সামনে ফাইনাল পরীক্ষা থাকার কারণে অনেকদিন ধরে লেখা হয়না। বিটা থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে অনেক আগে থেকে লেখার ইচ্ছা ছিল। অতি সম্প্রতি একটি কোর্সে বিটা থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে পড়তে গিয়ে লেখার লোভ আর সামলাতে পারলামনা।
থ্যালাসিমিয়া একটি বংশগত রোগ এবং জিন (Gene) বাহিত। পিতা-মাতার মাধ্যমে সন্তানেরা পেয়ে থাকে। থ্যালাসিমিয়া শব্দটির উৎপত্তি গ্রিক শব্দ Thalassa থেকে। যার অর্থ সমুদ্র। ভূমধ্যসাগর সন্নিহিত অঞ্চলে এ রোগটির প্রাদুর্ভাব বেশি । এজন্য একে থ্যালাসিমিয়া বলা হয়। বংশানুক্রমিক ভাবে এ রোগটি বংশধরদের মধ্যে প্রবেশ করে। জিনের (Gene) মাধ্যমে মূলত এ রোগটি পিতা মাতা থেকে সন্তানে প্রবেশ করে। পিতা ও মাতার কাছ থেকে সন্তানরা এই রোগের একটি করে মোট দুইটি রোগ বাহিত জিন গ্রহণ করলে নিজেরা রোগাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। পিতা মাতা আক্রান্ত অথবা বাহক উভয়ই হতে পারেন। বাহক অবস্থায় তাদের রোগের কোনো লক্ষণ থাকে না। তবে তারা তাদের সন্তানদের মধ্যে এই রোগ ছড়িয়ে দিতে পারেন। এটা কোনো ছোঁয়াচ বা সংক্রামক রোগ নয়। এজন্য একজনের কাছ থেকে অন্যজনের কাছে খাবার, পানীয়, বাতাস, কাপড়-চোপড় ইত্যাদির মাধ্যমে ছড়ায় না। থ্যালাসিমিয়া রোগের প্রধান কারণ লোহিত রক্তকণিকার হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিক ভাবে তৈরি না হওয়া। এর ফলে হিমোগ্লোবিনের প্রধান কাজ অক্সিজেন কোষ গুলোতে পৌঁছে দেয়া এবং কার্বনডাই অক্সাইড কোষ থেকে নিয়ে শরীরের বাইরে বের করে দেয়ার কাজ বাধাগ্রস্থ হয়।
হিমোগ্লোবিন একটি টেট্ট্রামার প্রোটিন যার দুটি আলফা শিকল ও দুটি বিটা শিকল রয়েছে। আলফা অথবা বিটা শিকলের জিনে মিউটেশন ঘটার কারণে একটি পূর্নাঙ্গ হিমোগ্লোবিন গঠিত হতে পারেনা। আর ত্রুটিপূর্ন্ গঠনযু্ক্ত হিমোগ্লোবিন অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারেনা।
শরীরে রক্ত উৎপাদন ব্যবস্থা এবং উপকরণ ঠিক থাকার পরও হিমোগ্লোবিনের ত্রুটির জন্য রক্তের কাজ বাধাগ্রস্থ হয়। ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন সহ লোহিত রক্ত কণিকা গুলো তাদের স্বাভাবিক ব্যাপ্তিকাল 120 দিন পূর্ণ হওয়ার পূর্বে্ ধ্বংস হয়ে যায়। যার ফলে রক্তাল্পতা, বিশেষ ভাবে রক্তের লাল কণিকার মাত্রাতিরিক্ত ক্ষয়জনিত কারণে রক্তাল্পতার লক্ষণ (Haemolytic Anaemia) এ রোগে দেখা যায়।থ্যালাসিমিয়া মূলত দুই ভাগে বিভক্ত
১. বিটা থ্যালাসিমিয়া,
২. আলফাথ্যালাসিমিয়া,
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে থ্যালাসিমিয়া বেশি দেখা যায়। বাংলাদেশে বিটা থ্যালাসিমিয়া বেশী দেখা যায় ।বিটা থ্যালাসিমিয়া দুই প্রকার
(১) বিটা থ্যালাসিমিয়া মেজর
(2) বিটা থ্যালাসিমিয়া মাইনর।
তাছাড়াও বিটা জিরো এবং প্লাস নামে দুইধরণের থ্যালাসেমিয়া রয়েছে।
বিটা থ্যালাসিমিয়া মেজর হয়ে থাকে তাদের, যাদের পিতা-মাতা উভয়েই বিটা থ্যালাসিমিয়ার বাহক। ছোটবেলা থেকেই এরা গুরুতর রক্তাল্পতায় ভুগতে থাকে। এ রোগের লক্ষণ সাধারণত তিন মাস বয়স থেকে আঠারো মাস বয়সের মধ্যে দেখা দেয়।রোগী ফ্যাকাশে হয়ে পড়ে। রোগীর ুধামন্দা দেখা দেয়। খাবার পরে বমি করে।ঘুমোতে পারে না। রক্তের হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ৩-৫ গ্রাম/ ডেসিলিটারে নেমে আসে। জন্ডিস দেখা দিতে পারে। লিভার ও প্লীহা বড় হয়ে যায়। চেহারায় মঙ্গোলীয় পরিবর্তন চোখে পড়ে। এরা প্রায়ই জীবাণু সংক্রমণের জন্য সর্দি, কাশি ও জ্বরেভোগে। সংক্ষেপে বলা যায়, রোগী যদি ফ্যাকাশে এবং হলদে হয়ে পড়ে, বয়সের তুলনায় তাকে ছোট দেখায়, নাক চ্যাপ্টা হয় এবং পেট বড় দেখায় তাহলে এ রোগ সন্দেহ করা হয়। যদি চিকিৎসা না করা হয় তবে পাঁচ-ছয় বছরের মাথায় শিশুর জীবনহানির সম্ভাবনা থাকে। এ ধরনের রোগী রক্ত দেয়ার মাধ্যমে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।বিটা থ্যালাসিমিয়া মাইনর আক্রান্ত হয় তারা, যারা পিতা কিংবা মাতা যেকোনো একজনের কাছ থেকে বিটা থ্যালাসিমিয়া জিন পেয়ে থাকে।
বিটা থ্যালাসিমিয়া মাইনর বা বিটা থ্যালাসিমিয়া ট্রেইট গ্রুপের লোকদের বলা হয়, এরা সুস্থ বহনকারী (Healthy Carrier)। তাদের তেমন কোনো রোগ লক্ষণ দেখা যায় না। তাদের দৈনন্দিন কাজকর্মে কোনো অসুবিধা হয় না। তারা স্বাভাবিক জীবনযাপন করে। তবে তারা সামান্য রক্তাল্পতায় ভুগতে পারেন। তাদের মানসিক বৃদ্ধি স্বাভাবিক এবং ঠিকসময়ে প্রাপ্তবয়স্ক হন। তারা স্বাভাবিক বিবাহিত জীবনযাপন করতে পারেন। তারা সন্তান উৎপাদন বা ধারণে সক্ষম। তবে তাদের সন্তানদের এ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ৫০ শতাংশ। থ্যালাসিমিয়া মাইনর যারা তারা শুধু বাহক।
থ্যালাসিমিয়াজীনের বাহক বা বাহিকা যদি এমন একজনকে বিয়ে করেন যিনি ওই জীনের বাহক বাবাহিকা নন, তাহলে তাদের মিলনে জন্ম নেয়া সন্তান সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে জন্মনিতে পারে ৫০ শতাংশ।বর্তমান চিকিৎসা ব্যবস্থায় এ রোগের সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব নয়। থ্যালাসিমিয়া আক্রান্ত রোগীদের নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করা প্রয়োজন। আর যে সব রোগী রক্তসঞ্চালনের ওপর নির্ভরশীল তাদের রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ৯-১০.৫গ্রাম/ডেসিলিটারের ওপর রাখতে হবে। যে সব রোগী মাঝে মধ্যে রক্ত নেয়ার দরকার হয় তাদের রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ সাধারণত ৭ গ্রাম/ডেসিলিটার রাখার চেষ্টা করতে হবে। এসব রোগীর চিকিৎসায় অস্থি-মজ্জা সংযোজনে (Bone Marrow Transplantation) ভালো ফল পাওয়া যায়।
বাংলাদেশে সম্প্রতি অস্থি-মজ্জাসংযোজন শুরু হয়েছে।খাবারের ক্ষেত্রে যে সব খাবারে অধিক পরিমাণ লৌহ থাকে, সেই সব খাবার পরিহার করাটা উত্তম। কম লৌহযুক্ত খাবারে মাছের তালিকায় রুই, কাতলা, পাঙ্গাশ, বোয়াল, মাগুর, শোল মাছমহ বিভিন্ন দেশি প্রজাতির মাছ রয়েছে ।বিভিন্ন প্রকার শাকসবজির মধ্যে পাকা টমেটো, বাঁধাকপি, মিষ্টি কুমড়া, মিষ্টি আলু, ঢেঁড়স করলা, , মুলা শালগম, কাঁচাকলা, লাউ, ইত্যাদি। ফলের মধ্যে পাকা আম, লিচু, পেয়ারা, কলা, পাকা পেঁপে, কমলা লেবু, আপেল, বেল, আমলকি, আঙ্গুর ইত্যাদি। মধু, দুধ, দই ইত্যাদিও নিয়মিত খাওয়া যাবে। চাল, ময়দা, পাউরুটি এ্বং মসুর ডালও খাবারের তালিকায় রাখা যাবে।থ্যালাসিমিয়া প্রতিরোধে বিয়ে-পূর্ব রক্ত পরীক্ষা জরুরি। প্রি-নেটালডায়াগনোসিসের মাধ্যমেও আগেই রোগ চিহ্নিত করা যায়। যারা বাহক হবে তারা কখনোই এমন একজনকে বিয়ে করবেন না যিনিও বাহক। এর ফলে থ্যালাসিমিয়া আক্রান্ত শিশুর জন্ম প্রতিরোধ করা সম্ভব।