পাহাড় কেটে আবাসন কোম্পানির সুউচ্চ ভবন নির্মাণ, অপরিকল্পিতভাবে সড়ক নির্মাণ, প্রভাবশালীদের বেপরোয়া কায়দায় মাটি বিক্রির ব্যবসা এবং অবাধে বন উজাড় করার ফলে প্রতিবছর পাহাড় ধসে বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। অথচ এই পরিবেশগত বিপর্যয় ও পাহাড় ধসে বিপুল প্রাণহানি রোধে সরকারের ইতিবাচক কোন পদক্ষেপ নেই।
বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো সাধারণত বেলে মাটির। এ মাটি নরম ও ঝুরঝুরে হয়। প্রচণ্ড গরমে পাহাড়গুলোতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফাটল ধরে এবং প্রবল বর্ষা শুরু হলে বৃষ্টির পানি এসব ফাটলে ঢুকে বৃহদাকার ধস নামায়। তাছাড়া বর্ষা শুরু হওয়ার সাথে সাথে পাহাড়ের উপর পড়ে থাকা গাছপালা ও খড়কুটো পরিষ্কার হয়ে যায়। তাই সহজেই বৃষ্টির পানির সাথে ধসে পড়ে পাহাড়ি এসব মাটি। নিচে পড়া ঐ মাটি ট্রাকে করে বিক্রি করা হয়। এভাবে পাহাড়ের ভেঙ্গে পড়া ঢালু অংশে বেড়া দিয়ে ঘর তুলে নিম্ন আয়ের মানুষদের ভাড়া দেয়া হচ্ছে। এভাবে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে হাজার হাজার পরিবার। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ছিন্নমূল মানুষ এসব পাহাড়ে নামমাত্র ভাড়া দিয়ে বাস করছে। কমদামে পাওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষেরা মৃত্যুর কথা জেনেও এসব পাহাড়ে বাস করছে।
চট্টগ্রামে একের পর এক পাহাড় কেটে গড়ে তোলা হচ্ছে ইটভাটা ও বসতি। ফলে বৃষ্টি নামলেই পাহাড় ধসে পড়ছে। আর প্রাণহানি ঘটছে শত শত মানুষের। বিগত ৫ বছরে ৫শ'রও বেশি মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে এসব জায়গায়। এর মধ্যে আবার শিশুর সংখ্যাই শতাধিক। বান্দরবানে দেশের বড় বড় শিল্পপতিদের রয়েছে হাজার হাজার একরের পাহাড়ি প্লট। এসব প্লটে প্রভাবশালীরা বিলাসবহুল বিভিন্ন ফলের বাগান এবং বাড়ি বানাতে গিয়ে পাহাড়ি গাছ কেটে সাবাড় করে চলেছে। পাহাড়খেকো এসব রাঘববোয়ালরা আবার রাজনৈতিক দিক থেকে প্রভাবশালী হওয়ায় তারা থেকে যাচ্ছে পর্দার আড়ালে বা ধরাছোঁয়ার বাইরে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে এই পাহাড় কর্তনকারী কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের নাম পর্যন্ত নেই।
স্বাধীনতার পর থেকে শতাধিক পাহাড় কাটা হলেও জড়িতরা রয়েছে সকল ধরণের আইনি আবর্তের বাইরে। ২০০৭ সালে পাহাড়ধসের পর বিভাগীয় কমিশনারকে প্রধান করে পাহাড়ধস ব্যবস্থাপনা ও পুনর্বাসন কমিটি গঠন এবং প্রাণহানির ঘটনা এড়াতে এই কমিটি বেশ কিছু সুপারিশ করেছিল। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী এসব সুপারিশের কোনটিই বাস্তবায়ন করেনি সংশ্লিষ্ট মহল।
এই সমস্যা সমাধানে নিম্নরূপ কিছু করণীয় হতে পারে -
#পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সুনির্দিষ্ট জাতীয় পাহাড় ব্যবস্থাপনা নীতিমালা প্রণয়ন করা।
#যে সমস্ত পাহাড়ের পাদদেশ ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেগুলোকে পূরণ করে পাহাড়ের আরও ক্ষয়রোধ করা।
#আইন করে পাহাড় থেকে যত্রতত্র বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ করা।
#নির্বিচারে পাহাড় কাটার সাথে জড়িত প্রভাবশালী ব্যক্তি, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা।
#পাহাড়ধসে যারা মারা গেছেন তাদের পরিবারের জীবিত সদস্যদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করা।
#বিভিন্ন পাহাড়ে যারা ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাস করছে তাদের স্থানান্তর ও পুনর্বাসন করা।
#পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িতদের নামে মামলা দায়ের করা এবং মামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা।
#পাহাড়ি এলাকার ১০ কিলোমিটারের মধ্যে কোন ইটভাটা নির্মাণের অনুমতি না দেয়া।
#পাহাড়ি এলাকার ৫ কিলোমিটারের মধ্যে কোন আবাসন প্রকল্পের অনুমোদন না দেয়া।
#পরিবেশ অধিদপ্তরকে আরও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা।
#ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইন- ১৯৮৯,ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-১৯৮৯,পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫,পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা-১৯৯৭,পরিবেশ আদালত আইন-২০০০,ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-১৯৯৬ এবং এই সংক্রান্ত অন্যান্য আইন ও বিধি সংশোধন করে যুগোপযোগী ও অবিলম্বে সেগুলো কার্যকর করা।