ঝুম বর্ষায় বগা থেকে রাইক্ষ্যং লেক
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
প্ল্যানিং শুরু হয়েছিল ফেসবুকে। কামরুল ভাই প্রস্তাব দিলেন বান্দরবান ট্যুরের, গন্তব্য বগালেক হয়ে রাইক্ষ্যং লেক আর রাইক্ষ্যং প্রপাত। জায়গাগুলোর মাহাত্ম্য সংক্ষেপে বলি - বগালেক দেশের সর্বোচ্চ প্রাকৃতিক লেক, রাইক্ষ্যং লেক সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক লেক আর রাইক্ষ্যং প্রপাত দেশের সবচেয়ে বড় জলপ্রপাত। প্রথমটা বান্দরবানে আর পরের দুটো রাঙামাটিতে, কিন্তু যেতে হয় বান্দরবান হয়েই। বর্ষাকাল চলছে, তার মাঝে এমন কিছু জায়গায় যাওয়ার প্রস্তাব। কীভাবে ফেলি! অতএব, দ্বিতীয়বার চিন্তা না করে ভীড়ে গেলাম দলের মাঝে।
সবকিছু ঠিকঠাক হবার পর গত ১৯ জুন রাতের বাসে ঢাকা থেকে রওনা দিলাম আমরা। আর পরদিন যখন বগালেকের পাহাড়ের নীচে চান্দের গাড়ি থেকে নামলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা হতে চলেছে। চাকায় চড়ে ভ্রমণ সেখানেই শেষ, পরবর্তী দুদিন পা-জোড়াই আমাদের ভরসা। পাহাড় বেয়ে প্রিয় বগালেকে পৌছে গেলাম সন্ধ্যার মাঝেই। পথে পেয়ে গেলাম রংধনুর দেখা, মুগ্ধতা নিয়েই শুরু হল ভ্রমণের আসল অংশ।
এবারো সিয়াম দিদির কটেজেই উঠলাম। নতুন তিনটা কটেজ হয়েছে-একদম লেক ঘেঁষে। বারান্দাটা একেবারে লেকের উপর গিয়ে পড়েছে, বসলেই মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়। কোনমতে ব্যাগ ফেলে জায়গা দখল করেই সবাই গিয়ে ঝাঁপ দিলাম বগালেকে। পানিটা যতটা ঠান্ডা হবে ভেবেছিলাম ততটা না হওয়ায় একটু আক্ষেপ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম সবে, সঙ্গে সঙ্গে নামলো ঝুম বৃষ্টি। নীচে ঈষদুষ্ণ লেক, উপরে বরফশীতল বৃষ্টির পানি- দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তিই যেন উবে গেল! অবশ্য সেই মুষলধারে বৃষ্টির কল্যানে রাতে বারবিকিউ করার প্ল্যানটা মাঠে মারা গেল।
পরদিন সকালে নাস্তা সেরে রওনা দিলাম পুকুরপাড়ার উদ্দেশ্যে। অভিযাত্রী নয়জন, সাথে গাইড সাদেক ভাই। বগালেক থেকে পুকুরপাড়া হাঁটাপথে একদিনের রাস্তা। যাওয়ার পথে তিনটি বড় পাহাড় আর তিনটি আদিবাসী পাড়া পড়ে- হারমুন পাড়া, সাইকট পাড়া আর আনন্দ পাড়া।
সাইকট পাড়া পর্যন্ত ট্রেইল নির্ভেজাল, বেশ আরাম করে চলে আসা যায়। পথে পথে শুধু পানির জন্য থামতে হয়। পানির উৎস হিসেবে পথে পথে অনেক সরু ঝিরি পড়ে। এছাড়াও স্থানীয়দের ব্যাবহার করা পানির গর্ত থেকেও পরিষ্কার পানি পাওয়া যায়। খোশমেজাজে এগুচ্ছিলাম। পাহাড়ের একেকটা বাঁক ঘুরছিলাম আর আশপাশের পাহাড়ের রূপ দেখে কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়াচ্ছিলাম। দূর পাহাড়ে আলোছায়ার খেলা চলছে। কালচে সবুজ পাহাড়গুলোর যে অংশে মেঘের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো পড়ছিল সেখানে যেন টিয়া রঙের আগুন ধরে যাচ্ছিল!
রাস্তার কষ্টদায়ক অংশটার শুরু মূলত সাইকট পাড়ার পর থেকে। বেশ খানিকটা পথ ঝিরি দিয়ে যেতে হয়, আর ঝিরিই হচ্ছে জোঁকের অভয়াশ্রম! “খুব তাড়াতাড়ি হাঁটতে হবে। জোঁক ধরলে ছাড়ানোর জন্য দাঁড়ানো যাবেনা। একটা জোঁক ছাড়াতে ছাড়াতে আরো পাঁচটা এসে ধরবে”- এই ছিল গাইড সাদেক ভাইয়ের উপদেশ। উপদেশ কতটা কাজে লেগেছে তা বলতে পারছি না, তবে দুদিনে এত বেশীসংখ্যক জোঁক হাত দিয়ে ছাড়াতে হয়েছে যে জোঁক জিনিসটার প্রতি ঘেন্না বা ভয় উভয়ই চলে গেছে আমাদের।
দুপুরের আগেই আমরা আনন্দপাড়ায় পৌঁছে গেলাম। এরপরেই দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে বড় পাহাড়টা পড়ে। সেই পাহাড়টা বেয়ে নামতেই দেড়-দুই ঘন্টা লেগে গেল। পাহাড়ের গোড়ায় এসে পাথুরে রুমা খালের দেখা যখন পেলাম ততক্ষণে হাঁটুর জোর কমে এসেছে। গা এলিয়ে দিলাম খালে। স্রোত বেশ শক্তিশালী, একটু অসাবধান হলেই টেনে নিয়ে যাবে। স্রোত সামলে বেশ কিছুক্ষণ পানিতে শুয়ে থাকলাম।
সারাদিন পেটে দানাপানি পড়েনি। পানিতে দাপাদাপি করে উঠে আসার পর ক্ষুধায় চোখে রীতিমত অন্ধকার দেখছিলাম । “সাদেক ভাই দ্যা সেভিয়র” এগিয়ে এলেন বাঁচাতে। গেছো-স্টাইলে বেশ উঁচু একটা গাছে উঠে গেলেন, নেমে এলেন এক বোঝা বুনো জাম নিয়ে। মহাক্ষুধার্ত অবস্থায় মুঠোয় মুঠোয় সেই অমৃতসম জাম মুখে পুরলাম।
শেষ পাহাড়টায় চড়া শুরু করেছি সবে, শুরু হল তুমুল বৃষ্টি। পিচ্ছিল ট্রেইল চলার গতি কমিয়ে দিল। প্রকৃতির তান্ডব শুরু হল চারপাশে। সরু সরু পানির ধারা মিলে অস্থায়ী ঝর্ণা কিভাবে তৈরী হয় সে বিষয়ে হাতে-কলমে শিক্ষা হল। ঝিরিপথে রীতিমত ঢল নেমেছে। এসব দৃশ্য ঘরে বসে ন্যাশনাল জিওগ্রাফীতে দেখা অনেক আরামদায়ক, বাস্তব অভিজ্ঞতা কিছুটা ভয়েরই বটে।
বৃষ্টি থামার পর পাহাড়ী মশা আর বেকুব ডাশ ঝাঁপিয়ে পড়লো (বেকুব ডাশ মৌমাছির সাইজের। এরা নাকি মারার সময় পালাতে পারেনা, তাই নামের আগে বেকুব উপাধি)। ঢাকা ছাড়ার আগে বীরত্ব দেখিয়ে ম্যালেরিয়ার ঔষধ খেয়ে না আসায় নিজের উপর খিস্তি করতে থাকলাম। গামছা দিয়ে নাকমুখ গুঁজে পাহাড়টায় যখন চড়লাম, দূর থেকে দেখলাম পুকুরপাড়া আর বহু আকাঙ্খিত সেই রাইক্ষ্যং লেক। দেখে মনে হল হ্যাঁ, এ দৃশ্য দেখার জন্য এটুকু কষ্ট করাই যায়!
প্রকৃতিও যেন সারাদিনের পরিশ্রমের প্রতিদান যেন দেয়া শুরু করলো। আমরা তখন বান্দরবান-রাঙ্গামাটির সীমান্ত নির্দেশক পাহাড়ে বসে বিশ্রাম নিচ্ছি, একরাশ মেঘ এসে ঢেকে দিলো দৃষ্টি। চারদিকে শীতল বাষ্পের স্রোত, স্বর্গীয় এক অনুভূতি!
মেঘ সরে গেল একসময়, কিন্তু মুগ্ধ হবার পালা সেখানেই শেষ নয়! পাশের পাহাড়ে মেঘ জমে বৃষ্টি হচ্ছে, দূর থেকে বৃষ্টির শব্দ শুনছি আমরা, কিন্তু আমাদের পাহাড় খটখটে শুকনো!
পুকুরপাড়ার দেখা পাওয়া মাত্রই নতুন উদ্যমে হাঁটলাম। সন্ধ্যের মধ্যেই পুকুরপাড়ায় পৌঁছে গেলাম।
কটেজে ব্যাগ ফেলে বৃষ্টির পানিতে গোসল সেরে নিলাম। আমাদের গাইড সাদেক ভাই একজন রন্ধনশিল্পীও বটে! পাহাড়ী প্রস্তরকঠিন মুরগীকেও কীভাবে যেন মসলা দিয়ে বশে নিয়ে এসেছে। মুরগী আর ডাল দিয়ে গলা পর্যন্ত জুম চালের ভাত গিললাম। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে চাঁদ বেরিয়ে এসেছে। পূর্ণিমার দুদিন আগের চাঁদ(গত ২৩ জুন সুপার মুন ছিল, ২০১৩ সালের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে উজ্জ্বল চাঁদ)। ঘুমন্ত পুকুরপাড়া তখন জ্যোৎস্নায় ভাসছে! কটেজের বারান্দায় বসে বোবা হয়ে চেয়ে রইলাম আকাশের দিকে।
পরদিন সকাল সকাল রওনা দিলাম লেকের দিকে। মুগ্ধতা যেন কাটতেই চায়না! স্বচ্ছ পানিতে আকাশের পরিষ্কার প্রতিবিম্ব। এই জলাশয় মানুষ খনন করেনি, এতে এখনও প্লাস্টিকের খোসা ভাসা শুরু হয়নি, একে ঘিরে কোন অ্যামিউজমেন্ট পার্ক তৈরী হয়ে যায়নি- এই লেকই যথেষ্ট আপনাকে অ্যামিউজ করার জন্য! আবারো মনে হল, হ্যাঁ আমাদের পরিশ্রম সার্থক।
পুরো লেক চক্কর দিতে দিতে প্রাঞ্জ্যংপাড়ার দিকে এগুলাম আমরা। সেখান থেকে রাইক্ষ্যং প্রপাত এক ঘন্টার রাস্তা। বহুদূর থেকেই প্রপাতের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। পাহাড়ে পাহাড়ে আলোছায়ার খেলা দেখতে দেখতে প্রপাতে পৌঁছে গেলাম একসময়। পানির গর্জনে নিজেদের কথা বোঝা দায়! পাহাড়ী রাইক্ষ্যং নদী প্রতিমুহূর্তে বিশাল জলরাশি নিয়ে আছড়ে পড়ছে প্রপাতের ফেনীল নিম্নভাগে। ক্যামেরার ফ্রেমে পুরোটা প্রপাত আঁটানো যায়না। এরই নাম বুঝি ভয়ংকর সৌন্দর্য! এই সৌন্দর্য দূর থেকে দেখতে হয়, বেশী কাছে গেলে প্রাণ হারানোর যথেষ্ট ভয় আছে।
প্রপাত দেখা শেষে ফিরতি পথ ধরলাম আমরা। লেকের মাছ দিয়ে সকালের নাস্তা সেরে পুকুরপাড়া ছাড়লাম। দুপুরের মাঝেই রুমা খালে পৌঁছুলাম। আগের দিন যে রুমা খাল রেখে গিয়েছিলাম আজ আর তাকে চেনার উপায় নেই! গতরাতের বৃষ্টিতে খালের একেকটা বাঁক যেন একেকটা নাফাখুমে পরিণত হয়েছে। কোনটা বাদ দিয়ে কোনটার রূপ দেখি!
আবার পা বাড়াতে হল। হারমুন পাড়ায় পৌঁছাতে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত চলে এল প্রায়। দিগন্তে সূর্য মিলাবার মুহূর্তে আকাশের কত রঙ যে দেখলাম! রাতে ট্র্যকিং এর জন্য সাথে টর্চ ছিল। অন্ধকারে ঘন্টা-দুয়েক ট্র্যাকিং করে ফিরে এলাম বগালেকে এবং যথারীতি পানিতে ঝাঁপ!
এক ট্যুরে সব কিছুই পাওয়া হল- এই যখন ভাবছিলাম তখনই নতুন বিনোদনের খোরাক নিয়ে হাজির সাদেক ভাই। লেকের ঘাটে একটা নৌকা উপস্থিত। সেই নৌকা নিয়ে বগালেকের মাঝখানে গিয়ে বৈঠা থামানো হল। পূর্ণিমার আর একদিন বাকি, আকাশে বিশাল চাঁদ। রাত বারোটার পর জেনারেটরের ঘটঘট থামলো। সব আলো নিভে গেল শুধু একটি আলোর উৎস ছাড়া, যার দিকে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রয়েছি সবাই। কখনও চুপচাপ নির্জনতা উপভোগ করছিলাম আবার কখনও সবাই হেঁড়ে গলায় সঞ্জিবদার গান ধরছিলাম, “আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল চাঁদ”। ঘোরে আটকা পড়লাম যেন, ভোররাতে চাঁদ ডোবার আগ পর্যন্ত সেই ঘোর থেকে বেরুতে পারলাম না। মাঝ লেকে কাটানো সেই ঘন্টা চারেক সময়কে এক শব্দে বর্ণনা করতে বললে একটি শব্দই আমার মাথায় আসে, “অপার্থিব”।
এরপর বাড়ী ফেরার পালা। পরদিন সকালবেলা বগালেক কে বিদায় জানালাম, অবশ্যই তা শেষ বিদায় নয়।
বগালেকের নীচে ফিরতি চান্দের গাড়ীতে যখন উঠে বসলাম তখন সারা শরীরে টানা পরিশ্রমের ক্লান্তি। কিন্তু মনের মাঝে বিগত দুদিনের অসাধারণ কিছু স্মৃতি আর ব্যাগের মধ্যে ক্যামেরার অতি মূল্যবান দুটি মেমোরি কার্ড।
[ কিছু ছবি কামরুল ভাইয়ের তোলা। ক্যামেরার জন্য বন্ধু সাজিদকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ। ]
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
=বেলা যে যায় চলে=
রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।
সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন
মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন
সত্যি বলছি, চাইবো না
সত্যি বলছি, এভাবে আর চাইবো না।
ধূসর মরুর বুকের তপ্ত বালির শপথ ,
বালির গভীরে অবহেলায় লুকানো মৃত পথিকের... ...বাকিটুকু পড়ুন
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা কি 'কিংস পার্টি' গঠনের চেষ্টা করছেন ?
শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকেই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামক সংগঠন টি রাজনৈতিক দল গঠন করবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা চলছেই।... ...বাকিটুকু পড়ুন
শেখস্থান.....
শেখস্থান.....
বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন