somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

থিসিস ডে

১৪ ই জুন, ২০১৫ রাত ৮:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নিগার ঘুম ভাঙ্গলো সকাল দশটা চল্লিশে। চোখ কচলে মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েই মেরুদণ্ডে বয়ে যাওয়া শীতল স্রোতটা অনুভব করলো সে। অ্যালার্মের স্নুজ অপশনটাকে গালি দিতে দিতে যথাশীঘ্র কিছু অজুহাত খুঁজতে থাকলো। আজ সোমবার; থিসিস ডে। থিসিস সুপারভাইজারকে ঠিক সকাল দশটায় ফোন করে শিডিউল নেয়ার দায়িত্ব ছিল তার উপর। আজকের গ্রুপ-রিপোর্টটাও তারই করার কথা ছিল।


কিছুটা সাহস জুগিয়ে মোবাইলটা আবার হাতে তুলে নিলো সে। স্যার সকাল এগারোটায় সাক্ষাতের সময় দিয়ে ফোন রাখলেন। ক্ষিপ্রতার সাথে ল্যাপটপের ডালা খুললো নিগা। হাতে সময় আছে মিনিট পনেরো। এর মাঝে নেট থেকে অন-টপিক কোন পেপার ডাউনলোড করে তার কভার পেইজ চেঞ্জ করে নিজেদের নাম বসাতে হবে। এরপর সদ্যপ্রসূত পেপারখানা প্রিন্ট করিয়ে ছুটতে হবে কাজী নজরুল ইসলাম হল থেকে যোজন যোজন দূরের নিউ অ্যাকাডেমিক বিল্ডিঙে। নিগার পরবর্তী পনেরো মিনিট যেনো উড়াল দিয়ে চলে গেলো!


স্যারের রুমের বাইরে দেখা মিললো নিগার বাকি তিন থিসিস পার্টনারের। একই গ্রুপে নিগা, ফরাশ, সার্কিট এবং কানাই! এমন আত্মঘাতী থিসিস গ্রুপ আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর!


যেমন ফরাশের কথাই ধরা যাক। মানুষ হিসেবে সে নিপাট ভদ্রলোক। শুদ্ধ চলিত ভাষা ছাড়া কথাই বলে না! বন্ধুদের ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করে। শার্টটা প্যান্টে গুঁজে নিলেই মনে হবে বুঝি কোনো সাক্ষাৎকার দিতে এসেছে। স্বভাবতই ধরে নেয়া হয়েছিল সে’ই হবে গ্রুপের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি। ভুল, সবই ভুল! ফরাশের সকল অধ্যবসায় কেবল একটি জিনিসকে ঘিরেই - যেকোনো মূল্যে দুপুরের বাস ধরতে হবে। বুয়েট বাসের এমন অনুগত ভোক্তা আর দেখা যায়নি কখনও। তবে এরপরও সে গ্রুপের মধ্যমণি। স্যারের সাথে কথোপকথনের দায়িত্বটা বরাবরই সে পালন করে আসছে।


এদিকে নিগার জীবনের গত চারবছর কেটেছে ল্যাপটপের চৌদ্দ ইঞ্চি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে। কখনও মুভি, কখনও টিভির মেগা সিরিজ আবার কখনও বা কেবল ডেস্কটপ ব্যাকগ্রাউন্ড। তার আলসেমী কিংবদন্তীতুল্য! যেকোনো প্রকার কায়িক শ্রম থেকে সে সদা তফাতে থাকে। পড়তে “বসা”- ব্যপারটায় তার এতই প্রবল অ্যালার্জী যে, রুমে বসার জন্য কোন চেয়ার পর্যন্ত রাখেনি সে। তবে মাঝে মাঝে নিগার মধ্যেও থিসিস করে জগতোদ্ধারের বাসনা জাগে। তখন সে অনলাইনে বাকি পার্টনারদের উদ্দেশ্যে কিছু উৎসাহব্যঞ্জক বাণী ঝেড়ে দিয়ে আবারো পিঠটা এলিয়ে দেয় বিছানায়।


অন্যদিকে সার্কিট ফাঁকিবাজিকে শিল্পের একটি শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। থিসিস ডে সোমবার। অতএব বেছে বেছে প্রতি রোববার রাতে সার্কিট কোন না কোন দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। একজন মুমূর্ষু রোগীকে আর যাই হোক, অন্তত রিপোর্ট প্রস্তুত করতে বলা যায়না। এই মৌসুমী রোগ নিয়ে নিগার সাথে প্রায়ই সার্কিটের তুমুল বাগবিতণ্ডা হয়... এবং প্রতিবারই তাদের কথার মোড় ঘুরে ফিরে বর্ণবাদের পর্যায়ে চলে যায়। তবে তাই বলে সার্কিটকে পাষণ্ড ভাবা খুবই অনুচিত হবে। কোন কোন শুভলগ্নে সে তার থিসিস পার্টনারদের প্রতি কিছুটা দয়াপরবশ হয়। সেদিন কেউ তাকে রিপোর্ট প্রস্তুত করে, ডক ফাইল থেকে পিডিএফ এ কনভার্ট করে দিলে সে তীব্র অনিচ্ছায় সেটা প্রিন্ট করার দায়িত্ব পালন করে।


আর সবশেষে রয়েছে কানাই। যেকোনো দুনিয়াবী মায়ার ঊর্ধ্বে সে। উদাসী দৃষ্টি নিয়ে হেলেদুলে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় তাকে। শার্টের খোলা দুটো বোতামের ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয় তুলসীর মালা । এই নশ্বর পৃথিবীর কোন কিছুই তাকে স্পর্শ করে না। মাঝে-সাঝে ক্লাসে তার দেখা মিলে... শেষ বেঞ্চিতে কোন উচ্চমার্গীয় উপন্যাস হাতে...


আদর্শ পৃথিবীতে এই চারজনের কখনো একে অপরের ছায়াও মাড়ানোর কথা না। কিন্তু সিজিপিএ’র নির্মম পরিহাস আজ তাদের এক সুঁতোয় গেঁথেছে। তবে এ কথা মানতেই হবে, ওদের ‘থিসিস সুপারভাইজার’ ভাগ্য দারুণ ভালো! যদিও স্যারের ঝাড়ি কোন পূর্বাভাস দিয়ে আসে না, তবু দিনশেষে উনিই এই নিম্ন-মধ্যবিত্ত সিজিপিএ ধারীদের ভরসা। থিসিসে ভালো নম্বর তো দেনই... উপরন্তু থিসিস স্টুডেন্টদের জন্য ভালো চাকরির ব্যবস্থা করে দেন বলে উনার দারুণ সুনাম। এজন্য শর্ত শুধু একটাই- স্যারের সুনজরে থাকতে হবে, বেয়াদবী করা চলবে না! সেজন্যেই তো উনাকে সুপারভাইজার হিসেবে পেয়ে নিগা ঘোষণা দিয়েছিল, “দরকার হলে পা চাটতে চাটতে টেস্টবাড সব খসিয়ে ফেলবো, তবু চাকরী না নিয়ে ঘরে ফিরছি না”।


দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর অবশেষে স্যারের রুমে ঢুকার অনুমতি পেল ওরা। নিগা তার পোলো শার্টের একদম উপরের বোতামটিও আটকে নিলো। সবাই মৃদুতালে মার্চ করে রুমের ভেতরে ঢুকে যার যার চেয়ারের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। স্যারের ইশারা পেয়ে নিজ নিজ চেয়ারে বসে পড়লো। নিগা বিনয়ের সাথে রিপোর্টটা এগিয়ে দিলো।


রিপোর্ট হাতে নিয়েই স্যার সেই পুরোনো প্রশ্নটাই করলেন, “বলো, এই সপ্তাহে কি করে এসেছো...”। সঙ্গে সঙ্গে একেকজনের চোখ রুমের একেক কোনায় চলে গেলো। নিগা চোখেমুখে তীব্র অপরাধবোধ ফুটিয়ে তুলে একাগ্র চিত্তে মেঝে জরিপ করতে থাকে। আড়চোখে দেখতে পায় ফরাশ হাল ছেড়ে দিয়ে মুচকি হাসছে। এই মুহূর্তে কোনোভাবেই ফরাশের সাথে চোখাচোখি হওয়া যাবে না- তাহলেই হাসি আটকে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে। অন্যদিকে সার্কিট একটা সাদা খাতা কোলের উপর নিয়ে সমানে কলম ঘষে চলেছে...... ভাব দেখে মনে হচ্ছে স্যারের ছুঁড়ে দেয়া প্রশ্নটাই সে নোট করছে! আর কানাইয়ের মনোযোগ যথারীতি এই কক্ষের গণ্ডি পেরিয়েছে বহু আগেই।


স্যার নানা সুরে একই প্রশ্ন কয়েকবার করে শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়ে নিজেই শব্দ করে রিপোর্টখানা পড়া আরম্ভ করলেন। যার সুবাদে ওরা নিজেরাও এই রিপোর্টে আদতেই কি আছে তা প্রথমবারের মত জানতে পারলো। নিগা অবশেষে চোখ তুলে তাকালো- বেশ কিছুক্ষণের জন্য এখন ওরা নিরাপদ। স্যার রিপোর্টের নানা ভুল-ভাল ধরিয়ে দিতে থাকেন। সবাই একতালে মাথা দুলায়। সার্কিট অতি উৎসাহী হয়ে “আহা, ইশশ্‌!” টাইপ শব্দ প্রয়োগ করে বুঝিয়ে দেয়, এ সবই অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল। কিভাবে যে সবার চোখ এড়িয়ে গেল!


স্যার যখন রিপোর্টের রেফারেন্স অংশে পৌঁছান তখনই সবার মাঝে অস্থিরতা বাড়তে থাকে। এই সময়টাই সবচেয়ে ক্রুশ্যাল! সম্ভ্রম নিয়ে ফিরতে হলে যেকোনো পদ্ধতিতে এখুনি রুম থেকে বের হতে হবে। স্যার একসময় তীব্র হতাশা নিয়ে রিপোর্ট থেকে চোখ তুলেন। সবাই পুনরায় চেহারায় বিষাদ আনতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ঠিক এই মুহূর্তে ত্রানকর্তা রূপে আবির্ভূত হয় ফরাশ। তরল সুরে বলে উঠে, “স্যার এই রিপোর্টে যে মেথডটা বলা হয়েছে তার একটা ইম্প্রুভড মেথডের আইডিয়া আমাদের মাথায় এসেছে। আমরা কি ডিপার্টমেন্টাল লাইব্রেরীতে গিয়ে এটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করবো?”। চেহারায় অনাস্থার ছাপ রেখেই স্যার অনুমতি দেন।


মুহূর্তের মধ্যে দরজার বাইরে ওদের আকর্ণবিস্তৃত হাসি দেখা যায়। একছুটে লিফটে উঠে সবাই। সেই লিফট কখনো তিনতলার ডিপার্টমেন্টাল লাইব্রেরীতে থামে না। ফরাশ ছুটতে থাকে বাস ধরার উদ্দেশ্যে। নিগার চিন্তা স্পয়লার এড়িয়ে “গেম অফ থ্রোন্স” এর নতুন পর্বটা কখন দেখতে পারবে তা নিয়ে। সার্কিট মুখে একটা অন্ধকার হাসি ঝুলিয়ে হলের দিকে পা বাড়ায়। কানাই আকাশ দেখতে দেখতে পলাশীর পথ ধরে।


পরবর্তী রোববার রাত পর্যন্ত তাদের মধ্যে আর কোন যোগাযোগ হয়না...



ছবিঃ 9gag
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে আগস্ট, ২০১৫ ভোর ৫:১৯
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:২৪


আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সত্যি বলছি, চাইবো না

লিখেছেন নওরিন হোসেন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:০৮



সত্যি বলছি, এভাবে আর চাইবো না।
ধূসর মরুর বুকের তপ্ত বালির শপথ ,
বালির গভীরে অবহেলায় লুকানো মৃত পথিকের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা কি 'কিংস পার্টি' গঠনের চেষ্টা করছেন ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:১০


শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকেই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামক সংগঠন টি রাজনৈতিক দল গঠন করবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা চলছেই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্থান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্থান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×