ভোর পাঁচটার মতো হবে৷ কলিং বেলটা বেজে উঠলো৷ বাইরে বেশ বৃষ্টি হচ্ছে৷ এই বৃষ্টির মধ্যে এত ভোরে কে এলোরে বাবা! ঘুমে ভরা চোখে উঠে গেলাম দরজা খুলতে৷ দেখি কালাম দাঁড়িয়ে আছে৷ ভিজে একেবারে চপচপ৷
'কি ব্যাপার! এই ভোর বেলা কোথা থেকে ভিজতে ভিজতে উদয় হলে? বাইরে দাঁড়িয়ে ভিজছো কেন? ভিতরে এসো৷'
'ঢাকা এসেছি কাল রাতেই৷ যাত্রাবাড়িতে প্রায় দু'ঘণ্টা যানযটে আটকে ছিলাম৷ তাই দেরি হয়ে গেলো৷ ধানমন্ডি আসতে আসতে দেখি রাত প্রায় বারোটা বাজে৷ ভাবলাম এত রাতে আর আপনাকে বিরক্ত করি কেন৷ লেকের পাড়েই রাতটা কাটিয়ে দি৷ কিন্তু ভোরের দিকে হঠাত্ করেই বৃষ্টি শুরু হওয়ায় আর থাকতে পারলাম না৷'
কালামটা বরাবর এরকমই পাগল৷
'তা কাল রাতে যখন বিরক্ত করতে ইচ্ছে হলো না, তখন এত ভোরেই বা করতে গেলে কেন? আর একটু সকাল হলেই না হয় বেল বাজাতে', আমি বলি৷
গায়ের আর জামার পানি ঝাড়তে ঝাড়তে কালাম একটা বোকা বোকা হাসি দিল৷
'সে বয়স কি আর এখন আছে ভাই৷ সে সব দিনে সারারাত বৃষ্টিতে হেঁটেছি৷ ভেজা কাপড় গায়েই শুকিয়েছে৷ এখন আর শরীরে কুলায় না৷'
সত্যিইতো৷ বয়সতো আর বসে থাকে না৷ সময় কত তাড়াতাড়ি বয়ে যায়৷ তিরিশ বছর আগের ঘটনা৷ অথচ এখনো চোখের সামনে ভাসছে৷ মনে হয় এই সেদিনের কথা৷
কালামের বয়স এখন পঞ্চাশ হবে৷ চুলে পাক ধরেছে৷ মুখে বলিরেখা খুব স্পষ্ট৷ চোখে চশমা লেগেছে৷ তিরিশ বছর আগে সে ছিল টগবগে এক যুবক৷ এক জঙ্গী যোদ্ধা৷ কিছুটা খ্যাপাটে৷ নভেম্বরের শেষ দিকের ঘটনা৷ যুদ্ধের প্রায় শেষ পর্যায়ে৷ শিবপুর হানাদার মুক্ত হয়েছে৷ নরসিংদী জয়ের প্রস্তুতি চলছে৷ সে-রাতে আমাদের একটা দল চলেছে নরসিংদীর কাছাকাছি একটা আর্মির ক্যাম্প আচমকা আক্রমণ করার পরিকল্পনা নিয়ে, পথে একটা খাল৷ পানি বেশি না৷ মাঝখানে কোমর পর্যন্ত হবে৷ প্রায় সবাই লুঙ্গি পরে আছে৷ আমি লুঙ্গি পরে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না৷ দৌড় ঝাঁপের সময় প্যান্টই বেশি সুবিধাজনক মনে হয়৷ ভাবছি, এই শীতের রাতে প্যান্ট ভিজালে কি অবস্থা হবে৷ আমার আবার শীত খুব একটা সহ্য হয় না৷ আমার মনের অবস্থা কেমন করে যেন কালাম বুঝে গেলো৷
'আপনি কিছু চিন্তা করবেন না৷ আপনাকে আমি কাঁধে করে পার করে দেব৷'
আমার কোন আপত্তিই সে শুনলো না৷ অনেকটা জোর করেই সে আমাকে কাঁধে তুলে নিল৷
'আরে আপনার যে হালকা শরীর৷ খাল পার করানো কোন ব্যাপার নাকি! আমরা গ্রামের ছেলে৷ এর চেয়ে কত ওজন কাঁধে নিয়ে হাটে যাই৷'
'দেখো কালাম, এত কথা বলোনা, সাবধানে পার হও৷'
'আরে ধূর৷ আপনি চুপচাপ বসে থাকেন তো৷ আমরা গ্রামের ছেলে৷ আমাদের জন্য এটা কোন...'
কালাম কথাটা পুরো শেষ করতে পারলো না৷ তার আগেই সে একটা হোচট খেয়েছে৷ দু'জনেই পানির মধ্যে গড়াগড়ি খেয়ে ভিজে চুপচুপ হয়ে কোনমতে খাল পার হলাম৷
কালামকে ধোয়া পায়জামা পাঞ্জাবী দিলাম৷ গোসল সেরে নাস্তা খেতে বসলো৷
'তারপর বলো দেখি কি কাজে ঢাকায় এসেছো?'
'আরতো পারা যাচ্ছে না৷ একটা চাকুরি চাই৷'
কালাম বেশ অনেকক্ষণ ধরে নাস্তা খেলো৷ তারপর আমরা গিয়ে বসলাম বসার ঘরে৷ কালাম ডান পা-টা একটু টেনে টেনে হাঁটে৷ গোড়ালির কাছে হাড় একটু ভাঙা৷ অনেক চিকিত্সা করানো হয়েছে৷ দু'বার অপারেশনও করা হয়েছে৷ কিন্তু সম্পূর্ণ সারেনি৷
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরের কথা৷ নরসিংদী হাসপাতালে ওকে দেখতে গিয়েছিলাম৷ তখন ও হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে৷ সারা শরীরে বহন করছে স্বাধীন দেশের রক্ষীবাহিনীর নির্যাতনের চিহ্ন৷
আমাকে দেখে কালাম একটু ম্লান হেসে বললো, 'যেসব মুক্তিযোদ্ধারা বর্ডারের ওপারে থেকে যুদ্ধ করলো, তারাতো যুদ্ধ শেষে ঘরে ফিরে এলো৷ আর আমরা যারা দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছি, স্বাধীন হওয়ার পর ঘর ছাড়তে বাধ্য হলাম৷'
বাংলাদেশের যে সব এলাকায় দেশের মাটিতেই সশস্ত্র সংগ্রাম সংগঠিত হয়েছে, শিবপুর তাদের মধ্যে অন্যতম৷ এখানকার মুক্তি যুদ্ধের নেতৃত্বে ছিল বামরা৷ সেজন্য বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই এলাকায় রক্ষীবাহিনীর অত্যাচারও হয়েছে বেশি৷ অস্ত্র খোঁজার নাম করে কতো ছেলেকে যে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে দিনের পর দিন আটকে রাখা হয়েছে, তার হিসাব নেই৷ রক্ষীবাহিনীর অত্যাচারে এলাকার অধিকাংশ নেতা কমর্ীই শিবপুর ছেড়ে ঢাকায় এসে আশ্রয় নেয়৷ কালামও ঢাকায় ছিল৷ এক রাতে শিবপুর গিয়েছিল মা'র সাথে দেখা করার জন্য৷ দুর্ভাগ্য কালামের৷ সে রাতেই সে রক্ষীবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়৷
ক্যাম্পে নিয়ে কোন প্রশ্ন করার আগেই প্রায় পনেরো মিনিট ধরে চলে কিল-ঘুষি আর লাঠির বাড়ি, তারপর অশ্রাব্য কয়েকটা গালি দিয়ে ক্যাম্পকর্তা প্রশ্ন করে, 'বল শালা, তোদের অস্ত্র কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস?' সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা৷ গলা শুকিয়ে গেছে৷ ঠোঁট আর চোখের কোণ দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে৷ তবু ক্ষীণ কণ্ঠে কালাম বলার চেষ্টা করে, 'অস্ত্রতো সবই জমা দেওয়া হয়েছে৷ আর অস্ত্র কোথায় থাকবে!'
পরের ঘটনা ওর খুব একটা মনে নেই৷ কে যেন চিত্কার করে বলেছিল, 'টাঙ্গা শালাকে৷'
কালামকে হাত পা বেঁধে টাঙানোর পরে ওর শরীরের উপর দিয়ে কি বয়ে গেছে, ও বলতে পাবে না৷ ক্যাম্পে কালামকে পাঁচ-সাতদিন রাখা হয়৷ ওখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় নরসিংদী হাসপাতালে৷
একটা এ্যামবুশে কালাম আমার পাশেই ছিল৷ শত্রু পক্ষের প্রচণ্ড পাল্টা আক্রমণের মুখে আমরা পিছু হঠছিলাম৷ বৃষ্টির মতো গুলি মাথার উপর দিয়ে শিস কেটে যাচ্ছিল৷ ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে হামা দিয়ে পিছাচ্ছিলাম৷ পিছনে একটা খাদ মতো৷ সেখানে লাফিয়ে নামতে গিয়ে একটা বাঁশের গিটে লেগে কালামের হাঁটু থেকে প্রায় ফুট খানিক উপর পর্যন্ত গভীর ভাবে কেটে গেলো৷ কাটা জাগায় শক্ত করে কাপড় বেঁধে আমরা দু-তিনজন কোন মতে ধরাধরি করে ওকে পিছনের একটা গ্রামে নিয়ে এলাম৷ অসম্ভব ওর সহ্য শক্তি৷ এত বড় একটা কাটা, কিন্তু একবারও ব্যথায় কাতরাতে দেখলাম না৷
বাঁশে কালামের পা কেটে যাওয়ার ঘটনাটা কিন্তু একটু অন্যভাবে রটলো৷ অন্যান্য ক্যাম্পে প্রচার হলো যে কালামের পায়ে 'ব্রাশ' ফায়ার লেগেছে৷ যখন কোন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে একবার ট্রিগার চাপলেই একাধিক খুলি বের হতে থাকে, তাকে বলা হয় 'বার্স্ট' (Burst)ফায়ার৷ কিন্তু বার্স্ট ফায়ারকে অনেকেই ভুল করে 'ব্রাশ' ফায়ার বলে থাকে৷ যা হোক, কালামের পায়ে 'ব্রাশ' ফায়ার লাগার কথা শুনে অনেকেই কালামকে দেখতে এলো৷ আর সে বিছানায় শুয়ে তার 'ব্রাশ' ফায়ার লাগার ঘটনা বেশ ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে সবাইকে বর্ণনা দিতে লাগলো৷
একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা কালাম৷ সুদীর্ঘ তিরিশ বছরেও দারিদ্র্যের শৃঙ্খল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেনি সে৷ ছোট খাটো ব্যবসার চেষ্টা করেছে৷ চাকুরি করেছে৷ কিন্তু টিকতে পারেনি৷ বিয়ে করেছে৷ দুই মেয়ে আছে, বউ মারা গেছে বছর পাঁচেক আগে৷ মেয়েদের বিয়ে দিতে পারেনি৷ পঞ্চাশ-উর্ধ কালাম৷ নিজেকে তার খুব অসহায় মনে হয়৷ আজো মুক্তিযোদ্ধা কালাম নতুন করে মুক্তির স্বপ্ন দেখে৷ কিন্তু পথ খুঁজে পাচ্ছে না৷
(পূর্ব প্রকাশিত)