দ্বিতীয় মৃত্যুর ঘোর থেকে উঠে এক কাপ চা কিংবা প্রিয়তমার ঠোঁটের মত সিগারেটের স্পর্শ আমার মনে এক ধরনের নিস্পাপ আনন্দের জন্ম দেয়।এই নশ্বর জীবনের অনেক কিছুর মতই আনন্দটা খুব বেশীক্ষণ স্থায়ী হয়না।নশ্বর দেহের মধ্যে যে অবিনশ্বর মনের বাস, সেই মনে শুরু হয় এক অদ্ভুত কোলাহল।কেউ যদি আমার সেই কোলাহল দেখত, তবে তার সমুদ্র দর্শন হয়ে যেত।কারন সেখানেও অবিরাম জোয়ার ভাঁটার মত ঢেউয়ের উৎসব চলে।তবে মানবের মনের সেইসব জোয়ারভাটার উৎসব কিংবা অবিরাম খুঁজে ফেরার বিষণ্ণতায় ডুব দিয়েছিল এক কালজয়ী পুরুষ।যাকে আপনারা সবাই লালন ফকির নামে ডাকেন।আমার মনের অতলেও দেখি তাকে ডুব সাঁতার দিতে।
যেমন ধরেন, একদিন একটা গল্প লিখছিলাম।গল্পের প্লট ছিল ক্ষুধার্থ মানুষের হাহাকার নিয়ে।একজন মানুষ একটি কুকুরের সাথে ডাস্টবিন থেকে ময়লা খাবার ভাগ করে খায়।গল্পের সেই মানুষগুলোর যন্ত্রণা আমাকেও স্পর্শ করছিল।খুব ইচ্ছে করছিল গল্পে একটা বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলি।ঠিক যখন আমি গল্প লেখায় নিমগ্ন তখনই পাশের বাসা থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসে।এই কান্নার আওয়াজ আমার পরিচিত।পাশের বাসার কাজের মেয়েটিকে প্রায়ই নির্মম ভাবে প্রহার করা হয়।সেদিনও তাই করা হয়েছিল।তাই বাচ্চা মেয়েটি চীৎকার করে কাঁদছিল।কিন্তু তার সেই কান্নায় আমি প্রচণ্ড বিরক্ত হলাম।কারন গল্পে মনোযোগ দিতে পারছিলাম না।তখন হঠাৎ করে লালন ফকির আমার সামনে উপস্থিত।একটু বিদ্রুপের হাসি হেসে তিনি বললেন,
-তুই নিজেই মূল থেকে বিচ্ছিন্ন।
-গল্প লিখে কি মূলে পৌঁছা যায়রে বোকা?
তার এমন কথায় আমি একটু বিভ্রান্ত হলাম।বললাম কি সব হেঁয়ালি করছেন!কিছুই বুঝতে পারছিনা।তখন তিনি নিজের মনেই গান ধরলেন,
মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।
মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই মূল হারাবি।।
এই মানুষে মানুষ গাথা
গাছে যেমন আলকলতা।
জেনে শুনে মুড়াও মাথা
জাতে ত্বরবি।।…………..
আমি চাই কিংবা না চাই, উনি নিজের মন মত এসে আমাকে গান শুনিয়েই যাবেন।একবার কিছু জ্ঞানী গুণী মানুষের সাথে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনায় বসেছিলাম।আলোচনা করেই দেশ জাতির দুঃখ সব লাঘব করে ফেলছিলাম!নিজেদেরকে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে হচ্ছিল।তখন ফকির বাবাজী সেই আলোচনার আসরে এসে হাজির।কোন কথা না বলেই তিনি গান ধরলেন,
-বেদ বিধির পর শাস্ত্র কানা
আর এক কানা মন আমার।
এসব দেখি কানার হাট বাজার।
পণ্ডিত কানা অহংকারে
মাতবর কানা চোগলখোরে
সাধু কানা অন বিচারে
আন্দাজে এক খুঁটি গেড়ে
চেনে না সীমানা কার……….
বুঝতেই পারছেন!!!
এই গানের পর আলোচনা কোন ভাবেই আর শুরু করা গেল না!
একদিন শুনলাম এলাকায় সালিশ বসবে।সেই সালিশে আমাকেও আমন্ত্রন জানানো হয়েছে।সালিশের কারন শুনে আমি বিরক্ত হলাম।এলাকার এক হিন্দু ছেলে আর মুসলিম মেয়ে বিয়ে করে ফেলেছে। তারা দুজনই নাকি তাদের নিজস্ব জাতকে এবং ধর্মকে অবমাননা করেছে!তাই সমাজের মুসলিম এবং হিন্দু মোড়লরা সিদ্ধান্ত নিল তাদের দুজনকে শাস্থি পেতে হবে।এই মুসলিম এবং হিন্দু মোড়লগুলোকেও আমি চিনি।এমন কোন আকাম কুকাম নেই যেটা তারা করে নাই। কিন্তু ধর্মের মুখোশ পড়ে আছে বলে তাদের সাত খুন মাপ।আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম ক্ষমতাবান এই সমাজপতিদের সাথে কোন রকম বিবাদে যাব না।তাই সালিশে চুপ থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম।কিন্তু সেই কালের ধারক লালনকে কে চুপ করাবে?তিনি সালিশেও চলে এলেন।এসেই গান ধরলেন,
-জাত গেল জাত গেল বলে
একি আজব কারখানা
সত্য কাজে কেউ নয় রাজি
সবই দেখি তা না না না….
আসবার কালে কি জাত ছিলে
এসে তুমি কি জাত নিলে
কি জাত হবে যাবার কালে
সে কথা ভেবে বলো না…
এই এক গান শুনেই মোড়লরা রাগে নিজেদের মাথার চুল নিজেরাই......
আর এই একবিংশ শতকের আমি অবাক বিস্ময়ে শুনছিলাম এক জ্ঞানী সাধকের গান, যার আলোর মত অন্ধকারকে স্পর্শ করার ক্ষমতা কখনই ফুরিয়ে যাবে না।
মাঝেমাঝে নিজের মধ্যেই অতলে ডুবে থাকা কিছু একটাকে নিজের কিছু বলে মনে হয় না।মনে হয় দূর নক্ষত্রের মতই তার আলোকরশ্মি শত আলোকবর্ষ পর আমার হৃদয়কে স্পর্শ করছে।তখন মন খুব বিষণ্ণ হয়।মনে হয় জীবন এক অপ্রাপ্তির খেলা ছাড়া আর কিছুই না।যখন আমি এই অধরাকে ধরার তীব্র যন্ত্রণায় আক্রান্ত হই, তখন লালন আমার পাশে তামাক নিয়ে বসেন।এক ঘোরের মাঝে আমি শুনে যাই তার গাওয়া গান,
বাড়ির কাছে আরশীনগর
সেথায় এক পড়শী বসত করে
আমি একদিনও না দেখিলাম তাঁরে ।।
… গেরাম বেড়ে অগাধ পানি
নাই কিনারা নাই তরণী পারে,
বাঞ্ছা করি দেখব তারে
কেমনে সে গাঁয় যাই রে ।।
কি বলব সে পড়শীর কথা,
হস্তপদ স্কন্ধ-মাথা নাইরে
ক্ষণেক ভাসে শূন্যের উপর
ক্ষণেক ভাসে নীড়ে ।।
পড়শী যদি আমায় ছুঁতো,
যম যাতনা সকল যেতো দূরে
সে আর লালন একখানে রয়
লক্ষ যোজন ফাঁক রে
মাঝে লক্ষ যোজন ফাঁক রে ।
আমি একদিনও না দেখিলাম তাঁরে।
যাইহোক, আমার এবং লালন ফকিরের পরাবাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়ে আপনাদেরকে আর বিরক্ত করতে চাচ্ছি না।লানন ফকিরের পাগলামি অনেকেরই সহ্য হয় না।তার পাল্লায় পড়ে আমিও যদি পাগলামি করতে থাকি তবে কখন কার মাথায় ফতোয়ার জন্ম নিতে শুরু করবে কে জানে!?তবে তিনি কিন্তু এখনও আমার পাশে বসে গান গাচ্ছেন!এই গানটি শুনিয়ে আমি আপাতত বিদায় নিচ্ছি!!!তিনি গাচ্ছেন,
- একটা পাগলামি করে
জাত দেয় সে অজাতেরে দৌড়ে গিয়ে
আবার হরি বলে পড়ছে ঢলে
ধূলার মাঝে ।।
একটা নারকেলের মালা
তাতে জল তোলা ফেলা করঙ্গ সে
পাগলের সঙ্গে যাবি পাগল হবি
বুঝবি শেষে ।।
পাগলের নামটি এমন
বলিতে অধীন লালন হয় তরাসে
চৈতে নিতে অদ্বৈ পাগল
নাম ধরে সে ।।
তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে….. !!
আহা! আহা!
ভবের রাজ্যে ডুবে দেখ
দেখবি হাজার ঢেউ!
ঢেউয়ের মধ্যে তীর আছে।
তীরের মধ্যে ভীড়ের কাছে
চক্ষু মেলে দেখ!
দেখবি সেথায় বসে আছে
তোর আমার কেউ।
এইটা আমার গান। যদিও এই গান শুনে লালন বলেছিলেন, তোর দ্বারা কিছু হবে না।তারপরও তিনি বারবার ফিরে আসেন। তাকে ফিরে আসতেই হয়।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৩৭