পারেনি।তবে মাশা সুস্থ হয়ে ইংল্যান্ডেই পড়ালেখা করতে থাকে।এলানের মনে হয়েছে মাশার দেশে ফিরে যাওয়াটা উচিৎ হবেনা।দেশে ফিরে গেলেই সেই ভয়াল স্মৃতি তাকে আবারো প্রভাবিত করবে।
মাশা প্রায় সুস্থ হয়ে ওঠে।কিন্তু বছরখানিক পরেই জীবন তার কাছে অর্থহীন মনে হতে থাকে। এলানের সাথেও সে একধরনের জটিল সম্পর্কে জড়িয়ে যায়।নিজেকে চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে দিবে বলে তাই সে একদিন অনেকগুলো ঘুমের ঔষধ খেয়ে ফেলে।সে নাকি মরেই গিয়েছিল।ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করে দেয়।কিন্তু কোন এক রহস্যময় উপায়ে মাশা আবার জীবিত হয়ে গিয়েছে।সেটা এখনো এক অমীমাংসিত রহস্যই রয়ে গেছে।
তারপর মাশা আবার দেশে ফিরে আসে।নিজের মত করেই বাঁচতে শিখে সে।অতীতের সব ভয়াল স্মৃতিগুলোকে ভুলে গিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই জীবনযাপন করতে থাকে মাশা।কিন্তু একদিন তার বারান্দায় অনেকগুলো শামুক দেখে ভয় পায় মাশা।ফানা এবং শামুকের সেই ভয়াবহ দৃশ্য মনে পড়ে যায় তার।সে এলানের সাথে যোগাযোগ করে।এলান নিজেও চিন্তিত হয়ে পড়ে।সে মাশাকে তার কাছে চলে আসতে বলে।মাশা আবার ইংল্যান্ড চলে যায়।
অপার্থিব
কিন্তু এলান মাশাকে বাঁচাতে পারেনা।একদিন ওরা সব মাশার কাছে আসে।ওদের দেখে মাশার খুব একটা ভয় হয়না।তার কাছে মনে হয় এমন দৃশ্য সে বহুবার দেখেছে।তার বরং অনেক কৌতহল হয়!ফানার সাথে সেদিন ওরা কি করেছিল তা জানার একটা গোপন ইচ্ছা তার মধ্যে সবসময়ই ছিল।আবার একধরনের অদ্ভুত ভয় মাশাকে আচ্ছন্ন করে!কিন্তু সেই ভয় আবার কি এক অজানা ভালোলাগায় মাশাকে নির্লিপ্ত করে ফেলে।একধরনের ঘোরের মধ্যে থেকেই এক অজানা সম্মোহনে অসহায় মাশা নিজেকে ওদের কাছে সমর্পণ করে দেয়।
এলান এখন যে দৃশ্য দেখছে তার জন্ম এই ভুবনে না।এমন এক দৃশ্যের বর্ণনা এলান মাশার কাছে অনেকবার শুনেছে।কিন্তু তাকেও একদিন এই অপার্থিব দৃশ্যের মুখোমুখি হতে হবে তা সে কখনও কল্পনাও করেনি!এলান সম্মোহিত মানুষের মত মাশার নগ্ন শরীরের দিকে তাকিয়ে আছে!মাশার নগ্ন শরীরে হেঁটে বেড়ানো শামুকগুলো যেন তাকেও ইশারায় কিছু একটা বলতে চাচ্ছে!সেই নির্বাক সময়ে তার বোধগুলো সব ঘুমিয়ে পড়ে!সেই ঘুম আর জাগরনের মুহূর্তে এলান খুব তীব্রভাবে অনুভব করে, একদিন ওরা তার কাছেও আসবে!
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:২৯