খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসের আধিপত্য খুব একটি লক্ষ করা যায়নি। বাংলা গদ্যের প্রাচীনতম নিদর্শনের মধ্যে দোম আন্তোনিওর 'ব্রাহ্মণ রোমান-ক্যাথলিক সংবাদ' এবং মনো-এল-দা-আসসুম্পসাঁও রচিত 'কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ' নামের প্রশ্নোত্তরমূলক রোমান ক্যাথলিক ধর্মের তত্ত্বকথা-নির্ভর গ্রন্থের নাম উল্লেখযোগ্য। পর্তুগিজ পাদ্রি মনো-এল-দা-আসসুম্পসাঁও পর্তুগিজ ভাষায় একটি বাংলা শব্দকোষ এবং একটি বাংলা ব্যাকরণগ্রন্থ রচনা করেন যাতে সে দেশের ধর্মপ্রচারকেরা এদেশে এসে সহজে দেশীয় ভাষা শিখে নিয়ে ধর্মপ্রচার করতে পারেন। এভাবেই বাংলাদেশে খ্রিস্টান মিশনারিদের ধর্মপ্রচারের সূত্রে বাংলা গদ্যগ্রন্থ লেখা শুরু হয়।
ইংরেজ আমলে বাংলা সাহিত্য :-
পলাশির যুদ্ধের পর ইংরেজরা রাজ্য শাসনের জন্য বাংলা লেখার প্রয়োজনীয়তার কথা উপলব্ধি করে বাংলায় গ্রন্থরচনায় তৎপরতা দেখাতে শুরু করেন। খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে শ্রীরামপুর মিশন প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানকার মিশনারিরাই বাংলা ভাষা চর্চা শুরু করে বাংলা গদ্য গ্রন্থ রচনায় উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। বাইবেলের অনুবাদ, যিশুর চরিত-কাব্য-নিবন্ধ, বাংলা ব্যাকরণ ও অভিধান রচনার পাশাপাশি বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশ, বাংলা হরফে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের ব্যবস্থাও তাঁরা করেন। এতে এ যাবৎ পুথি নির্ভর বাংলা পদ্য-গদ্যের প্রসার বাড়ে। নতুন বাংলা হরফ হালহেড সাহেবের 'বাঙ্গালা ব্যাকরণ' -এ সর্বপ্রথমে ব্যবহৃত হয়।
১৮০০ খ্রিস্টাব্দে তরুণ ইংরেজ রাজকর্মচারিদের দেশীয় ভাষা-শিক্ষা দানের উদ্দেশ্যে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপিত হলে উইলিয়াম কেরি সংস্কৃত ও বাংলার শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। তাঁর গদ্যরচনা প্রচেষ্টার পরিচয় বাইবেলের বাংলা অনুবাদে, 'ইতিহাসমালা'য়, 'কথোপকথন'-এ বিধৃত রয়েছে। কথ্যভাষায় গদ্যরচনা করে তিনি পরবর্তী গদ্যকারদের পথপ্রদর্শক হয়ে উঠেছেন। এছাড়া তিনি কৃত্তিবাসী রামায়ণ, কাশীদাসী মহাভারতের কিছু অংশ, বিষ্ণুশর্মার হিতোপদেশ, বাল্মীকি রামায়ণের মতো গ্রন্থ প্রকাশ করেন। তাঁর নেতৃত্বে সংস্কৃত, মারাঠি, পাঞ্জাবি, কন্নড় প্রভৃতি ভাষায় অভিধান গ্রন্থ, ব্যাকরণ রচিত হতে থাকে।
কেরির সহযোগী পণ্ডিতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য -রামরাম বসু, মত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, চণ্ডীচরণ মুনসী, রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ রায় প্রমুখ। রামরাম বসুর 'প্রতাপাদিত্য চরিত্র' আর 'লিপিমালা', মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের 'প্রবোধ চন্দ্রিকা', 'বত্রিশ সিংহাসন', 'রাজাবলী', 'হিতোপদেশ', চন্ডীচরণ মুনসীর 'তোতা ইতিহাস', রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়ের 'মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রম', হরপ্রসাদ রায়ের 'পুরুষ পরীক্ষা' ইত্যাদি বাংলা গদ্য রচনার প্রথম যুগের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। আরবি ফারসি শব্দ কিংবা সংস্কৃত শব্দে ভরা এসব পাঠ্যপুস্তক ছিল দুর্বোধ্য এবং অনুবাদ ও অনুকরণের গণ্ডিতে আবদ্ধ। রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) প্রথম পাঠ্যপুস্তকের বাইরে বাংলা গদ্যকে ব্যবহার করলেন। ধর্ম, দর্শন, সমাজনীতি, রাজনীতির কথা তিনি গদ্যে আলোচনা করে তার শক্তি প্রকাশ করলেন।
তাঁর গদ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ' বেদান্তগ্রন্থ ', ' বেদান্তসার ', ' উৎসবানন্দ বিদ্যাবাগীশের সহিত বিচার ', ' গোস্বামীর সহিত বিচার ', 'সহমরণ বিষয়ক প্রবর্তক ও নিবর্তক সম্বাদ ', ' ভট্টাচার্যের সহিত বিচার ', ' কবিতাকারের সহিত বিচার ', ' পথ্যপ্রদান ' ইত্যাদি। তিনি গৌড়ীয় ব্যাকরণ নামে প্রথম বাংলা ব্যাকরণগ্রন্থও লেখেন। রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন 'উপদেশকথা', 'বিদ্যাকল্পদ্রুম' প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন। পাঠ্যপুস্তক রচয়িতা হিসেবেও ডিরোজিওর এই ভাবশিষ্য খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর রচিত ষড়দর্শন সংবাদ একটি দর্শনতত্ত্ব বিষয়ক গ্রন্থ। মূলত 'তত্ত্ববোধিনী' পত্রিকা পরিচালনা সূত্রে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) বাংলা গদ্যরচনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তাঁর রচিত ধর্ম, দর্শন, আধ্যাত্মিক সাধনামূলক গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ----'ব্রহ্মধর্ম', 'আত্মতত্ত্ববিদ্যা', 'ব্রাহ্মধর্মের মত ও বিশ্বাস', 'খ্রীষ্ট ধর্মের ব্যাখ্যা', 'আত্মজীবনী' ইত্যাদি। তাঁর রচনায় স্পষ্টতা, অনুভূতিপ্রবণতা, সহজ সরল বর্ণনা, সর্বোপরি উপনিষদের ভাবরসে জারিত মননের স্পর্শ পাওয়া যায়।
বাংলা সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অবদান:-
ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা গদ্যসাহিত্যের বিকাশে সাহিত্যিক ও সাংবাদিক ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৭৮৭-১৮৪৮) -এর নাম স্মরণীয়। 'সমাচার চন্দ্রিকা'র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ভবানীচরণ ব্যঙ্গাত্মক ও নকশা জাতীয় রচনায় দক্ষতা দেখিয়েছেন, যার মধ্যে 'কলিকাতা কমলালয়', 'নববাবু বিলাস', 'নববিবি বিলাস' উল্লেখযোগ্য। কলকাতার তৎকালীন বাঙালি সমাজ তাঁর বিদ্রুপাত্মক দৃষ্টিতে গ্রন্থগুলিতে চিত্রিত হয়েছে। তাঁর রচনায় ইংরাজি শব্দের প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। 'বাংলা গদ্যের প্রথম যথার্থ শিল্পী' ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) রচিত অনুবাদমূলক রচনার মধ্যে 'বেতাল পঞ্চবিংশতি', 'বাংলার ইতিহাস', 'শকুন্তলা', 'সীতার বনবাস', 'ভ্রান্তিবিলাস', 'মহাভারতের উপক্রমণিকা' প্রভৃতি, সমাজ সংস্কারমূলক রচনার মধ্যে 'বিধবা বিবাহ চলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব', 'বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার' ইত্যাদি, শিক্ষামূলক রচনার মধ্যে 'বর্ণপরিচয়', 'কথামালা', 'চরিতাবলী', 'আখ্যান মঞ্জরী' ইত্যাদি, ছদ্মনামে লেখা হাস্যরসাত্মক রচনার মধ্যে 'অতি অল্প হইল', 'আবার অতি অল্প হইল' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তাঁর আত্মজীবনীটি (বিদ্যাসাগর চরিত) একটি অসম্পূর্ণ রচনা। এছাড়া তিনি 'প্রভাবতী সম্ভাষণ' নামে একটি ব্যক্তিগত শোক আখ্যান রচনা করেন। ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক তাঁর একটি মৌলিক রচনা 'সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব'।
কথ্য ভাষায়, হালকা ছাঁদে লিখিত তাঁর দুটি গ্রন্থ 'ব্রজবিলাস' ও 'রত্ন-পরীক্ষা'। সাধু বাংলা গদ্যের সৌন্দর্য বিদ্যাসাগরে হাতেই বিকশিত হয়। ভাষার ওজস্বিতার সঙ্গে রচনার লালিত্য বিদ্যাসাগরের অবদান। তাঁর রচিত ভিত্তির উপরই পরবর্তীকালে বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। এবং তাদের হাত ধরেই বাংলা সাহিত্যে উপন্যাস সৃষ্টি হয়। অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০-২৮৮৬) উনিশ শতকের মননশীল প্রাবন্ধিকদের মধ্যে অগ্রগণ্য। 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা'র সম্পাদক এই মানুষটির শ্রেষ্ঠ কীর্তি 'ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়'। তাঁর অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে 'বাহ্যবস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার', তিন খন্ডে বিভক্ত 'চারুপাঠ', 'ধর্মনীতি' এবং মৃত্যুর পর প্রকাশিত 'প্রাচীন হিন্দুদিগের সমুদ্রযাত্রা এবং বহির্বাণিজ্য' বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বাস্তব ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি এবং বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, ইতিহাস, দর্শন প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে স্বচ্ছন্দচারিতা তাঁর প্রবন্ধে অননুকরণীয় মননশীলতা এনেছে এবং বিদ্যাসাগরীয় গদ্যরীতির সার্থক প্রয়োগে তা যথেষ্ট প্রসাদগুণেরও অধিকারী হয়েছে।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিভিন্ন প্রবন্ধ ও পত্রিকা :-
রাজেন্দ্রলাল মিত্র (১৮২৪-১৮৯১) বিবিধার্থ সংগ্রহের সম্পাদক হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। তাঁর লেখা গ্রন্থের মধ্যে 'প্রাকৃত ভূগোল', 'শিবাজী চরিত্র' প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তারাশঙ্কর তর্করত্ন (১৮২৮-১৮৫৮) 'ভারতবর্ষীয় স্ত্রীগণের বিদ্যাশিক্ষা', 'পশ্বাবলী', 'কাদম্বরী' প্রভৃতি গ্রন্থের প্রণেতা। বিদ্যাসাগরের গদ্যরীতি অনুসরণকারীদের মধ্যে তিনি অগ্রগণ্য ছিলেন। রাজনারায়ণ বসুর (১৮২৬-১৮৯৯) উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে 'বিবিধ প্রবন্ধ', 'আশ্চর্য স্বপ্ন', 'স্বদেশীয় ভাষা অনুশীলন', 'আর্যজাতির উৎপত্তি ও বিচার', 'ধর্মতত্ত্বদীপিকা' ১ম ও ২য় ভাগ, 'সেকাল আর একাল', 'হিন্দুর আশা', 'বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক বক্তৃতা' প্রভৃতি। তাঁর গদ্য সাবলীল ও স্বাদু। আজীবন মাতৃভাষা চর্চা করেছেন ও মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের বিষয়ে সোচ্চার থেকেছেন। দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ (১৮১৯-১৮৮৬) ছিলেন 'সোমপ্রকাশ' পত্রিকার সম্পাদক। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য দুটি গদ্যগ্রন্থ 'রোমরাজ্যের ইতিহাস' ও 'গ্রীস রাজ্যের ইতিহাস'। তিনি সহজ, সরল ও সাবলীল ভাষায় গদ্য রচনা করেছেন।
ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গদ্য লেখক ভূদেব মুখোপাধ্যায় (১৮২৭-১৮৯৪)। তাঁর 'পারিবারিক প্রবন্ধ', 'সামাজিক প্রবন্ধ', 'আচার প্রবন্ধ', 'স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস' প্রভৃতি প্রবন্ধ গ্রন্থ, 'সফল স্বপ্ন' ও 'অঙ্গুরীয় বিনিময়' নামক ইতিহাসাশ্রয়ী রোমান্স ও শিক্ষা সংক্রান্ত রচনাবলির মধ্যে 'শিক্ষা বিষয়ক প্রস্তাব', 'প্রাকৃতিক বিজ্ঞান', 'পুরাবৃত্তসার', 'ক্ষেত্রতত্ত্ব' প্রভৃতি গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য। সুললিত সংস্কৃত বহুল গদ্য তাঁর রচনারীতির বৈশিষ্ট্য। প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪-১৮৮৩) বাংলা গদ্য সাহিত্যের প্রথম সার্থকভাবে চলিত ভাষা ব্যবহারের কৃতিত্বের অধিকারী, এর আগে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় নববাবু বিলাসে (১৮২৫) এই রীতির প্রবর্তন করতে গিয়ে সমধিক নিন্দিত হলেও ১৮৫৮-য় 'আলালের ঘরের দুলাল' -এ একই ধরনের গদ্যরীতির অনুবর্তন করে প্যারীচাঁদ পাঠক সমাজের প্রবল সমাদর লাভ করেন এবং টেকচাঁদ ঠাকুর ছদ্মনামে বাংলা সাহিত্যে চিরস্থায়ী আসন লাভ করেন। তাঁর গদ্যরীতি 'আলালী গদ্য' নামে বিখ্যাত।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুন, ২০২০ দুপুর ১:৫৬