'বাইবেল বলছে জিসাস ক্রাইস্ট ছাড়া আর কোনো পয়গম্বর সম্পূর্ণ নিষ্পাপ ছিলেন না, ক্রাইস্ট ছাড়া আর কোনো অবতার শিষ্যদের জন্যে নিজের জীবন উত্সর্গ করেন নাই, এবং তিনি ছাড়া আর কোনো নবী পৃথিবীর শেষ সময়ে ইহধামে প্রত্যাবর্তন করবেন না৷'
আমার এতো বড় কথায় 'তুমি জিনিয়াস, তুমি সত্যিই জিনিয়াস' বলতে বলতে শর্টস্ এবং টি শার্ট পরিহিত যে প্রৌঢ় নারী, মীপ স্মিথ, আবেগে-উচ্ছ্বাসে আমাকে আলিঙ্গনে চেপে ধরতে দ্বিধা করেন নি, সেই তিনিই 'কমিউনিজম ছাড়া মানুষের মুক্তি নাই'_আমার এই আস্থার দৃঢ়তায় তেলে-বেগুনে দপ্ করে উঠলেন৷ তাঁরই বাড়ির বাগানের নাম-না-জানা ফুলগুলির দিকে অপলক তাকিয়েছিলাম আমি৷ ঠিক তখন 'পয়মন্ত দা! পয়মন্ত দা!!' এই মাঝারি মাত্রার চিত্কারে পেছন ফেরা মাত্র, জিনস্-এর পুরু প্যান্ট সত্ত্বেও মিন্টুর লৈঙ্গিক এলাকার দিকে আমার পলক পড়ে৷
'দেশ থিকা আপনের বাবার চিডি আইছে৷ ফিলিপাইন্যা ডেরাইভার হালায় আপনের চিডি আমারে দিবার চাইছিল না৷ আমি কাইড়া লইয়া আইছি৷ চিডি না পাইয়া গত দুই সাপ্তা আপনের মনডা খুব খারাপ আছিল তো৷' কারো কারো আড়ালের মন্তব্যে মিন্টুকে ধুরন্ধর মনে হলেও আমার জন্যে সক্রিয় তার এই আবেগে কৃত্রিমতা সন্ধানের ইচ্ছা হল না৷ মীপের ভিলার সামনে দাঁড়ানো অবস্থাতেই, খাম খুলে, আমেরিকানদের সঙ্গে খাতির রেখে যেভাবেই হোক অপর গোলার্ধে পাড়ি জমাতে বাবার পরামর্শ পাওয়ার পরেই, বিভ্রান্তি, অনিশ্চয়তা ও অসহায়ত্বের অনুভবে দুই পায়ে চলেও বুকে হেঁটে নিজের আশ্রয়স্থলের দিকে রওনা হলাম৷
বর্ণিত অনুচ্ছেদের ভাষাভঙ্গিতে একটা গল্প ফাঁদবার ইচ্ছা সত্তার গভীরে প্রথমে মুকুলিত ও পরে শিহরিত হয়৷ কিন্তু মধ্যবিত্তের চিন্তা কিংবা বুদ্ধি প্রায়ই উল্লম্ব বিধায় তার নানান স্মৃতিতেও গিঁট পড়ে৷ আমার পূর্বপুরুষদের অবস্থানের ইতিহাস আমাকে ঠিক গরিবের বাচ্চা বলবে না৷ তথাপি উন্নততর জীবিকার সন্ধানে এই রিয়াদে আসা৷ অলিখিত ডায়েরির পাতা ওড়ে পত পত৷ সাড়ে পাঁচ বছর আগে এসেই সাড়ে পাঁচ মাস যাবত্ রাস্তায়-সড়কে, অফিসে-দোকানে, এমনকি মকানে আমার চাকরি প্রার্থনা৷ ওই পর্যায়ে একদিন আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখেই এক আরব মনিবের ইন্টারভিউ৷ স্মিত মুখে মৌখিক পরীক্ষাগ্রহণ শেষ না হতেই আচম্বিতে তার ক্ষুব্ধ বিদ্বেষ এবং কর্ণবিদারী উচ্চ কণ্ঠে তড়িত্ নির্দেশ, 'ইয়া আল্লাহ বার্রা! ইয়া আল্লাহ বার্রা!! আল্লার দোহাই তুই বেরিয়ে যা!'
দ্বিরুক্ত বাক্যটির ধাক্কা এতদিন পর এই মুহূর্তেও বুকে এসে লাগলে ফাইলবন্দি য়ু্যনিভার্সিটির সনদপত্রগুলিতে আমারই চোখের পানির দাগ দেখবো বলে নিজের রুমের দিকে এগোই, ক্রমশঃ৷ সেই আরবটির কক্ষ ত্যাগের সময়ে কীভাবে ছোটবেলাকার বাড়িঘেঁষা শ্রাবণের নদীটির ধরনে উপচে পড়েছিল আমার চোখের পানি, একেবারে বৃষ্টির মতো? কিন্তু আমাকে ঘিরে আবর্তিত বাবার স্বপ্ন, মিন্টুর 'বাংলা' দরদ আর এতোদিনের ভালোবাসার সঙ্গে এক্কেবারেই বেমানান মীপের ক্রোধের স্মৃতি পথিমধ্যে মারমুখো হয়ে উঠলে, প্রতিরক্ষাহীনতায় বাতাসে হেলান-দেয়া অবস্থায় একটি আকস্মিক অস্পষ্ট হট্টগোল আমার সমীপে দাঁড়িয়ে যায়৷
'হালা মালাউনের বাচ্চা মালাউন! মুসলমান সাইজা এহানে আইছস৷ আকাডা, বগলে ইট লইয়া হাঁটস৷ আবার বড় বড় কথা কস্', হিংসায় মজিদ হিংস্রপ্রায়৷
'আরইব্যাদের লাহান হালার পুতরে ধইরা...', বেঁটেখাটো আলতাফ ঘৃণায় বেশ লম্বা হয়ে ওঠে৷
'কেউ এহানে শখে আহে নাই, ঠেকায় পইরা আইছে৷ ধর্ম তুইলা গালি দেস ক্যান? জানস না কাফেররেও কাফের কইতে নাই?' চাপ দাড়িতে প্রশান্তকান্তি, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কায়েম-করা এনামুল সাত-আট জনের জটলা ভেদ করে৷
আমি ডাক নামে হিন্দু হলেও মুসলমানের ছেলে বলেই কিংবা অন্য কোনো কারণে আমার কাছেই বিচার সকলে চেয়ে বসলে এবং এনামুলের কথিত বাক্যের প্রতিধ্বনি তুলে সমাধানের পরামর্শ দিলে, বাগানকমর্ীদের সকলেই লাঞ্চ ব্রেকে ভিলামুখি হয়৷ যেতে যেতে একজন না হেঁকে পারে না, 'পয়মন্তের কি, হে তো বিধমর্ীগোই বেশি পছন্দ করে!'
নিজের সেই সনদপত্রের উপর অশ্রুর পুরানো দাগ দেখার ইচ্ছাটাই আমি ভুলে গেলে মিন্টু রুমে এসে কাঁদে, 'বেলাকউডের বাসার কার্পেট শ্যাম্পু করার পার্ট টাইমডা সালাউদ্দিনই আমারে লইয়া দিছে৷ এই কাম মজিদের করনের আছিল, আমি জানতাম না৷ মজিদ আমারে আকাডা কইল ক্যান? ধানমন্ডির ক্লিনিকে মেডিকেল টেস্ট দেওনের আগে চাকরির লোভে নকল খাতনার কায়দা নিজের হাতে করছিলাম৷ রক্ত পড়ছে অনেক৷ বাপে তো জায়গাসম্পত্তি যা কিছু আছিল সব বেইচ্যা দিয়া আমাগোরে পথে বসাইবার চাইছিল৷ মায়ে মেম্বরের বাড়িতে তহন কামলা খাটছে৷ বড়লোক মামার থনে টাকা কর্জ কইরা এই দেশে আইছি৷ এই এমেরিকানরা পার্ট টাইম করাইয়া ভাল পয়সা দেয়৷ কোম্পানির ৪৫০ রিয়াল বেতনে বাগানের ঘাস কাইট্টা কি আর ঋণ শোধ করতে পারুম!'
ভারতের হিন্দু এ দেশে অনুমোদিত, কিন্তু বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় এখানে নিষিদ্ধ জেনেও বিস্ময় মানিনি এই মার্কিন কম্পাউন্ডগুলোর বাইরের পুরো আরব জগত্ নানান অনুশাসনের কঠোরতায় নির্বাক বলেই৷ তবুও প্রায় সাত বছরের ছোট মিন্টুকে বুকে জড়াতে ইচ্ছা হলে সে আমাকে আদরের ঘর্মাক্ত স্পর্শে পুরুষজন্মের-আনন্দে-ক্ষমতাবান করে তোলে৷ ক্রন্দন থেকে আলিঙ্গন আর আবেগ হতে মিন্টুর, সেইসঙ্গে আমারও, দ্রুত অবস্থান্তরে অবাক হইনি৷ সে আর তার মামাত ভাই প্রেমরতন, তারই ভাষ্য মোতাবেক, 'কেরানিগঞ্জ থিকা ঢাকা আইয়া টেকার অভাবে রক্ত বেইচ্যা ইংলিশ রোডে বাজে পাড়ায় গিয়েছিল৷'
একদিন আমি মিস্টার ইসমের দেয়া বাইবেলের বঙ্গানুবাদ বিছানা থেকে পা বাড়িয়ে কিঞ্চিত্ ঠেলে দিলে কিতাবটি টেবিলের অপর ডান কোনায় গিয়ে ঠেকে৷ আমি বিশ্বাসঘাতক জুডাস না হলেও, ক্রুসিফিকেশনের পথে এখনো অগ্রগামী বন্দী জিসাস পাশ ফিরে বাঁকা চোখে আমাকে দেখলেও অভিশাপ দিলেন না৷
মিন্টু শাসনের স্বরে বলে, 'এমেরিকানগো লগে থাকলেও আমরা আরইব্যা কোম্পানির লোক৷ ধর্মের বইডা যে এহানে ফালায়া থুইছেন, জানেন না এই দেশে ঘরের দেয়ালও গোয়েন্দাগিরি করে! এয়ার বেইসে বাঙালী ক্লিনারগো বাইবেল দিতে গিয়া ইসম ধরা খাইছে৷ এই দেশে আর থাকতে পারল না৷ অথচ এহানকার গবারমেন্টের মত আরইব্যারা হগলতে এমেরিকার ঠ্যাঙ চাটে৷ আর শোনেন৷ এই দেশ আপনের লাইগা না৷ আপনের জায়গা এমেরিকায়৷ টেকাও কামাইবেন, স্বাধীনভাবে চলবেন৷' আমার বাবার স্বপ্নকে এভাবেই রঞ্জিত করে মিন্টু৷
'কিন্তু মীপ আর তার স্বামী বব তো কইল আমি খ্রিস্টান হইলে তারা আমারে তাগো দেশের কোনো গির্জায় চাকরি লইয়া দিতে পারবো৷ আদারওয়াইজ পারবো না৷ নিজের দেশে তাগো কোনো ব্যবসা নাই৷ আরো কইল আমি খ্রিস্টান হইলে তাগো একটা টিভি চ্যানেলে আমার সাক্ষাত্কারও লওয়াইয়া দিবো৷'
'মন্দ কি!' বলে মিন্টু আরো এগোয়, 'আপনে ত কন ভালবাসা ছাড়া আপনের কোন ধর্ম নাই৷ হুনছি লিকোভিক আর তার বউ, ব্যাপটাইজ না কি কয়, হেইডা করায়৷ সার্টিফিকেট দেয়৷ হেগো হগলরে ধইরা তদবির শুরু কইরা দেন৷ আপনে ত কন আপনের কাছে নিজের লেখাপড়ার সার্টিফিকেটগুলারও কোন দাম নাই৷ ব্যাপটাইজের সার্টিফিকেটটা দরকারি কাগজ হিসাবে রাখবেন৷ এমেরিকায় কয়েক বছর থাইকা মাল কামাইয়া তারপর দেশে সেটল হইবেন৷ এহানেও ত ব্রিটিশ ম্যানেজারের এসিসটেন হিসাবে ভালা চাকরি করতাছেন৷ কিন্তু আরইব্যা কোম্পানি সাব-কনটাকের নামে আপনেরে দিয়া ৬ হাজার রিয়াল কামাইয়া সব মিলাইয়া আড়াই হাজার ধরাইয়া দেয়৷ আর আপনে খরচা করেন বেশি৷ দেশে কিছু করতে হইলে আপনের মাসে ৫ হাজার রিয়াল ইনকাম হওন দরকার৷'
এরই মধ্যে লিকোভিকের সাথে আল-ইয়ামামা কম্পাউন্ডে গিয়ে আমি যে কী ঘোরের বসে ব্যাপটাইজড্ হই সে-ব্যাখ্যা পাড়ার বদলে, হঠাত্ এক লাফে বিছানা ছেড়ে ব্রিফকেস খুলে সেই অদ্ভুত ঘটনার ছবি ও সত্যায়িত সনদপত্র ইত্যাদি মিন্টুর সামনে মেলে ধরলে, সে সু্যইমিং পুলের লবিতে সমবেত ছবির তাগড়া তরুণীদের প্রসঙ্গে প্রেরণার উত্তাপ সঞ্চারিত করে৷
'আইজ আপনে আমারে লাঞ্চের সময় দেরি করাইয়া দিছেন৷ পরশু দিন খাইয়া যাইতে যাইতে বিশ মিনিট দেরি হইছে দেইখা ফিলিপাইন্যা সুপারভাইজার হালায় আমার দুই ঘণ্টার বেতন কাইট্যা রাখব কইছে৷ আরেকটু দেরি হইলে ত ফাকিং টাকিং কইয়া খালে ফালায়া দিত৷'
কিঞ্চিত্ স্মিত মুখে মিন্টু অভিযোগ কিংবা বিরক্তি ঝাড়লো কিনা, এটি প্রশ্নাতীত বলেই আমি মুচকি হাসতেই সে আমারই রুমের দরোজা লক করে, সবক'টি দাঁতের ঝিলিকে হেসে, এই সন্ধ্যাকে বইয়ে দিল রাতের তারার নহরে৷ বাইরে সারা পৃথিবী পুড়ে যাচ্ছে অঢেল জ্যোত্স্নায়৷ দেশে থাকলে এই নূরে আমি আদর্্র হতাম৷ এসির ঠাণ্ডা আরো বাড়াতে অনুরোধ করে খাটের নিচের বোতলটা নিতে বলতেই মিন্টুর প্রশ্ন,
'ক্যাডায় দিছে?'
'স্যারা বীপ৷ এই মহিলা আগে আমাকে কোনোদিন মদ্য উপহার দেননি৷'
আমাকে কিছুটা অবাক করেই মিন্টু বলে, 'ওইদিন মাল্টিপারপাস রুমে ডিনার পার্টিতে নাচনের সময় ওই বুড়া বেডি আপনেরে চুমা খাইছে৷ এই বয়সে এত খায়েশ হইল ক্যান?'
মদ্য পান করতে করতে ভাবি দেশে ফিরলে ভালো চাকরি মিলবে না, এমনকি আদৌ আমার কর্মসংস্থান ঘটবে কিনা এ মর্মে সক্রিয় অতল চিন্তা ও ভয়ের সঙ্গে
বাস্তবায়ন-অযোগ্য বাবার স্বপ্ন তথা আমার ভবিষ্যত্হীনতা যুক্ত হলে ভেসে যাই আপন অশ্রুতে৷ অস্তিত্বে একটা ধর্মের, সে যে-ধর্মই হোক, মুখোশ এঁটে উন্নততর জীবিকার জন্যে যে আমার পক্ষে আত্মপ্রতারণা সম্ভব হবে না, মিন্টুর কি এখনো তা বোধগম্য নয়? পথে পথে কর্ম ভিক্ষার সেই সময়ের হয়তো পুনরাবর্তন ঘটবে, কিন্তু আত্মসত্তা বিক্রয়ের প্রস্তুতির তো প্রশ্নই আসে না৷ বাবার প্রতি সহানুভূতিশীলতায় দিশেহারা হয়ে সেই সু্যইমিং পুলে একবার ডুব দিয়েছি ঠিকই, কিন্তু ভেসে উঠেছি৷
শোনা যায় কোম্পানি আমাদের অনেককেই দেশে পাঠিয়ে দেবে৷ বোয়িং মিডলইস্ট লিমিটেডের সাথে চুক্তি নবায়ন করবে না৷ ওদিকে বাতাসের আগে আগে খবর ধেয়ে আসে, বব স্মিথ, লিকোভিক, বব থরম্যানসহ সাত জনের চাকরি নবায়িত হয়নি৷ এই কম্পাউন্ডের আর সকল মার্কিনির মত তাঁরাও এখানকার এয়ারফোর্সে কর্মরত ছিলেন৷ খুব সকালে আমারই দোতলার রুম থেকে স্পষ্ট শুনতে পাই আলতাফের গলা, 'বব স্মিথ আমারে তার চাকরি যাবার খবর দিয়াই কইল : লা হাউলা ওয়ালা কুয়াতা!'
'ওয়ালা কুয়াতা না, ওয়ালা কুয়েত বলতে হইব,' ড্রাইভার দিদার তারপর নিজেই কারণ দর্শায়৷ প্রতিবেশী দুই রাষ্ট্রে মার্কিন উপস্থিতিকে শয়তানের সমাগম হিসেবে স্থানীয়রা অভিহিত করে৷
'তোর পণ্ডিতি ফালায়া থো৷ ববে আর মীপে পার্টটাইম করাইয়া আমারে বহুত টেকা দিছে৷ বাইতে টিনের ঘর তুলছি৷ ভাবছি ছোড ভাইডার লাইগা ভিসা পাঠামু, আর কিনা চইলা গেল কামডা৷ এই বাউন্ডারির বাইরে ত পার্টটাইম হারাম৷ তাছাড়া, বাইরে লুকায়া একটা গাড়ি ধুইলেও আরইব্যারা দশ রিয়ালের বেশি দেয় না৷ বব আমারে পঞ্চাইশ রিয়াল কইরা দিত,' আলতাফকে এই প্রথম নিরহংকার হতে শুনি৷
দিদারেরও সামান্য সহানুভূতি ঝরে পড়ে, 'ববরা ত ইসমের মত ধরা খায় নাই, চাকরি গেল ক্যান?'
নীচ তলায় সকলে নিরুত্তর৷ হঠাত্ একটা থমথমে আবহ৷ শিরশ্ছেদের কথা এই সাত সকালে কেন মনে পড়ে? দেশীয় ভাইদের কারো কারো মতো আমি তো কেন্দ্রীয় মসজিদের মাঠে কোনোদিনই অপরাধীদের হত্যাযজ্ঞ দেখতে যাইনি! তবুও দৃষ্টির সহজাত দোষে বাথরুমে ঢুকতেই, বাথটাবে দেখি, আমার রক্তাক্ত ছিন্ন মুণ্ড, মাংসের ভাস্কর্যের মতো স্থাপিত, ভেসে যাচ্ছে অনাগত অসংখ্য মুহূর্তের বৃষ্টিতে৷
পরে ভিলার বাইরে অফিসমুখো হয়ে কয়েক কদম এগুতেই টু হান্ড্রেড ব্লকের বাগান থেকে নিদারুণ উদ্বিগ্নতায় হেঁটে আমার সামনে এসে এনামুল বলে, 'পয়মন্ত দা, আইজ ভোর রাইতে দেশ থিকা মিন্টুর টেলিফোন আইছিল৷ গতকাইল ডেলিভারির সময় হের ভাবি মারা গেছে৷ অাঁতুইড়া মাইয়াডা মরে নাই৷ আপনে নাকি কাইল রাইত কইরা হুইছেন৷ এর লাইগা সকাল সকাল হে আপনেরে জাগায় নাই৷'
আমার তাত্ক্ষণিক স্তব্ধতা কেন চৌচির হয় মিন্টুরই বিগত গোপনীয় কিছু সংলাপে? মিন্টু বলেছিল, 'ছুডিডা ভালা কাটছে দ্যাশে৷ ডেইলি ইংলিশ রোডে মাল খাইছি৷ আমার বৌদির তহন সাত মাস৷ হেরেও ছাড়ি নাই৷ খবরদার, একথা কাউরে কইয়েন না৷'
নাইন হান্ড্রেড ব্লকের একটি ভিলার সিঁড়িতে একা বসে, মপ, ব্রাশ ইত্যাদি ফ্রন্ট ইয়ার্ডে শুইয়ে রেখে, তেত্রিশ বছরের যুবক বিজয় পোদ্দার ওরফে মিন্টু খান ডুকরে ডুকরে কাঁদে৷
বাউন্ডারির বাইরের রাস্তা, সেই সঙ্গে আমার বক্ষ কাঁপিয়ে বহুদূর ছুটে যায় একটা ট্রেইলার, না-কি 'কাকা' হবার অগ্রিম আনন্দে মিন্টুর কেনা সেদিনের খেলনা গাড়িটা?
মূল গল্পঃ খালেদ হামিদী