বোমাবাজীসহ নানা রকম সন্ত্রাস করে জনগণের মধ্যে সমর্থন সৃষ্টির দ্বারা অথবা ইসলামী শাসন কায়েমের কথা বলে নির্বাচনে মোল্লারা জয়লাভ করবে এটা বাংলাদেশে বর্তমানে মোল্লাদের উপদ্রব সত্ত্বেও চিন্তা করার অর্থ হলো বাঙলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস, ঐতিহ্য এমনকি বর্তমান বাস্তবতা সম্পর্কে কোন ধারণা না থাকা ৷ অথবা ধারণা থাকলেও অন্য কোন উদ্দেশ্যে এই বাস্তবতাকে আড়াল করা ৷ এটা বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে এক ধরনের কুত্সাও বটে ৷ এর কারণ এই অঞ্চলের জনগণ পাকিস্তান আমল থেকে একটানাভাবে সামপ্রদায়িকতাসহ ধর্মের সব রকম রাজনৈতিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এসেছেন ৷ এমন সংগ্রামের দৃষ্টান্ত সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে আর নেই ৷
১৯৭২ সাল থেকে শাসক শ্রেণীর শোষণ নির্যাতনের জাঁতাকলে পড়ে স্বাধীনতা পরবর্তী পর্যায়ে তাঁদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ধূলিসাত্ হতে থাকার ফলে তাঁদের অনেকের মধ্যে যে পরকালের চিন্তা বৃদ্ধি পেয়েছে এ কথা আগে বলা হয়েছে ৷ কিন্তু এই চিন্তা দেশের লোককে আবার রাষ্ট্রের ইসলামীকরণে উদ্বুদ্ধ করে কোন পার্টিকে ক্ষমতায় বসাতে পারে এর মত উদ্ভট চিন্তা আর কি হতে পারে? এ চিন্তা যে বাংলাদেশের জনগণের নয়, এটা জামাতে ইসলামীর ভোটের বাক্সের অবস্থা থেকেই বোঝা যায় ৷
জামাত সমর্থকদের কিছু ভোট লাভ করে বিএনপি-আওয়ামী লীগের থেকে ভোটে এগিয়ে থাকবে বিএনপির এই হিসেব যদি সঠিক হয় তা হলেও এটা মনে করার কারণ নেই যে, জামাতের ভোটের বাক্স ভর্তির জন্য জনগণ নির্বাচন কেন্দ্রে ভীড় করবেন ৷ তাছাড়া জামা'আতুল মুজাহিদীনসহ মোল্লাদের সংগঠনগুলি যেভাবে কাজ করে তাতে তাদের লক্ষ্য নির্বাচনে দাঁড়ানো ও তাতে জয়লাভ করে ক্ষমতা দখল, এর কোন প্রমাণ কোথাও নেই ৷
বাংলাদেশে ক্ষমতা দখলের দ্বিতীয় পথ হলো সামরিক অভ্যুত্থান, যা পর পর কয়েকবার ঘটেছে ৷ প্রথম অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানসহ তাঁর পরিবারের লোকজন হত্যা এবং কয়েকজন মেজরের তাবেদারীতে মোশতাকের সরকার গঠন, খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দ্বিতীয়বার সরকার পরিবর্তন ৷ কয়েকদিন পরই আবার কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনীর সিপাইদের অভ্যুত্থান ও জিয়াউর রহমান কর্তৃক ক্ষমতা দখল ৷ চতুর্থবার সামরিক বাহিনীর মধ্যে পাল্টাপাল্টি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান ও মঞ্জুর হত্যার পর এরশাদ কর্তৃক ক্ষমতা দখল ৷ সামরিক বাহিনীর লোকেরা বাংলাদেশে আবার অভ্যুত্থান ঘটাতে পারে, এমন সম্ভাবনা নাকচ করার নয় ৷
কিন্তু অভ্যুত্থানের পর তারা বাংলাদেশের মোল্লাদেরকে ক্ষমতায় বসিয়ে ইসলামী শাসন প্রবর্তন করবে এটা এক উদ্ভট চিন্তা ছাড়া আর কি?
বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের তৃতীয় পথ হলো, বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যেই গণঅভ্যুত্থান ৷ এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে একটানা নয় বছর আন্দোলনের শীর্ষে এক নাগরিক গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটেছিল ৷ জামা'আতুল মুজাহিদীন এককভাবে অথবা তাদের মত অন্য মোল্লা সংগঠনগুলি একত্রিত হয়ে এই ধরনের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করবে এটা শুধু অবাস্তবই নয়, এক ধরনের উন্মাদ চিন্তা ৷
এত গেল বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে ক্ষমতায় যাওয়ার এক একটি পথ, যার কোনটির মাধ্যমেই বাংলাদেশের তথাকথিত ইসলামী মৌলবাদী সংগঠনগুলির পক্ষে ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব নয় ৷ কিন্তু বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় কাঠামো উচ্ছেদ করে সশস্ত্র গণযুদ্ধের মাধ্যমে সামাজিক বিপ্লব ক্ষমতা পরিবর্তনের একটা পথ ৷ সে পথ ধরার জন্য প্রয়োজন যে সব উত্পাদন সম্পর্কের ওপর দাঁড়িয়ে, ভূমি সম্পর্ক, শিল্প সম্পর্কের ওপর দাঁড়িয়ে এই রাষ্ট্র ব্যবস্থা টিকে আছে তাকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা, তার উচ্ছেদের জন্য সংগ্রাম করা ৷ অর্থাত্ বাংলাদেশে সামন্তবাদের অবশেষ, শিল্পবাণিজ্য পুঁজি ও সাম্রাজ্যবাদ, বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা ৷ কোন ইসলামী মৌলবাদী সংগঠন এবং বাংলাদেশে তার সংস্করণ, মোল্লাদের নেতৃত্বাধীন জামা'আতুল মুজাহিদীনের মত সংগঠন, এই কাজ করা তো দূরের কথা, এই চিন্তার ধারে কাছেও থাকতে পারে এ চিন্তা ঘোরতর উন্মাদের পক্ষেই সম্ভব ৷
তাহলে? বাংলাদেশে জামা'আতুল মুজাহিদীনের মত সংগঠন যে ক্ষমতায় গিয়ে ইসলামী শাসন ও কোরানের আইন চালু করার জন্য সংগ্রাম করছে, এই চিন্তা বা বক্তব্যের সাথে ইসলামী মৌলবাদী নামে কথিত এই সব ধর্মীয় চক্রের চরিত্রের ও বাংলাদেশের বাস্তবতার কি কোন সম্পর্ক আছে? সম্পর্ক যে প্রকৃতপক্ষে নেই, এটা উপরোক্ত বিশ্লেষণ এবং আলোচনা থেকে যথেষ্ট পরিষ্কার ৷
এদের দ্বারা রাষ্ট্রীয় অথবা সরকারী ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনা যদি না থাকে, তাহলে এই জঙ্গী ইসলামী সংগঠনগুলির তত্পরতার উদ্দেশ্য কি? তারা ক্ষমতা দখল করতে চায়, কিন্তু ক্ষমতা দখল যে তাদের পক্ষে সম্ভব নয়, এটা না বোঝার কারণেই কি তারা এই জঙ্গী তত্পরতা চালিয়ে যাচ্ছে? এই অবস্থা যে কোন সংগঠনের সাধারণ কর্মীদের হতে পারে ৷ কিন্তু যারা এই সংগঠনগুলি বড় আকারে গড়ে তুলেছে ও নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা এই অর্বাচীন চিন্তার বশবর্তী হয়ে কাজ করছে, এমন মনে করার যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই ৷
তালেবানদের দ্বারা আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর বাংলাদেশের মোল্লাদের একাংশ আওয়াজ তুলেছিলো,
'আমরা হবো তালেবান, বাঙলা হবে আফগান'
এ আওয়াজ যে আফগানিস্তান ও বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে অজ্ঞতা ও সাধারণভাবে মহা মূর্খতার পরিচায়ক তাতে সন্দেহ নেই ৷
চলবে.....
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে অক্টোবর, ২০০৭ সকাল ৮:৫১