গত বেশ কিছুদিন ধরেই নিশাতের মাঝে চাঁপা উত্তেজনা কাজ করছে। তার বাসার সবার ভেতরেই কি এমন কিছু হচ্ছে?
আনন্দ যেমন সংক্রামিত হয় উত্তেজনাও কি তেমনি কিছু?
নিজেকে করা প্রশ্নের উত্তর বের করার আগেই মা ডাক দিলেন ভেতর থেকে।
- কি করছিস মা, আয় কিছু একটা মুখে দে। অন্যের
বাড়ি চলে যাবি কিছুদিন পর,
কি না কি খাওয়া দাওয়া করবি।
- কিছু খাবো না মা, খিদে নেই।
- একটা কিছু মুখে দে।
- না মা, একটু শোবো। উঠে খাবো।
নিজের ঘরে ফিরে কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। আজ বাদে কাল তার বিয়ে, সব কিছুই ভীষন সুন্দরভাবে আয়োজন করা হয়েছে, তবু যেন কি একটা নেই। কিসের যেন অভাব।
বিকেল বেলা নিশাতের সবচেয়ে কাছের বন্ধু জুঁই এলো। জুঁইকে দেখে উঠে বসতে বসতে বলল,
- কিরে, তুই এই অবেলায়?
- ভালো লাগছিল না বাসায়, তাই চলে এলাম।
- তোর এই হাল কেন? বার্ড ফ্লু মুরগির
মতো লাগছে কেন
তোকে? মন খারাপ?
- না রে, এমনি শরীরটা ভালো লাগছে না।
- বিয়ের আগেই এই অবস্থা, পরে কি করবি?
- চুপ কর ফাজিল।
জুঁই আসলেই চুপ মেরে গেল। তারপর নিশাতের দিকে একটি প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল,
-রোহান ভাই পাঠিয়েছে এটা।
আমেরিকা থেকে আজ সকালেই আমাদের বাসার ঠিকানায় আসলো।
চুপচাপ প্যাকেটটি খুলল নিশাত , হ্যা যা ভেবেছিল তাই।
বছর দু'য়েক আগের কথা,
টিএসসিতে বসে আছে মোটা ফ্রেমের চশমা পরা এক যুবক।
এলোমেলো করে ফেলে রাখা মাথার চুল আর গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি মূহুর্তেই তাকে সবার কাছ থেকে আলাদা করে। একমনে বসে মোবাইল টিপছে আর সিগারেট টানছে।
- ভাইয়া, আপনার কাছে ১০০ টাকার ভাংতি হবে?
মেয়েটির ডাকে মাথা তুলে তাকালো সে।
উঠে মানিব্যাগ থেকে ভাংতি দিয়ে আবার নিজের কাজে মন
দিলো।
- অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আমার নাম নিশাত,
ইকোনমিকস ফাইনাল ইয়ার, আপনি।
- আমি রোহান।
- কি করেন ভাইয়া? আপনি কি স্টুডেন্ট? নাকি জব করেন?
কারো জন্য ওয়েট করছেন?
একসাথে এতো গুলো প্রশ্ন শুনে রোহানের মেজাজ সপ্তম আসমানে উঠার আগেই সে নিজেকে সামলে নিয়ে সবগুলোর
প্রশ্নের উত্তর দিলো।
কেন যেন মেয়েটিরউপর রাগ করতে পারলো না, হেসে দিলো তার কথা বার্তা শুনে। আর এভাবেই একজন ডাক্তারের
সাথে কখন যে কথার ভাঁজে ভাঁজে নিশাত নিজের সমস্ত সত্তা জড়িয়ে ফেলবে, এক নতুন গল্পের শুরু হবে দুজনের কেউ সেদিন জানতো না।
আজিজ সুপারের দোতালায় দাঁড়িয়ে রোহান বলছে,
- আচ্চা, তোমার কি মুখ ব্যাথা করে না?
এতো কথা তুমি বল কিভাবে? একটি মানুষ কিভাবে সারাদিন এতো বকবক করতে পারে।
- হ্যা এখন তো আমাকে ভালো লাগবেই না, চারপাশে কতো সুন্দরী ডাক্তার। আমার সব কিছুইতো এখন তোমার কাছে বিষ।
- কি বলছো এসব, কিসের ভেতর কি টেনে আনছো!!! আচ্ছা বাদ
দাও এসব, চলেন কোথাও গিয়ে একটু খাওয়া দাওয়া করি।
খুব খিদে পেয়েছে।
-ওকে, চলো।
জুঁই নিরবতা ভাংলো,
- নিশাত, একটা কথা বলবি?
- হুম
- রোহান ভাইয়ের সাথে তুই অমন করতি কেন সবসময়?
মানুষটা তোর জন্য এতো কিছু করলো আর তুই কিনা তাকে এভাবে কস্ট দিলি, কেন?
- তুই বুঝবি না, কেউ বোঝেনি।
- তারপরও তুই বল।
- জানিশ জুঁই, সেদিন আমি ইচ্ছে করে অমন করি নি,
ওর সাথে অন্য কোন মেয়ে আমি কেন যেন সহ্য করতে পারতাম
না।
- কিন্তু তাই বলে তুই, ভাইয়ার হসপিটালে গিয়ে সিনক্রিয়েট করবি!!!
- আমার ভুল হয়ে গিয়েছিল রে জুঁই।
আমি ওকে হাজার বার বুঝাতে চেয়েছি। কিন্তু রোহান ওর জেদ
থেকে সরে আসে নি।
নিজের জায়গায় ও ঠিকই ছিলো। আমার সামনে যাতে আর
না পরতে হয়, তাই সবাইকে একা ফেলে চলে যায় আমেরিকা।
- তুই যোগাযোগ করিসনি আর?
- অনেক ট্রাই করেছি, সে কোন এনসার দেয় নি।
আমাকে প্রায় বলতো,
নিশাত আমাকে রাগিয়ো না কোনদিন,
আমি চাই না যাকে এতো বেশি ভালোবেসেছি
সে আমার ভয়ংকর রূপটি দেখুক। আজ আমি বুঝি ওর কথা। আজ বুঝি।
মেহেদী রাঙা হাতে বেহালাটি নিয়ে নিশ্চুপ অশ্রুপাত করছে এক তরুণী।পাশে রাখা ছেঁড়া প্যাকেট এর উপর পরে থাকা চিঠি উড়ে গেল দখিনা বাতাসে।
কেন যেন নিশাতের কানে ভেসে আসছে বেহালার করুণ
সুরে রোহানের সেই প্রিয় কবিতা ....
" তোমারো কি কিছু কথা ছিলো কিছু নীল ব্যর্থতা
কিছু বিনষ্ট ফসলের ক্ষেত
আজীবন নির্বাক অপেক্ষার সাহস
তোমারো কি কিছু কথা ছিলো কিছু লালিত বেদনা
কিছু বিপরীত নদীতে ফেলে আসা নিজস্ব প্রতিকৃতি
আমার কিছু কথা ছিলো কিছু দুঃখ ছিলো
আমার কিছু তুমি ছিলো তোমার কাছে ! "