মানালী টু কিলং এর পর থেকে...
ইন্ডিয়ায় বেশ কিছুদিন হয়ে গেছে... হিন্দি ভাষায় নিজেদের অগ্রগতি জানিয়ে শুরু করি। আলমের ঈশ্বরসম হিন্দিজ্ঞানের কথা তো আগেই বলেছি। মূক ও বধিরের ভূমিকায় এখনো বেশ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়ে চলেছে সে। আশফাকও যে কিছুমাত্র কম যায়না তাও জানা হয়ে গেছে এদ্দিনে। ছেলেটা মোটামুটি পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে যে ওর শব্দভান্ডারে হিন্দি শব্দের সর্বমোট সংখ্যা একটি- ‘ঘচু’। শব্দের সঠিক মানে কি সেটা আমরা কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারিনা, তবে ভালো কিছু যে না তা সহজেই অনুমেয়। রাবা সবকিছুতেই কয়েককাঠি সরেস। সে হিন্দি অ্যাকসেন্ট দিব্যি বাংলা আউড়ে চলেছে। শফিক আবার এসব কোন চেষ্টার মধ্যেও নাই... আয়াজকে ব্যাক্তিগত দোভাষী হিসেবে নিয়োগ দিয়ে দিয়েছে। আয়াজ, নোয়েল, আদিত্য সিং আর সেমি-ওপারের দাদা আজিমুল্লাহ বেশ ভালো হিন্দি পারে। আদিব আর আমার অবস্থা মোটামুটি। কয়েকটা শব্দ জোড়া লাগিয়ে বেশ সময় নিয়ে একেকটা বাক্য প্রসব করি......এবং প্রতিটা বাক্যই হিন্দি সিনেমার সংলাপের মতো নাটকীয় শোনায়।
২৫.০৭.১৪
চারটা......নিজেদের অবাক করে দিয়ে ঠিক ভোর চারটায় গেস্টহাউজের নীচে জড়ো হলাম সবাই। ঠান্ডা যেন চামড়া-হাড় ভেদ করে অস্থিমজ্জায় সুড়সুড়ি দিচ্ছে। সবারই চোখ ঢুলঢুলে- রাত্রের পরিধি ছিল মাত্র আটঘন্টার মত। এদিকে রাহুল ভাইয়ের কোন খোঁজ নেই। আধাঘন্টা ঠান্ডায় কাঁপাকাঁপি করার পর দেখলাম রাহুল ভাই গাড়িতেই ঘুমাচ্ছেন। তাড়াতাড়ি ব্যাগ বোঝাই করে চড়লাম গাড়িতে। রাহুল ভাই গঞ্জিকায় একটি শলাকা ঠোঁটে ঝুলিয়ে এবং আরেকটি শলাকা কানের পাশে গুদামজাত করে ইঞ্জিন চালু করলেন। গন্তব্য লাদাখের রাজধানী- লেহ। সূর্য ডোবার আগে পাড়ি দিতে হবে সাড়ে তিনশো কিলোমিটার। দূরত্ব বেশী না... কিন্তু সমস্যা একটাই- এটা ঢাকা-চিটাগাং হাইওয়ে না।
আলো ফোঁটা শুরু হয়েছে। রাতের ঘুমের সিক্যুয়াল শুরু করেছে কেউ কেউ। কিছুক্ষণ পরেই অবশ্য ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠলো সবার। রাহুল ভাইয়ের সতর্কবার্তা যে মোটেই অমূলক ছিল না তা বুঝতে বাকি রইলো না। রাস্তার মাঝ বরাবরই চলে গেছে বড়সড় এক জলপ্রপাত। সরু রাস্তার একপাশে খাদ... শুধু একবার চাকা পিছলানোর জন্য অপেক্ষায় আছে। জায়গাটা খুব ধীরেসুস্থে পার হলো গাড়ি।
কিছুদূর যাবার পরই আবার গাড়ির গতি কমানো হল। ঘুমজাড়ানো চোখে একবার বাইরে তাকিয়েই ঘুম চলে গেল। দরজা খুলে হুড়মুড় করে ছুটলাম সবাই বাইরে। রাস্তার ঠিক পাশেই ছোটখাট এক পরমাসুন্দরী লেক। অগভীর টলটলা পানিতে চারপাশের পরিষ্কার প্রতিবিম্ব। পানির নীচে বিছানো নুড়িগুলোও দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার। পানি অতরিক্ত ঠান্ডা বলে পানিতে নামার লোভ সামলাতে হল। রাহুল ভাইকে লেকটার নাম জিজ্ঞেস করলে জানালেন যে এর কোন নাম নেই। গাড়িতে ফেরার সময় কেউ একজন প্রস্তাব করলো, “এটাকেই প্যাংগং বলে চালিয়ে দিবি নাকিরে!”
নাম ছিল না
শিশু লেকটা ছেড়ে এসে আলিফ লায়লার রহস্যময় জগতে এসে পড়লাম। পার্থক্য শুধু এইটাই যে আলিফ লায়লার ঘোলাটে পরিবেশ কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ধোঁয়ায় তৈরী আর এখানকারটা মেঘ ছিঁড়ে ছিঁড়ে তৈরী করা। সাহিত্য কি একটু বেশী ঝেড়ে ফেলছি?! তাহলেও কিচ্ছু করার নেই আমার, পরিবেশটা সত্যিই এমন ছিল। গাড়ির দুপাশে মেঘ, দূরের পাহাড়ে মেঘ...সামনের রাস্তাটাও মেঘের দখলে।
মেঘ ছিঁড়ে-ফুঁড়ে চলেছে গাড়ি। একে একে পাড়ি দিচ্ছি জিপসা, দারচা, জিংজিংবার। এখন ঠিক কোথায় আছি তা জানার কোন উপায় নেই। দূরদূরান্তে কোন জীবনের চিহ্ন নেই। সেসব নিয়ে তখন কারো মাথাব্যাথাও নেই। সবুজ পাহাড় দেখে অভ্যস্ত বাঙ্গালীদের জন্য প্রথমদর্শনে এই ধূসর পাহাড়গুলি বেশ আকর্ষনীয়ই মনে হয়। আমরা মজে আছি পাহাড়ের বৈচিত্রে। সঙ্গে চলেছে ভাগা নদী।
আলিফ লায়লা
ভাগা নদীই পথ দেখিয়ে নিয়ে এল তার উৎপত্তিস্থলে। ‘সূর্যতাল’ লেক- ষোল হাজার ফুট উচ্চতার লেকটি উচ্চতার বিচারে ভারতবর্ষে তৃতীয়, সারা পৃথিবীতে ২১তম। এই মৌসুমে বরফ গলে লেকের। রাস্তার ধার ঘেঁষে কিছুক্ষণ সঙ্গ দিল গাঢ়সবুজ পানি।
সূর্যতাল
সূর্যতালের সাথে সাথেই পৌঁছে গেছি আজকের প্রথম মাউন্টেন পাস, ‘বারালাচা লা’। এখানেও জনমানবের কোন চিহ্ন নেই। এই পাসকে নিয়ে বেশ মজার লোককথা প্রচলিত আছে। (উচ্চমার্গীয় রোমান্টিক কাহিনী- আবেগতাড়িত হয়ে পড়লে লেখক দায়ী থাকবে না।) কথিত আছে যে, সূর্যের পুত্র ভাগা আর চাঁদের কন্যা চন্দ্রা একে অপরকে ভালোবাসতো। তারা তাদের ভালোবাসাকে চিরস্থায়ী করার উদ্দেশ্যে এই বারালাচা লা তে আরোহন করে। কিন্তু দুজন দুদিকে চলে যায়। পরে বহু পথ ঘুরে পুনরায় তান্দিতে মিলিত হয় এই কপোত-কপোতী। তাদের গতিপথটাই ভাগা নদী এবং চন্দ্রা নদী। এবং তাদের মিলনে সৃষ্টি হয়েছে চন্দ্রাভাগা (চেনাব) নদী (যেটা গতদিন তান্দিতে ছেড়ে এসেছি)। বারালাচা দর্শন দিল আরেকটি নতুন নদী-জুনাম, যেটি আমাদের সারচুর পথ দেখাবে।
বারালাচার পর থেকে মেঘের পাশাপাশী নতুন সঙ্গী হিসেবে যোগ দিল বরফ। এখানকার বরফ রোথাং এর মতো নোংরা নয়, এক্কেবারে দুধসাদা। মাঝারি উচ্চতার পাহাড়গুলা ছেয়ে আছে থোকা থোকা বরফের চাঁইয়ে। একটু সমতলের মত একটা জায়গায় প্রথম জনবসতির দেখা পেলাম। কয়েকটা তাঁবু নিয়ে একটা ক্যাম্পিং সাইট। সকালের নাস্তা সারার জন্য বাছাই করা হলো জায়গাটা। নাস্তা কিলং এর নেপালী ছেলেগুলাই দিয়ে দিয়েছিল সাথে করে। বরফে ছাওয়া পাহাড়ের দিকে ফিরে ঠান্ডা ব্রেড-অমলেট চিবাতেও খারাপ লাগছিলো না। শেষের এককাপ গরম চা কে দশে দশ দেওয়া যায়।
নিজেদের ব্ল্যাডার সচেতনতার পূর্বাভাস আগের দিনই দিয়েছিলাম, তাই ভূমিকা না করে মূল কথায় আসি। জলাহারের পরই জলবিয়োগের খায়েশ জাগলো। বরফে জলবিয়োগের ব্যাপারে অনেকদিন ধরেই মনের মধ্যে ফ্যান্টাসি পুষেছি। অতএব খায়েশ মেটাতে নিচের ছবির পাহাড়গুলোর দিকে চলে গেলাম। আর বাকিটুকু ইতিহাস... বরফ গলিয়ে হীমাচলের ওয়াটার লেভেল বাড়িয়ে দিয়ে ফিরে আসলুম।
জলাহার এবং জলবিয়োগের স্থান
তাঁবুগুলোর একটিতে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়া হলো। প্রত্যেকটা তাঁবুই একেকটা সরাইখানা। ভেতরে সারি দিয়ে সাজানো পুরু তোষকের বিছানা আর গুটিয়ে রাখা লেপগুলোকে ছেড়ে আসতে চোখটা ভিজে যাচ্ছিলো বারবার।
তাঁবুর ভেতরটা। রাবা থেকে নেয়া ছবি
রাস্তার হানিমুন স্টেজটা মোটামুটি শেষ হয়ে গেল। দুর্গম থেকে দুর্গমতর হয়ে চলেছে পথ, সেই সাথে গাড়ির গতিও ঠেকেছে ঘন্টায় দশ কিলোমিটারের নীচে। শফিক প্রকাশ্যে এবং আদিব মনে মনে গালি দিতে শুরু করলো আমাকে এবং আলমকে। দুজনেরই উচ্চতাভীতি আছে। আর আমরাও সুবিবেচক বন্ধুর মতো সামনে কি কি দূর্ঘটনা ঘটতে পারে তা বিশদ বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম। গালিটাতো রীতিমত আয় করেই নিয়েছি, নাকি?!
YOLO
ফুসফুসের ভেতরর শূন্য অনুভূতিটা বাড়ছে ক্রমশ। অক্সিজেন দুষ্প্রাপ্য। মাথাব্যাথায় রাবায়েত কাত হয়ে পড়ে আছে পেছনে। কেউ কেউ চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর ব্যার্থ-চেষ্টা চালাচ্ছে। নিজের অ্যাজমার ইনহেলারগুলো বের করে নিলাম। ডানহাতটা কিন্তু সবসময়ই ক্যামেরার বাটনে রেখেছি। নতুন কোন পাহাড়ের দেখা পেলে ক্লিক করতে কোন ভুল হচ্ছিলো না।
সারচু যখন পৌঁছুলাম তখন প্রায় দুপুর। ইন্টারনেটে জুনাম নদীর তীরের রক ফরমেশন দেখার পর থেকেই আয়াজ এর গল্প করে আসছিলো। এবার চর্মচক্ষে দেখা হলো। বিশাল সমতল উপত্যকার শেষে জুনাম নদী। তার পাশে পাথরের কত নকশা! কাকতাল!?
সারচু। আয়াজ থেকে নেয়া ছবি
সারচুকে একটা শীতল মরুভূমি বলা যায়। প্রাণহীন প্রান্তরে মানুষ তো দূরে থাক কোন সবুজের দেখাও নেই। ঠান্ডা কনকনে হাওয়ায় দম নেয়া দুঃসাধ্য। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম এখানে একরাত তাঁবু খাটিয়ে ক্যাম্পিং করতে পারলে জীবনে আর কিছু চাইবার থাকবে না। যাইহোক, হিমাচল প্রদেশকে বিদায় জানানোর সময় হয়ে এসেছে। আমাদের র্যুটে এখান থেকেই শুরু জম্মু-কাশ্মীর প্রদেশ... এখান থেকেই শুরু লাদাখ...
এরপরের লেখাঃ ভারতভ্রমণঃ সারচু টু লেহ
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০১৫ রাত ৮:৫৪