ফতোয়াবাজ একক ব্যক্তি বটে, কিন্তু কখনো অসংগঠিত নয় ৷ আর্থ-সামাজিক পশ্চাত্পদতা এবং প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির নানা উপাদান নিরবচ্ছিন্নভাবে শক্তি যোগাচ্ছে ফতোয়াবাজদের ৷ সামন্তবাদের অবশেষ এখনো এদেশের গ্রামসমাজের সদরে-অন্দরে ক্রিয়াশীল বলে মূল বা প্রান্তিক পর্যায়ের স্থানীয় নেতৃত্ব সেই অশিক্ষা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ৷
সমাজবিকাশের গতিধারা সাধারণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলেও লক্ষ্য করা যায়, সর্ববিধ পশ্চাত্পদতাই কুসংস্কার এবং ফতোয়াবাজির লালনভূমি ৷ শিক্ষা-সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা যে সমাজে অবহেলিত, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যে-সমাজ পশ্চাত্পদ এবং দেশী-বিদেশী প্রতিক্রিয়াশীল শোষকশ্রেণী যে-দেশে রাষ্ট্রশক্তির নিয়ন্ত্রক, সেখানে ফতোয়াবাজির উন্মেষ ও বিকাশ অতি সাধারণ ঘটনা ৷ রাষ্ট্রক্ষমতায় প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী শক্তির অধিষ্ঠানই যে ফতোয়াবাজের উত্থান ও বিকাশে মূল সহায়ক তার জ্বলন্ত প্রমাণ ছিল কিছুদিন আগের আফগানিস্তান ৷
এদেশেও আমরা ফতোয়াবাজদের পুনরুত্থানের পটভূমি মূল্যায়ন করলে দেখতে পাই, পঁচাত্তর-পরবর্তী গণবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সঙ্গে এর যোগসূত্র ও কার্যকারণ সম্পর্ক বিদ্যমান ৷ আধ্যাত্মিকতা এবং ইহজাগতিকতা, ধর্ম এবং রাজনীতি যখন আলাদা অবস্থান থেকে সমাজজীবনে সংযুক্ত থাকে তখন মৌলবাদ ও এর অপক্রিয়া উজ্জীবনের অবকাশ পায় না ৷ কিন্তু ধর্ম ও রাজনীতি একীভূত হলে বা সমাজে ধর্মের নামে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হওয়ার সুযোগ থাকলে সেই সমাজ জীবনে ফতোয়াবাজির উত্থান ঘটে ৷
বাংলাদেশে ফতোয়াবাজি নিরসনকল্পে হাইকোর্টের বিচারপতিদ্বয় রায়ের শেষ অংশে যে সিদ্ধান্ত ও দিকনির্দেশনা দিয়েছেন তা মূল্যায়নের দাবী রাখে ৷ ফতোয়াবাজির স্বরূপ বিশ্লেষণ করলে নির্দ্বিধায় বলা যায়, তাঁদের পরিকল্পিত ও নির্দেশিত পথে সরকার সুদৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করলেই ফতোয়াবাজির নির্মম নির্যাতন থেকে গ্রামবাংলার হতদরিদ্র প্রান্তিক মানুষ, বিশেষতঃ অবলা নারীসমাজ মুক্তি পেতে পারে ৷ অথচ হাইকোর্ট কর্তৃক ফতোয়াবিরোধী রায় ঘোষিত হওয়ার পর লক্ষ্য করা যায়, এদেশের ধর্মব্যবসায়ী মৌলবাদীচক্র সেই রায়ের বিরুদ্ধে 'জেহাদ' ঘোষণা করে বসে ৷
গণতান্ত্রিক পন্থায় তারা রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন না-করে সহিংসতার পথ বেছে নিয়েছে ৷ যদিও ফতোয়াবিরোধী রায়ের অংশ বিশেষ স্থগিত ঘোষিত হয়েছে এবং এর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল পর্যন্ত করা হয়েছে, তবু আন্দোলনের নামে মৌলবাদীদের 'যুদ্ধংদেহি' জেহাদি তত্পরতা স্থগিত হয়নি ৷
বাংলাদেশের ধর্মব্যবসায়ী ফতোয়াবাজরা তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থে ফতোয়া বৈধ রাখার যত অপচেষ্টাই করুক না কেন, ইসলামের পুণ্যভূমি সৌদি আরবের পবিত্র কাবা শরিফের শ্রদ্ধেয় ইমামের কাছ থেকে কিন্তু আমরা ভিন্ন বাণী পাই ৷ তিনি ফতোয়াকে অবৈধ বলেই ঘোষণা করেছেন ৷
কুয়েত সিটি থেকে এএফপি পরিবেশিত খবরটির শিরোনাম :
"ফতোয়ার ধর্মীয় বা আইনগত বৈধতা নেই : কাবা শরীফের ইমাম ৷" ফতোয়াতন্ত্রের আজন্মলালিত বিশ্বাসবিরোধী চোখ-ঝলসানো এই খবরটিতে বলা হয়েছে : "ইসলামের সবচেয়ে পবিত্র মসজিদ কাবা শরীফের পেশ ইমাম শেখ সালেহ্ বিন হামিদ বলেছেন, 'কুয়েতি সঙ্গীত শিল্পী আবদুল্লাহ রুওয়াইশেদের বিরুদ্ধে একজন সৌদি ধর্মীয় নেতার মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া অবৈধ এবং তা কার্যকর করা বাধ্যতামূলক নয় ৷...' কাবা শরীফের ইমাম বলেন, 'গত সপ্তাহে সৌদি ধর্মীয় নেতা হমৌদ বিন শোয়াইবি কুয়েতের নেতৃস্থানীয় পপ সঙ্গীত শিল্পী রুওয়াইশেদের বিরুদ্ধে যে ফতোয়া দিয়েছেন, তার কোন সরকারি মর্যাদা নেই এবং এটা কোন ধর্মীয় মতামত কিংবা বিচারবিভাগীয় আদেশও নয় ৷' বক্তৃতা প্রদান সফরে কুয়েতে ওয়াজ করার জন্য এসে তিনি বলেন, 'যিনি এই ফতোয়া দিয়েছেন তার দায়-দায়িত্ব তাঁর নিজের৷ ধর্মীয় কিংবা আইনগত রায়ের বৈধতা এই ফতোয়ায় নেই' ৷" (যুগান্তর, ৬.৮.২০০১)
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে অক্টোবর, ২০০৭ সকাল ১০:৫৬