১৯৭৬ সালে বিশেষ সামরিক আদালতে কর্নেল আবু তাহের তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের জবাবে যে জবানবন্দি দিয়েছিলেন, তাতে ৭ নভেম্বরের পূর্বাপর ঘটনা এবং রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের বিবরণ রয়েছে। গুরুত্ব বিবেচনা করে জবানবন্দিটির একটি অংশের সংক্ষিপ্ত পুনর্মুদ্রণ।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর খোন্দকার মোশতাক আহমদের যে সরকার ক্ষমতা নেয়, তার কোনো রাজনৈতিক ভিত্তি ছিল না। সেনাবাহিনীর ছোট একটা অংশ ছাড়া মোশতাকের প্রতি অধিকাংশ সেনা কর্মকর্তারই সমর্থন ছিল না। সাধারণ জনসমর্থন তো ছিলই না। পরিবর্তন বলতে যা হয়েছে তা হলো, আগে ইন্দো-সোভিয়েত শক্তির আধিপত্য মেনে দেশ চলত; শেখ মুজিব নিহত হওয়ার পর সেখানে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলো। মোশতাক সরকারের দুর্বলতা ও ব্যর্থতার সুযোগ নিয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ একটি নতুন চক্রান্তে নেতৃত্ব দেন। তিনি ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থানের (কাউন্টার-রেভল্যুশনারি ক্যু) মাধ্যমে ক্ষমতা নিয়ে নেন।
ওই দিন নারায়ণগঞ্জে আমি আমার বাড়িতে অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী ছিলাম। অসুস্থ অবস্থায় ভোর চারটার দিকে একটি ফোন রিসিভ করলাম। ফোনটি করেছিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। তিনি আমার সাহায্য চাইছিলেন। আলাপ শেষ হওয়ার আগেই লাইনটা কেটে গেল। ওই দিন বহু সেনাসদস্য, এনসিও এবং জেসিও আমার নারায়ণগঞ্জের বাড়িতে এলেন। তাঁরা আমাকে জানালেন, ভারত খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানে মদদ জুগিয়েছে এবং সেই বাকশালের সমর্থকেরা আবার ক্ষমতা দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে। তাঁরা বললেন, বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং মূল সেনাবাহিনীর মধ্যে তুমুল উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। যেকোনো সময় গোলাগুলি শুরু হয়ে যেতে পারে।
আমি দ্রুত সেনাসদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের শান্ত থাকতে বললাম। একই সঙ্গে চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের খোঁজখবর রাখার এবং নিজেদের মধ্যে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখার পরামর্শ দিলাম। আমি তাদের সবাইকে দেশের সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রাখার জন্য তৈরি থাকতে বললাম। তাদের বোঝালাম, কিছু উচ্চাকাঙ্ক্ষী কর্মকর্তা স্রেফ ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সাধারণ সৈনিকদের ব্যবহার করতে চাইছে। আমি সাধারণ সৈনিকদের ব্যারাকে ফিরে যেতে বললাম। যে যতই উসকানিমূলক কথা বলুক, তা কানে নিয়ে নিজেদের মধ্যে তারা যেন গোলাগুলি না করে, সেই অনুরোধ জানালাম। পাশাপাশি জনগণের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে যেকোনো সময় ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তৈরি থাকতেও তাদের পরামর্শ দিলাম।
৩ নভেম্বরের পর জাতি কী ভয়ংকর ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তা কারোই অজানা নয়। আমাদের জাতীয় সম্মান ও সার্বভৌমত্ব কীভাবে ভূলুণ্ঠিত হচ্ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ সময় জনগণের কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে ভারত খালেদ মোশাররফকে পেছন থেকে মদদ দিচ্ছিল।
দেশ যখন সার্বভৌমত্ব-সংকটে টালমাটাল, রিয়ার অ্যাডমিরাল এম এইচ খান এবং এয়ার ভাইস মার্শাল এম জি তোয়াব সেই মুহূর্তে খালেদ মোশাররফকে মেজর জেনারেলের পদবিচিহ্নিত ব্যাজ পরিয়ে দিচ্ছেন—এমন দুর্ভাগ্যজনক দৃশ্য জাতিকে দেখতে হলো। এসব নিচু মানসিকতার লোকজনের প্রতি আমার করুণা হয়। ওদিকে জিয়াউর রহমান? খালেদের কাছে বন্দী হয়ে তিনি তখন ঠক ঠক করে কাঁপছেন। তোয়াব এবং খান দুজনই তখন নতুন প্রভুর পদলেহনে ব্যস্ত।
৪ নভেম্বর বিকেলে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান তাঁর এক আত্মীয়ের মাধ্যমে আমার কাছে খবর পাঠালেন। জিয়ার অনুরোধ ছিল, আমি যেন সেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে আমার প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে তাঁকে মুক্ত করি ও দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করি। আমি তাঁকে শান্ত থাকতে ও মনে সাহস রাখতে বলেছিলাম। আমি তাঁকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হবে এবং সব ধরনের অপকর্মের অবসান ঘটানো হবে। এদিকে সেনাবাহিনীর সজাগ অফিসার ও সৈন্যরা আমাকে বিশ্বাসঘাতক খালেদ মোশাররফ চক্রকে উৎখাত করার জন্য প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা নিতে অনুরোধ করে আসছিল। এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি তাগিদ এসেছিল সিপাহিদের, বিশেষ করে এনসিও এবং আরজেসিদের কাছ থেকে।
সৈন্যদের মধ্যে ব্যাপক যোগাযোগ, আলোচনা ও মতবিনিময়ের পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের পরিকল্পনা প্রস্তুত করা হয়। ৬ নভেম্বর আমি সৈনিকদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে রাখলাম। ঢাকা সেনানিবাসের সব ইউনিট প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সবাইকে সজাগ থাকতে ও পরবর্তী নির্দেশের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলে দেওয়া হলো। ৬ নভেম্বর সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে সতর্ক করে দেওয়া হয়। ৭ নভেম্বর ভোররাত একটায় সিপাহি অভ্যুত্থান শুরু হবে বলে ঠিক হয়। আমাদের সিদ্ধান্তগুলো ছিল: ১. খালেদ মোশাররফ চক্রকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা, ২. বন্দিদশা থেকে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা, ৩. একটা বিপ্লবী সামরিক কমান্ড কাউন্সিল গঠন করা, ৪. দল-মতনির্বিশেষে সব রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তি দান, ৫. রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহার, ৬. বাকশালকে বাদ দিয়ে একটা সর্বদলীয় গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠন করা, ৭. বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ১২ দফা দাবি মেনে নেওয়া ও তার বাস্তবায়ন করা।
সবকিছুই পরিকল্পনামাফিক হয়। বেতার, টিভি, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ, পোস্ট অফিস, বিমানবন্দর ও অন্যান্য সব গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র প্রথম আঘাতেই দখল করা হয়। ভোররাতে জিয়াকে মুক্ত করে দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার বড় ভাই ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ খানের সঙ্গে আমি ভোর তিনটার দিকে সেনানিবাসে যাই। সঙ্গে ছিল ট্রাকভর্তি সেনাদল।
জিয়াকে আমি তাঁর নৈশ পোশাকে পেলাম। সেখানে ব্রিগেডিয়ার মীর শওকতসহ আরও কয়েকজন অফিসার ও সৈনিক ছিল। জিয়া আমাকে আর আমার ভাইকে গভীরভাবে আলিঙ্গন করলেন। জলভরা চোখে তিনি আমাদের তাঁর জীবন বাঁচানোর জন্য কৃতজ্ঞতা জানালেন। তাঁর জীবন রক্ষার জন্য জাসদ যা করেছে, তার জন্য জিয়া আমার প্রতি ও জাসদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বললেন, আমরা যা বলব, তিনি তা-ই করবেন। আমরা তখন পরবর্তী করণীয় নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনা করি। তখন ভোর চারটা। আমরা একসঙ্গে বেতার ভবনে পৌঁছাই। পথে আমরা তাৎক্ষণিক কর্মপদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করি।
এর মধ্যে বেতার থেকে সিপাহি অভ্যুত্থানের ঘোষণা করা হয়। জিয়াকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘোষণা দেওয়া হয়। বেতার ভবনে যাওয়ার পথে জিয়া শহীদ মিনারে একটা জনসমাবেশে ভাষণ দিতে রাজি হয়েছিলেন। তাই কথামতো আমি শহীদ মিনারে সমবেত হতে সিপাহিদের নির্দেশ দিয়েছিলাম। ঠিক হয়, সেখানে আমি ও জিয়া সমাবেশে ভাষণ দেব। তাহলে অফিসারদের ছাড়াই যে বিপ্লবী সৈনিকেরা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেছে, সেই সৈনিকদের কাছে দেওয়া অঙ্গীকার থেকে কেউ পিছু হঠতে পারবে না।
উৎফুল্ল মনে সৈনিকেরা শহরের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। একসঙ্গে এদের জড়ো করতে কিছুটা সময় দরকার। এ কারণে শহীদ মিনারে সমাবেশের সময় সকাল ১০টায় ঠিক করি। হাজারো মানুষ খুশিমনে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল, তারা বিপ্লবী সৈনিকদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে স্লোগান তুলেছিল।
সকাল সাড়ে আটটায় সৈনিকেরা আমাকে জানাল যে খন্দকার মোশতাক আহমদ বেতার ভবনে ঢুকে ভাষণ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমি তখন বেতারকেন্দ্রে গেলাম। মোশতাককে আমি খুব স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলাম যে চক্রান্তের রাজনীতির দিন শেষ; তাঁকে এখনই বেতারকেন্দ্র ছেড়ে যেতে হবে। তিনি আমার কথামতো চলে গেলেন। এরপর আমি সমাবেশে ভাষণ দেওয়ার জন্য জিয়াকে আনতে সেনানিবাসে গেলাম। সেখানে পৌঁছে দেখি, পরিস্থিতি বদলে গেছে। জিয়া দাড়ি কামিয়ে সামরিক পোশাকে সুসজ্জিত হয়েছেন। তাঁকে দেখে মনে হলো, তিনি বন্দিদশার ধকল কাটিয়ে উঠেছেন। শহীদ মিনারে যাওয়ার কথা তুললে জিয়া সেখানে যেতে অস্বীকৃতি জানালেন।
বিনয়ের সঙ্গে জিয়া যুক্তি দেখালেন যে তিনি একজন সৈনিক, তাঁর গণজমায়েতে বক্তৃতা দেওয়া সাজে না। তিনি আমাকে শহীদ মিনারে গিয়ে সেনাদের উদ্দেশে বক্তৃতা দিতে বললেন। এ কথা শুনে আমি সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরে আসার জন্য শহীদ মিনারে নির্দেশ পাঠালাম।
১১টার দিকে আমরা সেনা সদর দপ্তরে একটা আলোচনায় বসি। একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ব্যাপারে আমরা নীতিগতভাবে একমত হই। সেই আলোচনায় উপস্থিত ছিলাম আমি, জিয়া, তাওয়াব, এম এইচ খান, খলিলুর রহমান, ওসমানী ও মুখ্য সচিব মাহবুব আলম চাষী। সরকারের ধারাবাহিকতার প্রশ্নে একটা আইনগত সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। সবাই চাচ্ছিলেন, বিচারপতি সায়েম দেশের রাষ্ট্রপতি হবেন (সায়েমকে খালেদ মোশাররফ ৫ নভেম্বর নিয়োগ করেছিলেন)। আমি তা মেনে নিলাম কিন্তু আমি চাচ্ছিলাম, জিয়া হবেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। তবে জিয়া তাতে আপত্তি জানালেন। পরে ঠিক হলো, জিয়া, তাওয়াব আর এম এইচ খান প্রত্যেকেই উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হবেন। এঁদের ওপর কোনো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বভার ন্যস্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। ঠিক হলো, বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে তিন উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসককে নিয়ে একটা উপদেষ্টা কাউন্সিল গঠন করবেন। সেদিনের আলোচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তা হচ্ছে, সব রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হবে; রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনার পর রাজনৈতিক কার্যকলাপ চালু করতে দেওয়া হবে এবং মোশতাক সরকার ঘোষিত সাধারণ নির্বাচনের নির্ধারিত সময়ের আগেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সায়েম শুধু এক অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চালাবেন। আমি এই সভাকে ৭ নভেম্বরের বিপ্লবকে স্বীকৃতি দিতে বললাম।
বিকেলের দিকে আমি বেতারকেন্দ্রে যাই। বিপ্লবী সৈন্যরা জিয়াউর রহমানের কাছে ১২ দফা দাবি পেশের সিদ্ধান্ত নেয়। তারা চাচ্ছিল, তাদের দাবি পেশ করার সময় আমি সেখানে উপস্থিত থাকি। বেতারকেন্দ্র থেকে আমি জিয়াউর রহমানকে টেলিফোন করি এবং সৈন্যদের প্রস্তাবের কথা তাঁকে জানাই। তখন সৈন্যরা প্রচণ্ডভাবে উত্তেজিত। বেতারকেন্দ্রের ভেতর তারা কাউকে ঢুকতে দিচ্ছিল না। পৌনে আটটার দিকে জিয়ার সঙ্গে মোশতাক ও সায়েমকে বেতারকেন্দ্রে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। বিপ্লবী সৈন্যদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পেশ করা ১২ দফা দাবির দলিলে জিয়ার সম্মতিসূচক স্বাক্ষরের পরই তাঁদের বেতারকেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হয়।
খন্দকার মোশতাক ও বিচারপতি সায়েম জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। আমি আর জিয়া তখন বেতার ভবনের টেলিভিশনকক্ষে একসঙ্গে বসে ভাষণ শুনছি। সায়েম তাঁর ভাষণে আমাদের আলোচনায় নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরলেন। এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতেই পরদিন ৮ নভেম্বর মেজর জলিল ও আ স ম আবদুর রবকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। সেদিন আমি জেনারেল জিয়াকে টেলিফোন করে এর জন্য ধন্যবাদ জানাই আর মতিন, অহিদুরসহ অন্য বন্দীকেও সেই সঙ্গে মুক্তি দিতে অনুরোধ করি।
৮ তারিখ সন্ধ্যায় জিয়া আমাকে জানালেন, কয়েকটা ঘটনায় কিছু অফিসার মারা গেছেন। আমি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সম্ভাব্য সব ধরনের সাহায্য করার প্রস্তাব দিই।
আমি তখনই সেনানিবাসে আসার প্রস্তাব করি। জিয়াকে জানাই যে বিপ্লবী সৈন্যদের ওপর আমার কড়া নির্দেশ ছিল, যাতে কোনো অফিসারের ওপর এভাবে আক্রমণ করা না হয়। ১১ তারিখ পর্যন্ত জিয়া আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করেন। কিন্তু ১২ তারিখের পর তাঁকে আর পাওয়া যাচ্ছিল না। সব যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। আমি যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেই জিয়া আমাকে এড়িয়ে যেতে থাকেন।
২৩ নভেম্বর পুলিশের একটা বড় দল আমার বড় ভাই ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ খানের বাড়ি ঘেরাও করে এবং তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ নিয়ন্ত্রণকক্ষে নিয়ে যায়। এ ঘটনা শুনে আমি জিয়াকে ফোন করি। অন্য প্রান্ত থেকে আমাকে জানানো হয়, জিয়াকে পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁর পরিবর্তে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান মেজর জেনারেল এরশাদ আমার সঙ্গে কথা বলবেন। এরশাদ আমার কথা শুনে বলেন, আমার ভাইয়ের গ্রেপ্তারের ব্যাপারে সেনাবাহিনী কিছুই জানে না। ওটা হচ্ছে একটা সাধারণ পুলিশি তৎপরতা। আমি তখনো জানতাম না, আমার ভাইকে যখন পুলিশ গ্রেপ্তার করে, তখন একই সময়ে মেজর জলিল, আ স ম আবদুর রবসহ অন্য অনেক জাসদের নেতা-কর্মীকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এসব জানার পর আমার বুঝতে আর অসুবিধা হলো না, যাদের আমরা ৭ নভেম্বর ক্ষমতায় বসিয়েছিলাম, তারা আবার এক নতুন ষড়যন্ত্রের খেলায় মেতেছে।
২৪ নভেম্বর এক বিরাট পুলিশ বাহিনী আমাকে ঘিরে ফেলে। কর্তব্যরত পুলিশ অফিসার আমাকে জানালেন, জিয়ার সঙ্গে কথা বলার জন্য তাঁদের সঙ্গে যাওয়া দরকার। আমি অবাক হয়ে বললাম, জিয়ার কাছে যাওয়ার জন্য এত পুলিশ প্রহরার কী দরকার? এরা আমাকে একটা জিপে তুলে সোজা এই জেলে নিয়ে আসে। এভাবেই যাদের প্রাণ বাঁচিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছিলাম, সেই সব বিশ্বাসঘাতকের দল আমাকে জেলে অন্তরীণ করল।
জিয়া শুধু আমার সঙ্গেই নয়, বিপ্লবী সেনাদের সঙ্গে, ৭ নভেম্বরের অঙ্গীকারের সঙ্গে, এক কথায় গোটা জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আমাদের পেছন থেকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। খালেদ মোশাররফের সঙ্গে তুলনায় জিয়া মুদ্রার অন্য পিঠ বলেই প্রমাণিত হয়েছে।
আমাদের জাতির ইতিহাসে আর একটাই এ রকম বিশ্বাসঘাতকতার নজির রয়েছে, তা হচ্ছে মীর জাফরের বেঈমানি। বাঙালি জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে সে গোটা উপমহাদেশকে ২০০ বছরের গোলামির পথে ঠেলে দিয়েছিল। ভাগ্য ভালো যে এটা ১৭৫৭ সাল নয়। ১৯৭৬। আমাদের আছে বিপ্লবী সিপাহি জনতা। তারা জিয়াউর রহমানের মতো বিশ্বাসঘাতকদের চক্রান্তকে নির্মূল করবে।
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক! আমার দেশ দীর্ঘজীবী হোক!
তথ্য সুএ: Click This Link