‘মহিষকুড়ার উপকথা’য় গভীর বন-জঙ্গল পরিবেষ্টিত একটা গ্রাম ও সেখানকার মানুষের জীবন-অভ্যাস-আচার-সংস্কার আর সেই গ্রামকে ঘিরে থাকা সুবিশাল বৃক্ষরাজি-প্রাণীকুলের জীবনের কথা বলা হয়েছে পাতায় পাতায়। অমিয়ভূষণ মজুমদার উপন্যাসের শুরুতেই বলে নিচ্ছেন ‘বিচ্ছিন্নতাকে চোখের মণির মতো রক্ষা করে’ এই গ্রামের অধিবাসীরা। বোঝাই যাচ্ছে, দুনিয়ার তাবৎ আয়োজন-আধুনিকতা থেকে এই গ্রাম বঞ্চিত অথবা বলা ভালো, এখানকার প্রাণবন্ত-বন-জঙ্গল-মানুষ-হরিণ-হাতি-বাঘ-মোষ-গোখরো-বনস্পতি কেউই এই আধুনিকতা চায় না। ইলেকট্রিকের উজ্জ্বল তার, লরি-ট্রাক-বাস, পীচ-সড়ক-আধুনিকতার সব আগমনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার সংগ্রামে সদা-লিপ্ত এখানকার নদী-নালা-ডোবা-দহ-জীবজন্তু-মানুষ।
আরো অনেক লড়াই হাজির হয় ধীরে ধীরে এই উপন্যাসে। বন ও ক্ষেতের লড়াই, আধিয়ার ও গিরিগৃহস্থের লড়াই, আসফাক ও জাফরুল্লার লড়াই, সামন্ত ও আধুনিক সমাজের মধ্যকার লড়াই। বন ও ক্ষেতের মধ্যে অবিরাম লড়াই চলতে থাকে। বন দখল করে মানুষ তার লাঙ্গল-ট্রাক দিয়ে, অন্যদিকে বনও তার সমস্ত শক্তিমত্তা দিয়ে ক্ষেত প্রতিরোধ করতে চায়। একবার বন জিতে তো আরেকবার ক্ষেত জয়ী হয়। এ দ্বৈরথে অধিকাংশ সময়ই জিতে যায় ক্ষেত, লাঙ্গল, মানুষ। এই মানুষ, ক্ষমতাবান জাফরুল্লার মতো গুটিকতক মানুষ-গিরিগৃহস্থ।
আটশ বিঘা সম্পত্তির মালিক জাফরুল্লা ব্যাপারির চার বউ, অনেক চাকর-বাকর, গরু-মহিষ, বাথান, এমনকি বনেরও মালিক জাফরুল্লা। তার অধীনে কাজ করে আসফাক, চাউটিয়া, ছমির, সাত্তার, সোভানসহ নামহীন-গোত্রহীন আরো অনেক মানুষ।
চরিত্রগুলোর নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে, মহিষকুড়া, তুরুককাটা, ভোটমারিসহ নানা গ্রাম থেকে ততোদিনে বনকেন্দ্রীক জীবন-যাপনে অভ্যস্ত জনগোষ্ঠীরা উচ্ছেদ হয়েছে। অমিয়ভূষণের মনোযোগের বিষয় এখন নতুন করে বসতি স্থাপনকারী অধিবাসীরা-তারা গুণগতভাবে আগেকার আদি বাসিন্দাদের মতোই অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু জীবন নির্বাহ করে। মহিষকুড়ার বন-জঙ্গল-মানুষের মালিক-মহাজন এক জাফরুল্লা ব্যাপারি, তার ইশারায় সবকিছু নড়েচড়ে।
এই উপন্যাসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ব্রিটিশ শাসন শেষ হবার পরের সময়-পরিধিতে ব্যাপ্ত। তবে এখানে বর্ণিত গ্রাম মহিষকুড়াকে পুরনো অনেক গ্রামের সাথে রদবদল করা যাবে। বিশেষ করে, প্রথম দিককার মহিষকুড়ার বর্ণনার সাথে পুরনো বাংলার গ্রামের মিল পাওয়া স্বাভাবিক। কোচবিহার শহরে জন্ম ও বেড়ে ওঠা অমিয়ভূষণের পক্ষে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের জন্য বেগ পেতে হয়নি। তবে, অধিকাংশ স্থানেই মার্জিত বাংলা ভাষার ব্যবহার করা হয়েছে।
কাহিনীটা শুরু হয় এক নাটকীয়তার ভেতর দিয়ে। দশ বছর আগের এক কাহিনীর বয়ান দিয়ে যায় জাফরুল্লার বাপ ফয়েজুল্লার আমলের চাকর চাউটিয়া। সে-সময় এক বুনো মোষ ফয়েজুল্লার বাথানে ঢুকে পড়েছিল। ফাঁদ পাতায় দক্ষ চাউটিয়া বর্মণ সে যাত্রায় কৌশলে ফয়েজুল্লার বাথান রক্ষা করে। পাহাড় সমান উঁচু বুনো মোষটার বর্ণনা আসফাকের মনে দাগ কাটে গভীরভাবে। একসময় আসফাক স্বপ্নে দেখে সে নিজেই বুনো ষাঁড় হয়ে গেছে। বাস-বিকই, আসফাকের ক্ষমতা বা ‘পায়োর’ দরকার সেই বুনো ষাঁড়ে মতোই। জাফরুল্লার সবচেয়ে ছোট বিবি কমরুনের সাথে আসফাক ঘর-সংসার করতে চেয়েছিল। কিন্তু আসফাকের মনোবাঞ্ছা পূরণ হয় না। অথচ কমরুন বিবিকে সে-ই এই বাথানে নিয়ে এসেছে। আসফাক ভেবেছিল বোধ হয় এটাই ঠিক। আসফাক এখন জোয়ান হয়েছে। ‘দেখেক কুমর এলা মুই সিয়ানা হইছং। তোর মাথা ছাড়ি উঁচা’, কমরুন বিবিকে আহ্বান জানায় সে। আসফাক আফসোস করে তার গাবতান-মাদি মোষ না থাকার কারণে, থাকলে সে ঠিকই কমরুনের সাথে সংসার করত।
জাফরুল্লার ক্ষমতার সাথে সে পেরে ওঠে না। নিজের ঔরষের ছেলে মুন্নাফকে সে তার নিজের ছেলে হিসেবে দাবি করতে পারে না। মুন্নাফও মালিকের মতো আচরণ করে। ‘মিঞা সাহেব’ সম্বোধন পরিবর্তন করে আসফাকের নাম ধরে ডেকে ওঠে। প্রতিশোধ স্পৃহা জেগে ওঠে আসফাকের। ওষুধ আনতে দেরি করে, বাঁশের চটি তোলে না, গরু-মোষ ঠিকঠাক উঠল কিনা দেখে না, না-ঘুমিয়ে সারারাত উঠে উঠে জাফরুল্লার অন্দরমহল পাহারা দেয় না। এভাবেই আসফাক প্রতিশোধ নেয়, তৃপ্তি পায়, আবার ভয়ও পায়। অন্ধকারের মুখোমুখি আসফাক বলে ওঠে, ‘তো ব্যাপারি। তোমরা থাপ্পড় মারছেন, দশ বিঘা ভুঁই দিছেন, মুইও চাষ দেং নাই। মুই ওষুধ আনং নাই, তোমরাও না-মরেন। তামাম শুধ।’ জাফরুল্লা আসফাককে দশ বিঘা ডোবা জমি দিয়েছিল। কিন্তু সে চাষ করতে পারেনি, তার একার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সে এখন এটাকে প্রতিশোধের আগুন হিসেবে বিবেচনা করে।
শহরে ওষুধ আনতে গিয়ে আসফাক হারিয়ে যায় বনের মধ্যে। ‘ভুলুয়া’র কবলে পড়ে পথ হারিয়ে সে দিক-বিদিক ছুটতে থাকে। ভীষণ ভয় পায়, ঘোর তৈরি হয়। একসময় মনে হয় আসফাক বুনো ষাঁড় হয়ে গেছে। বুনোটার মতোই ডাকতে থাকে ‘আঁ-আঁ-ড়’। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, অমিয়ভূষণ আরেক কথাশিল্পী গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের জাদুবাস্তববাদের সফল প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। বুনো মোষ হয়ে যাওয়ার ঘটনা আসফাকের বেশ কয়েকবার ঘটে। আসফাকের জীবনের সমস- বিষয়ই মোষকে কেন্দ্র করে। একটা গাবতান মোষের জন্য কমরুনকে না পাওয়ার বঞ্চনা, অন্যদিকে জাফরুল্লার বাথানে মোষের দেখাশোনার দায়িত্ব তার ওপর। জীবিকা আর বঞ্চনা-দুটোই আসফাককে তাড়িয়ে মারে বারবার।
স্বপ্নে ষাঁড় হয়ে গেলেও কোনো লাভ সে বাস্তবে দেখে না। ‘সব বনই কারো-না-কারো-যেমন সব জমিই কারো-না-কারো। হঠাৎ কিছুক্ষণের জন্য তুমি বুনো ষাঁড়-মোষ হতে পার, এই বন আর বনের নয়, তাও অন্য একজনের।’ আসফাকের হয়ে কথক এটা বলে দেয়। আসফাকের মালিক জাফরুল্লা। বনের মালিকও সে। ফলে ষাঁড় হয়ে স্বাধীন হতে চাইলেও আসফাক কোনো আশা দেখে না। আসফাক স্বাধীনতা পায়নি। সারাজীবনের জন্য আবদ্ধ সে জাফরুল্লার বাথানে।
ভারতের আকাদেমী পুরস্কার পাওয়া এই উপন্যাসে আধিয়ারদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের কথা এসেছে। তবে তা ছাড়া ছাড়া, অল্পপরিসরে। অমিয়ভূষণের উদ্দেশ্য হয়ত আধিয়ারদের লড়াইয়ের কথা বলা না। কিন্তু আরো বিস্তৃত পরিসরে উপন্যাসটি লেখা হলে লেখক সে-বিষয়টাকে এড়াতে পারতেন না। বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো একটা গ্রাম মহিষকুড়া আর সেখানকার মানুষের ছবি আঁকাই লেখকের মূল উদ্দেশ্য। আবার কোনো কোনো জায়গায় মনে হতে পারে, উপন্যাসটি আসফাক ও কমরুনের প্রেম কাহিনির বর্ণনা।
উপন্যাসের শেষের দিকে দেখা যায়, জাফরুল্লা ব্যাপারি একটা বিশাল ট্রাক নিয়ে আসে। বুনো মোষের জায়গা দখল করে আধুনিক কলের মোষ। আসফাক এই ট্রাকটাকে কলের মোষ হিসেবেই সম্বোধন করে। মানুষ সমান উঁচু কলের মোষের সঙ্গে কোনো মোষেরই লড়াই-জেতার ক্ষমতা হবে না। সে যতো দেখে ততোই অবাক হয়। এখানে, সেই মহিষকুড়া গ্রামের আধুনিকতার দিকে যাত্রা শুরু। গল্পেরও শেষ হয় এখানে।
অমিয়ভূষণ মজুমদারের এই উপন্যাস নিয়ে একটা লেখা প্রথম আলোর `ছুটির দিনে'-র পাতায় বের হয়েছে বেশ অনেক আগে। এবার ইষৎ পরিবর্তন করা হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ রাত ৯:২৩