ছুটি পেলে আর মাথা ঠিক থাকেনা, শহরের বাইরে ঘুরতে যাওয়ার জন্য হাঁসফাঁস করতে থাকি। ভ্রমণপাগলা কিছু সঙ্গীও জুটে যায়। আর একই বাতিকগ্রস্থ সমবয়সী একজন খালাতো ভাই থাকলে আর কি চাই! এক ফোন কলেই প্ল্যান হয়ে গেলো রামগড়-খাগড়াছড়ি যাওয়ার। অবধারিতভাবে শেষ মুহূর্তের আগে বাসায় কিছু জানাই নি। সবকিছু ঠিকঠাক হওয়ার পর রওনা দেয়ার দুদিন আগে বাসায় ব্রেকিং নিউজটা দিলাম। পত্রিকায় খবর পড়ে পড়ে অন্য সবার বাবা-মায়ের মতই আমার আব্বা-আম্মাও মনে করেন কোথাও ঘুরতে যাচ্ছি মানেই পাহাড়ী খাদে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছি বা পানিতে ডুবে মরতে যাচ্ছি। অতএব এককথায় নাকচ! কিন্তু তারা ভালোমতই জানতেন যে অনুমতি না দিলে তাদের না জানিয়েই চলে যেতে পারি। তাই অন্যভাবে সবচেয়ে বড় শাস্তিটা দিলেন- শর্ত দিলেন তাদেরও সাথে নিতে হবে। মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। অভিবাবক নিয়ে ঘোরার জায়গা হচ্ছে সোনার গাঁ, ময়নামতি এসব। পাহাড়ে অ্যাডভেঞ্চারে সমবয়সী পাবলিক লাগে। কিন্তু কি আর করা! রাগে গজরাতে গজরাতে রওনা দিলাম বিশাল গ্রুপ নিয়ে।
আগে থেকে প্ল্যান করা ছিলো যে ফেনীর মহিপাল থেকে খাগড়াছড়ির বাসে উঠে মাঝামাঝি রাস্তায় রামগড়ে নেমে যাবো। যারা পার্বত্য জেলাগুলোর কোনো জেলায় বাসে চড়েছেন তাদের খুব ভালো করেই জানা থাকার কথা যে পাহাড়ী রাস্তার অধিকাংশ বাসই ঢাকাইয়্যা লোকাল বাসের মতো। আমার অভিবাবকের সম্ভবত সে বিষয়ে ধারণা ছিলো না। ফলে তথাকথিত যে ‘সুপার’ সার্ভিসে করে আমরা রওনা দিলাম তা দেখে তাদের যাওয়ার ইচ্ছা অনেকটাই মিইয়ে গেল বলে মনে হল। লোকজন বাসের মধ্যে সংসার পেতে বসেছে, রীতিমত হাউ-কাউ অবস্থা! আব্বা-আম্মার চেহারা দেখে নিজেদের জ্বালা কিছুটা মেটাচ্ছিলাম, আর তাদের দিকে তাকিয়ে যে দৃষ্টি দিচ্ছিলাম তার অর্থ দাঁড়ায়, “মানা করসিলাম না আমি! বুঝো ঠ্যালা এবার।”। যাইহোক, কিছুক্ষণ পর বাস ছাড়লো। বাংলার গ্রাম দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম। আধাঘন্টা যাওয়ার পর বাস যখন বারৈয়ারহাটে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ছেড়ে খাগড়াছড়ির রাস্তায় উঠলো, জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই রক্ত নেচে উঠলো! হঠাৎ করেই পাহাড়ের রাজ্যে ঢুকে পড়েছি। একপাশে পাহাড়ের দেয়াল, আরেকপাশে গভীর খাদ আর অনেক নীচে পাহাড়ী জনপদ। এই দৃশ্য এর আগেও পার্বত্য জেলাগুলোতে দেখেছি। কিন্তু যতবারই দেখা হোক না কেন এমন দৃশ্য কখনও একঘেয়ে লাগবে না। রাস্তা বেশ বিপজ্জনক, কিন্তু বাস ড্রাইভারের স্টিয়ারিং হুইল ঘুরানো দেখে মনে হলো সে ভিডিও গেমস খেলছে। ভয়াবহ সব বাঁকও সে সাঁই সাঁই করে পার হয়ে যাচ্ছিলো। আম্মার ভয়ে পাংশু মুখের দিকে তাকিয়ে আরেকদফা মজা নিলাম।
রাস্তার দুপাশে সেগুন, বাঁশ আর রাবার বাগান দেখতে দেখতে ঘন্টাতিনেকের বাস ভ্রমণের পর রামগড় পৌছালাম। রামগড় খুব বড় কোনো জনপদ না। তবে যতটা আশা করেছিলাম তার চেয়ে বেশ উন্নতই বলতে হবে। পাশ দিয়ে বয়ে চলা পাহাড়ী নদী ফেনী বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশকে বিভক্ত করেছে।
ফেনী নদী। ওপারে ভারত সীমান্ত
সীমান্তে গোলমালের কারণে একসময় রামগড় প্রায়শই পত্রিকার খবর হতো। সেগুলোও পত্রিকার ভেতরের পাতায়ই রয়ে যেত। কিন্তু এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে খুব বেশী আলোচনা হয়নি কখনো। ফলস্বরূপ জায়গাটা অনেক পর্যটকের দৃষ্টিগোচর হয়নি আজো।
রামগড় ঐতিহাসিক দিক দিয়ে বেশ গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। Bangladesh Rifles (BDR) ১৭৯৫ সালের ২১ জুন ব্রিটিশদের মাধ্যমে সর্বপ্রথম রামগড়েই যাত্রা শুরু করে। তখন এর নাম ছিল Ramgarh Local Battalion।
এছাড়াও ১৯৭১ সালে “মুক্তি-ফৌজ” এর প্রথম ট্রেনিং ক্যাম্প রামগড়ে গঠন করা হয়। ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের (বীর উত্তম) স্বাধীনতা যুদ্ধে মহালছড়ি সেক্টরে পাক হানাদের দের হাতে প্রাণ হারান।
বাস থেকে নেমে প্রথমেই আমরা পৌরসভা এলাকা ঘুরতে বেরোলাম। রামগড় পৌরসভার মাঝে একটা কৃত্রিম লেক বানানো হয়েছে পর্যটকদের জন্য, যার উপর একটা ঝুলন্ত সেতু আছে। লেকের দুপাশে কংক্রিটের বসার আসন, সময় কাটানোর জন্য বেশ একটা জায়গা।
কৃত্রিম লেকের উপর বানানো ঝুলন্ত সেতু
লেক দেখা শেষ হলে রওনা দিলাম BARI’র Hilltract Agricultural Research Station এবং Horticulture Centre দেখতে। HARS এ নানা ফলজ এবং মসলাজাতীয় উদ্ভিদের বিশাল জায়গা জুড়ে বাগান আছে। কৃষি গবেষণার জায়গা, তাই গাছে গাছে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশী ফল ধরে আছে, সেগুলোর সাইজও চমকে দেয়ার মতো!
রসালো জাম
সারাদেশে পাঠানোর জন্য আলাদা করা হচ্ছে ফল
স্থানীয় একজনের কাছে শুনলাম বাগানের অদ্ভুত নিয়মের কথা, “এখানে বসে যত পারেন খান, কিন্তু বাগানের বাইরে ফল নিতে পারবেন না!”। সাথে মুরুব্বী মানুষ থাকায় এতো সুন্দর একটা অফারের মায়া ত্যাগ করে আমাদের সুবোধ বালক হয়ে থাকতে হলো।
জংলা এলাকায় ঘুরতে আসা মানেই হঠাৎ হঠাৎ বন্যপ্রানীর দেখা পাবার আশায় থাকা। আসার আগে শুনেছিলাম যে পাহাড়ে বানর-হনুমানের দেখাতো পাবোই, ভাগ্য ভালো থাকলে হরিণের দেখাও মিলতে পারে! কিন্তু বিধিবাম। গাছে গাছে অনেক কাঠবিড়ালী আর পাখি ছাড়া তেমন কোন বন্যপ্রানীর দেখা পেলাম না।
HARS থেকে বের হয়ে Horticulture Centre এ গেলাম। সেখানে হচ্ছে নানারকম সৌন্দর্যবর্ধক উদ্ভিদের পরিক্ষামূলক চাষ। গাছগুলোর নামও বেশ অদ্ভুত। ‘হাতির কান’ বা ‘ভাত’ নামে কোন সৌন্দর্যবর্ধনকারী গাছের নামকরন করার ব্যাপারটা হজম করতে কিছুটা কষ্টই হচ্ছিল!
এই দুইটি জায়গা ঘুরার সময় আব্বা-আম্মার মুখে প্রশস্তির হাসি দেখতে পেলাম, যার অর্থ দাঁড়ায়, “নাহ! ছেলেগুলা কিছুতো শিখছে!”।
জ্ঞান আহরণ পর্ব শেষ হলে রওনা দিলাম রামগড়ের মূল আকর্ষণ চা বাগানের দিকে। হ্যাঁ, সিলেটের বাইরে অল্প যে কয়টা জায়গায় চা বাগান রয়েছে রামগড় তার একটা। পৌরসভা থেকে রিকশা ভাড়া করলাম। আধাঘণ্টার মতো রাস্তা, রাস্তার পাশের পাহাড়ী সরু নদী দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম Ramgarh Tea Estate এ। বাগানের গেট দিয়ে ঢুকেই মন ভরে গেলো, আকাশে মেঘ, নীচে ঘনসবুজ চা বাগান। এমন নয় যে চা বাগান নতুন দেখলাম, কিন্তু চা বাগান এমনই একটা জায়গা যেখানে যতবারই যাওয়া হোক না কেন, মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। মেঘলা পরিবেশে বাগানের ছবি তোলা শুরু হল।
মেঘলা দিনে রামগড় চা বাগান
রামগড় টি এস্টেট
দুচোখ দিয়ে সৌন্দর্য গিলছিলাম, ঠিক তখনই বৃষ্টি নামলো। তাড়াহুড়া করে আশ্রয় খোঁজা শুরু হল। বাগানের সিকিউরিটি গার্ড একটা কাঠের তৈরি কটেজ(যাকে কটেজের ধ্বংসাবশেষ বলাই অধিক যৌক্তিক) দেখিয়ে দিলো। বৃষ্টির সময় চা বাগানের সৌন্দর্য কাগজে কলমে বুঝানোর জিনিস না, এটা গিয়ে দেখার জিনিস। ওই অদ্ভুত পরিবেশে কাঠের কটেজে বসে বৃষ্টি থামার অপেক্ষার সেই সময়টা কল্পনা করলে আবার রামগড়ে ছুটে যেতে ইচ্ছে করে।চা বাগানের কটেজ
বৃষ্টি থামলে আমরা আবার হাঁটা শুরু করলাম। বাগানের একপ্রান্তে এসে সেই পাহাড়ী নদী ফেনী’র দেখা পেলাম। দেরি হয়ে যাচ্ছিলো; চা বাগান থেকে বের হয়ে তাড়াহুড়া করে যখন রামগড় পৌরসভায় ফিরে আসলাম তখন বিকাল হয়ে এসেছে। আরেকটি “সুপার” সার্ভিসে করে আমরা খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
খাগড়াছড়িতে ঘুরতে যাওয়ার কথা আসলেই সবাই সাধারণত আলটিলা সুড়ঙ্গ বা রিসাং ঝর্ণায় যাবার প্ল্যান করেন। তাদেরকে ট্যুরের একটা দিন রামগড়ে ঘুরার জন্য বরাদ্দ রাখতে পরামর্শ দিচ্ছি, গিয়া আফসোস করতে হবেনা সে নিশ্চয়তাও দিচ্ছি। থাকার ব্যবস্থা নিয়েও মাথা ঘামাতে হবে না, কারণ রামগড় একদিনে ঘুরে ফেলার মতো জায়গা। খাগড়াছড়ি গেলে সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে ঘুরে আসা যায় রামগড় থেকে। আর বন্ধুদের সাথে গেলে কম খরচে লোকাল বাসে করেও যাওয়া যায়, তবে সেই বাসযাত্রা খুব একটা সুখকর হওয়ার কথা না।
[লেখাটা লিখেছিলাম বাংলানিউজ টুয়েন্ট ফোরের জন্য। লিংকঃএকদিনেই পুরো রামগড়]
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই এপ্রিল, ২০১৫ সকাল ৯:৫৪