যখন মধ্যরাত
ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন মিহিন চোখ মেলে দেখে নির্ঘুম তারাদের অস্তিত্ব।খুব ঘুম পাচ্ছে, খুব।কিন্তু ঘুম হচ্ছে দ্বিতীয় মৃত্যু।মৃত্যুর মত কোন কিছুই ভালো লাগে না মিহিনের।কিন্তু সবকিছুকে একদিন মরে যেতে হয়।এমনকি আকাশের যে তারাগুলো মিহিনের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে তারাও সব একদিন ধ্বংস হবে।মিহিনের ধারনা কোন একদিন ঘুমের মধ্যে মরে পড়ে থাকবে সে।যদিও বেঁচে থাকা মানেই শুধু মরে যাওয়ার সাথে বিরোধ নয়।বেঁচে থাকা মানে নিজস্ব বোধগুলোর সাথে অবিরাম সংগ্রামে মেতে থাকা। আজকাল বেঁচে থাকাটা মিহিনের জন্য খুব একটা আনন্দের ব্যাপার নয়।মাঝে মাঝে মনে হয়, বেঁচে থেকে কোন লাভ নেই।মরে গেলেই সব চিন্তা মুহূর্তে শেষ।কিন্তু এই মুহূর্তে সব শেষ হয়ে যাওয়ার চিন্তাটাই তাকে শিহরিত করে।শুধুমাত্র মৃত্যু চিন্তাই তাকে মনে করিয়ে দেয় সে বেঁচে আছে।
যেদিন মিহিনের পোষা কুকুরটা মরে গেল সেদিন সে বুঝেছিল মৃত্যু কত ভয়ংকর হতে পারে।মৃত্যু ভয়ংকর জীবিত মানুষের জন্য।হারিয়ে যাওয়া সবকিছুর জন্য মানুষের ভিতর এক ধরনের হাহাকার কাজ করে।অথচ চারপাশের অনেককিছুই ক্রমাগত মিহিনের কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।হারিয়ে যাচ্ছে বহমান সময় যার প্রতি মিহিনের সবচেয়ে বেশী রাগ।হারিয়ে যাওয়ার সময় স্রোতের মত ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে প্রিয় সব মুহূর্তগুলো।কিন্তু সময় কিছু উচ্ছিষ্ট রেখে যায় মানুষের মনে।সময়ের রেখে যাওয়া উচ্ছিষ্টগুলো আজ মিহিনকে বেঁচে থাকার আনন্দ দেয় না।ময়মনসিংহ গীতিকায় একটি গান আছে,যার প্রথম দুটি লাইন হচ্ছে,
"উইড়া যায়রে বনের পঙ্খী
পইরা থাকে মায়া"।
মিহিনের কাছে মনে হয় আসলেই তাই।বেঁচে থাকতে হলে মানুষকে মায়া নিয়ে পড়ে থাকতে হয়।যেমন মিহিনের এখন মনে পড়ছে মাধবীলতার মায়াবী চোখ জোড়ার কথা।সমরেশের কালবেলা উপন্যাসের মাধবীলতা নয়।মিহিনের মাধবীলতা।যার চোখে একসময় কোন কারন ছাড়াই ডুব দিত মিহিনের অস্থির পথ চলা।সময় আজ মিহিনের কাছ থেকে সেই চোখ জোড়া কেড়ে নিয়ে গেছে।বরং মিহিনকে দিয়ে গেছে এমন কিছু স্মৃতি যা কখনই তাকে আরাম দেয় না।মাধবীলতাও কালবেলার মাধবীলতার মত মিহিনকে জড়িয়ে ধরেনি।বরং ছেঁড়ে চলে গেছে বহুদূর।কিন্তু মিহিন দূরে সরে যেতে পারেনি।বারবার তাকে ফিরে যেতে হয় সেইসব মুহূর্তগুলোর কাছে।জীবনানন্দা দাশ হয়তোবা এজন্যই লিখেছিলেন ,
“তবু তোমাকে ভালোবেসে
মুহূর্তের মধ্যে ফিরে এসে
বুঝেছি অকূলে জেগে রয়
ঘড়ির সময়ে আর মহাকালে যেখানেই রাখি এ হৃদয় ।”
মিহিন ঘুমিয়ে যাচ্ছে।সুখ, দুঃখ কিংবা স্মৃতির পদচারনা কোন কিছুই ঘুমকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারছে না।ঘুমের কাছে মিহিনকে পরাজয় বরণ করে নিতে হবে।সকল কোলাহলকেই কোন না কোন সময় নীরব হয়ে যেতে হয়।
স্নিগ্ধ সকালে
রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে অন্ধকারের বুকে যখন প্রথম আলো এসে প্রবেশ করে তখন চারপাশের সব কিছুকে খুব মায়াময় মনে হয়।সেই ঘোরলাগা সময়ে কোন শিশুর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে মনে হয়, সার্থক এ মানব জীবন।কলিমের ঘরেও নতুন শিশু এসেছে।কিন্তু আজ ঘোর লাগা মুহূর্তে সে শিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে কলিম নিজের ভিতর এক ধরনের আতংক অনুভব করে।এই শিশুটিকে পৃথিবীতে নিয়ে আসার জন্য নিজেকে অপরাধী মনে হয় তার।তার মনে হয় মানব জন্ম সবার জন্য আশীর্বাদ নয়।কলিমের ঘরে জন্ম নেয়া শিশুটির জন্য তা কখনও আশীর্বাদ হতে পারে না।কলিমের বয়ে চলা দারিদ্র্যতার অভিশাপ তার এই নিস্পাপ শিশুটিকেও বহন করতে হবে।কলিম যে কারখানায় কাজ করে তা কিছুদিন ধরে বন্ধ হয়ে আছে।তার আয় রোজগার প্রায় বন্ধ।রহিমা কিভাবে বাচ্চাটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে তা সে নিজেই জানে।সারাদিন মানুষের বাড়িতে বাড়িতে কাজ করেও সে বাচ্চাটিকে মাতৃ স্নেহে যেভাবে আগলে রেখেছে তা কলিমকে বিস্মিত করে।কলিমের ভিতর মাঝে মাঝে একটি গোপন ইচ্ছে কাজ করে।তার খুব ইচ্ছে করে একদিন রহিমার পা ধরে সালাম করে।কিন্তু সে যা ভাবে তা কখনও করা হয়ে উঠে না।যেমন রহিমার সাথে কাল রাতে তার খুব ঝগড়া হয়েছিল।ঝগড়ার এক পর্যায়ে কলিমের মাথায় খুন চেপে যায়।সে কাল রাতে রহিমার গাঁয়ে হাত তুলেছিল।সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত বিধ্বস্থ রহিমা সারারাত শিশুটিকে আগলে ধরে কেঁদেছিল।এই সব মুহূর্তে কলিমের খুব মরে যেতে ইচ্ছে হয়।কিন্তু তারপরও বেঁচে থাকার সব গ্লানি নিয়ে তাকে জীবনের ভার বহন করে ক্রমাগত ছুটে চলতে হয়।
কলিমরা আজ বেতন ভাতার দাবীতে তাদের কারখানা ঘেরাও করবে।মালিকপক্ষ আলোচনার নামে দিনের পর দিন কালক্ষেপণ করে যাচ্ছে।দাবী মানা না হলে আজ দুপুর থেকে তারা অনির্দিষ্ট কালের জন্য অবস্থান করে আন্দোলন চালিয়ে যাবে।যদিও এ আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে কলিম খুব একটা আশাবাদী না।তাদের প্রতিপক্ষ শুধু মালিক পক্ষ না।কলিম বহুবার দেখেছে যখনি বেঁচে থাকার দাবীতে শ্রমিকরা আন্দোলন শুরু করে তখনই কিছু ভুঁইফোড় মানুষ কোথা থেকে যেন উদয় হয়।তারা টাকা দিয়ে এবং বিভিন্ন রকম দিকনির্দেশনা দিয়ে শ্রমিক নেতাদের বিভ্রান্ত করতে চায়।এদেরকে বড় ভয় হয় কলিমের।
মধ্যদুপুরে
তীব্র রোদে কড়া ভাঁজা হয়ে হাঁটার মধ্যে আনন্দ খুঁজে পাওয়াটা যে কোন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের জন্য খুব কঠিন ব্যাপার।অথচ ইরার আজ রোদের আগুনে নিজেকে ঝলসে ফেলতে ইচ্ছে করছে।অনেকক্ষণ হল সে ক্রমাগত হেঁটেই যাচ্ছে।ঘামে এবং ক্লান্তিতে মাখামাখি হয়েও ইরার থামতে ইচ্ছে করছে না।তার মনে হয় মিহিন তাকে এই অবস্থায় দেখলে খুব মজা পেত।আজ এই মুহূর্তে মিহিনকে খুব আনন্দ দিতে ইচ্ছে করছে ইরার।মিহিন তার কাছে এর বেশী কিছু চায়নি কখনই।কিন্তু ইরার মনে হয় আনন্দের মুহূর্তগুলো আজকাল মিহিনের কাছে বিষাদ হয়ে ধরা দেয়।মিহিনের সাথে ওর পরিচয়টা অনেক দিনের।সেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকে।মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ইরার কাছে শিল্পপতির বখে যাওয়া ছেলে মিহিনকে কখনই ভালো লাগেনি।মিহিনও ইরার কাছ থেকে সবসময় দূরে দূরে থাকত।কিন্তু মাস খানেক আগে হঠাৎ একদিন ইরার গানের অনুষ্ঠানে মিহিনকে বসে থাকতে দেখে বেশ অবাক হয় ইরা।সবসময় সবকিছুকে তোয়াক্কা করে চলা মিহিনকে কেন যেন খুব এলোমেলো মনে হয় ইরার কাছে।অনুষ্ঠান শেষ হবার পর সে ইরাকে বলেছিল তুমি খুব সুন্দর গান কর।বিদ্রুপ করতে চেয়েও মিহিনের বিষণ্ণ চোখের দিকে তাকিয়ে সেদিন নিজেকে সামলে নিয়েছিল ইরা।
একদিন ক্যাম্পাসের এক নির্জন কোনে স্থির বসে আকশের দিকে তাকিয়ে ছিল মিহিন।এভাবে মিহিনকে দেখে অভ্যস্থ নয় ইরা।তার কাছে মনে হয়েছিল মিহিন হয়তোবা প্রেম বিষয়ক জটিলতার মধ্যে আছে।কিন্তু ক্যাম্পাসের সবাই সবসময় দেখে এসেছে প্রেম ভালোবাসা নিয়ে ক্রমাগত ফান করা মিহিনকে।তাই অনেকটা কৌতহলের বশেই সে সেদিন মিহিনকে জিজ্ঞাসা করেছিল,মিহিন প্রেমে পড়েছে কিনা?মিহিন বিষণ্ণ হাসি হেসে বলেছিল এই প্রথমবার আমি বেঁচে থাকার প্রেমে পড়েছি।ইরা, তোমার সাথে আমার কখনও সেভাবে কথা বলা হয়নি।ইদানিং বেঁচে থাকাটা আমার কাছে খুব অর্থপূর্ণ মনে হয়।সেদিন তোমার গান শুনে খুব আনন্দ পেয়েছিলাম।এইসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আনন্দের অনুভূতিগুলোকে নিয়ে কখনই ভাবা হয়নি।কিন্তু এখন ভেবে আনন্দে থাকার চেষ্টা করছি।বেঁচে থাকার প্রতিটি মুহূর্তকে আমি এখন উপভোগ করতে চাই।কারন খুব দ্রুতই আমি কিংবা মুহূর্ত কেউ কাউকে খুঁজে পাবে না।মিহিনের মুখে কথাগুলো শুনে কেমন যেন ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিল ইরা।খুব দরদ নিয়ে সে মিহিনকে বলেছিল, কি হয়েছে তোমার?মিহিন একটি শব্দে জবাব দিয়েছিল, লিউকমিয়া।ডাক্তার বলেছে হাতে খুব বেশী সময় নেই।সবাই দেশের বাইরে থেকে চিকিৎসা করাতে চেয়েছিল।কিন্তু আমি জানি ডাক্তাররা কোন ভাবেই আমাকে বাঁচাতে পারবে না।তাই শেষ সময়ে এই পরিচিত ভুবনেই বেঁচে থাকতে চাই।ইরা সেদিন মিহিনের হাত নিজের হাতে নিয়ে বলেছিল, আমি তোমার শেষ মুহূর্তের বন্ধু হলাম।
আজ হাঁটতে হাঁটতে ইরা শুধু মিহিনের কথাই ভাবছিল।সে হয়তোবা মৃত্যু ভয়ে আতংকিত মিহিনের অসহায়ত্ব দেখে তার প্রেমে পড়ে গেছে।মিহিনের বেঁচে থাকার আকুতিকে সে ভালোবেসে ফেলেছে।মিহিন তাকে মাধবীলতার কথা বলেছে।মিহিন ইরার মাঝেও মাধবীলতাকে খুঁজে বেরায়।মধ্য দুপুরের তীব্র রোদে ইরা হেঁটেই যাচ্ছে।সূর্যের আগুনস্পর্শ তবু মুছে দিতে পারেনি তার অশ্রুধারা।
যখন নেমেছে আঁধার
সিরাজুল ইসলামকে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে।পরিস্থিতি খুব দ্রুতই নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাচ্ছে।শ্রমিকরা আজ দুপুর থেকেই অবস্থান নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।বিশিষ্ট শিল্পপতি সিরাজুল ইসলাম তার এই জীবনে অনেক বড় বড় ঝামেলা মোকাবেলা করেই আজ এই পর্যন্ত আসতে পেরেছেন।কিন্তু এবারের ঝামেলা তিনি সহজভাবে সামাল দিতে পারছেন না।তবে শেষ চেষ্টাটা তাকে করতে হবে।শ্রমিক নেতাদের মধ্যে কয়েকজনকে তিনি টাকা দিয়ে কিনে ফেলেছেন।কিন্তু সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কৈ এর তেলে কৈ ভাজবেন।শ্রমিকদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে জঙ্গি আন্দোলনে রূপান্তরিত করে পরে পুলিস দিয়ে তা নিয়ন্ত্রন করতে হবে।এইসব ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ লোক সবসময় তার হাতের কাছেই থাকে।এখন শুধু সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করতে হবে।পারিবারিক কারনেও সিরাজুল ইসলাম খুব চিন্তিত।তার একমাত্র ছেলে মিহিনের হাতে বেঁচে থাকার জন্য খুব বেশী সময় নেই।সিরাজুল ইসলাম দেশের বাইরে নিয়ে চিকিৎসা করাতে চেয়েছিলেন।কিন্তু ছেলেটা শেষ ক’টা দিন এদেশেই থেকে যেতে চেয়েছে।
কলিম কেমন যেন বিপদের গন্ধ পাচ্ছে।চারপাশের ফিসফাস, হঠাৎ করে নেমে আসা নিরবতা সবকিছুই তার কাছে ঝড়ের পূর্বাভাস বলে মনে হচ্ছে।খুব খারাপ একটা ঝড় আসবে।ঝড়ের তাণ্ডবে ভেঙে যাবে তাদের বেঁচে থাকার আন্দোলন।কিছু শ্রমিক নেতা ভিন্ন সুরে কথা বলতে শুরু করেছে।এক রাতের মধ্যেই তাদের এই পরিবর্তনের কারন কলিম খুব ভালো করেই জানে।তারা টাকার কাছে বিক্রি হয়ে গেছে।মালিকরা পারেও বটে!হঠাৎ করে একদল শ্রমিক ঘোষণা দেয় রাস্তায় নেমে গাড়ি ভাঙতে হবে।তারা লাঠি ইট পাথর নিয়ে রাস্তার দিকে দৌড়ে যেতে থাকে।কলিম ভাবে, যেভাবেই হোক ওদেরকে থামাতে হবে।তা না হলে সেই পুরানো খেলা খেলেই মালিকপক্ষ আবার জিতে যাবে।কলিম উগ্র শ্রমিকদের থামাতে রাস্তায় চলে আসে।কিন্তু ততক্ষণে গাড়ি ভাঙার উৎসব শুরু হয়ে গেছে।কলিম দেখতে পায় বাস থেকে নামা এক মহিলা তার শিশুকে কোলে নিয়ে পাগলের মত ছুটাছুটি করছেন।কলিমের হঠাৎ করে রহিমা এবং তার মেয়েটির কথা মনে হয়ে যায়।সে দৌড়ে গিয়ে বাচ্চাটিকে ইটের আঘাত থেকে বাঁচাতে চায়।কিন্তু ততক্ষণে পরিকল্পনা অনুযায়ী দাঙ্গা পুলিস নেমে গেছে।তারা শ্রমিকদের উদ্দেশ্য করে গুলি চালাতে থাকে।কিছু একটা এসে প্রচণ্ড ধাক্কায় যেন উপড়ে ফেলে কলিমের বেঁচে থাকার আজন্ম স্বাদ।রক্তে ভিজে যাচ্ছে রাজপথ।কলিম চারপাশে তবু একটি শিশুর মুখ খুঁজে ফিরে।কোথায় সে মুখ!কোথায়?
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৪১