রামাল্লা থেকে মাইল সাতেক দুরে ফিলিস্তিনী শরণার্থী শিবির আল জালাযোন ৷ সরু অলি গলির দুপাশে ঠাসাঠাসি দোতলা তিনতলা বাড়ী, রংচটা দেয়াল ৷ গত পঞ্চাশ বছর ধরে দু`তিন প্রজেন্মর প্রায় এগার হাজার ফিলিস্তিনীর ঠিকানা এই শিবির ৷
তাদের একজন ষাটোর্ধ বিধবা আয়েশা ৷ এই শিবিরেই ইসরাইলী সৈন্যদের গুলিতে ছেলেকে হারিয়েছেন তিনি, হারিয়েছেন সবচেয়ে প্রিয় নাতিকে ৷
একজন শরণার্থীর উপাখ্যান
আয়েশার জন্ম বর্তমানের ইসরাইলী শহর জাফার কাছে এক গ্রামে ৷ ১৯৪৮ এ আরব-ইসরাইলী যুদ্ধের সময় তিনি কিশোরী ৷ লাখ লাখ ফিলিস্তিনীর মত সেসময় তার পরিবারও গ্রাম ছাড়ে৷ প্রথমে তারা ওঠেন জেরিকোর কাছে আখবদ জাবের শরণার্থী শিবিরে, পরে চলে আসেন আল জালাযোন ৷ এখানেই আছেন গত পঞ্চাশ বছর ৷ স্বামী মারা গেছেন বেশ আগে ৷ থাকেন ছোট মেয়েকে নিয়ে ৷
বসে ছিলেন যেখানে পেছনে বাধানো তার নিহত ছেলে আওয়াদ হাসানের ছবি ৷ ১৯৯৪ তে বাড়ীর সামনে নিহত হয় আওয়াদ ৷ পাশেই নাতির ছবি ৷ সুদর্শন কিশোর ৷
আমার চোখের সামনে, বাড়ীর সামনে আমার জলজ্যান্ত যুবক ছেলেকে গুলি করে মারল
আল জালাযোন শিবিরের বাসিন্দা আয়েশা
কিভাবে মৃ্ত্যু হল এ দুজনের, দোভাষির মাধ্যমে জিজ্ঞেস করতে বেশ কিছুক্ষন চুপ থাকলেন আয়েশা ৷ তারপর ইশারা করে দরজার বাইরে নিয়ে গেলেন আমাকে৷
বাড়ীর সামনে ছোট্ট চত্বরের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললেন ঠিক এখানে দাড়িয়ে গাড়ী ধুচ্ছিল
আওয়াদ ৷ তিনি ছিলেন ছেলের ঠিক পেছনে ৷ সেদিন সারা শিবিরে প্রচুর ইসরাইলী সৈন্য ৷ কাছে কোথাও গোলমালের শব্দ শোনা যাচ্ছিল ৷ বললেন ইসরাইলী একজন সৈন্য চিৎকার করে ঘরের ভেতরে যাওয়ার কথা বললো ৷
“আমরা ঢুকতে যাচ্ছি ৷ হঠাত পেছন থেকে গুলি ৷ পেছনে তাকিয়ে দেখি রক্তে ভেসে যাচ্ছে আওয়াদ ৷
আমার চোখের সামনে, বাড়ীর সামনে আমার জলজ্যান্ত যুবক ছেলেকে গুলি করে মারল,“ বলতে বলতে চোখের কোন ভিজে উঠলো আয়েশার ৷
“একজন ইসরাইলী সৈন্য কঙ্কালের মত কি একটা আঁকা একটি কাগজ তুলে চিৎকার করছিল-- প্রতিশোধ, প্রতিশোধ“৷
আয়েশার কথায় কোন ঝুট ঝামেলায় থাকতো না আওয়াদ৻ মাইকেল জ্যাকসনের গানের খুব ভক্ত ছিল৻ আমেরিকা যাওয়ার চেষ্টা করছিল ৷ সেদিনই কাগজপত্র জমা দিতে যাওয়ার কথা ছিল ৷ রামাল্লায় কারফিউ চলছিল বলে যেতে পারেনি ৷
তারপর ছেলের শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতে ১৫ বছরের নাতি, তার বড় মেয়ের একমাত্র ছেলের মৃ্ত্যু দেখতে হয়েছে আয়েশাকে ৷
“সৈন্যরা তার ঠিক দুচোখের মাঝখানে গুলি করেছিল“৷ শিবিরের কাছে কালান্দিয়া নামে জায়গায় ইসরাইলীরা যেখানে দেয়াল তুলছে সেখানে আরো কিছু ছেলের সাথে বিক্ষোভ করছিল ঐ কিশোর ৷ ইসরাইলী সৈন্যরা সরাসরি গুলি করেছিল তাদের ওপর ৷ ২০০৩ সালের ৯ই ডিসেম্বর ৷
“তার মা --আমার বড় মেয়ে-- তখন থেকে অসুস্থ,“ আয়েশা বললেন৷
ঠিকানা শরণাথী শিবির
Rafah refugee camp
রাফার শরণার্থী শিবির
১৯৪৮ এ আরব-ইসরাইলী যুদ্ধের পর দশ লাখেরও বেশী ফিলিস্তিনী অধুনা ইসরাইল থেকে ঘর ছাড়া হয়ে গাজা ও পশ্চিম তীর ছাড়াও সিরিয়া, জডার্ন, লেবানন, মিশরে গিয়ে ওঠে ৷ তারপর ১৯৬৭ র যুদ্ধে যোগ হয় আরো লাখ চারেক৻
জাতিসংঘের হিসেবেই নিবন্ধিত ফিলিস্তিনী শরণার্থীর সংখ্যা এখন ৪২ লাখের মত ৷ এদের মধ্যে প্রায় ১২ লাখ ফিলিস্তিনীর স্থায়ী ঠিকানা এখনও শরণার্থী শিবির ৷ অধিকৃত পশ্চিম তীর ও গাজাতে এখনও ২৭ টি শিবিরে সাড়ে ছ`লাখ ফিলিস্তিনীর বসবাস ৷ দশকের পর দশক ধরে তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, এমনকি অধিকাংশ সময় খাদ্যেরও মূল যোগানদাতা জাতিসংঘ ৷
আমি তো এখানে জেলখানায়৷ এই ক্যাম্প থেকে ইউনিভার্সিটি, আবার ক্যামপ
আল আমারি শিবিরের আহমেদ
এসব ফিলিস্তিনী শরণার্থী শিবিরগুলোর দেয়ালে দেয়ালে, দোকানে, রেস্টুরেন্টে, ঘরে অবধারিতভাবে একধরনের পোষ্টার চোখে পড়বেই ৷ তা হল ইসরাইলী সৈন্যদের গুলিতে নিহত, আত্মঘাতি হামলা করতে গিয়ে নিহত কিশোর, তরুন, যুবকের ছবি ৷ পোষ্টারের ব্যাকগ্রাউন্ডে ফিলিস্তিনী পতাকা, কোনটায় জেরুসালেমের আল আকসা মসজিদের প্রতিকৃতি ৷ কোনটায় ইয়াসের আরাফাতের প্রতিকৃতি৻ কোনটায় নিহত হামাস নেতা শেখ ইয়াসিনের ৷
শিবিরের ছোট ছোট বাচ্চাদের কাছে জিজ্ঞেস করলেও বলে দেবে পোষ্টারে এই তরুনের কি নাম, কবে কোথায়, কিভাবে মারা গেছে সে ৷ বলবে তাদের ঘরে কার কার পোষ্টার রয়েছে ৷
ইসরাইলীদের বক্তব্য এ সব শরণার্থী শিবিরে কিশোর তরুনদের জঙ্গীবাদে দীক্ষা দেয়া হয় ৷ ছোট থেকেই ঢোকানো হয় হিংসার বীজ ৷
আল-আমারি শরণার্থী শিবির
রামাল্লার উপকন্ঠে এই শরণার্থী শিবির থেকে ২০০২ সালে এক তরুনী জেরুসালেমের আত্মঘাতি হামলা চালিয়ে ইসরাইলে নতুন এক উদ্বেগের জন্ম দিয়েছিল ৷ কারন ২৭ বছরের ওয়াফা ইদ্রিস ছিল প্রথম কোন মেয়ে আত্মঘাতি হামলাকারি ৷ তখন থেকে এই আল আমারি ইসরাইলী সৈন্যদের কড়া নজরদারীতে৻ মাঝে মধ্যেই অভিযান চলে এখানে ৷
ক্যাম্পে প্রবেশের প্রায় মুখে ভিডিও গেমসের ছোট একটি দোকান ৷ সাত-আট থেকে শুরু করে ১৬/১৭ বছরের বেশ কজন কিশোর তরুনের ভীড় ৷ খেলছে দুজন, বাকিরা ভীড় করে দেখছে ৷
তাদের একজন মোহাম্মদ ৷ ১৮ বছর বয়স ৷ সবে রামাল্লার বিরজেত বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছে ৷ এই ক্যামেপই জন্ম ৷ কিনতু আদিবাস এল্লুদ৻ এল্লুদ এখন ইসরাইলের একটি শহর ৷ ১৯৪৮ এ আরব-ইসরাইলে যুদ্ধে দখল করা ৷
আল আমারি শরণার্থী শিবিরি
কেমন কাটছে জীবন এই শিবিরে- জিজ্ঞেস করলাম মোহাম্মদকে ৷ “আমি তো এখানে জেলখানায় ৷ এই ক্যাম্প থেকে ইউনিভার্সিটি, আবার ক্যাম্প“৷
“অনেক জায়গায় যেতে ইচ্ছে করে, উপায় নেই“৷ কালান্দিয়া চেক পয়েন্ট ৷ বিতুনিয়া চেকপয়েন্ট ৷ ইসরাইলীরা সৈন্যরা থামাবে ৷ বলবে যাওয়া যাবে না ৷
ফিলিস্তিনী তরুন, যুবকদের প্রায় সবারই এই একই আক্ষেপ ৷ বিশেষ করে দু`হাজার সালে দ্বিতীয় ইন্তিফাদা বা গণ-আন্দোলন শুরুর পর থেকে তাদের চলাফেরার ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রন আরোপ করেছে ইসরাইল৷
বয়স যদি কম হয়, বিশেষ করে ঠিকানা যদি কোন শরণার্থী শিবির হয়, ইসরাইলী চেকপয়েন্ট গলে বেরুনো প্রায় অসম্ভব ৷
জীপ নিয়ে সৈন্যরা একজনের ওপর দিয়ে চালিয়ে দিয়েছিল ৷ আমি দেখেছি
জাবেদ, আল আমারি শিবির
দোকানের বাইরে দেয়ালে লাইন দিয়ে সাঁটা ইন্তিফাদায় নিহত দুই তরুনের পোষ্টারের সম্পর্ক জিজ্ঞেস করলে আহমেদ বলল আমার ঘরেও কয়েকজনের ছবি আছে ৷ তিনটি বড়, ছোট ছোট
অনেকগুলো ৷
মোহাম্মদ বলল এই ক্যাম্প থেকেও অনেকে মারা গেছে ইন্তিফাদায়, যাদের অনেকেই তার চেনা
ছিল ৷ বেশ কজনের নাম বলল ৷
“লড়াই ছাড়া কোন উপায় নেই ৷ নারী, পুরুষ সবাই লড়াই করব,“ ধীরে ধীরে কঠিন হতে থাকলো ১৮ বছরের তরুনের মুখ ৷
মন দিয়ে আমাদের কথোপকথন শুনছিল বছর আটেকের একটি বালক ৷ নাম জাবেদ ৷ জিজ্ঞেস করলাম বড় হয়ে কি হবে ? উত্তর দিল সৈনিক হবে ৷ কেন জিজ্ঞেস করতে বলল ইসরাইলী সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ করব ৷
জাবেদ বলল একবার ট্যাংক নিয়ে ক্যাম্পে ঢুকে সৈন্যরা গুলি করছিল ৷ “আমি ভয় পেয়েছিলাম ৷ জীপ নিয়ে তারা একজনের ওপর দিয়ে চালিয়ে দিয়েছিল ৷ আমি দেখেছি“৷
অধিকৃত পশ্চিম তীর এবং গাজায় সাড়ে ছ লাখের মত ফিলিস্তিনী শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দা ৷ ফিলিস্তিনী পর্যবেক্ষকদের মতে বেকারত্ব, অনিশ্চিত ভবিষ্যত, রাজনৈতিক মীমাংসায় স্থবিরতা এবং নিত্যদিনের জীবনযাপনে ইসরাইলী দখলদারিত্বের ধাক্কা -- এসবের ফলে এসব শিবিরে জন্ম হচ্ছে জঙ্গী, বেপরোয়া এক প্রজন্মের ৷ জঙ্গী সংগঠনগুলোর শক্ত ঘাঁটি হয়ে উঠেছে এসব শরণার্থী
শিবির ৷
হারানো শৈশব
আল আমারি শরণার্থী শিবিরের ভিডিও গেমসের দোকানের মালিক ওয়ালিদ ৷ বছর পঞ্চাশ বয়স ৷ মাঝে কয়েকবছর উপসাগরের একটি দেশে গ্রাফিক ডিজাইনারের কাজ করেছেন ৷ দুবছর আগে ফিরেছেন পরিবার ও ছেলেমেয়েদের জন্য ৷ কাজ না পেয়ে এই দোকান খুলে বসেছেন ৷
ওয়ালিদের জন্ম এই শিবিরে ৷ পূর্বপুরুষের বাড়ী এল্লুদে ৷ ১৯৪৮ এ ইসরাইলীরা এল্লুদ দখল করে নেয়ার পর তার তার দাদা ও বাবা পরিবার সহ এখানে পালিয়ে আসে৷ অন্যান্য আত্মীয়স্ববজনদের কেই চলে যায় মিশরে, কেই জর্ডানে ৷
আশা করি আল্লাহ সুদিন আনবেন ৷ না হলে এসব ছেলেরা সব সন্ত্রাসী হবে
ওয়ালিদ, আল আমারি শিবির
“আপনি যদি এই ক্যাম্পের জীবন সম্পর্ক জানতে চান, এককথায় বলব নরক ৷ বিশেষ করে বাচ্চাদের কোন স্বাভাবিক শৈশব নেই ৷ খেলনা নিয়ে খেলা, মাঝে মধ্যে বেড়াতে যাওয়া ৷ ওরা জানেইনা এসব“৷
বললেন এখানকার ছোট ছোট শিশুরা জানে তাদের দূর্ভোগের ইতিহাস ৷ “আপনি ছ- সাত বছরের একজন বাচ্চাকেও পরিচয় জিজ্ঞেস করে দেখুন ৷ তাদের জন্ম হয়ত রামাল্লার এই শিবিরে, কিন্তু বলবে আমি তেল আবিব থেকে, আমি জাফা থেকে, আমি রামাল্লা থেকে“৷
ওয়ালিদ বললেন ইসরাইলী সৈন্যরা এই ক্যাম্পে ঢোকেনি এরকম একটা মাসও যায়না ৷ “সৈন্যরা ক্যাম্পে ঢুকে যা করে -- গুলি, ধাক্কা দিয়ে দরজা ভেঙ্গে ফেলা, কিছু তরুন যুবককে ধরে নিয়ে যাওয়া -- বাচ্চারা এসব জন্ম থেকে দেখছে“৷
ওয়ালিদ বললেন আগে ছিল দখলদারিত্ব ৷ এখন সাথে যোগ হয়েছে চরম অর্থনৈতিক দুর্দশা ৷ আগে দখলদারিত্ব ছিল, কিন্তু কাজ ছিল ৷ এখন তাও নেই ৷
“আশা করি আল্লাহ সুদিন আনবেন ৷ না হলে এসব ছেলেরা সব সন্ত্রাসী হবে,“ বিদায় দেয়ার আগে বললেন ওয়ালিদ৷
বিবিসি থেকে সংকলিত।